১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবস। দিল্লির রেডিও স্টেশন থেকে ভোরবেলায় গান গেয়ে সবে স্টুডিও থেকে বেড়িয়েছেন, হঠাৎ এক অফিসার হন্তদন্ত হয়ে তার কাছে ছুটে এসে বললেন — প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে, লালকেল্লায় ভারতের জাতীয় পতাকা যখন তিনি উত্তোলন করবেন তখন ওই বিশেষ মূহুর্তে গাইতে হবে ‘সোনেকা হিন্দুস্থান মেরা, সোনেকা হিন্দুস্থান’, সঙ্গে কয়েকটি ভজনও। গরিমায় ভরা ফেলে আসা অতীতের এই কিংবদন্তি শিল্পী হলেন সর্বভারতীয় সংগীত জগতের সাধিকা যূথিকা রায়।
সেদিন প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রাখতে পারার জন্য তিনি তো উৎফুল্ল হয়েছিলেনই সঙ্গে পন্ডিতজিও অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। পরে প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও পণ্ডিতজির বাড়িতে বসে অনেক ভজন শুনিয়েছিলেন যূথিকা রায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে নানান গুণীজন।
তখন চলছে গান্ধীজীর ভারতছাড়ো আন্দোলন। কলকাতাতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা থামাতে মহাত্মা গান্ধী উঠলেন বেলেঘাটায়। সরোজিনী নাইডু ছিলেন যূথিকার ভজন গানের ভক্ত। তার অনুরোধে একদিন সকালে মাকে সঙ্গে নিয়ে গান্ধী-সন্দর্শনে এসেছিলেন যূথিকা। সেদিন বাপুজি ছিলেন মৌনী, খালিগা চোখে মোটা কাঁচের চশমা পড়ে মাদুরের উপর বসে খাতায় কি সব লিখছিলেন। পাশে বসা আভা গান্ধী বললেন, বাপুজীর এখন এক মিনিটও সময় নেই। কিন্তু যূথিকার ভজন শোনার জন্য বাপুজি খুবই আগ্রহী, ঠিক হলো পাশের ঘরে গান্ধীজি যখন স্নান করবেন তখন যেন যূথিকা এই ঘর থেকেই বাপুজির প্রিয় ভজনগুলি গিয়ে শোনান।
বাপুজি পাশে ঘরে চলে যেতেই যূথিকা তার সুমিষ্ট গলায় ভক্তি ভরে একের পর এক ভজন শোনাতে লাগলেন — ‘তোহে পিয়া মিলেঙ্গে’, ‘ম্যায়তো ওয়ারী যাউ রাম’, ‘প্যারে দর্শন দিও আজ’, ‘ম্যায়নে চাক্যর রাখজি’… স্নান সেরে বাপুজি সকলের সামনে এসে দাঁড়ালেন, সঙ্গে সঙ্গে গান থামিয়ে যুথিকা তাঁকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। প্রাণভরা হাসিতে হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন বাপুজি। সেদিন তাঁর দর্শন পেয়ে গান শুনিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন যূথিকা দেবী। মহাত্মা গান্ধী যূথিকার ভজন শুনে তাঁকে ‘মীরাবাঈ’ উপাধি উপহার দেন।
সেদিন বিকালেই ময়দানে তার প্রার্থনা সভায় গান গাওয়ার অনুরোধ এলো। ‘ওরে নীল যমুনার জল’ গান দিয়ে শান্তির বাতাবরণ যেন পরিপূর্ণতা পেয়েছিল সভায়। অনেক বছর পর পোরবন্দরে গান্ধীজীর জন্মকক্ষে বসে অনেক গান গেয়েছিলেন তিনি। সে বছরই পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী সম্মান।
১৯৫৩ সালের একটি ঘটনা বলি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্মৃতিতে দার্জিলিং-এর একটি টিবি হাসপাতাল তৈরির জন্য চ্যারিটি প্রোগ্রাম হয় রাজভবনের খোলা মাঠে মুম্বাই আর কলকাতার নামী শিল্পীদের নিয়ে। সে বারই লতা মঙ্গেশকর প্রথম আসেন কলকাতায়। প্রোগ্রামটি হয় তিন দিন ধরে। পঙ্কজ মল্লিক আর উৎপলা সেনের দ্বৈত কণ্ঠের স্তোত্র পাঠ দিয়ে শুরু হতো প্রতিদিনের অনুষ্ঠান। তারপরেই লতা, গীতা, হেমন্তকুমার আলাউদ্দিন খাঁর বাজনা। এরপর ডাক পড়ল যুথিকা রায়ের। আলাউদ্দিন-এর বাজনা পর মঞ্চ ওঠা তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ওস্তাদির পর গান জমানো খুব শক্ত ব্যাপার। সকলেই প্রায় এড়িয়ে চলতেন। দুরু দুরু বক্ষে মঞ্চে উঠলেন যুথিকা রায়। গাইলেন ফইয়াজ হাসানের লেখা ‘বোল রে মধুবনমে মুরালিয়া’ আর মীরাবাঈয়ের বিখ্যাত ভজন ‘যোগি মাত যা’, সুর কমল দাশগুপ্তের। প্রথমটি বাগেশ্রী আর দ্বিতীয়টি ভৈরবী রাগের ওপর। গান শেষ হলো ,সুরের মূর্ছনায় ভাসলেন সকল শ্রোতাবৃন্দ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন লতা মঙ্গেশকর অসাধারণ কণ্ঠের অধিকারী এই সাধিকাকে।
যূথিকা রায়ের জন্ম ১৯২০ সালের ২০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার আমতা’য়। অবশ্য তাঁদের আদি বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের খুলনার সেনহাটি’তে। ডাক নাম ছিল ‘রেণু’। পিতা সত্যেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন স্কুল ইনসপেক্টর। বদলির চাকরি। ঘন ঘন বদলির কারণে লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটত। সেকারণে ১৯৩০ সালে তাঁর মা স্নেহলতা দেবী কলকাতার চিৎপুরে ঘর নেন।
যুথিকা রায় বিশাল বিস্তৃত সংগীত জীবনের দু-চার কথায় শেষ হওয়ার নয়। ছোটবেলা থেকেই গান শিখেছেন সংগীতগুরু জ্ঞানরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যাযের কাছে। বড় বোন বেথুন কলেজে ভর্তি হন। আর যূথিকা ছোটবেলা থেকেই গানে অনুরক্ত ছিলেন বলেই বরানগরে জ্ঞানরঞ্জন সেনের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করেন ।
জ্ঞানরঞ্জনের বিশেষ বন্ধু ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। যূথিকার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ১৯৩০ সালে নজরুল ইসলামের চেষ্টায় প্রথম গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড হয় ‘স্নিগ্ধ শ্যাম বেণী বর্ণা’ গানটি। কিন্তু মোমের রেকর্ডে ত্রুটি থাকায় সে রেকর্ড আর বাজারে বেরোয়নি।
এরপর ১৯৩৪ সালে গ্রামাফোন কোম্পানী থেকেই তার প্রথম রেকর্ড বেরোয়। প্রণব রায়ের কথায় আর কমল দাশগুপ্ত সুরে “আমি ভোরের যূথিকা” এবং ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে’ এই দুটি গানের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে সর্বস্তরে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। রেকর্ডে যূথিকা নাম থাকলেও ব্র্যাকেটের নাম দেয়া হতো রেণু।
ভোরের যূথিকা গানটির দৌলাতে একের পর এক গান রেকর্ড হতে লাগলো। কাজী নজরুল ইসলাম আর কমল দাশগুপ্ত-র সুরে ‘ওরে নীল যমুনার জল’, ‘জয় বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী বীর’, ‘পরমপুরুষ সিদ্ধযোগী মাতৃভক্ত যুগাবতার’,
‘যদি রাধা হতে শ্যাম’, ‘দিন চলে যায়’, ‘হে কবি বিদায়’, ‘স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর’, ‘শতেক বরষ পরে’, ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’, যূথিকার গাওয়া সে সব গান তখন নানাজনের মুখে মুখে ফিরত।
দীর্ঘ চার দশকের সঙ্গীত জীবনে জনপ্রিয় ছায়াছবির গান-সহ অজস্র ভজনও গেয়েছেন তিনি। দিল্লি, কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ এলাহাবাদ লক্ষৌ পাটনা, জলন্ধর সহ বহু বেতারকেন্দ্রে গান গেয়েছেন। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সিংহল ও পূর্ব আফ্রিকাতেও তিনি গান গেয়েছেন। তাঁর গাওয়া গানের মোট রেকর্ড সংখ্যা ১৭৯ টি।
ভারতের বাঙালি খ্যাতকীর্তি এই ভজন গায়িকা শেষ জীবনে শ্যামপুকুর স্ট্রিটের পুরনো বাড়িতেই সপরিবারে থাকতেন। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক সন্ধ্যায় চন্দনগর রবীন্দ্রভবনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত করা হয় কিংবদন্তি এই শিল্পীকে। এটিই ছিল তার শেষ মঞ্চানুষ্ঠান। ৯৩ বছর বয়সেও অসীম জীবন শক্তির প্রতীক ছিলেন তিনি। সেই বয়সেও তিনি গান শেখাতেন। নিয়মিত লেখালেখির মধ্যে তিনি থাকতেন। যূথিকা রায়ের আত্মজীবনী ‘আজও মনে পড়ে’ বইটি পুরোটাই তাঁর নিজের লেখা। গত ২০ এপ্রিল ছিলো এই সুরসাধিকার ১০৪ তম জন্মদিবস। পরাধীনতার যন্ত্রণায় মানুষ যখন বিধ্বস্ত, তখন একটু শান্তির পরশ পেতে রেডিওতে এক বাঙালি গায়িকা কন্ঠে শোনা যেত একের পর এক ভক্তিরসে সমৃদ্ধ ভজন এবং দেশাত্মবোধক গান। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন সংগীত সাধিকা। ভারী মিঠে, কোমল সুরের দোলা কিভাবে যেন পুরনো সময়টাকে ফিরিয়ে দেয় তা তার গান শুনলেই অনুভব করা যায়।
অপূর্ব লেখা
আন্তরিক ধন্যবাদ।
ভালো লাগলো
থ্যাঙ্ক ইউ