১৯৪৩ এর গনহত্যা
১৯৪৭ এর ক্ষমতা হস্তান্তরের কয়েক বছর আগে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। অন্য মতে সেটা ছিল পরিকল্পিত গনহত্যা। শুনতে কেমন লাগছে না! হিটলারের গনহত্যা নিয়ে কত সমালোচনা হয়! বা হিরোশিমা নাগসাকির পারমানবিক বোমায় মৃত্যু। ৩০ লক্ষের বেশী বাঙালীর মৃত্যু নিয়ে কোন অনুষন্ধান হয় না। ইংরেজরা রটিয়ে দিয়েছিল ধানের বাদামি দাগ রোগের জন্য খাদ্য উৎপাদন কম হয়েছিল; তাই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।শাসক তার অজুহাত খাড়া করে এখানকার জনগন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বুঝিয়ে দিয়েছে। এখনো বহু মানুষ বিনা প্রশ্নে ওই কথাই সত্যি বলে মেনেছেন। ইংরেজের কোন দায় ছিল না এখানকার কালো চামড়ার অভুক্ত প্রজাদের গনবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাওয়ানোর। সাদা চামড়ার লোকের প্রতি অগাধ আস্থা তাই যাচাই করা, প্রশ্ন করার প্রয়োজন অনুভব করেন না। তাই হিটলারের রাজত্বে গনহত্যা হয়, বাংলারটা নিরীহ দুর্ভিক্ষ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। উপনিবেশ চলে গেলে আমরা এখনো উপনিবেশ মানসিকতায় উর্ধে উঠতে পারিনি, আমাদের মজ্জায় আছে। শাসন ব্যবস্থা, আমলা তন্ত্র, উপনিবেশিক ইতিহাস, চিকিৎসা, কৃষি ব্যবস্থা সবই নকল করা। বিকল্পের কথা, স্বতন্ত্রতার ভাবি না, ভাবতে দেওয়া হয় না।
গ্রামের মানুষ কাতারে কাতারে কলকাতা শহরে ভিড় করেছিলেন খাবারের আশায়। ভাত নয়, ভাতের ফ্যানটাই তারা চেয়েছিলেন। একটু ফ্যান দাও গো মা-এই ক্রন্দন কলকাতার আকাশ বাতাস মুখরিত করে দিয়েছিল। এমন দৃশ্য দেখা গেছে গরুর গোবর থেকে হজম না হওয়ার ডাল বেছে মানুষ খাওয়ার চেষ্টা করছেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে জাপানি আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচতে বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সাথে হাত মিলিয়ে কলকাতা শহরেই ইংরেজ শাসক খাবার মজুদ করেছিল। গ্রাম থেকে ধান চাল বলপূর্বক কৃষকের নেওয়া হয়েছিল। যাতে ইংরেজ শাসকের কোন সেনা, পুলিশ বা রাজকর্মচারীর খাবারের অভাব যেন না হয়। তাঁরা কিন্তু কেউ মারা যাননি। আবার জঙ্গলমহলের আদিবাসীরা যাঁরা বাজারের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না তাঁরাও কিন্তু কেউ মারা যাননি। আর এই অবিভক্ত বাংলার সর্বত্র কিন্তু এই তথাকথিত মন্বন্তর ঘটানো সম্ভব হয়নি। এই মন্বন্তর কিন্তু ঘটানো হয়েছিল, একে পরিকল্পিত গণহত্যা বলা হয়। মধুশ্রী মুখার্জির লেখা চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এসব হল অচর্চিত ইতিহাস। চার্চিল মহাশয়ের কুপরিকল্পনা ও দুরভিষন্ধির কথা জানলে স্তম্ভিত হতে হয়।
খাবারের অভাব তাই দুর্ভিক্ষ!
প্রশ্ন হল খাবারের অভাব সত্যি কি ছিল? অধ্যাপক অমর্ত্য সেন গবেষণা করে দেখিয়েছেন পৃথিবীর কোন দুর্ভিক্ষই খাবারের অভাবের জন্য নয়। ১৯৪২ সালে খাবার যথেষ্ট উৎপাদন হয়েছিল যা পরের বছর- ১৯৪৩ সালে খাওয়া হবে। তাহলে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ কেন? খাদ্য উৎপাদন ১৯৪১ সালে তুলনামূলক ভাবে কম হয়েছিল তাহলে দুর্ভিক্ষ ১৯৪২ সালে হল না কেন? আসলে দুর্ভিক্ষ রাজনৈতিক কারণে হয়,করানো হয়। তিনি এটাও দেখিয়েছেন যে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে খাদ্যপ্রাপ্তির সরলরৈখিক সমীকরণ নয় অর্থাৎ উৎপাদন বাড়লেই সবাই খেতে পাবেন এমনটা বলা যায় না। যদি না খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা এবং মানুষের কিনে খাওয়ার ক্ষমতা না থাকে। ড. দেবল দেব তাঁর লুঠ হয়ে যায় স্বদেশ ভূমি গ্রন্থে খুব ভালো করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সহজ কথায় বলতে গেলে দেখুন না অনেকেরই স্বপ্নের মোবাইল আইফোন কিনতে চান কিন্তু বাজারে আইফোন আছে। আপনার কাছে অর্থ নেই। কুড়ি পঁচিশ টাকা কেজি পিঁয়াজের দাম যখন যখন আশি একশ টাকায় পৌঁছোয় তখন আমরা পেঁয়াজ খাওয়া কমিয়ে দেই, অনেকে হয়তো কিনতেই পারেন না। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজ আছে। দেবু দত্ত গুপ্তের খরা দাও ঈশ্বর বইয়ে (Everybody Loves a Good Drought by P Sainath) বলা হয়েছে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ওড়িষ্যার কালাহান্ডি জেলা রাজ্যের বেশীর ভাগ খাদ্য সরবরাহ করত। কিন্ত এক বিশেষ রাজনৈতিক কারনে ওই জেলাকে খরা পিড়িত জেলা হিসেবে ঘোষনা করা হয়। খরার জন্য সরকার থেকে অনেক অর্থ বরাদ্দ হবে এবং তার থেকে প্রসাদ পাওয়ার সুবিধা আছে।
১৭৯৮এ প্রকাশিত হয় টমাস রর্বাট ম্যালথ্যাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব অনুযায়ী জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ ১-২-৪-৮-১৬ গুণিতকে লাফিয়ে বাড়ে এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়ে সরল গণিতিক হারে অর্থাৎ ৪-৬-৮-১০। তিনি দাবী করলেন এই কারনেই দুর্ভিক্ষ হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করলে দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা পড়বে। কিন্ত কোন জীবের সংখ্যা অনন্ত হতে পারে না। মানুষের ও অন্যান্য প্রানীর পেটের ভিতরে থাকা জীবাণু কি বেড়ে গিয়ে অনন্তে পৌঁছোয়? পুঁজিবাদী রাসায়নিক কৃষির প্রবক্তাদের স্বপক্ষে এটা খুব কাজের কথা। মানে জনসংখ্যা বাড়ছে তাই কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে রাসায়নিক কৃষির দ্বারা। যদিও পরে এই তত্ত্ব ভুল প্রমানিত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির থেকে খাদ্য উৎপাদন সবদেশেই বেশী হচ্ছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদন ও খেতে পাওয়ার সম্পর্ক সরল রৈখিক নয়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ
সরাসরি ব্রিটিশের উপনিবেশিক প্রভাব কমে গেলেও ১৯৪৭ এর পর থেকে কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারতের উপর ব্যপক প্রভাব ফেলে। বৃহৎ পুঁজিবাদী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সুসম্পর্ক পছন্দ করতেন না। সেখানকার নিয়মকরা মনে করতেন ক্ষুধা দারিদ্র থাকলেই বুঝি সমাজতন্ত্র চলে আসবে। আর এই সমাজতন্ত্র যেন ভারতে না চলে আসে (Perkins, 1977)। ১৯৫৪য় মার্কিন সেনেটর ও পিএল ৪৮০র (মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সংশোধনী ক্রম পাবলিক ল ৪৮০ নং ) প্রবক্তা হার্বাট হামফ্রের যুক্তি ছিল খাদ্যের জন্য মানুষ আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হলে সেটা আধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করবে (Purushothaman, 2014)। ভারতের প্রথম কৃষি মন্ত্রী কে কে মুন্সি মহাশয় কৃষিক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ সংকট অনুধাবন করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে চেয়ে ছিলেন বাস্তুতান্ত্রিক দিক এবং এলাকাভিত্তিক কৃষক ও বিকেন্দ্রিত গ্রামীণ সমাজের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। তিনি ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যময় জলবায়ু, মাটি, ভূ-গর্ভস্থ জলতল, পুষ্টিগত মান এবং ফসল বৈচিত্রের উপর জোর দিয়ে কৃষি উৎপাদনের কথা বলেছিলেন। প্রাকৃতিক জীবন চক্রের পুনরুদ্ধার করাটাই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু তদানীন্তন নীতিনির্ধারকরা কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি রাসায়ন ভিত্তিক মার্কিন চটজলদি সমাধানেই মজেছিলেন। ১৯৫০ সালে শ্রীলংকার কলম্বোতে কমনওয়েলথ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেটির নাম ছিল কলম্বো প্ল্যান। এর উদ্দেশ্য ছিল ওই দেশগুলিতে কোন ক্রমেই যেন সমাজতন্ত্র ঢুকে না পড়ে।
সেই জন্যই ভারতের নবনিযুক্ত নীতি প্রণেতাদের তারা বোঝাতে লাগলেন- দেখো বাপু তোমাদের দেশে কিন্তু খাবারের অভাব হবে। তোমাদের কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ছে। তোমাদের কিন্তু একটা বড় দুর্ভিক্ষ হয়েছে। সুতরাং এখনই আমাদের থেকে খাবার রপ্তানি করতে হবে। তোমাদের খাবারের উৎপাদন বৃদ্ধিরও দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে এবং তার প্রযুক্তিও আমরাই দেব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিটা কি? মার্কিন সরকারি নীতি হলো যে অভুক্ত গরিব দেশে মানবিক কারণেও আমেরিকার উদ্বৃত্ত খাবার পাঠায় না, ২০০৮ সালে হাইতিতে খাবার অভাবকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা বাধলেও তারা কোন খাবার পাঠায় না। যদি সেই রাষ্ট্র তাদের মনোমত হয়, তাদের কথা শুনে চলে বা ভবিষ্যতে তাদের কথা শুনে চলবে এই প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলেই সেই দেশকে আমেরিকা খাদ্য সরবরাহ করে। বিভিন্ন সময়ে তাদের কর্মকর্তারা বলেছেন যে খাদ্য একটি অস্ত্র। একটি দেশকে নিয়ন্ত্রিত করতে হলে সেই দেশের সরাসরি সেনাবাহিনী পাঠানো যেতে পারে দ্বিতীয়ত সেই দেশে নিজের মনমত সরকারকে বসানো যেতে পারে এবং তৃতীয়তঃ খাদ্য দিয়ে সেই দেশকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে এবং এই তৃতীয় পদ্ধতিটাই সবথেকে কার্যকরী পন্থা বলে তারা মনে করেন।
ইতিমধ্যে ভারতবর্ষে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ১৯৫১ সালে থেকেই কৃষি সম্প্রসারণের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছেন এবং একটি প্রোগ্রাম চালু হয়েছিল ইন্টেন্সিভ এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ১৯৬০-৬১ থেকে। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশজ কৃষি ব্যবস্থাগুলোকে বাতিল করে বিদেশি প্রযুক্তির রাসায়নিক সার কীটনাশক ও তথাকথিত উচ্চফলনশীল ফসলের বীজ যাতে কৃষকরা ব্যবহার করেন। এককথায় রাসায়নিক কৃষির স্বপক্ষে ব্যাপক বিজ্ঞাপন প্রচার। বিশ্ব ব্যাংক এবং ইউ এস এইড ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে ভারতে সার কীটনাশক তৈরীর কারখানার জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ হয় এবং আমদানির ক্ষেত্রে নিয়ম কানুন শিথিল করা এবং দেশিয় নিয়ন্ত্রণ বিধি তুলে দেওয়ার জন্য। বিভিন্ন রাজ্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হল। হাজার বছরের টেকসই, পরিক্ষিত দেশজ আঞ্চলিক কৃষি পদ্ধতি, মিশ্র ফসল ও বিপুল ফসল বৈচিত্র্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এক ধরনের ফসল চাষের জন্য রাসায়নিক কৃষির পঠন পাঠন চালু হল। [ক্রমশ]
লেখক প্রাক্তন কৃষি অধিকারিক, জৈবকৃষি ও দেশজ ফসলের গবেষক ও লেখক