বাঙালির কিছু খাবারে পুজো পুজো গন্ধ মেশানো থাকে, যেমন ধরুন নারকেল নাড়ু কিংবা নারকেলের সন্দেশ। নারকেল/ডাব শুভ হওয়ায় সব পুজোতেই ব্যবহৃত হয়। পিঠে, পায়েস, নাড়ু, সন্দেশ থেকে শুরু করে সব রকম রান্নাতেই নারকেলের স্বাদ জুড়লে কম-বেশি সবার পছন্দ হয়। শুধু স্বাদেই নয় এই নারকেল বা ডাব আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষেও খুবই উপকারি।সাবেকি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এর অবদান অনন্য। তাইতো নারকেল গাছকে বলা হয় ট্রি অফ লাইফ।
“কোকোনাট” নামটি (প্রাচীনরূপে কোকোয়ানাট) এসেছে পুরানো পর্তুগিজ শব্দ কোকো থেকে, যার অর্থ “মাথা” বা “খুলি”। নারকেল শেলের উপর খাঁজকাটা ৩টি চিহ্ন রয়েছে যা মুখের বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, ফলে এটির এরূপ নামকরন।
নারকেলের আদি বাসভূমি কিন্তু ভারতে নয়। যদিও বেশ কিছুদিন আগে ভারতে রাজস্থানের মরুভূমি থেকে প্রাচীনতম নারকেলের এক ফসিল আবিষ্কার করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কোথাও নারিকেল উৎপন্ন হয়েছে। অনেকই বিশ্বাস করেন নারকেলের উৎপত্তি আসলে উত্তর-পশ্চিম দক্ষিণ আমেরিকা। নারকেলটি সমুদ্রের জলে ভাসতে ভাসতে নদীর মোহনা দিয়ে মূল স্থলভাগের গ্রীষ্মমন্ডল অঞ্চলে অলবনাক্ত জমিতে বিস্তার লাভ করেছে।
প্রতি ১০০ গ্রাম নারকেলের মধ্যে আছে ৩৫৪ ক্যালরি, ১৫.২৩ গ্রাম শর্করা, ৩৩ গ্রাম ফ্যাট, ২০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৩৫৬ মিলিগ্রাম পাটাশিয়াম, ১৫ গ্রাম কার্বহাইড্রেট, ভিটামিন বি-৬, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, সেলেনিয়াম এবং জিঙ্কের মতো খনিজ। নারকেলে আছে প্রচুর ফাইবার। যা পাকস্থলীর হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ক্যালরি ও চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে, যা শরীরে চর্বি জমতে বাধা দেয়। নারকেলে থাকা ক্যালশিয়াম হাড় সুস্থ রাখে। খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরে প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি দরকার তার দশ ভাগের এক ভাগ নারকেল খেয়ে পূরণ করতে পারেন। এই হিসাব অনুযায়ী কারও যদি দিনে ১ হাজার ৫০০ ক্যালরি দরকার হয়, তবে নারকেল থেকে গ্রহণ করতে পারবেন ১৫০ ক্যালরি।
এতে উপস্থিত ভিটামিন-সি এবং ডি চুল ও ত্বককে ভালো রাখে। তাই ডায়েটে আনতে হবে কয়েক টুকরো নারকেল। এটি ত্বক উজ্জ্বলরাখে বলিরেখা পড়তে বাধা দেয়। এতে উপস্থিত লরিক অ্যাসিড এবং মনোলোডিং যৌগ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণযুক্ত হওয়ায় স্কাল্পের জীবাণু নাশ করে, চুল স্বাস্থ্যকর হয়। শুধু ওজন কমাতে সাহায্য করে তা নয়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, এপিলেপসি ও এসাইমাস প্রতিরোধ করতে ক্যান্সার ঝুঁকি কমাতে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে নারকেল। অগ্ন্যাশয়কে ভাল রাখতে, যে কোনও অর্গ্যানের ডি টক্সিফিকেশনে, কোলেস্টরল কমাতে, দাঁত ও মাড়ি ভালো রাখতে, অস্ট্রিওপোরেসিস, অস্ট্রিও আর্থারাইটিস বা যে কোনও হাড় সংক্রান্ত রোগের অব্যর্থ ওষুধ এটি।
অনেকে মনেই প্রশ্ন জাগে ডাব না নারকেলের জল বেশি উপকারী? শাঁস তৈরি হবার আগে কচি অবস্থার নাম ডাব যার খোলের মধ্যে থাকে প্রচুর জল যেটি স্বাদেও মিষ্টি বেশি এবং হাইড্রেটিং৷ ডাবের শাঁসে স্নেহ পদার্থ কম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের মতো ইলেকট্রোলাইট উপস্থিত। অপরদিকে নারকেলের জলে থাকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, এটির ক্যালোরিও অনেকটাই বেশি। নারকেলের জলে সোডিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ বেশি থাকলেও হাইড্রেশন, পোস্ট ওয়ার্কআউট ড্রিঙ্ক হিসেবে ডাবের জল নারকেলের জলের তুলনায় বেশি কার্যকরী।
তবে পরিপুষ্ট হয়ে শাঁস তৈরি হবার আগেই যদি কাঁদি কাঁদি ডাব খেয়ে নেওয়া হয় শুধু ভেবে যে, ডাবের জল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় তাহলে প্রচুর সম্ভাব্য খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আমাদের দেশে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কেরালা ও তামিলনাড়ুতে নারকেল চাষ হয়। পর্তুগিজদের আগমনের পরই কেরালায় সংগঠিত নারকেল চাষ শুরু হয়েছিল। এখানে ডাব বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রিত সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে যা পশ্চিমবঙ্গে নেই।
দক্ষিণ ভারতে নারকেলের চাষ হয় মূলত ছোবড়া ও শাঁসের জন্য। সেখানে ভেতরের খোল হয় ছোট। শাঁস দিয়ে তৈরি হয় তেল, ঝুনো নারকেলের শাঁস শুকিয়ে ঘানিতে পেশাই করে তেল এবং ছিবরে (খোল) পাওয়া যায়। নারকেলের ছিবরে বিদেশে রপ্তানি হয় বিস্কুট তৈরির উপকরণ হিসেবে ছোবড়া দিয়ে তৈরি হয় দড়ি ইত্যাদি।
অধিকাংশ মানুষ এখনো ভাবে যে ডাবের জল পেট মাথা ঠান্ডা রাখে। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের বক্তব্য ডাবের জলে কিছু খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ছাড়া শরীরের উপকারী উপাদান বিশেষ কিছু নেই প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম লবন থাকাতে ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের শরীরে সেটির অভাব মিটিয়ে দিতে পারে ঠিকই কিন্তু ডায়রিয়া বা কলেরা হলে বা বড় অস্ত্রোপচারের পর ডাবের জলের পরিবর্তে মুখ বা শিরা দিয়ে পটাশিয়াম মিশ্রিত জল কিংবা ফলের রস দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। যারা কিডনির সমস্যায় ভুগছেন ডাবের জলের অতিরিক্ত খনিজ লবণ শরীরে ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে। রক্তচাপের সমস্যা থাকলে অতি অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে ডাবের জল খান।
ডাবের জলে অত্যাধিক পটাশিয়াম থাকায় অন্ত্রের পেরিস্টোলসিস ব্যাহত হয়ে পেট ফেঁপে যেতে পারে। এই জন্য অম্বলের রোগীদের দেওয়াই যাবে না কারণ এটি অম্লভাবাপন্ন। অন্যদিকে গরমের সময় ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে সোডিয়াম বেরিয়ে যাওয়ায় দেহে এর মাত্রা অনেক কমে যায় ডাবের জলে সোডিয়াম নেই বললেই চলে সেই অভাব পূরণের জন্য এই সময়ে সামান্য লবণ মিশ্রিত জল খাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। না হলে সোডিয়াম বা পটাশিয়ামের ভারসাম্য বিকৃত হয়ে যন্ত্রের কাজ ব্যাহত হয়।
তা বলে কি আমরা ডাব খাব না, অবশ্যই খাবো প্রথমত পথে-ঘাটে পানীয় জল কতখানি পরিশ্রুত তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায় কিন্তু ডাবের জল সুস্বাদু শুদ্ধ ও সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত তাই ডাবের জল পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে পারে ডাব ধীরে ধীরে নারকেলের পরিণত হলে তাতে প্রোটিন-সহ অন্যান্য উপাদান গুলির পরিমাণ বেড়ে যায়। বেশি পরিমাণে ক্যালরি মিলে বলে পুষ্টিকর সহজপাচ্য নারকেলের জল শিশুসহ সবার ক্ষেত্রে উপকারী। কম দামে সহজে প্রাপ্য এ জাতীয় সম্পত্তির অপচয় দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে।
সুন্দরবন এলাকায় নারকেল চাষের বিশেষ সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু এখানে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ হয় না। সরকারি সাহায্য পেলে এখানে নারকেল ভিত্তিক বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠতে পারে গত কয়েক বছর ধরে ক্ষুদ্র মাকড় থেকে ডাবের গায়ে বিশ্রী দাগ তৈরি হয়েছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাকড় দলবদ্ধভাবে কচি ডাবের বৃতির/বোটার খোলের নিচে (Perianth) থাকে। এই দাগের যথাযোগ্য চিকিৎসা হচ্ছে না।
বিশ্ব নারকেল দিবস বাওয়াল কোকোনাট ডে সারা বিশ্বের প্রতিবছর ২রা সেপ্টেম্বর পালিত হয়। ভারতে বিশেষ করে মুম্বাই ও কঙ্কন কোস্ট এলাকায় জেলারা বিশ্ব নারকেল দিবস পালন করে। নারকেলের কোনো অংশই ফেলে দেয়া যায় না এর চাষ বৃদ্ধি ও বিস্তারের জন্য সারা বিশ্বেই দিবসটি পালন করা হয়।
২৬ জুন প্রতি বছর ন্যাশনাল কোকোনাট ডে বা জাতীয় নারকেল দিবস প্রধানত আমেরিকায় পালিত হয়। উদ্দেশ্য একই নারকেল চাষ উৎপাদন বৃদ্ধি ও বহুমুখী ব্যবহারের চেষ্টা। সুন্দরবন এলাকায় নারকেল চাষের বিশাল সম্ভাবনা আছে এখানে প্রায় প্রতি বাড়িতে দুই একটা নারকেল গাছ আছে অযত্নে বেড়ে উঠেছে। এখানে নারকেল ভিত্তিক বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটাই পরিবর্তন হবে। বর্তমানে এই চাষের জন্য অনেক চাষী এগিয়ে এসেছে পরিবর্তন হয়েছে চাষ পদ্ধতিতেও। নারকেলের শাঁস, পাতা থেকে ঝাঁটাকাঠি, নারকেলের ছোবড়া থেকে গদি তৈরির ফলে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। মানুষকে উদ্ভূত করার জন্য ব্লকভিত্তিক এই দিবসটি জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হোক।
বাজারে বোতল ভর্তি daber জল কি উপকারী।
ওতে কি daber জল আছে?
ডাবের জলকে নানান প্রসেস করে বোতল বন্দী করা হয়, যা খুউব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। তাই গাছ থেকে পাড়া ডাবের জলই স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।