১৯৪১ সাল। আমি তখন রিপন কলেজে আই-এ পড়ি। খেলি সেকেন্ড ডিভিসনে হাওড়া ইউনিয়নে। বলাবাহুল্য আই. এফ. এ-র বর্তমান সভাপতি শ্রদ্ধেয় হেমন্তদা (দে) আমাকে প্রায় জোর করেই বাড়ীর মত করিয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ময়দানে খেলতে নিয়ে আসেন। আর কলেজের সহপাঠি চঞ্চল (ব্যানার্জি) ও শরৎ দাস। এরা তখন ইউনিভার্সিটি খেলে। কলকাতায় তখন আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতা।
সেবার ইউনিভার্সিটি থেকে নির্দেশ জারি করা হল : কেউ ইউনিভার্সিটির অনুমতি ছাড়া কলকাতা ছাড়তে পারবে না। আমি তখন ছোট। ভাবতাম, আমি কি খেলব ইউনিভার্সিটির হয়ে? বোধহয় না। তাই কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ফুটবল খেলতে গেলাম লখনউ-এ। যেদিন ফিরলাম সেদিন ফাইনাল খেলায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ড্র করেছে পাঞ্জাবের সঙ্গে—পরের দিন রিপ্লে। এখনকার মত তখন কথায় কথায় ‘যুগ্ম বিজয়ী’ হতো না।
রিপ্লের দিন সকালেই কলেজের প্রফেসর ইন-চার্জ ফর স্পোর্টস এণ্ড গেমস আমাদের বাড়ী এলেন। বললেন, সকাল সকাল কলেজ এসো। তারপর মাঠে এসো।
মাঠেই আমার না বলে লখনউ-এ যাওয়ার অপরাধ মুকুব হয়ে গেল এক দরখাস্তে। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় দলে খেলতে দেওয়া হল। অবশ্যই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই খেলায় আমরা ৩-১ গোলে জিতলাম। সোমানা বোধহয় দুটো গোল করেছিল মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গল এজমালি মাঠে। এবং সম্ভবতঃ মোহনবাগানের কর্তাব্যক্তিরা মাঠে ছিলেন। বোধহয় তাঁদের আমার খেলা মনে ধরেছিল।
পরের বছর আশুতোষ কলেজে পড়া অনিলদা (দে) আমার বাড়ী এলেন। মোহনবাগানের হয়ে খেলার জন্য। অথচ আমার সেবার এরিয়ানে যাওয়া একরকম ঠিক। কিন্তু মোহনবাগানের ডাক মানে একেবারে পূর্নিমার চাঁদ। তায় আবার আমার মাতামহ স্বগতঃ ডা. বিভূতি চরণ সামন্ত তখন মোহনবাগানের মেম্বার। স্বভাবতঃই বাড়ীর পরিবেশ এবং পরিমণ্ডল তখন মোহনবাগান বলতে অজ্ঞান। সেই ১৯৪২ সাল থেকে মোহনবাগানে আমার প্রবেশ। প্রস্থান খেলোয়াড় থেকে ১৯৬০।
যদিও ১৯৪২-এ মাত্র ৪টি কি ৫টির বেশী ম্যাচ খেলতে পাইনি। লীগে আমরা পয়েন্ট পেয়েছিলাম ২৪টা খেলে ৩৬। আমরা হয়েছিলাম তৃতীয়। ইস্টবেঙ্গল প্রথম।
তখন মোহনবাগানে আমি খেলছি ব্যাকে শরৎ দাস-এর সঙ্গে। তিনি তখন আমার খেলার গুরু। গোলে কলেজের সহপাঠি চঞ্চল ব্যানার্জি ও ডি সেন। এছাড়া টি. আও দ্বিপেন সেন, রাসবিহারী দাস, অমল মজুমদার, নির্মল মুখার্জী, নির্মল চ্যাটার্জী, বিজন বোস ও কে রায় প্রমুখ।
কিন্তু পরের বছর। এবার আমরা লীগে আর তৃতীয় নয়। এবার পেলাম লীগ, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। সেই সঙ্গে ট্রেডর্স কাপ। পরের বার অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে আমার জীবনে এলো এক শুভক্ষণ। লীগের দৌড়ে তখন এগিয়ে আছে মহামেডান। ওরা ২৩টা খেলে ৩৯। আর আমরা ৩৮। লীগের শেষ খেলা ওদের সঙ্গে। সেই খেলায় আমাদের জিততেই হবে যদি লীগ পেতে চাই। জিতলাম এক গোলে। এবং সেটা আমারই ফ্রি-কিক থেকে। ভাবতেও পারি নি ওদের ইসমাইলের মত গোলকীপার কিম্বা জুম্মা খার মত ব্যাককে পরাজিত করে ওদের জালে বল পাঠাবো।।
সেই ম্যাচ থেকেই জনসমক্ষে আমাকে ‘মান্না’ বলে পরিচিত করলো। জীবনে প্রথম সাফল্য। তাই তার আনন্দও অসীম ।
এই রকম ফ্রি-কিক থেকে অনেক গোল করেছি। যেমন ‘৫২-য়। শীল্ড ফাইনালে রাজস্থানকে, ৫৫-য় ও ৫৮-য় লীগে ইস্টবেঙ্গলকে। কিন্তু সেদিনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
১৯৪৫ থেকে ‘৪৭ পর্যন্ত লীগে আমাদের চললো কোনরকমে ঠুকঠাক করে। তবে ‘৪৫-এ লীগ-শীল্ডের রানার্স হলাম। ‘৪৬-এও লীগে রানার্স। কিন্তু ‘৪৭-এ ভারত স্বাধীন হবার পর শীল্ড পেলাম। সে কী আনন্দ আমাদের! এতকাল ১৯১১-র কত রূপকথার কাহিনী শুনেছি। এবার ছত্রিশ বছর পর সেই শীল্ড আমরা ঘরে তুললাম। সেই সঙ্গে বৃটিশ প্রফেশনাল টীম খেলতে এলো প্রদর্শনী।
ওই দলেরই বিখ্যাত ফুটবলার কার্টিস সাহেবকে আমরা দশ দিনের জন্য কোচ হিসাবে পেয়েছিলাম। ওর কাছেই শিখলাম সত্যিকারের ফুটবল কিভাবে খেলতে হয়।
পরের বার ১৯৪৮। এবারও শীল্ড পেলাম। সেই সঙ্গে লীগে দ্বিতীয় হ’লাম।
তবে মজা হ’ল ১৯৫১-য়। আমরা লীগ শেষ করেছি ২৬টা খেলে ৪৪ পয়েন্ট করে। ইস্টবেঙ্গল তার আগের চ্যাম্পিয়ান। আমরা ওদের থেকে তিন পয়েন্ট পেছিয়ে। ওদের তিনটে খেলা বাকী। ইস্টবেঙ্গল ওই তিনটে খেলায় দুটো ড্র করলো, একটায় হারলো। ফলে লীগ জুটলো আমাদেরই কপালে। সেবার লীগের প্রথম খেলায় ওদের আমরা হারিয়েছিলাম তিন গোলে। ফিরতি খেলায় ওরা আমাদের হারালো দু-গোলে।
সেবার শীল্ড ফাইনালে ওদেরই মুখোমুখী হ’লাম। ওরা তার আগে দু’বার পর পর শীল্ড জিতেছে। দারুণ উত্তেজনায় ভরা খেলার প্রথমদিন আমরা ড্র করলাম। ঠিক খেলার শেষ দিকে ভবানীপুরের বিখ্যাত রবি দাস (তখন লীগে একদলে খেলে শীল্ডে অন্য দলে খেলা চলতো) একটা অপূর্ব সুযোগ নষ্ট করলো। তিনদিন বাদে আবার খেলা। এবার ইস্টবেঙ্গল সালের দেওয়া দু’গোলে আমাদের হারিয়ে পর পর তিনবার শীল্ড নিলো।
তার পরের বার কান্না হাসির দোলায় দুলে কোনও ট্রফি জুটলো না। লীগে ইষ্টবেঙ্গলের সঙ্গে লড়তে লড়তে মাঝ পথে আমারই নেতৃত্বে ভারতীয় দল চললো হেলসিঙ্কি ওলিম্পিক। মোহনবাগান থেকে আমি ছাড়াও সাত্তার এবং রুনু গুহঠাকুরতা দলভুক্ত হলো। আর এই তিন জনের অনুপস্থিতি দলের কত যে ক্ষতি করতে পারে তার প্রমাণ আমরা লীগে হ’লাম অষ্টম। শেষ তিনটি দলের ওপরে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে। সেবার লীগ পায় ইষ্টবেঙ্গল।
ওলিম্পিক থেকে ফিরেই মরা গাঙে বান ডাকতে শুরু করলো।
সেবার শীল্ডের আগে মোহনবাগানের সঙ্গে ওলিম্পিক দলের খেলা হল কলকাতায়। আমরা জিতলাম দু’গোলে। আর সেবারই বি. এন. আর. থেকে সমর ব্যানার্জি (বদ্রু) এবং জর্জ থেকে স্বরাজ (ফিশে) চ্যাটার্জী শীল্ডে আমাদের দলে এলো। বহু পুরানো গোলকীপার এবং আমার সহপাঠি চঞ্চলের জায়গায়।
শীল্ডে কোয়ার্টার ফাইনালে রেলকে (২-১) এবং সেমি ফাইনালে এরিয়ানকে (২-০) হারিয়ে আমরা রাজস্থানের সঙ্গে ফাইনাল খেললাম। প্রথম অর্ধেই দু’গোলে পিছিয়ে পড়লাম। হাফ টাইমে যখন টেন্টে ফিরছি তখন মনে হচ্ছে ‘ধরিত্রি তুমি দ্বিধা হও!’ লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট। লীগে যে রাজস্থানকে আমরা তিন গোল দিয়েছি সেই রাজস্থানই এখন দু’গোলে এগিয়ে?
মনের মধ্যে এ-প্রশ্ন থাকলেও দর্শকরা আমাদের উৎসাহ দিচ্ছেন। তারা বলছেন, “এখনো হাফ টাইম বাকী”। এই উৎসাহ সেই মুহুর্তে কতখানি যে প্রাণ সঞ্চার করেছিলো, আজ ভাবলে সত্যিই আনন্দ পাই।
দ্বিতীয়ার্ধের পঁয়ত্রিশ মিনিটের শেষ দশ মিনিটে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে একটা গোল আমি শোধ করি ফ্রি-কিক থেকে। আর খেলা ভাঙ্গার চার মিনিট আগে বদ্রুর সেন্টার থেকে হেডর রাজা বশিথ (যাকে বাকার বলেও ডাকতো) সে গোলটী শোধ করলে তার স্বভাবসুলভ হেডেই।
ফিরতি খেলা অষ্টমীর দিন। সারাক্ষণ আমরা একচেটে খেলেও গোল করতে পারলাম না। গোলশূন্য ভাবেই শেষ হল। আর খেলা হয় নি।
পরেরবার ১৯৫৩ লীগ হঠাৎ ট্রাম আন্দোলনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। যদিও ইস্টবেঙ্গলের থেকে এক কি দুই পয়েন্টের তলায় ছিলাম। ফিরতি লীগের অনেক খেলা তখন বাকী। এই ফাঁকে ইস্টবেঙ্গল গেল ইউরোপ ট্যুরে। আমরা কোথায় যাই? কলকাতাতেই রইলাম। এই শীল্ডে ইণ্ডিয়ান কালচার লীগের কাছে হেরে শীল্ড গেল হাতছাড়া হয়ে। কিন্তু কে জানে একটা নতুন রেকর্ড তখন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
সেবারই আমার নেতৃত্বে মোহনবাগান শুধু প্রথম ডুরাণ্ড নেয় নি, পরের দু’বছর ১৯৫৪ ও ৫৫ যথাক্রমে প্রথম লীগ শীল্ডের জোড়া মুকুট এবং প্রথম রোভার্স ঘরে তোলে। সঙ্গে ফের লীগ।
১৯৫৬-য় ফের ডাবলস্ সেই সঙ্গে রোভার্স একটুর জন্য হ’ল হাতছাড়া মহামেডানের কাছে। ‘৫৫-য় ওদের হারিয়ে রোভার্স পেলাম, ৫৬-য় ওদের কাছেই জিততে জিততে হেরে গেলাম। সেবার লীগ নিয়ে প্রথম পর পর তিনবার লীগ জিতলাম।
১৯৫৭ সালটা ভাল যায়নি। ‘৫৮-ও নয়। কারণ ‘৫৮-য় লীগ এবং শীল্ড দুটোই হাতে এসে ফিরে গেল। লীগ গেল ইস্টার্ণ রেলের কাছে একটা পেনাল্টী অপচয়ের খেসারতে আর শীল্ডে ইস্টবেঙ্গলের কাছে জিততে জিততে প্রথম দিন হল ১-১। অকালে হল ফাইনাল এবং হার। নারায়ণের দেওয়া একমাত্র গোলে।
১৯৫৯ আর ‘৬০ লীগ শীল্ডে ঠাসা সেই সঙ্গে ডুরাণ্ড। ঐ বছরই আমার ফুটবল জীবনের ইতি। শেষ বছর আমার খেলার কথা ছিলনা। দল থেকে ওলিম্পিকে অনেকে চলে যেতে খেলতে হ’ল।
মোহনবাগানে আমার সঙ্গে অনেকেই খেলেছেন। অনেকের নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। যাদের পড়ছে তাদের কথা আলাদা আলাদা ভাবে বলতে চাই না। এরা অনেকেই প্রতিভাধর ছিলেন, যারা ছিলেন না তাঁরাও ক্লাবের জন্য জান-প্রাণ লড়িয়ে একাগ্রভাবে খেলেছেন। দল ছাড়ার কথা এরা কোনদিন ভাবতেও পারেন নি এখনকার মত। এরা হলেন গোলে চঞ্চল ব্যানার্জি, ভরদ্বাজ, স্বরাজ চ্যাটার্জি, এবং সনৎ শেঠ। ব্যাকে পি বড়ুয়া, রহমান, শরৎ দাস, সুশীল গুহ, হাফে রতন সেন, শুভাশীষ গুহ, সুভাষ সর্বাধিকারী, চন্দন সিং, টি আও, নরসিয়া, কেম্পিয়া, জার্নাল সিং ও মহাবীর। ফরোয়ার্ডে শিবু সেন, ভেঙ্কটেশ, বাবু, বশিথ, অরুণ সিংহ, কেষ্ট পাল, সমর (কেষ্ট) দত্ত, সাত্তার, বদ্রু ব্যানার্জি, জে, এন্টনী নায়ার, রমন এবং চুণী গোস্বামী। এবং আরও যারা এই মুহূর্তে মনে আসছে না।
দু’টি দশক চল্লিশ এবং পঞ্চাশ মোহনবাগানে খেলে যে কি পরিমাণ আনন্দ পেয়েছি তা মনের মণি কোঠায় আজও জ্বলজ্বল করছে।
কভার ছবি : শৈলেন মান্না এবং আহমেদ খান
১৯৪৪ সালের লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান।
সেই বছর মোহনবাগান দলে ছিলেন —
রাম ভট্টাচার্য, চঞ্চল ব্যানার্জি, শরত দাস, শৈলেন মান্না, মানস দাশগুপ্ত, বি. বাসু, অনিল দে, টি. আও, দীপেন দাস, নির্মল চ্যাটার্জি, দীননাথ রায়, এ. মজুমদার, কে. রায়, নিমু বাসু, অমল ভৌমিক , নির্মল মুখার্জি, এ. ব্যানার্জি।
পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত