রবিবার | ১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:৪৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
বিবেকের মুখ : পার্থ রায় কল্লোলের কাল : তপন মল্লিক চৌধুরী দশমীর বিকেল, জলঙ্গী নদীতীরে মেলবন্ধনের আনন্দমুখর ছবি : অমৃতাভ দে উৎসবে ফেরাই জীবন…. : অশোক মজুমদার দ্বিশতবর্ষে পদার্পণ করলো বাঁকুড়ার অযোধ্যার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো : কমল ব্যানার্জী একটি গ্রামের বাড়ির পুজো… : বিজয় চৌধুরী আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে… : লুৎফর রহমান রিটন ময়নাপুর দেওয়ান বাড়ীর পুজো : কমল ব্যানার্জি মা দুর্গার মহাস্নান পর্ব : রিঙ্কি সামন্ত কোষ্টিয়া গ্রামের শীট বাড়ির দুর্গাপুজো : কমল ব্যানার্জী অয়দিপাউস : রিমি মুৎসুদ্দি পোড়খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনকথা : হরিশংকর জলদাস সাজসজ্জার পুজো : নন্দিনী অধিকারী আঠেরো শতকে কলকাতার ভেড়া যেত অস্ট্রেলিয়ায় : অসিত দাস জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (অষ্টম পর্ব) : বিজয়া দেব হরিয়ানায় হ্যাট্রিক করলেও উপত্যকার মানুষ বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ে গান্ধী জয়ন্তী : দীপাঞ্জন দে পটের পাড়ায় মাজরামুড়ায় : রঞ্জন সেন একটি ড্যান্স হাঙ্গামা : শৈলেন সরকার গুণের রাজা পানিফল, দুর্গা পুজোর নৈবেদ্যে অপরিহার্য : রিঙ্কি সামন্ত স্কুল পালিয়ে কী রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায়? : সাইফুর রহমান পুজোয় বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় পরিষেবার মান উন্নত করতে বিদ্যুৎ দপ্তরের তৎপরতা তুঙ্গে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় গানের ভিতর দিয়ে দেখা পুজোর ভুবনখানি : সন্দীপন বিশ্বাস নবদুর্গা নবরাত্রি : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সাদা কালোয় কুমোরটুলি : বিজয় চৌধুরী জেল খাটাদের পুজো, মাইক আসছে মাইক, ছুটছে গ্রাম : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কাশ্মীর নির্বাচনে বিপুল সাড়ার নেপথ্যে কি ৩৭০ বিলোপের জবাব : তপন মল্লিক চৌধুরী তর্পণের তাৎপর্য : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মহালয়ার চন্ডীপাঠ মন্ত্র, মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্র : বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৪
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই মহাঅষ্টমীর আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বিবেকের মুখ : পার্থ রায়

পার্থ রায় / ১৬ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৪

কাঁধে ব্যাগ ঝোলান আর পায়ে জুতো জোড়া গলানো বাকি। এবার ছবিটার সামনে দুহাত জোড় করে দাঁড়াবে মিউনিসিলিপালিটির সুপারভাইজর সুকুমার চট্টরাজ। ঠোঁট নড়বে। পিছনে ওর স্ত্রী শতরূপা স্বামীর অফিস ব্যাগ হাতে ছটফট করতে থাকবে। ট্রেন আসার সময় হয়ে যায়। নিত্য যাত্রার আগে নিত্য কর্ম। কিছু বলার জো নেই। মুখ ঝামটা খেতে হবে। সব শেষে ট্রেন ধরার তাগিদে ৫৫ ছুঁই ছুঁই সুকুমার মিলখা সিং হয়ে ছুটবে। এটা একটা খুব কমন দৃশ্য। স্বাভাবিক ভাবে এই ব্যাপারটা শতরূপা এবং বাড়ির কারুর একেবারেই পছন্দ নয়। কতো রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সুকুমারও তেমনি একরোখা। কিছুতেই একটু আগে ভাগে তৈরি হবে না।

স্বামী বেরিয়ে গেলে শতরূপা ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। “একটা নাস্তিক লোককে কী বশ করেছ। সত্যি তোমার ক্ষমতা আছে ঠাকুর”। ভক্তিভরে কপালে দুবার হাত ঠেকিয়ে কিচেনের দিকে ছোটে। গুচ্ছের কাজ বাকি। শতরূপা ভুল কিছু বলেনি। সুকুমারের মধ্যে ভক্তি টক্তি কোন কালেই ছিল না। সেই মানুষটা যখন অ্যাতো ভক্তি নিয়ে পরমহংসদেবের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, শতরূপার বেশ লাগে। তবে ওই আর কী! আর একটু আগে থেকে তৈরি হলে অফিস যাবার সময় অ্যাতো টেনশন হয় না।

আঠেরো ইঞ্চি বাই বারো ইঞ্চির ছবি। সোনালী সরু ফ্রেমে বাঁধানো। কালো ছায়ার ব্যাকগ্রাউন্ডে পাকা গম রঙা পরমহংসদেবের মুখ। গলা থেকে শরীরের বাকি অংশ দৃশ্যমান নয়। বছর খানেক আগে এক ফেসবুক বান্ধব সুকুমারকে দিয়েছিল। মেসেঞ্জারের ইনবক্সে। সুপ্রভাত জানিয়ে। ভাগ্যিস যে পাঠিয়েছিল এডিট করে ছবির ওপর সুপ্রভাত লিখে দেয়নি। কে দিয়েছিল মনে নেই। তবে লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটের মতো ছবিটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল সুকুমার। বাড়ির অন্যদেরও খুব ভাল লেগেছিল। আসলে কিছু কিছু জিনিষ আছে যা সর্বজনীন ভাল লাগা আদায় করে নিতে পারে। পাড়ার বিভূতিবাবুর মতো। যাকেই জিজ্ঞাসা করা হোক “বিভূতিবাবু কেমন মানুষ?”। উত্তর একটাই “অমন ভাল মানুষ হয় না”। ছবিটাও তেমনি। ছবির প্রতি মুগ্ধতা এখন ছবির মধ্যে থাকা মহামানবের প্রতি এক অপার ভক্তি এবং নির্ভরশীলতাতে বদলে গেছে। ছবির দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন মনের সব ময়লা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা? হিপনোটিজম? থট রিডিং পাওয়ার? না কি বিরল সারল্য যা একটা আয়নার মতো কাজ করে? যে আয়নার সামনে অন্তরের সমস্ত নগ্ন চেহারা বেআবরু হয়ে পড়ে। স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতস্বিনীর নিচে সবকিছু যেমন দৃশ্যমান, ওঁর দৃষ্টির নিচেও তেমনি মনের গহীনে থাকা সব গোপনীয়তা স্পষ্ট প্রতীয়মান।

“ও সুকুমার, ছবিটারে বাঁধাইয়া ফ্যাল। ভাল জায়গায় বাঁধাইতে দিস”। সুকুমারের মা বলেছিলেন। ছবিটা বাঁধিয়ে এনেছিল বটে সহেলী! সুকুমারের মেয়ে। মোড়ক খোলার পরে সুকুমারের দৃষ্টি স্থির। মেয়েকে জড়িয়ে কপালে চুমু খেল খুশিয়াল বাপ। নাগালের মধ্যে ছবিটা টাঙ্গানো হল। সুকুমার নিজের হাতে নরম পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে ঝকঝকে রাখে। প্রতি শনিবার ঠাকুরের গলায় টকটকে লাল জবাফুলের মালা শোভা দেয়।

এবার কী হল শুনুন। ছবিটা দেওয়ালে অধিষ্ঠিত হবার পরে সুকুমারদের পরিবারে কিছু ঘটনা ঘটল। সবটাই ভবিতব্যের নিয়মে অথবা কর্মফলে ঘটে। কিন্তু সুকুমারের বদ্ধমূল ধারণা যে ওইসব ঘটনা ঠাকুরের ছবি টাঙ্গানোর সুফল। প্রথমে ধরুন সুকুমারের মায়ের কথা। বুড়ি একদিন বাথরুমে পড়ে গেলেন। এই বয়সে পড়ে গেলে বড়সড় বিপদ, ক্ষয়ক্ষতি হবার চান্স থাকে। তেমন কিছু হল না। মচকে টচকে ছড়ে টড়ে গেল। সাত আট দিনেই বুড়ি দিব্যি চাঙ্গা। দ্বিতীয় ঘটনা সহেলীর নেট একজামের গণ্ডী পেরুনো। প্রথমবার সফল হতে পারেনি। রাতে খেতে বসে গদ্গদ হয়ে সুকুমার মেয়েকে বলল, “ঠাকুরের ছবিটা অমন সুন্দর করে বাঁধিয়ে এনেছিস। তাই ওনার আশীর্বাদ পেয়েছিস”। শুনে সহেলীর ভ্রু জোড়া রামচন্দ্রের ধনুক! “তার মানে? আমার রাতদিন পড়াশুনার কোন দাম নেই? সব ক্রেডিট তোমার ঠাকুরসাহেবের?”। শতরূপা খুশির আবহ নষ্ট হতে দিতে নারাজ। তাই দেরী না করে মেয়েকে চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ছেলে গোগোল জয়েন্টে বেশ ভাল র‍্যাঙ্ক করে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েছে। পড়াশুনায় গোগোল বরাবরই ভাল। সেটা সবাই জানে। সাদামাটা সরকারী চাকুরে সুকুমার জয়েন্টে ছেলের র‍্যাঙ্ক নিয়ে টেনশনে ছিল। সরকারী কলেজে না হলে লাখ লাখ টাকা খসিয়ে প্রাইভেট কলেজে পড়ানো কি চাট্টিখানি ব্যাপার? তাই এইক্ষেত্রেও অম্লান বদনে সুকুমারের উপসংহার “সব পরমহংসদেবের কৃপা”।

যত দিন যাচ্ছে ঠাকুরের ওপর ওর নির্ভরশীলতা বেড়ে চলেছে। সুকুমার এখন আগের থেকে অনেক বেশী প্রত্যয়ী। কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতা? সুকুমার ঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠাকুরও ওকে দেখে। দুজন দুজনকে দেখতে থাকে। মানসিক সেতুবন্ধন তৈরি হয়। অবশেষে সুকুমার দিশা দেখতে পায়। আসলে ঠাকুরের প্রভাবে প্রভাবিত আলোকিত এক সত্তা অন্তর থেকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়। ছবিটা এমন ভাবে রয়েছে যে বাড়ি ঢুকলেই ছবিটার মুখোমুখি। সুকুমারের মুখে আকর্ণ বিস্তৃত দাঁত কেলানে আর ঠাকুরের মুখে ভুবন ভোলানো হাসি। উল্টোটাও হয়েছে। ওর তরফে কোন ভুল ভ্রান্তি অন্যায় হলে অমনি সহেলীর ‘ঠাকুর সাহেবের’ মুখ গম্ভীর। মানে সুকুমারের এমনটাই ধারণা। সেদিন যেমন। শতরূপা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। পূজার জামা কাপড় দিতে। মা পাড়ার মন্দিরে কীর্তন শুনতে যাবে। শতরূপারা ফেরার সময় মাকে মন্দির থেকে ডেকে নিয়ে একসাথে বাড়ি ঢুকবে। সুকুমারের সামনে গোল্ডেন চান্স! পুজোর লম্বা সরকারি ছুটির আগে শেষ দিন। বন্ধুদের সাথে ‘জলের’ প্রোগ্রাম। সুকুমার অবিশ্যি অবরে সবরে খায়। ঘরে ঢুকে ওর মনে হল ছবিতে ঠাকুরের ভ্রু কুঁচকে আছে। তরলের তারল্যে টেটিয়া সুকুমার বলল, “কী হল, গুরু? খেপচুরিয়াস?

সুকুমার যেন শুনতে পেল “শালা, সুরা পান করেছিস। দেখিস এরপরে সুরা তোকে গ্রাস করবে”।

“যতো সব আং সাং কথা। আমি কি রেগুলার খাই? পুজোর আনন্দে এইটুকুনি”, দুই আঙ্গুল যতোটা কাছে আনা যায় সেইটুকু এনে দেখাল সুকুমার।

“যা ইচ্ছে কর। আমার কাছে আসিস না”

“উফ! চাপ নিও না, বস! লিমিটেড ইনকাম। সুরা হামকো নেহি গ্রাস করেগা। টেনশন নেহি লেনেকা”।

হুইস্কিটা হেব্বি ছিল। মৌতাত একটু দেরী করে আসে। বাড়ি ফেরার পরে বেশ লাগছে। রিমঝিম! রিমঝিম! বাড়ির লোকেরা এখনও ফেরেনি। স্নান করে নিলে ঠিক হয়ে যাবে। টেরছা চোখে আর একবার তাকায় ঠাকুরের ছবির দিকে। একটু রাগ হয়। রাজেশ খান্নার মতো একটু ঝুঁকে ডান হাত প্রসারিত করে বলে, “বুঝি না বাপু তোমার ব্যাপার স্যাপার। তোমার কালী মাতা তো আর যে সে মা নন। জগত জননী মা। সেই মায়ের পূজায় কারন লাগে। রাইট? আর এই গরীব দু চার পেগ সেবা করলে তোমার মুখ বাংলার পাঁচ। অক্কে! না খাবার চেষ্টা করব। প্রমিস। এবার ওই ইস্পিশাল স্মাইলটা দাও দেখি। দেখে বাথরুমে যাই”।

সুকুমারের অন্তর্দৃষ্টি দেখতে পায় ঠাকুরের মুখে সেই অপাপবিদ্ধ, ক্ষমাসুন্দর হাসি।

“ধুস শালা! পাগল! অ্যাক্টো করছে”

***

প্রকৃতিতে শরতের ছোঁয়া। কিছুটা গরমের আঁচ থাকলেও তেজ অনেকটাই স্তিমিত। নীল আকাশ যেন একান্নবর্তী পরিবারের কর্তামশাই। টুকরো টুকরো সাদা মেঘেরা বাড়ির কাচ্চা বাচ্চা। আকাশের কোলে কাঁখে আনন্দে হুটোপুটি করছে। কল্লোলিনী কলকাতা সাজের প্রস্তুতিতে মশগুল। বেশ লাগে সুকুমারের। ছেলেবেলার দিনগুলো মনে পড়ে। খুব কম মাহিনা ছিল পোস্টমাস্টার বাবার। নুতন জামার থেকেও বেশী লোভনীয় ছিল ফটাস ফটাস করে ফাটা খেলনা বন্দুক আর গুলি। একটা নুতন তাঁত নাহলে ছাপার শাড়ি পরে ওদের মা অষ্টমীর অঞ্জলী দিতেন। মা রীতিমত মান অভিমান করে ওদের বাবাকে ওঁর নিজের জন্য ধুতি আর শার্ট কিনতে বাধ্য করতেন। সাদা শার্ট। হাতা গুটিয়ে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেমন পরতেন। এতেই সবার মনে শরতের আকাশের মতো ঝলমলে আনন্দ ছিল। বাবা শুধু অষ্টমী আর দশমীতে ছুটি পেতেন। আর এখন? এবছর একটানা দশ দিন ছুটি। ছোট্ট শহরে হাতে গোনা চারটে পুজো হত। সুকুমাররা পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের কোয়ার্টারে থাকত। কাছেই একটা হিন্দি প্রাইমারি স্কুল ছিল। সেখানে দুর্গা প্রতিমা বানানো হত। মহালয়ার দিন থেকে পুজো পুজো ভাব। রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ যেন রেফারির হুইসেল। তিনদিনব্যাপী চলা শারদীয়া ম্যাচের সূচনা করতেন উনি। প্রতিমা নিরঞ্জনে সেই ম্যাচের সমাপ্তি। বাবা টেবিল ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন। কর্কশ সেই ঘুম ভাঙ্গানিয়া শব্দ সেদিন মধুর শোনাত। কনিষ্ঠতম শ্রীকুমার বয়সে ওদের দুই ভাইয়ের থেকে বেশ কিছুটা ছোট। ও মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকত। ওদের আবদারে বাবাও সেদিন ওদের সাথে শুতেন। একটা বড় খাটে পাঁচ জন। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। এক চিলতে ফাঁকা জায়গা ছিল না। সমস্ত শূন্যস্থান ভরে থাকত স্নেহ মায়া মমতার মেদুর বাতাসে। আগের দিন বিকেলে কথা হয়ে থাকত। মহালয়া শুনে ওরা দুভাই আর বাবার কলিগদের ছেলেমেয়েরা ছুটত হিন্দি স্কুলে। মুগ্ধ হয়ে দেখত মায়ের চোখ আঁকা। মায়ের কাছে জেনেছে একে চক্ষুদান বলে। সবার শেষে আর এক মজাদার পর্ব। বাবা পাঁড়েজির দোকান থেকে ঠোঙা ভরতি করে গরম জিলিপি আর সিঙ্গারা নিয়ে অপেক্ষা করতেন। সবাই মিলে একসাথে মজা করে খাওয়া হত। সবুজ দুব্বো ঘাসের মতো দিন ছিল সেসব। নরম। পেলব। হাজিরা খাতায় সই করে নিজের চেয়ারে বসে একটু জল খেয়ে সেলফোনটা টেবিলে রাখল। ফাইলে হাত দেবার আগে যুত করে একটা সিগারেট খাবে বলে যেই ব্যাগের চেইনে হাত দিয়েছে পাশের টেবিল থেকে অমল উঠে এল। অমল যেন তক্কে তক্কে থাকে কাকে মুরগী করবে। ও কিছু বলার আগেই সুকুমার একটা সিগারেট ওর দিকে বাড়িয়ে দেয়। ভ্রু কুঁচকে সিগারেটের দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন ওটা খুশি মনে নেয়নি।

“শুধু একটা সিগারেটে এরকম সুখবর দেওয়া কি উচিত? শ্যাম্পেনের বোতল ওপেন করে চিয়ার্স করতে হয় দাদা”।

সচকিত হয় সুকুমার। ওর জন্য সুখবর? একটা খবর ওর কানেও এসেছে। প্ল্যান স্যাংশন দপ্তরের ইনচার্জ বিশ্বতোষবাবু সামনের মাসে রিটায়ার করছেন। ওঁর জায়গায় নাকি সুকুমারের কথা ভাবা হচ্ছে। কাজে দক্ষ বলে অফিসের সব স্তরে ওর সুনাম আছে। কলিগদের মধ্যেও পপুলার। সময়ে অসময়ে যাঁতাকলে পড়লে এই সুকুমার চট্টরাজ ওদের ভরসা।

“কী খবর?”

ঠোঁট ছুঁচলো করে রিং বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে এমন ভাবে সুকুমারের দিকে তাকাল যেন ওর হাতেই সব ক্ষমতা। সুকুমার জানে অমল এখন কিছুক্ষণ ভাঁজ দেবে। ততক্ষণ ধৈর্য না ধরে উপায় নেই। অমলের খবর মানে পাকা খবর। পুরসভার অলিন্দে এমন কোন খবর নেই যা ওর ওয়্যারলেস অ্যান্টেনার ব্যাসার্ধ এড়িয়ে গেছে। শালা পাক্কা খবরি! দপ্তরের প্যাম্পার্ড চাইল্ড। ছেড়ে রাখা হয়। ঘুরে ফিরে বেড়া। কাজ কাম করতে হবে না। শুধু খবরটা ভাল আর পাকা হওয়া চাই।

“সামনের মাসে তো তোমার ঘর, চেয়ার বদল হচ্ছে। খনিতে পোস্টিং হচ্ছে”

“মানে?”

“এইতো! নাটক করছ। তোমার হার্ড ডিস্কে ঢোকেনি এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছ?”

অমল ভুল কিছু বলেনি। না বোঝার কিছু নেই। সুকুমার তো অন্য সূত্রে আগেই আভাষ পেয়েছিল। কিন্তু অমলের থেকে পাকা খবরটা বের করতে হলে একটু “ন্যাকা ষষ্ঠী” সাজতে হবে। যতটা সম্ভব “কিসসু বুঝিনি” মার্কা মুখ করে বলল, “বিলিভ মি আমি তোর কথা বুঝতে পারছি না। গিঁট খুলে বল। হ্যাঙ্গিং রাখিস না”

অমল একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। সুকুমার জানে ওকে মাপছে। মাপুক। আধপোড়া সিগারেটের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করে, “এর পরে এসব ফ্লেক টেক আর চলবে না। ফাইভ ফিফটি ফাইভ। ম্যাক্স টু উইকস! অর্ডার বের হল বলে। প্ল্যান অ্যাপ্রুভাল সেকশনের কর্তামশাই। আলাদা চেম্বার। দরজার বাইরে নেমপ্লেট। শ্রীযুক্ত বাবু সুকুমার চট্টরাজ, অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। মোটা পরদা। এসি! কুল! কুল!”। অমলের বলার ভঙ্গিতে সুকুমার হেসে ফেলে। আরও নিশ্চিন্ত হতে হবে। “গ্রেডেশন লিস্ট অনুসারে তো ওই দপ্তরের অশোকবাবু সিনিয়র। ওনাকে টপকে আমাকে দেবেন কেন?”

“এমন একজনের নাম বললে! রোগে ভোগা মানুষ। “ম্যাঙ্গোহোপের” হোল সেলার! আদ্ধেক দিন অফিসে আসেন না। সান্যাল সাহেব ছুটিতে যাবার আগে ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উনি পত্রপাঠ জানিয়ে দিয়েছেন উনি এই দায়িত্ব নিতে অক্ষম। সান্যাল সাহেব জয়েন করেই তোমাকে ডাকবেন। উইলিংনেস জানতে”। সান্যাল সাহেব হলেন সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার।

***

পাঁচটা বাজলে অফিস ফাঁকা হতে শুরু করে। সাড়ে পাঁচটা বাজে। কিছু লং পেন্ডিং ফাইল ছাড়তে হবে। কেসগুলো কিছুটা জটিল। অফিস আওয়ার্সের মেছো হাটে মস্তিষ্ক কাজ করে না। দু চারটে ফাইল আবার অন্যদের। ওকে দিয়ে কার্যোদ্ধার করে কেউ কেউ রীতিমতো দুপয়সা উপরি কামাচ্ছে। ও কি জানে না? সব জানে। পিয়ন রতনকে চা আনতে বলে একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে গা ছেড়ে দেয় সুকুমার। চাকরি জীবনের শেষ বেলায় যখন সুযোগ আসছে সেটা সাদরে গ্রহণ করলে ক্ষতি কি? এমন নয় যে ভয় করছে না। ভিজিল্যান্স, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ওপরওয়ালাদের রক্তচক্ষু নিয়ে এই দায়িত্ব সামলানো খুব সহজ নয়। মনের ভেতর থেকে আর এক সুকুমার চট্টরাজ বলে, “দ্যাখ, কিছু পেতে গেলে একটু রিস্ক নিতেই হয়। তুই কাজ জানিস। কিসের ভয়?” সুকুমারের অনেকদিনের সাধ রিটায়ারমেন্টের পরে এই শহর থেকে দূরে কোথাও বাকী জীবনটা কাটাবে। গাছ গাছালির ছায়ায়। পাখির কুজনে। দূষণমুক্ত নিস্তব্ধ পরিবেশে। উত্তরবঙ্গ, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম নাহলে বোলপুর- যখন যেখানে বেড়াতে গেছে মনের গভীরে এই ইচ্ছেটা তত শেকড় গেড়েছে। যানজট, জনসংখ্যা আর দূষণের চাপে শহরটা যেন বুড়িয়ে গেছে। ঘুম ভাঙ্গে বাড়ির কাছের বাস ডিপোর চেঁচামেচি, খিস্তি খেউর শুনে। গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া বাইক, অটোর কর্ণবিদারী এয়ার হর্ন। ডিসগাস্টিং!

শতরূপা বাস্তববাদী। স্বামীর আবেগি ভাবনায় রাশ টেনে বলে, “বয়স বাড়লে রোগ ব্যাধি বাড়ে। ওসব জায়গায় কলকাতার মতো চিকিৎসার সুবিধা মিলবে? পার্মানেন্টলি ওসব জায়গায় থাকা খুব যুক্তিসঙ্গত নয়”। সুকুমার অস্বীকার করতে পারে না। ওর ইচ্ছে পথ পালটায়। আজকাল অনেকেই শান্তিনিকেতনের কাছে প্রান্তিকে ফ্ল্যাট নাহলে বাড়ি কিনে রাখে। শান্ত প্রকৃতির কোলে কিছুদিন থেকে প্রাণে বাতাস লাগিয়ে ফিরে আসে কল্লোলিনীর ভিড়াক্রান্ত কোলে। বেশ দুদিক রক্ষা হয়। কাগজের প্লেন ভাসানোর মতো ইচ্ছেটাকে ভাসিয়েছিল বন্ধু মহলে। খোঁজও এসেছিল কিছু। শেষ পর্যন্ত সুকুমার পিছিয়ে গেছে। সাধ আর সাধ্যের সখ্য হয়নি। সঞ্চয় ভাঙিয়ে এত টাকা খরচ করা! আজ নাহয় কাল মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। ছেলের ফিজ কম কিন্তু দামি দামি বইয়ের জোগান তো দিতে হয়। তার মধ্যে গেট একজামের প্রস্তুতির জন্য প্রাইভেট টিউটরকে মোটা অঙ্কের ফিজ অ্যাডভান্স দিতে হয়েছে। অসুখ বিসুখ, বিপদ আপদ তো আছেই। মাকে নিয়ে অবশ্য চিন্তা নেই। বাবার সেভিংস আর ফ্যামিলি পেনসনের দৌলতে মা অর্থনৈতিক ভাবে আত্মনির্ভরশীল। সেবা যত্নেরও ঘাটতি নেই।

“সুকুমারদা, শুভ বিজয়া। একটু দেরি হয়ে গেল। অলসো হার্টিয়েস্ট কনগ্র্যাচুলেশন!”। ভাবনার অতলে ডুবে থাকা সুকুমারের চটকা ভাঙে। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে শিতেন্দু কর। যাদবপুর গড়িয়া অঞ্চলে প্রমোটারি করে। মেট্রো হবার পর থেকে ওই অঞ্চলটা এখন প্রমোটারদের কাছে সোনার খনি। বয়স বেশী না। এরই মধ্যে প্রচুর পয়সা করে ফেলেছে। ব্যবসার আঁটঘাট যেমন ভাল বোঝে, এই অফিসের নাড়ি নক্ষত্র হাতের তালুর মতো চেনে। শাসক দল ছাড়াও সব রাজনৈতিক দলকে হাতে রেখে দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছে। ওর একটা কেস সুকুমার উদ্ধার করে দিয়েছিল। সুলেখার দিকে একটা জি প্লাস ফোর প্রমোটিং করতে গিয়ে বাছাধন খুব ফেঁসে গিয়েছিল। ডিসপিউট ল্যান্ড। পাশের এক বিধবা ভদ্রমহিলার কিছুটা জমি অকুপায়েড। ওপর মহলে ভদ্রমহিলার কানেকশন ভাল। কমপ্লেন ঠুকে দিতে প্ল্যান গেল আটকে। স্থানীয় নেতাদের ধরেছিল শিতেন্দু। আরও ঘেঁটে ঘণ্ট হয়ে গেল। কেউ যখন কিছু করতে পারছে না, সুকুমারের ডাক পড়েছিল। সুকুমার নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছে। শিতেন্দুর প্ল্যানারকে দিয়ে কন্সট্রাকশন ডিজাইনে খানিকটা অদল বদল করিয়ে এমন ব্যবস্থা করল যে সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। ও ক্রেডিট পেল না। যারা ফাইলটা ডিল করছিল, শিতেন্দুর থেকে বেশ ভাল দাঁও মেরে নিয়েছে। তবে শিতেন্দু বুদ্ধিমান। ওকে একটা দামি আই ফোন গিফট করেছিল। ওটা সহেলী ইউজ করছে।

“শুভ বিজয়া। বসুন। কনগ্র্যাচুলেশন কেন?”

“ভাল খবর চাপা থাকে না, দাদা। আপনার প্রমোশন তো শুধু সময়ের অপেক্ষা”। ব্যবসার স্বার্থে শিতেন্দুর মতো লোকেদের হাঁড়ির খবর রাখতে হয়।

“বসব না সুকুমারদা। এই সময় অফিস ফাঁকা থাকবে জেনেই এসেছি। এটা প্লিজ রাখুন”। একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় শিতেন্দু।

“এখন মিষ্টি কেন? অর্ডার বের হোক। তখন না হয় …”

“আরে না না। ভাই কি দাদার জন্য বিজয়ার মিষ্টি আনতে পারে না?”

অন্তরের অন্তঃস্থলে আর এক সুকুমার খুক খুক করে হেসে ওঠে। “বস! এতো সবে শুরু। কতো শত ভাই ব্রাদার সুকুমার চট্টরাজের ফেভার পাওয়ার জন্য ভেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। পরিযায়ী পাখির মতো আসবে। দলে দলে। ঠোঁটে স্বপ্নপূরণের খড়কুটো নিয়ে।

“দাদা, একটা বড় কাজে হাত দিতে চলেছি। কসবার দিকে। জি প্লাস নাইন। মাথায় আপনার হাত চাই। ব্যাস! আর কিছু না। প্ল্যান প্রায় তৈরি। আশা করছি দিন দশেকের মধ্যে জমা দিতে পারব”

“সব ঠিক আছে। আগে ওই জায়গায় যাই”

“ওটা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। যেটা বলছিলাম দাদা। একটু আধটু ডিভিয়েশন থাকতে পারে। স্বীকার করে নেওয়া ভাল। কারণ আপনার চোখকে ফাঁকি দেওয়া শিবেরও অসাধ্য। এই প্রথম বড় কাজে হাত দিতে চলেছি। একটু দেখবেন। আপনার এই ভাই যোগ্য লোকের যোগ্য মর্যাদা দিতে জানে”। ***

কিচেন থেকে শতরূপার চিৎকার শুনল মনে হল যেন। টিভির ভলিউম কমিয়ে দিল উৎকর্ণ সুকুমার। এই তো শিতেন্দুর প্যাকেটটা হাতে নিয়ে কিচেনে গেল চা বানাতে। নিশ্চয় হাতে ছ্যাকা খেয়েছে নাহলে আঙুল কেটেছে।

“শুনছ! শিগগিরি এস। দেখে যাও”

পড়িমরি করে কিচেনের দিকে ছুটল। শতরূপার হাতে সেই মিষ্টির বাক্স। বিস্ফারিত চোখ। মুখ ফ্যাকাশে। মিষ্টির প্যাকেটে মিষ্টির বদলে পাঁচশ টাকার নোটের একটা বেশ মোটাসোটা বান্ডিল। দেখে সুকুমারের চোখ ছানাবড়া। বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। এই তাহলে যোগ্য লোকের জন্য যোগ্য মর্যাদা! কী ভয়ংকর! অবশ্য ব্যাগের মধ্যে আর একটা প্যাকেট মিষ্টি ভর্তি। কলকাতার এক নামী মিষ্টির দোকানের মিষ্টি। আশ্চর্য ব্যাপার! শিতেন্দু এতটুকু হিন্টস দেয়নি। সুকুমার তাড়াতাড়ি বাক্সের মুখ ঢাকা দিয়ে নিচু স্বরে বলে, “আমি জানতাম না। বিজয়ার মিষ্টি বলে দিয়েছে। এখন আলমারিতে ভরে রেখে দাও। পরে দেখছি। কাউকে কিছু বলবে না”। ভাগ্যিস বাড়িতে অন্যরা কেউ নেই। টাকার বান্ডিলের ওপর গার্টার দিয়ে একটা চিরকুট আটকানো। “দাদা, পঞ্চাশ হাজার আছে। এটা অগ্রিম। এই ভাইকে একটু দেখবেন। ডোন্ট ওরি”। কোন নাম লেখা নেই। শতরূপার এখনও ঘোর কাটেনি। শতরূপা জানে পদোন্নতি হলে মাহিনার অতিরিক্ত অর্থাগমের সম্ভাবনা আছে। তাই বলে এই অঙ্কের? এ যেন জমি বাড়ি বিক্রির মতো। অগ্রিম বায়না দিয়ে বেঁধে রাখা।

সুকুমারের চোখে মুখে প্রাথমিক চমকের চিহ্নগুলো মুছে গেছে। চায়ের কাপে প্রতিটি চুমুকে তৃপ্তির ছোঁয়া। দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ পুঁজের মতো জমে জমে বুকের ভেতরে একটা মুখবিহীন ফোঁড়া হয়েছিল। এখন ফোঁড়া ফেটে যাবার স্বস্তি। এটাও ঠাকুরের অসীম কৃপার ফল। এই যাহ! একেবারে ভুলে গিয়েছিল। ছবির দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকায়। এ কি! থমকে যায়। ওর দৃষ্টিতে ঠাকুরের ভুবনজয়ী হাস্যমুখ ধরা পড়ে না। উল্টে মনে হয় সেখানে একরাশ বিরক্তি। অসম্মতির ভ্রুকুটি। দুটো বিপ্রতীপ সত্তা সংঘাতের জন্য মুখোমুখি। এই সংঘাত তাৎক্ষণিক এবং ক্ষণস্থায়ী নয়। বাস্তবিক ভাবে প্রলম্বিত হল। সুকুমারের ভেতরে এক টানাপড়েন শুরু হল। এক সত্তা ঠাকুরের প্রতিনিধি। ক্রমাগত বলছে, “ওরে, এই টাকায় তোর অধিকার নেই। এ পথ ভুল পথ। লোভের আগুনে একদিন সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে। পরিশ্রম করে যা পাচ্ছিস তাতে সন্তুষ্ট থাক। কীসের অভাব তোর? ফিরিয়ে দে ওই সর্বনাশা ধন।”

অন্য সত্তা প্রবল বাধা দিয়ে ওঠে। “হাহ! যতো ফালতু বকোয়াস! বেকার সেন্টি হচ্ছিস! তোকে দিয়ে কার্যোদ্ধার করে তোর কিছু কলিগ দিব্যি টু পাইস কামিয়ে নিচ্ছে। তুই গান্ডু বুড়ো আঙুল চুষছিস। যে কাজ জানে সে ফন্দি ফিকিরও জানে। বুকে বল আন। কিসসু হবে না”। এ যেন এক সাংঘাতিক টাগ অফ ওয়ার। সুকুমার একটা দড়ি। একবার একপক্ষ হেঁইয়ো বলে হ্যাঁচকা টান মারছে তো আর একবার অন্য পক্ষ।

***

আজ রাস্তার আলোগুলো জ্বলেনি কেন? বাড়ি ঘরদোরই বা কোথায়? এত দিনের চেনা পথ কেমন অচেনা ঠেকছে। এই সময় এত সুনসান! ঠাহর করে নিতে হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সুকুমার। কিন্তু কেউ যেন ঠেলছে ওকে। ক্রমাগত। পেছন থেকে। বাধ্য হয়ে চলতে থাকে। দুটো হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে। শিশুর মতো টলমল পায়ে। একটা সাপোর্ট পেলে ভাল হত।

“আমি কি এই পথে বাড়ি ফিরি? এত অন্ধকার কেন? লোড শেডিং? শতরূপা ফোন করে কিছু বলল না তো। এমন হলে মেয়েটাও তো ফোন করে। অদ্ভুত!”। সুকুমার ধন্দে পড়ে। সুকুমারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হাঁটার গতি বাড়ে। এই সরকার রাস্তাগুলো ভাল করেছে। ফলে খানাখন্দরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে না। কেউ ঠেললে তো পিঠে তার স্পর্শ অনুভব করত। মনে হচ্ছে যেন একটা ঝোড়ো হাওয়া নিঃশব্দে ওকে সামনের দিকে ঠেলছে। রাস্তাটা বেশ। রাজগির, দেওঘরের মতো। বেশ লাগছে। পার্কের স্লিপে বাচ্চারা যেমন ঢালের মুখে বসে শরীর ছেড়ে দেয়। তখনও তো ওদের কেউ ঠেলে না। ওকেও কেউ ঠেলছে না অথচ ও এগিয়ে চলেছে মসৃণ ভাবে। ঢাল বেয়ে নেম যাচ্ছে। এরই মাঝে এক ফালি আলোর আভাস দেখতে পেল কি? ভুল দেখল? নাহ! আলোটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। গাড়ির ফ্রন্ট লাইট? সুকুমার উচ্ছসিত হয়। যাক বাবা এই ঘুটঘুটে অন্ধকার কাটবে। এদিকে গতি যে ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। আলোটা যত এগিয়ে আসছে তত তীব্র হচ্ছে তার তেজ। চোখ ধাঁধানো। হঠাৎ সুকুমার দেখে সেই আলো গার্ড করে একটা অবয়ব এগিয়ে আসছে। আরও, আরও কাছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবু ভরসা জাগে। সুকুমার আপ্রাণ চেষ্টা করে মুখ দেখার। আচমকা দেখে ঢালটা খাড়াই নেমে গেছে। ফলে গতি তীব্রতর হয়েছে। ধুর বাবা! ধরার মতো কিছু নেই। এবার কেন জানি ভয় ভয় করছে। দমবন্ধ করা গরম। সেই অবয়ব এখন অনেক কাছে। যত কাছে, তত বড়। তত আলো। আলোর ঝলকানি সইয়ে নিয়ে প্রাণপণে তাকায় সুকুমার। ওই মুখের দিকে। ঠাকুর! পরমহংসদেব! লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়ার আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। শিশুসুলভ উচ্ছাসে এগিয়ে যায় সুকুমার। একি! ঠাকুর যে সরে দাঁড়ালেন। অভিমানী মুখ। দুচোখে বিষাদ। ঠাকুর সরে দাঁড়াতে সুকুমার প্রবল ভয়ে দেখতে পেল রাস্তাটা শেষ। নীচে অতলস্পর্শী, দিগন্তবিস্তৃত খাদ। তলিয়ে যেতে যেতে সীমাহীন আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠতে চায় “ঠাকুর বাঁচাও। আমাকে ধরো”। কিন্তু গলা দিয়ে যে স্বর বের হচ্ছে না। আবছা গলায় কেউ যেন ডাকে। শরীরে কোমল স্পর্শ।

“এইইই! স্বপ্ন দেখছ। ইস! ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছ। কতো বলি ইন্সটলমেন্টে একটা এসি কেনো”

ঘুম ভেঙে যায় সুকুমারের। বুকের ওপর শতরূপার হাত। “কী স্বপ্ন দেখছিলে? খুব ভয় পেয়েছ মনে হল”

উত্তর না দিয়ে ঘোর লাগা চোখে শুয়ে থাকে। শতরূপা বুকের কাছে ঘন হয়ে আসে। গালে আলগোছে চুমু দিয়ে বলে, “ঘুমাও। কাল শুনব কী স্বপ্ন দেখলে”।

***

কোথাও সুর কাটছে। স্বামীর আচরণে কিছু পরিবর্তন শতরূপার নজর এড়ায় না। অফিস যাবার আগে ঠাকুরকে প্রণাম করছে না। এমনকি ছবির সামনে পর্যন্ত দাঁড়াচ্ছে না সুকুমার। শতরূপার খুব খারাপ লাগে। জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারেনি। দায়সারা উত্তর পেয়েছে “যেতে যেতে মনে মনে প্রণাম করি। অফিসে হাজিরা নিয়ে খুব কড়াকড়ি”। এই প্রথম স্বামীর কথা অবিশ্বাস্য লাগে। হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ি নুতন কিছু নয়। যে মানুষটার মধ্যে ঠাকুরের প্রতি এমন পাগলপারা ভক্তি দেখেছিল, সেই মানুষের মধ্যে কেন এমন বিরূপ মনোভাব? বিশ্বাস না করলেও এই নিয়ে কথা বাড়ায়নি শতরূপা। ওর স্বভাবে নেই। সেদিন ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নের অবশ্য মাথামুণ্ডু থাকে না। সুকুমারই তো কতবার রসিয়ে রসিয়ে নানারকম স্বপ্নের কথা বলে। ভেবেছিল এবারও সুকুমার নিজে থেকে বলবে। কিছু বলেনি বরং সকাল থেকেই কেমন যেন আনমনা। শতরূপা নিশ্চিত কদিন ধরে ওর স্বামীর মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছে, তার সাথে ওই স্বপ্নের যোগসূত্র আছে। অযাচিত ভাবে এতগুলো টাকা পেয়ে চোখেমুখে যে খুশির ছটা ছিল সেটা আর নেই। অথচ ওই পদে বসবার একটা বাসনা তো ছিল। তাহলে কী হল? শতরূপারই বরং সায় ছিল না। এখনও নেই। সুখের থেকে শান্তি ভাল। আরও দু চারটে পার্টি নাকি অগ্রিম দিতে চেয়েছিল। সুকুমার ওদের ক্ষান্ত করেছে। শুনে শতরূপা স্বস্তি পেয়েছে। তবুও কেন জানি ওর বুকের মধ্যে শঙ্কার মেঘ গুড়গুড় করে।

মায়া হয় আবার অভিমানও হয়। সুকুমার কেন ওর সাথে শেয়ার করবে না? অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করে শতরূপা। এদিকে মেয়ের চোখেও বাবার পরিবর্তন ধরা পড়েছে। “মাম্মাম, বাবাইয়ের মধ্যে একটা চেঞ্জ নোটিশ করেছ? বস আজকাল তাঁর ঠাকুরসাহেবকে পাবলিকলি ভক্তি ডিসপ্লে করছে না”। মেয়েটা মহা ফচকে! অবশ্য বাপের মুড বুঝে ফচকেমি করে।

“হু। লক্ষ্য করেছি। অফিসে হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ি। তাই মনে মনে ভক্তি প্রদর্শন!”

“নো মাতাশ্রী। ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। পাত্তা লাগাও”

শতরূপা চুপ করে থাকে। বাড়ির কেউ ওই টাকার কথা জানে না। ওরা স্বামী স্ত্রী খুব সচেতন ভাবে এসব ব্যাপার গোপন রাখে। আরও দিন দুই অপেক্ষা করার পরে শতরূপা আলগোছে জিজ্ঞাসা করে, “কদিন ধরে দেখছি আনমনা হয়ে আছ। প্রমোশনের অর্ডারটা বেরিয়েছে?”

“নাহ। সান্যাল সাহেব ছুটি এক্সটেন্ড করেছেন। উনি জয়েন না করলে কিছু হবে না”

“প্রমোশন হলে কি ওই পোস্টেই জয়েন করতে হবে? অন্য কোন ব্র্যাঞ্চ অফিস বা অন্য কোন পোস্টে জয়েন করা যায় না? তেমন বুঝলে রিফিউজ করে দাও”

সুকুমার অবাক হয়। শতরূপার মুখে সেই সত্তার প্রতিধ্বনি যে সত্তা ওকে কোন প্রলোভনে সাড়া দিতে অনবরত বাধা দিচ্ছে। তাহলে কি ও ভুল করছে? বড় অস্থির লাগে সুকুমারের। নিরুত্তর থাকে।

আর একটু উস্কে দিয়ে শতরূপা বলে, “আজকাল কেমন জানি আচরণ করছ। শনিবার জবার মালা আনলে না। প্রণামটা পর্যন্ত করছ না। ঠাকুর কী দোষ করলেন? এটা ঠিক নয়” এবার ফুঁসে ওঠে সুকুমার। “ভুল তো করেছি ওই ছবিটা টাঙ্গিয়ে। ভক্তি দেখিয়ে মাশুল গুনছি। আগে তো এত দোটানায় ভুগতাম না। অন্যরা দিব্যি আমাকে দিয়ে কার্যোদ্ধার করে টু পাইস কামিয়ে নিচ্ছে। গুছিয়ে ফেলছে সব। আমার যখন সুযোগ এল ….”। সুকুমার থেমে যায়। শতরূপার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ব্যথায় নীল হয়ে যায়।

“ছিঃ! এমন কথা আর কখনও মুখে এনো না। অমঙ্গল হবে। ঠাকুর তো কোন অভাব রাখেননি। ছেলে মেয়ে দুটো ভাল পড়াশুনা করছে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতো এতটুকু বাড়তি চাহিদা নেই। বুলির শুনলাম এবার পিএইচডি তে চান্স হয়ে যাবে। ওদের কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের দুটো পোস্ট খালি হবে। প্রিন্সিপাল ম্যাম বলেছেন ওর জন্য চেষ্টা করবেন। আমি কি কোনদিন তোমার কাছে কাছে কিছু আবদার করেছি? করিনি কারণ আমাদের যা আছে তাতেই আমি সুখী”

ঘাড় গোঁজ করে বসে থাকা সুকুমারকে বিধ্বস্ত দেখায়। অনুতপ্ত মুখ। স্বগতোক্তির মতো বলে, “তোমার ঠাকুর এখন স্বপ্নেও থ্রেট করে”

পরিবেশ হালকা করার জন্য শতরূপা হেসে বলে, “তাই বুঝি? ঠাকুর এখন আমার হল? জানি না স্বপ্নে কী দেখেছ। এটুকু জেনে রেখো উনি থ্রেট করেননি। তোমাকে সতর্ক করেছেন”

“সেই তো আমার বেলা যতো ন্যায়নীতি। এমন স্বপ্ন তো অন্যদের দেখাচ্ছেন না”

“তুমি যে ওঁর প্রতি আস্থা রেখেছ। অন্যরা রাখেনি”

***

আজ ছট পূজার ছুটি। ছুটির দিনে সুকুমার লেট রাইজার। স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে শতরূপা ঠেলে তুলে দিয়েছে। “শিগগিরি ওঠো। দ্যাখো কাগজে কী খবর বেরিয়েছে। টিভিতেও দেখাচ্ছে”

ঘুমভাঙা চোখে সুকুমার টিভির পর্দায় চোখ রেখে ভ্যাবলা মেরে যায়। পুলিশ আর ভিজিল্যান্সের অফিসাররা মিলে এক পুরসভার শিবশঙ্কর নস্করের বাড়ি তছনছ করছে। কোটি টাকার ক্যাশ, প্রচুর গয়নাগাটি, বেনামে কেনা জমি বাড়ির কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করেছে। বিভিন্ন দেয়ালে বিশেষ ভাবে তৈরি চোরাকুঠুরিতে লুকানো ছিল। শিবশঙ্করবাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সুকুমার একসময়  শিবশঙ্করদার সাথে কাজ করেছে। দক্ষ অফিসার হিসেবে সুনাম ছিল।

লাফ দিয়ে ওঠে সুকুমার। অনেক হয়েছে টানাপড়েন। শিতেন্দুকে ফোনে রাসবিহারী ক্রসিঙে কালীঘাট মেট্রোর সামনে আসতে বলল। নিতে চায়নি। তবু জোর করে টাকাগুলো ফেরত দিয়ে সুকুমার বলেছে, “আমি ওই পোস্টে যাচ্ছি না। অন্য জায়গায় ট্র্যান্সফার না করলে অথবা অন্য পোস্টে না দিলে প্রমোশন ফরগো করব”। সুকুমার স্কুটি স্টার্ট দেয়। বিহ্বল শিতেন্দু সুকুমারের চলে যাওয়া দেখে।

নিজেকে ভারমুক্ত লাগছে। লেক মার্কেট থেকে টকটকে লাল জবার একটা মালা কিনতে হবে। এমন কোন নিয়ম নেই যে শনিবার ছাড়া অন্যদিন ঠাকুরের ছবিতে মালা দেওয়া যাবে না।

(গল্পের সমস্ত চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক)

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন