সংসদীয় রাজনীতিতে নীতি এবং ভোট — এই দুটির মধ্যে ভোট-ই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া সংসদে দলীয় উপস্থিতি না থাকলে যে সংসদীয় রাজনীতিতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায় না সে কথা মানেন বামপন্থীরাও। তাই ভোটই যে শেষ কথা তা সিপিএম তো বটেই, ফ্রন্টের অধিকাংশ শরিক দলগুলিও মনে করছে, ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা জোট করলে তৃণমূলকে যুঝতে অনেকটাই সুবিধা হবে। সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার স্বাদ যারা পেয়েছে, তারা যে কেবলমাত্র ‘বাম ঐক্য’ গড়ে তোলার মতো কাজকেই গুরুত্ব দেবে সেটা আর ভাবা সম্ভব নয়! তাই কল্পনাতীত হলেও নজিরবিহীনভাবে সিপিএম-তৃণমূল কংগ্রেস জোটও দেখা গিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির বহু প্রাচীন সমবায় সমিতির পরিচালন কমিটির নির্বাচনে। শুধু কি তাই, সেই নির্বাচনে জিতে দুই দল যৌথভাবে পরিচালন কমিটি গঠন করেছে। যেখানে সিপিএম বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলে আসছে সেখানে এই জোট যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কংগ্রেস চরিত্রগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু পুঁজিপতিদের-ই প্রতিনিধিত্ব করে সিপিএম এ কথা বললেও সম্প্রতি এ রাজ্যে সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে লড়েছে।
এ রাজ্যের একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বাম,কংগ্রেস ও আইএসএফ-এর ‘সংযুক্ত মোর্চা’ জোট ভোট বাক্সে এমন ভাবে বিফল হয়েছিল যে বাম-কংগ্রেসের যে টুকু ভোট ছিল তাও হারায়৷ কার্যত, বাম-কংগ্রেস ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল৷ বিধানসভা ভোট মিটতে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছিলেন, ভোট শেষ, জোট শেষ। তার কথা অনুযায়ী কংগ্রেসের সঙ্গে জোট আসলে ছিল নির্বাচনী সমঝোতা। যা ভোট মিটতেই শেষ হয়েছে। পরবর্তীতে রাজ্যের পুরভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেরা জোট না করে একাই খড়দহ, শান্তিপুরের মতো আসনে ভোট বাড়িয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোট লড়াইয়ের মতো চলতি বছর ত্রিপুরা বিধানসভা ভোটেও কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের মহাজোট হচ্ছে। উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে বাম, কংগ্রেস ও তিপ্রা মথা আসন সমঝোতা করে ভোট লড়বে। সাংবাদিক বৈঠক করে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি জানিয়েছেন, আপাতত নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। কে কটা আসনে লড়বে, কোথায় কে প্রার্থী দেবে তা নিয়ে পরবর্তীকালে আরও আলোচনা হবে।
ত্রিপুরাকে অনেকেই মিনি পশ্চিমবঙ্গ বলেন। পশ্চিমবঙ্গের মতোই সেখানেও কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সে রাজ্য শাসন করেছে। আবার ২০১৮ সালে সে রাজ্যের ক্ষমতা বদল হয়। বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি সরকার। বামেরা দীর্ঘ ৫ বছর বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে নিজেদের জায়গা ফেরত পাওয়ার জন্য মরিয়া লড়াই চালাচ্ছে। এবার বাংলার মতোই কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে বিজেপিকে হাঁটতে চায় সিপিএম। প্রসঙ্গত, একটা সময় পর্যন্ত ত্রিপুরায় দুটি দলই ছিল- কংগ্রেস ও সিপিএম। কিন্তু ২০১৮ র নির্বাচনে কংগ্রেসের সব ভোট গিয়ে পড়ে বিজেপির বাক্সে। অন্যদিকে ত্রিপুরায় কংগ্রেস একেবারে শূন্য হয়ে যায়। সেই অবস্থায় কংগ্রেস থেকে বেড়িয়ে সুদীপ রায় বর্মণ বিজেপিতে যোগ দেন। কিন্তু তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের সঙ্গে তাঁর বনিবনা না হওয়ায় তিনি ফের বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেন। ফের ভোট দাঁড়িয়েও জেতেন। এখন ত্রিপুরার কংগ্রেস সংগঠন বলতে সুদীপবাবুকেই ধরা হয়। কিন্তু একা সুদীপবাবু কি বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই দিতে পারবেন?
অন্যদিকে এ রাজ্যের জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় ত্রিপুরার রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারী প্রদ্যোৎ রায়বর্মণ ও তাঁর পার্টি তিপ্রা মথা এখন বিপুল জনপ্রিয়। আসন্ন ভোটে তিপ্রা মথার সঙ্গে কংগ্রেস ও বামেদের জোট হলে ত্রিপুরা নির্বাচনে বিজেপি বিরাট ধাক্কা খাবে বলেই মনে করেন রাজনইতিক বিশেষঙ্গরা। যদিও এখানে একটা ‘কিন্তু’ রয়ে গিয়েছে। প্রদ্যোৎ রায়বর্মণ আগে ছিলেন কংগ্রেসে। রাহুল গান্ধী তাঁকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি করেছিলেন। সুদীপ রায়বর্মণদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়াতেই তিনি কংগ্রেস ছেড়েছিলেন। এবার সেই প্রদ্যোৎ কি সুদীপের সঙ্গে আসন সমঝোতায় সহজ হবেন, এই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। তাছাড়া প্রদ্যোতের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসও সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে ত্রিপুরায় বিজেপির সন্ত্রাস, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি নিয়ে নাগরিকদের উদ্দেশে ছ’টি দল মিলে যৌথ বিবৃতি রেখেছেন। সেখানে সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, লিবারেশন, আরএসপি-র পাশাপাশি সই করেছেন ত্রিপুরা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্র চৌধুরীর তারপরেই সই করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বির্জিত সিংহ। এই ঘটনায় ত্রিপুরার রাজনীতিতে বাম-কংগ্রেস জল্পনা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।