রবিবার | ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৪:৩৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের দুর্গোৎসব : রিঙ্কি সামন্ত মর্ত্যে দুর্গাপূজার সেকাল ও একাল : অসিত দাস বই-বাই : নবনীতা দেব সেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘প্রবাসী’ ম্যান মেড নয় ডিভিসি-র পরিকল্পনা আর রূপায়নে গলদ : তপন মল্লিক চৌধুরী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে রাখাইনে সেইফ জোন তৈরি করা আবশ্যক : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ফলের নামটি পাকা কলা : রিঙ্কি সামন্ত বই-বাই : নবনীতা দেব সেন হেমচন্দ্র বাগচীর ১২০তম জন্মবর্ষ : দীপাঞ্জন দে নিম্ন চাপের অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত আরামবাগ : দেবাশিস শেঠ আরামবাগে ভয়াবহ বন্যা, দুর্যোগের পদধ্বনি, ক্ষোভ জনমানসে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মেয়েদের ক্ষমতায়নের পক্ষেও আওয়াজ তুলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী কবি দেবদাস আচার্য-র কবিতাজগৎ — বহমান পৃথিবীর জীবনপ্রবাহ, চেতনাপ্রবাহ : অমৃতাভ দে মনসার নাম কেন ঢেলাফেলা : অসিত দাস ভোও.. ও ..ও.. কাট্টা…! ভো… কাট্টা…! : বিজয় চৌধুরী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা : সন্দীপন বিশ্বাস নারীবেশী পুরুষ অভিনেতা শঙ্করকে সামাজিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় না : বিশ্বেন্দু নন্দ সাসারামের রোহতাসগড়, বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : নন্দিনী অধিকারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ : আহমাদ ইশতিয়াক আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর, এবারও অধরা রইলো আলোচনা : সুমিত ভট্টাচার্য জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব চাষির দুঃখের ঘরে সাপের বাসা, আজও রেহাই নেই ছোবলের হাত থেকে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সল্টলেক তথা লবণহ্রদই কি কুচিনান : অসিত দাস পদ্মা বা পার্শ্বপরিবর্তনী একাদশী ব্রতকথা : রিঙ্কি সামন্ত জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’ কত দিন বিনা চিকিৎসায় চলে যাবে অসুস্থ মানুষের প্রাণ? প্রশ্ন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের : সুমিত ভট্টাচার্য দেবী করন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ মন্তেশ্বরের করন্দা : প্রবীর কুমার সামন্ত প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার সংগীত সাধক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : রিঙ্কি সামন্ত শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের অন্দরে বাহিরে বিরাজমান সিণ্ডিকেট : তপন মল্লিক চৌধুরী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের দুর্গোৎসব : রিঙ্কি সামন্ত

রিঙ্কি সামন্ত / ৯ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

“জয়া যোগেন্দ্র-জায়া, মহামায়া মহিমা অসীম তোমার/একবার দুর্গা দুর্গা দুর্গা বোলে যে ডাকে মা তোমায়, তুমি করো তায় ভবসিন্ধু পার”… অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের বিখ্যাত দশ নম্বরী আইন পাশ হওয়া পর্যন্ত দুর্গোৎসব ছিল রাজা-প্রজা, সাহেব-মেমদের কলকাতার শ্রেষ্ঠ সামাজিক উৎসব। পুজো উপলক্ষে শুধু বঙ্গবাসীদের আনন্দ হতো তা নয়, তার চেয়ে বেশি আনন্দিত হতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব মেমদের। কলকাতার পুজো মানে তখন পরোক্ষেভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পূজা।

সাহেব মেমরা সেজেগুজে বসে থাকতেন কবে ধনী বাবুদের বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণপত্র আসবে তার অপেক্ষায়। পুজোর আগে ধনীবাবুরা সাহেবদের কার্ড পাঠাতেন কিংবা বিজ্ঞাপনের আয়োজন করতেন। কারণ বাবুরা জানতেন উপলক্ষ দূর্গাপূজা হলেও এই দুর্গোৎসব আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উৎসব, যা ছিল কোম্পানির নেক নজরে পরার রাজপথ।

বাঙালির দুর্গাপুজো রাতারাতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পূজোয় পরিবর্তিত হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল কোম্পানি তখনও এ দেশে পুরোপুরি শাসক হয়ে ওঠেনি। সুতরাং শাসকের ভূমিকাটা থেকে সেবায়েতের ভূমিকা তাদের নজরে ছিলো বেশি জরুরী। ফলে নেটিভদের পুজোয় বা আনন্দ যোগ দেওয়া ছিল তাদের কাছে সাধারণ শিষ্টাচার। কোম্পানি যখন সরকারিভাবে হিন্দুদের মন্দিরে তদারকি করতেন, প্রণামী সংগ্রহ করতেন দূর দূরান্ত থেকে তীর্থযাত্রীদের টেনে এনে মন্দিরের আয় বাড়াতে হতো। বিশেষ বিশেষ পর্বের দিনে দেবতার সম্মানার্থে কামান দাগানো হতো বা কখনো বিগ্রহের সঙ্গে মার্চ করতে হতো মাইলের পর মাইল। কোম্পানি কোন সংকটকালে রাজ পুরুষেরা মন্দিরে এসে বড় বড় ডালি নিয়ে পুজো দিয়ে যেতেন। কালীঘাটে এসব ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। শোনা যায় অনারেবল কোম্পানির একজন কর্মচারী মোকদ্দমা জিতে কালীঘাটে ৩০০০ টাকা পুজো দিয়ে গেছিলেন।

শুধুমাত্র কালীঘাট মন্দিরে পূজো দেওয়া হয়, ১৮ শতকের শেষ দিকে কোম্পানির এক কর্মচারী দুর্গোৎসব করতে নিজের টাকায়। তিনি হান্টারের “Aunals of Rural Bengal” এর বিখ্যাত ম্যানুফ্যাকচারার জন চিপস। বীরভূমের শান্তিনিকেতনের কাছে সুরুল গ্রামে তিনি জনপ্রিয় হন ‘শ্রীযুক্ত চিকবাহাদুর’ নামে। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কোম্পানির রাইটার অর্থাৎ কনিষ্ঠ কেরানির কাজ হিসেবে যোগদান চিপস মাত্র ১৬ বছর বয়সে। কয়েক বছর যেতে না যেতেই ভাগ্যদেবীর কৃপা বর্ষিত হল তাঁর উপর। কোম্পানি তাকে অডিটর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত করলেন। পরে ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে নিযুক্ত করা হয় বীরভূমের কোম্পানির প্রথম কমার্শিয়াল এজেন্ট হিসেবে। সেই সময় কোম্পানি সেখানে তুলা, রেশম, লাক্ষা, রঙ ইত্যাদি জমজমাট ব্যবসা করছিল। সুযোগ বুঝে চিপস নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসা জুড়লেন এর সঙ্গে।

কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। কোম্পানির অফিস ছিল সোনামুখীতে, চিপস থাকতেন সুরুলিতে। রায়পুরের লর্ড সিংহদের বংশের শ্যাম-কিশোর ছিলেন চিপসের দেওয়ান। তিনি একদিন চিপসকে পরামর্শ দিলেন দুর্ভাগ্য কাটানোর জন্য দুর্গাপুজো করতে। দুর্গাপূজোর সম্পর্কে কোম্পানির অফিসিয়াল মেজাজের কথা জানতেন চিপস। তাই সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন শ্যাম কিশোরের প্রস্তাবে। সুরুলিতে কোম্পানির কুঠিতে ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হলো। এমনকি উপোস করে অঞ্জলি অব্দি দিলেন চিপস। কাকতালীয়ভাবে চিপসের ভাগ্য এরপর থেকে ফিরতে শুরু করল। পরের বছর ব্যবসায় দ্বিগুণ লাভ হলো।

তারপর থেকেই প্রতি বছরই দুর্গাপূজা করতেন জন চিপস। অবশ্য সে পূজার খরচ কলকাতার ধনী বাবুদের পূজার খরচের মত নয়। তার দুর্গাপুজো বাবদ বছরে খরচা হতো মাত্র ৫০ টাকা। পূজার খরচ ১৭ টাকা আর বাকি টাকায় গাঁয়ের লোকেরা নতুন জামা কাপড় পেতো আর মহাষ্টমীর দিন খেতো ভরপুর ভোজ।

১৭৫৭ পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাবদের পরাজয়ের পর থেকেই প্রাদেশিক জমিদারদের মধ্যে এক ছদ্ম ক্ষমতায়ন ঘটে। এতদিন তারা প্রজাদের শাসন করলেও বকলমে ক্ষমতা ছিল নবাবদের হাতে। ইংরেজদের হাতে রাজ্য শাসনের ক্ষমতা গেলে, এই জমিদারদের মনে দীর্ঘদিনের লালিত অভীপ্সায় নতুন করে আশার আলো জাগে। প্রজাদেরকে নিজের বশে রাখতে এবং ইংরেজদের তোষামদ করতে দুর্গাপূজাকে সামনে নিয়ে আসেন জমিদাররা।

পুরনো কলকাতার দুর্গোৎসব সম্বন্ধে নতিবদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে হলওয়েলের “lnteresting Historical Events “গ্রন্থে। হলওয়েলের বিবৃতি অনুযায়ী, রাজা নবকৃষ্ণদেব ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে কলকাতায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন। অবশ্য অনেকের মতে বাংলা সর্বপ্রথম শরৎকালীন দুর্গাপূজার উদ্যোগ নেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তার পুজোর কথা শুনে শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেব বাড়িতে পুজো শুরু করেন। লর্ড ক্লাইভের অনুগ্রহ লাভের জন্য তিনি পুজোর সময় তাঁকে নিমন্ত্রণ জানাতেন। পুজোর সঙ্গে চলতো কবিগান, আখড়াই, বাঈ নাচ, যাত্রাপালা ও ভুরিভোজ। এসব মনোরঞ্জন করার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো সাহেবদের অনুগ্রহ আদায় করা।

নবকৃষ্ণের দেখাদেখি আরো অন্যান্য বড়লোকেরাও দুর্গোৎসবে সাহেবদের নিমন্ত্রণ করতে শুরু করলেন।

ক্যালকাটা ক্রণিকেল পত্রিকায় এরকম কয়েকজন বড়লোকের নাম পাওয়া যায়। নবকৃষ্ণ ছাড়া সেই তালিকায় ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, কেষ্ঠচাঁদ মিত্র, নারায়ণ মিত্র, রামহরি ঠাকুর, বারাণসী ঘোষ ও দর্পনারায়ণ ঠাকুর। এছাড়াও রাধাকান্ত চট্টোপাধ্যায়, রাজা সুখময় রায়, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও দ্বারকানাথ ঠাকুর। পুরনো কলকাতার পুজো বাড়ির আমোদ প্রমোদের একটি বর্ণনা ফ্যানী পার্কস তার ‘ভ্রমন বৃত্তান্ত’-এ দিয়ে গেছেন। তাঁর বর্ণনা থেকে দেবী মূর্তির, ঝাড় লন্ঠনের প্রশংসা ছাড়াও এলাহী খাবার দাবারের কথা জানা যায়। উপাদেয় খাবারের সঙ্গে বরফ, ফরাসি মদের ব্যবস্থা রাখা হতো। খাবার সরবরাহ করতেন বিদেশি পরিবেশক মেসার্স গান্টার এন্ড হুপার।

মন্ডপের অন্য একদিকে বড় হলঘরে সুন্দর বাইজিদের নাচ গান চলতো। সেখানে সাহেব ও এদেশীয় ভদ্রলোকেরা চেয়ারে বসে সুরা পান করতে করতে বাইজিদের নাচ গান শুনতো। এছাড়াও সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুর, কালীঘাট এবং আশপাশের গ্রামের লোকেরাও আসতো এদের নাচ গান শোনার ও শরৎকালীন দুর্গাপুজো দেখার জন্য।

দুর্গাপুজো উপলক্ষে সাহেব মেমদের আমন্ত্রণের অগ্রদূত হলেন শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণদেব বাহাদুর ও তার বংশধরেরা—রাজা শিবকৃষ্ণ, রাজা কালিকৃষ্ণ, রাজা গোপীমোহন প্রমুখ। শোনা যায় মহারাজা শিবকৃষ্ণের বাড়িতে দুর্গাপূজার সময় ‘দুর্গা মাইকি জয়’-এর বদলে ধ্বনি দেওয়া হতো ‘গড সেভ দ্য কুইন।’ এমনকি পুজো শুরুর আগে রাজা-রানির নামে জয়ধ্বনিও করা হত। শুধু তাই নয়, ইংরেজকে খুশি রাখতে পুজো শুরুর আগে সুর করে গাওয়া হত—

‘ভারত-কমলা স্বভাব চঞ্চল/ক্লাইবের বলে হইলা নিশ্চল/পুরনারী যথা স্বামীর আদেশ/সতত করয়ে পালন।’

এদেশীয় বড়লোকদের মধ্যে দুর্গাপূজা নিয়ে চলতো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। পূজায় ভক্তি ও নিষ্ঠার চেয়ে জাঁকজমকের ব্যবস্থা আর চোখ ঝলসানো উৎসবের ঘটাই ছিল বেশি। সামাজিক কৌলিন্যের মাপকাঠি ছিল কার পূজায় কতজন সাহেব আমন্ত্রিত হয়েছেন, কে কতজন ইংরেজ কর্মচারীকে উৎসবের মধ্যে টেনে আনতে পেরেছেন। এছাড়াও এসব ধনী বাবুদের মধ্যে নর্তকীদের নিয়েও চলত বাবু-লড়াই। আড়ম্বরের ব্যাপারে সেই সময় পাথুরেঘাটার জমিদার খেলাত ঘোষের বাড়ির দুর্গোৎসব বিলাসিতার জাঁকজমককে অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গোপীমোহন দেবের সঙ্গে সুকুমার রায়ের পুত্র রামচন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সবথেকে জোরদার, তখনকার সময় এ বিষয়ে সংবাদপত্রে খবর উল্লেখ হত।

১৮১৬ থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত ইংরেজি সংবাদপত্রের মাধ্যমে দুর্গাপুজোর উৎসবের অনুষ্ঠানসূচি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষিত হতো। এমনকি বিজ্ঞাপনে বাইজিদের নামও থাকতো — নর্তকী নিকি, বেগমজান, শ্রীজান, হিংগন আসারুন ও হীরা বুলবুল। নিকি সেই যুগের ইংরেজি সাময়িক পত্রসমূহের আলোচনার বিশেষ বিষয়বস্তু ছিল। সে যুগে নিকির সমকক্ষ নৃত্যগীতে পটিয়সী বাইজি আর ছিলনা। প্রতি রাতে নাচ গানের জন্য তার হাজার টাকা পারিশ্রমিক ছিল। শ্রোতারা তার সুরের নেশায় মাতাল হয়ে উঠতো। সে যুগে আর একজন বাইজি প্রসিদ্ধ লাভ করেন — বেগমজান। তার কালো হরিণ চোখ, মিষ্টি গলা শ্রোতাদের স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যেত। তার সুরেলা কন্ঠের হিল্লোলে সাহেবরা পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বাহবা জানাতো।

নাচের সঙ্গে ধনী বাবুদের বাড়ির পূজায় আরেকটি উপাচার ছিল সং সাজা। তারা কখনো রনপা চড়ে নেচে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত, কখনো বা বসে কাঁচের বোতল চিবাতো — এসব রঙ্গরসিকতায় সাহেবরা খুব আনন্দ পেতেন। নাচ-গান, খানাপিনা ছাড়া আরেকটি বড়মানুষী দেখানো হতো ঋণের দায়ে আটক থাকা কয়েদিদের মুক্ত করে। অনেক বাবু নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচা করে ইংরেজ কয়েদিদের মুক্ত করতেন।

শুধু তাই নয় প্রতিমার উৎকর্ষ নিয়েও প্রতিযোগিতা হতো। বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় সমস্ত প্রতিমা এনে হাজির করা হতো বাগবাজারের বালাখানার মাঠে। সেই বছরের শ্রেষ্ঠ প্রতিমার রূপদানকারী শিল্পীকে পুরস্কৃত করা হতো। সে সময় কুমোরটুলিতে এক ক্রিশ্চান কুমোর এন্টনি সাহেবকে তার প্রতিমার জন্য শ্রেষ্ঠ বিবেচিত করা হয়েছিল। এইভাবেই চলতো সাহেব ভজনা।

ইংরেজদের সংস্পর্শে নব উদ্ভূত কালচার নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল তৎকালীন বঙ্গসমাজকে। উল্লেখ করতে হয়, ইংরেজি সুরের মিশ্রনে ভারতীয় সংগীতের পরিবেশন তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৭৯২ সালে রাজা সুখময় রায় তাঁর বাড়ির দুর্গোৎসবে এই সংগীতের আয়োজন করেছিলেন।

হিন্দুদের উৎসবে খ্রিস্টানদের যোগ দেওয়া সঙ্গত কী না এ নিয়ে হিন্দুদের মধ্যে বিতর্ক তো আগাগোড়াই ছিল, এবার সেই বিতর্কের ঝড় তুমুল বইলো কলকাতার ইংরেজদের মধ্যে। শুরু হল মিশনারী সাহেবদেরও সমালোচনা। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ও এ নিয়ে প্রশ্ন তুলল। ১৮৩৩ সালে বের হল কোম্পানির বিখ্যাত ঘোষণা — হিন্দুদের মন্দিরাদি থেকে সরকারিভাবে হাত উঠিয়ে নিচ্ছেন ইংরেজরা। ১৮৩৭ সালে বন্ধ হয়ে গেল হিন্দু উৎসবে তোপ দাগানো। অবশেষে ১৮৪০ সালে এলো বিখ্যাত দশনম্বরী আইন: নেটিভরা প্রজা, আমরা রাজা, তাদের ধর্ম তাদের, আমাদের ধর্ম আমাদের। এরপর থেকে এদেশীয় লোকেদের বাড়ির কোন পূজা-পার্বণে উপস্থিত থাকতে পারবেন না ইংরেজরা সেই থেকেই দুর্গোৎসবে সাহেবদের আসা বন্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু অনেক ইংরেজরাই মন থেকে এ আইনের কথা মেনে নিতে পারেনি, তার প্রমাণ ইংরেজ কোবির লেখা ইংরেজি পদ্যটিতে —

“The Clutch, the Mart, the court of law.

The everywhere is deserted;

The very crows have ceased to caw.

And Echo’s broken hearted;

The palaced town in silence stands

For none are left in it to jaw;

being of for the Durga Puja.”

অর্থাৎ গির্জায় লোক নেই, কোর্ট-এ লোক নেই, চারদিক নিস্তব্ধ, দোকান বাজার সব খাঁ খাঁ, কোথাও কোন জন-মানবের সাড়া নেই, এমনকি কাকপক্ষীর পর্যন্ত রা নেই, কেননা কলকাতায় এখন দুর্গোৎসব। ইংরেজ কবির সুর যেন বিষাদগ্রস্ত কারণ তখন তারা আর ‘হিদেনদে’র পূজোয় অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কোম্পানির দেওয়া প্রাণবায়ু হারিয়ে কলকাতার দূর্গাপুজোর ফানুসটি চুপসে গেলো। এরপর থেকে শুরু হলো একালের বারোয়ারী, সর্বজনীন দুর্গোৎসব।

তথ্য সহায়তা : কলকাতার চলচিত্র, ডঃ অতুল সুর; দৈনিক স্টেটসম্যান; দুর্গা বাংলার লোকশিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি লোক সংস্কৃতিতে – লোক সংস্কৃতি গবেষণা পরিষদ এবং অন্যান্য।

২০২৩ পেজফোরনিউজ পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন