‘মেছো’ আর ‘ভেতো’ এই দুই শব্দের সঙ্গে বাঙ্গালীর প্রেম বহুদিনের। কেননা রসনা তৃপ্তির সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে মাছ। মাছের বাজার দর যতই চড়ুক না কেন, মাছ থেকে মাছের পটকা সমেত তেল, সবটা নিয়ে বাঙালির বাড়ী ফেরা। বাঙালির এই স্বভাবকে রীতিমতো টেক্কা দিতে হাজির চিন দেশের মানুষ।
শুনলে চক্ষু চড়কগাছ হবে, জুনের শেষে প্রমাণ সাইজের একটা তেলিয়া ভোলার দাম উঠলো তেরো লক্ষ টাকা। তাও যদি ইলিশ, স্যামন মাছের মতো কোন কুলীন মাছ হতো!! জানলে আরো আশ্চর্য হবেন, ১৩ লক্ষ টাকার একটি মাছের পটকা বিক্রি করে আয় ৫০ লক্ষ থেকে কোটি টাকা! আমাদের রাজ্যের দীঘা, কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবারের পাইকারি বাজারে এমনি দামে বিকোয় তেলিয়া ভোলা। সারা বিশ্বে এই মাছের পটকার একমাত্র বড় বাজার চিন।
২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফান্ড ফর নেচারের একটি রিপোর্টে বলা হয়, তেলিয়া ভোলার এক কেজি পটকা চিনে বিক্রি হয় ১৩ লক্ষ মার্কিন ডলারে, ভারতীর অঙ্কে প্রায় ১০ কোটি টাকা। কিন্তু পুরো কেনাবেচাটাই হয় চোরাবাজারে। ১৯৭৫ সাল থেকে এ দেশে এই মাছ শিকার ও পটকা বিক্রি — দুই নিষিদ্ধ। অতিরিক্ত শিকারের কারণে এই মাছ চিনে বিরল। ভারত ও মেক্সিকো থেকে চিনে পাচার হয়।
মেক্সিকোয় এই মাছের চোরাকারবার তুঙ্গে। দুর্মূল্য হওয়ার দরুন একে বলা হয় ‘কোকেন অফ দ্য সি’। সম্প্রতি পটকা চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে সে দেশের শুল্ক বিভাগ।
কিন্তু কেন, তেলিয়া ভোলা মাছের পটকার দাম এত বেশি? চিনের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় মাছের পটকার বিভিন্ন পদ বিপুল জনপ্রিয়। এই মাছের তেল ও মাংস থেকে তৈরি করা হয় জীবনদায়ী নানান ঔষধ। চিন-সহ বেশ কিছু দেশের বাসিন্দারা মনে করেন, পটকার গুঁড়ো খেলে বাতের ব্যথা থেকে দীর্ঘদিন সুস্থ থাকা যায়, ধরে থাকে যৌবন। অথচ, সেই দেশের সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা করেছে, এ ধারণা ভিত্তিহীন।
শুধুমাত্র বিশালাকার তেলিয়া ভোলা নয়, বাজারে বড়ো ভোলা, ভেটকি মাছের পটকার চাহিদাও রয়েছে চিনে। কর দিয়ে এগুলি রপ্তানি করতে হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চোরাপথে বাংলাদেশ, নেপাল হয়ে পাঠানো হয় চিনে। এমনকি ওষুধের সঙ্গে ক্যুরিয়ারে পাঠানো হয়।
এতো গেলো ধনী মাছের কথা। বাঙালির প্রোটিনের জন্য পছন্দের উৎস মাছ। আর যদি খাবার পাতের শুরুতে গরম ভাতে মাছের তেল থাকে, তা দিয়েই এক থালা ভাত সাবাড় করে দেওয়া যায় নিমেষে। শুধু স্বাদে নয়, একাধিক রোগ উপশমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মাছের তেল। মাছের তেল পাওয়া যায় মাছের কলাকোষ ও যকৃৎ থেকে। মাছের তেলে প্রোটিন, ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রচুর ভিটামিন, আয়োডিন ছাড়াও রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট।
মাছের তেল নিয়ে গবেষণাতে ডেনমার্কের বিজ্ঞানীরা দেখেন, গ্রীনল্যান্ড অধিবাসীগণ প্রচুর পরিমাণে ফ্যাট জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করেন, এর বেশিরভাগটাই সামুদ্রিক মাছ। ফলে এদের হার্টের রোগ, বাত, হাড়ের রোগ প্রায় হয় না বললেই চলে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রত্যেক মানুষের খাদ্য তালিকায় সপ্তাহে অন্তত দুদিন তেলযুক্ত মাছ বা মাছের তেল খাওয়া উচিৎ।
সামুদ্রিক মাছ সলোমন, টুনা, কর্ড, হেরিং ইত্যাদি মাছের তেল পুষ্টিগুণে ভরপুর। দেশীয় মাছ — রুই, কাতলা, ইলিশ, মৃগেল, চিতল, আড়, শংকর ইত্যাদি মাছেও রয়েছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। তবে পরিমাণে স্বল্প। সমুদ্রের মাছ সপ্তাহে এক বা দুই দিন খেলে পর্যাপ্ত পুষ্টি পাওয়া যাবে।
শরীরের জন্য ও হার্টের উপকারী ভালো কোলেস্টরেল বা এইচডিএল এর মাত্রা বাড়ায় মাছের তেল। ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, হাইপারটেনশন ইত্যাদি অসুখের আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে স্থূলত্ব। মাছের তেল বা ফিশ অয়েল সাপ্লিমেন্ট এর সঙ্গে উপযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করেলে ও নিয়মিত ব্যায়াম করলে ওজন কমাতে সাহায্য করে।
আমদের ত্বকে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও দীর্ঘক্ষণ সূর্যরশ্মি ত্বকের ক্ষতি করে। মাছের তেল ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
শিশুদের বুদ্ধির বিকাশে, স্মৃতিশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে ডিএইচএ গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। হবু মায়েরা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সমুদ্রের মাছ, মাছের তেল খেতে পারেন ।
ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধ করতে নিয়ম করে ফিশ অয়েল খাওয়া জরুরী। মানসিক অবসাদ কাটাতে, হ্যাপি হরমোন নিঃসরণ বাড়াতে মাছের তেল খুব উপকারী। এছাড়া অ্যাজমা, সিওপিডি, আর্থরাইটিস, পোষ্ট মেনোপোজ ইত্যাদি সমস্যায় মাছের তেল খুবই উপকারী।
কিন্তু রক্ত তরল করার ওষুধ যাঁরা সেবন করেন, অপারেশনের আগে অতি অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে মোটেও ভুলবেন না মাছের তেল খাওয়ায় জন্য।
Source : Various articles and journals have been referred for the Writeup.
খুব ভালো প্রতিবেদন।
Bhalo