খাদ্য রাজনীতি
একটা সহজ খাদ্য রাজনীতির উদাহরণ অনুযায়ী আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেই। ধরুন আপনার গ্রামে বন্যা হয়েছে, মানুষের খাবারদাবার নেই, মানুষ সহায় সম্বলহীন। আপনারই পাড়ার কিছু পরোপকারী মানুষ চাঁদা তুলে খাবার সংগ্রহ করে খিচুড়ি রান্না করে গ্রামের সবাইকে কোন একটা উঁচু জায়গায় খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ঠিক সেই সময় কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতা এবং বশংবদ অনুগামীরা (অন্য অর্থে চামচে) এসে ওই নিদৃষ্ট জায়গায় দলীয় পতাকা লাগিয়ে দিলেন। ছোটখাটো একটা বক্তৃতায় নেতা বললেন তারা অনেক কষ্ট করে খাবার জোগাড় করেছেন এবং স্থানীয় মানুষ যেন ওই খিচুড়ি আহার করেন। সব গ্রামে এটা সম্ভব হয়নি। বা কোন একটি গ্রামে কোন একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অভুক্ত গরিব মানুষদের ত্রাণ বিলি করতে যাচ্ছেন তখন শাসক রাজনৈতিক বললেন তারা যেন ওখানে কোন প্রাণ বিলি না করেন। অথচ শাসক দলও কিন্তু কোন ত্রাণ বিলি করতে পারেনি। ওনারা বিলি করলে শাসক দলের সম্মান হানি হবে। এর জন্য মানুষ না খেতে পেলেও কোন ক্ষতি নেই। এটা কিন্ত আন্তর্জাতিক স্তরেও আছে এবং সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করে আসছে।
খেসারীর ডাল নিয়ে খাদ্য রাজনীতি :
উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের উৎস হিসেবে ডাল খুব সহজ লভ্য। ধান কাটার কয়েক দিন আগে ডাল শস্য খেসারীর বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হত। কোন চাষ, সেচ, সার বিষ, নিড়ানী কিছুই লাগত না। শাক খাওয়া হয়। কৃষকের বাড়িতে সারা বছরের ডালের সংস্থান হত। অন্য ডালের মত অর্বুদ জাতীয় ফসল হওয়ার জন্য জমিতে নাইট্রোজেন আবদ্ধ হত পরবর্তী ফসলে কাজে লাগত, অর্থ্যাৎ জমির উর্বরতা বজায় থাকত। এই পরিবেশ বান্ধব চাষ ব্যবস্থা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপারীদের ভালো লাগল না। ১০০ বছর আগের বিহারের একটি সূত্র উদ্ধৃত করে বলা হল ওই ডাল খেলে পঙ্গু হয়। কিন্ত অর্থসত্য তথ্য পরিবেশন করা হল। মানুষ ভয় পেয়ে গেল। চাষ উঠে গিয়ে সেখানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, পাম্প সেট ও বীজের ভালো ব্যবসা হবে এমন চাষ — বোরো ধান চালু হল। সেচের জন্য মাটির তলার জল অনিয়ন্ত্রিত ভাবে তোলা শুরু হল। যদি অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ টানা দু মাস শুধু ওই ডাল ও ভাত খেয়ে যায় তাহলে পঙ্গু হতে পারে। কিন্ত আমরা একই ডাল রোজ খাই না। ডাল সিদ্ধ করে জল ফেলে দিয়ে খাওয়া হয়। ডাল-ভাতের সাথে অন্য শাক সবজি বা অন্য আমিষ খাবারও খাওয়া হয়। বিগত ১০০ বছরে ক’জন চিকিৎসক ওই পঙ্গু রোগী দেখেছেন বা চিকিৎসা করেছেন সেই তথ্য পরিসংখ্যান নেই। ব্যক্তিগত ভাবে চেনা কয়েকজন বয়স্ক চিকিৎসক বললেন তাঁরাও বইয়ে পড়েছেন, কোন রোগী চোখে পড়েনি। সুতরাং ভয় দেখিয়ে ব্যবসা হল। প্রোটিনের একটা সহজ লভ্য উৎসকে নষ্ট করা হল। এত বছর পরে ভয় কাটিয়ে ইদানীং আবার খেসারীর ডালের প্রচলন বাড়ছে।
গোটা ভারতবর্ষটাই লুন্ঠনের জায়গা
আমাদের একটু পিছনে তাকাতে হবে। গোটা ভারতবর্ষটাই লুন্ঠনের ইতিহাস। ১১ শতকে মহম্মদ গজনির পশ্চিম ভারত আক্রমন ও লুন্ঠন। ১৩৯৮ সালে তৈমুর লং ভারত আক্রমন ও লুন্ঠন। ১৭৯৩ সালে নাদরি শাহের লুন্ঠনের ইতিহাসও আমাদের সকলের জানা। কালিকটের কথা বলা দরকার কারন এখান থেকেই ঔপনিবেশিক লুম্ঠন শুরু। উল্লেখ্য পর্তুগীজ জলদস্যু ভাস্কো দা গামার ১৪৯৮ সালে কালিকটে আসার অব্যবহিত পরেই পর্তুগিজরা গোয়া, দমন, দিউ ও বোম্বাইতে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। মোঘল রাজত্ব থিতু হল ১৫২৬ সালের পর থেকে ১৭৭৫ সাল পর্যন্ত। অনান্য মুসলিম আক্রমন কারী ও ইংরেজদের মত এখান থেকে মোঘলরা সম্পদ লুঠ করে নিজেদের দেশে (ইদানীং কালের মধ্যপ্রাচ্যের উজবেকিস্তান) পাচার করেনি। ১৬১৭ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে বাণিজ্যের অনুমতি দান করেন। মোঘল রাজত্বের শেষ দিকে বনিক বেশে ব্রিটিশরা দেশে রাজত্ব কায়েম করল। বনিকের মানদন্ড হল রাজদন্ড। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বাংলাতে ঘাঁটি গেড়েছিল। তাদের কাছে বাংলা অত্যন্ত শস্য-শ্যামল ও প্রাচুর্যময় জায়গা ও প্রচুর সম্পদে ভরপুর। জনমানসে ধারনা আছে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এতই দুর্বিনীত, দুশ্চরিত্র এবং নিষ্ঠুর ছিল সেই কারনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে পলাশীতে সংঘর্ষের পরিণতি হিসেবে তাঁকে বাংলার মসনদ পর্যন্ত হারাতে হল এবং তার জন্য দায়ী সে তিনি নিজেই। ইংরেজরা এসেছিল বলেই দেশটার উন্নতি হয়েছে না হলে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে মজ্জিত হত।
এই অসত্য ঔপনিবেশিক ইতিহাস আমাদের শেখানো হয়েছে। ইংরেজ শাসন যেসব দেশেছিল না সেই সব দেশ কি অনুন্নত? ১৭৬৫ সালের আগে কৃষি ,কুটির শিল্পের ও কারিগরদের ভালোরকম মেল বন্ধন ছিল, অন্তদেশীয় ও আন্তর্জাতিক বানিজ্য হত খুব ভালো, গ্রামীন মহিলারা রোজগার করতেন, কারিগর ও কৃষকরা সেই অর্থে অত্যাচারিত হতেন না। ইংরেজ শাসক পুরো কাঠামোটাই নষ্ট করে দিয়েছিল নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে। বিশ্বব্যাপী মসলিন কাপড়ের ব্যবসার কথা স্মরণ করবেন। (নন্দ ২০২২) ১৭৬৫র পর ঐতিহাসিক রমেশ দত্তের হিসেবে যে ৬২০ মিলিয়ন পাউন্ড লুঠ হয়েছে, তাতে যদি মাত্র সরল ৫% সুদ প্রয়োগ করা যায়, তাহলে অঙ্কটার পরিমাণ হবে ২০১৬-র ভারতের জিডিপির ২/৩ অংশ, ২০১৫-র যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ৪৫%। রেলপথ তৈরীর মাধ্যমে লুন্ঠনের ইতিহাস পাই দেবত্র দে মহাশয়ের ঔপনিবেশিক রেল- লুন্ঠনের ইতিহাস গ্রন্থে। [ক্রমশ]
লেখক প্রাক্তন কৃষি অধিকারিক, জৈবকৃষি ও দেশজ ফসলের গবেষক ও লেখক
জৈব চাষের প্রচার ও প্রসার প্রয়োজন। আমি নিজে এই বিষয় আগ্রহী ও উদ্যোগী হতে চাই। স্যার যদি পাশে থাকেন, পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন ট্রেনিং নেবার সুযোগ করে দেন আমি নিজে বিভিন্ন জেলা ঘুরে চাষীদের উদ্বুদ্ধ করতে ইচ্ছুক।
অর্ণব চক্রবর্ত্তী
বারাসাত, উত্তর ২৪ পরগনা
৭০০৩৯৯১৩৮৯