অবিবেচক ব্যবহার। মাটির সঙ্গে মানুষের। গাছের সঙ্গে মানুষের। নিয়ত এই ব্যবহার ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ এবং প্রকৃতিকে। আবিষ্কার সুফলের উদ্দেশ্য। কিন্তু সেই আবিষ্কারের প্রয়োগ আর এক উদ্দেশ্যে। ফলে মাত্রারিক্ত অবিবেচক ব্যবহার মানুষকে কঠিন সমস্যার মুখে ফেলেছে। তা হল মাটিতে রাসায়নিক সার ও গাছে কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার। নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে ফসলে মাত্রাতিরিক্ত সার ও ওষুধ ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত পণ্যকে ‘বর্জন’ করতে পারছি না কেউ। এই ‘বর্জন’ যে বিষ তা জেনেশুনেও আমাদের গ্রহণ করতে হচ্ছে। বাঁচার জন্য খাদ্য দরকার। আর যে খাদ্য খাচ্ছি তাতে যে বিষের মাত্রা বাড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু সচেতন হলেই বহু রোগের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। বিশেষত চিকিৎসকেরা অকপটে স্বীকার করছেন, যে হারে চাষের উৎপাদিত ফসলে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে মানুষের মারণরোগ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এখন প্রায় ঘরে ঘরে ক্যানসার, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুস সংক্রান্ত, শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, যে হারে ওই সব রোগ বাড়ছে তাতে আরও ভয়ংকর দিন এগিয়ে আসছে। উৎপাদিত প্রতিটি ফসলে অর্থাৎ ধান, পাট, আলু, গম ও শাক-সবজি চাষ করতে গিয়ে জৈব সারের পরিবর্তে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করছেন। চাষিরা অতিরিক্ত বাড়তি রোগহীন ফসলের আশায় অবিবেচকভাবে সার ও ওষুধ ব্যবহার করছেন। ফলস্বরূপ দেখা যাচ্ছে সেই বিষ মানুষের শরীরে খাদ্যের সঙ্গে প্রবেশ করছে। দেখা দিচ্ছে কঠিন রোগ। যার হাত থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া সম্ভবপর নয়।
প্রসঙ্গত, চাষে উৎপাদিত ফসলে ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরলে গা শিউড়ে উঠবে। রাতারাতি সবজি বাড়াতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে হরমোন প্রয়োগ করা হচ্ছে। ৫০ গ্রাম বেগুন একদিন পরেই হরমোন প্রয়োগে ২০০ গ্রাম হচ্ছে। একইভাবে লাউ, কুমড়ো, পটল, শসা, ঝিঙে, লঙ্কা ও করলা-তেও হরমোন প্রয়োগ হচ্ছে। গাছের কাণ্ডে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে হরমোন প্রয়োগ করা হচ্ছে। সেই ফসল চাষির কাছ থেকে বাজারে আসছে। টাটকা-সতেজ বড় সাইজের সবজি দেখলেই ক্রেতাদের মন আকর্ষণ করে। আর সেই সবজি এখন প্রতিটি বাজারে হানা দিচ্ছে মানুষের মরণপথের পথিক হয়ে। চিন্তিত কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষি বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞরা। কৃষি বিজ্ঞানী ড. গোপালচন্দ্র সেতুয়া জানান, অধিকাংশ চাষি এখন অবিবেচকের মতো কাজ করছেন। বাড়তি ফসল ও লাভের জন্য নিজেরাই মরণকূপ খুঁড়ছেন। সেখানে আমার, আপনার কারও বাঁচার পথ নেই। মরণকূপের আকার বাড়ছে। সাবধান না হলে প্রতিটি পরিবারে একজন হয়তো কঠিন রোগের শিকার হবেন। গোপালবাবু আরও বলেন, চাষিরা ন্যাচারালকে করে ফেলছেন আর্টিফিসিয়াল। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এবং হরমোন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ, নিয়ম-নীতি মানছেন না বেশিরভাগ চাষি । সেটা উদ্বেগের। প্রথমে যেটা দরকার তা হল ফসল অনুযায়ী চাষ করতে গেলে আগে মাটি পরীক্ষা জরুরি। দু’বছর অন্তর মাটি পরীক্ষা না করে চাষ নয়। নাইট্রোজেন, পটাশ, ফসফরাস মাটিতে কী পরিমাণ প্রয়োগ করতে হবে তা মাটি বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে বলতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং সালফার মাটির ঘনত্ব অনুযায়ী প্রয়োগ জরুরি। তৃতীয়ত, স্বল্প খাদ্য অর্থাৎ বোরন, জিঙ্ক, মলিবডিনাম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে মাটির ঘনত্ব ও প্রয়োজন অনুসারে। এটা ঠিক করে দেবেন কৃষি বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞরা। কখনওই চাষিরা নিজেরা ঠিক করতে পারেন না। পরিমাণ মতো সার ও কীটনাশক ব্যবহার খুব জরুরি।
কৃষি বিজ্ঞানী গোপালবাবু আরও বলেন, আমাদের দেশের মাটিতে যেভাবে অম্লত্ব বাড়ছে তাতে যে কোনও ফসল উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি হবে। উৎপাদন কমবে। মাটি বন্ধা হবে ও নিজস্বতা হারাবে।তখন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ দিয়েও কোনও ফল হবে না। সেই দিনটা আর বেশি দূরে নেই, এখনই সচেতন না হলে। তাই জৈব প্রযুক্তিতে চাষ জরুরি। সুসংহত উদ্ভিদ খাদ্য জোগান পদ্ধতিতে চাষ দরকার। রাসায়নিক সার কমিয়ে জৈব সার বাড়ানো দরকার। জৈব প্রযুক্তিতে চাষ বাড়াতে হবে। এছাড়া আর একটি পদ্ধতি তা হল পাতার রস। নিম, আকন্দ, ধুতরা, ভূতভৈরব- এই চারটে গাছের পাতা জলে ফুটিয়ে পরের দিন ছেঁকে নিয়ে গোমূত্র এবং কেঁচো সার ধোওয়া জল, এর সঙ্গে অল্প পরিমাণে ডিটারজেন্ট ও দু-ফোঁটা কেরোসিন তেল মিশিয়ে গাছে স্প্রে করলে রোগপোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আর সেই গাছের ফসল মানব শরীরে উপাদেয় এবং অক্ষতিকারক হবে।
আরামবাগ মহকুমা কৃষি আধিকারিক (প্রশাসনিক) বিকাশ দে বলেন, জমিতে বেশি নাইট্রোজেন ব্যবহার করলে মাটি উচ্চ অম্লত্ব হয়। তখন জল ধরার ক্ষমতা কমে, মাটি শক্ত হয়ে যায়। মাটির উপকারী জীবাণুগুলোও ধ্বংস হয়। আর যে ফসল উৎপাদন হয় তা মানব শরীরের পক্ষে চরম ক্ষতিকর। একইভাবে বলা যেতে পারে মাটিতে ফসফরাস চাষিরা যে দেন তা সবটা কাজে লাগে না। মাত্র ১৫ শতাংশ ফসফরাস মাটিতে কাজে লাগে। এর ফলে মাটিতে আয়রন ফসফেট, জিঙ্ক ফসফেট, অ্যালিক অ্যাসিড ও নাইট্রিক অ্যাসিড বাড়ছে। যে ফসল উৎপাদন হচ্ছে তা মানুষ খাচ্ছে। তার ফলে শরীরে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে । বিশেষ করে পেটের ও ফুসফুসের সমস্যা। মানব শরীরে গ্রোথ কমছে। কমছে আয়ু। চিন্তায় কৃষি বিজ্ঞানীরা। উল্লেখ্য, বাজারে যে সমস্ত সবজি আসছে তার বেশিরভাগটাই রাসায়নিক সার ও ওষুধ এবং হরমোন প্রয়োগ করে তৈরি ফসল। সরাসরি বেগুন, করলা, শসা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, লাউ, কুমড়ো, আলুতে কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। চাষিরা মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগের কুফলের কথা ভাবছেন না। এঁরা ভাবছেন বেশি পরিমাণে ওষুষ দিলে দ্রুত পোকা মরবে এবং সতেজ ও পোকাহীন সবজি তোলা যাবে। আর সেটা করতে গিয়ে মানুষ নিজেরাই মরণকূপ খুঁড়ছেন। বাজারের বেগুন, করলা, পটল, শসা, লাউ, গাজর খোসা না ছাড়িয়েই অনেক বাড়িতে খাওয়া হয়। অনেকের জানা নেই যে, পোকা মারতে গেলে চাষিরা খুব সকালে, আর তা না হলে সন্ধ্যার ঠিক আগে ওষুধ প্রয়োগ করেন। সেই সমস্ত ওষুধ প্রয়োগ করা সবজি বাজারে আসছে। এছাড়া হরমোন প্রয়োগ করা সবজি দেখলেই খুশি হয়ে অনেকে তার দিকেই নজর দেন। সহজেই তা চলে আসে গৃহস্থের রান্নাঘরে। সেই সবজি খেয়েই যে আমাদের পেটের সমস্যা বাড়ছে, শ্বাসকষ্ট বাড়ছে, গায়ের চামড়ার পরিবর্তন হচ্ছে, ক্যানসারের মতো রোগের প্রকোপ বাড়ছে তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। চিন্তিত কৃষি বিজ্ঞানীরা ও কৃষিবস্তু বিশেষজ্ঞরা। এঁদের একটাই প্রশ্ন ‘অবিবেচকে’র কাজ করছে বেশ কিছু চাষি। এই ধারণা পাল্টাতে হবে। এ জন্য জৈব প্রযুক্তিতে চাষ বাড়িয়ে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। তবেই আমরা টিকে থাকব সুস্থ ও সবলভাবে।