আফসানা বেগম
‘হু… আর… ইউ?
ঠিক এই কথাটা বলল, জানো? ঠিক এভাবেই, টেনে টেনে আর থেমে থেমে।’
খানিকক্ষণ একটানা দাঁড়ি-কমাবিহীন কথা বলে যাচ্ছিল জয়তী। কাঁদোকাঁদো গলায় শেষ কথাটা বলেই আমার ঘাড়ে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। ঘাড়ের উপরে হাত বোলাতে লাগলাম। কিছুই বললাম না। জয়তী আমার ঘাড়ের উপরে ফোঁপানোর তালে তালে ফুলে উঠল আর চুপসে গেল বারকয়েক। আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকলাম। তার শরীরের কাঁপুনির ধাক্কা সামলাতে লাগলাম। তাকে কাঁদতে দিলাম। মোটামুটি ব্যস্ত জর্জ স্ট্রিটে একের পর এক গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে অন্তত ষাট কিলোমিটার বেগে চলে গেল। বাতাস কেটে যাওয়া বাতাসের ঢল আমাদের দুজনের গায়ে দোলা দিতে লাগল। আমি তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে জয়তীকে কাঁদতে দিলাম। জন্ম দিয়েছে, পনেরো বছর আগলে রেখেছে, আনন্দে-বিষণ্ণতায় কত মুহূর্তই না একসঙ্গে কাটিয়েছে—সেই সন্তান যখন চিনতে না পারে তখন মা হয়ে সে কতটা ভেঙে পড়বে, আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম।
একসময় জয়তীর ফোঁপানি কমে এলো। থেমেই গেল প্রায়। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘিরে আসছে। জর্জ স্ট্রিটে একই গতিতে একই দাগের উপর দিয়ে বয়ে চলা গাড়িগুলোতে হেডলাইট জ্বলতে শুরু করলো। প্রতিটা আলো তীর্যক থেকে লম্ব, আবার লম্ব থেকে তীর্যক হয়ে আমাদের শরীর ছুঁয়ে গেল। জয়তীর কান্নার শব্দ থামলে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘কিছু বলার নেই, কিন্তু এটাই কি হবার কথা ছিল না, জয়তী? তুমি ভালোমতো ভেবে বলো তো?’
সে আমার হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে নিলো। নিজের হাতের উলটো পিঠে চোখ মুছে নিয়ে ফুটপাথের লালচে পেভমেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকল। মুহূর্তগুলো লম্বা হতে লাগল। এত লম্বা যে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার সেই সুযোগে রাত নামিয়ে ফেলল। জয়তীর মনটা ঘোরাবার জন্য দূরের নিয়ন সাইন ইশারা করে বললাম, ‘চলো কফি খাই।’ জয়তী জামার হাতায় চোখ মুছে নিলো আরেক বার। রাস্তার আলোর নীচ দিয়ে ফুটপাথ ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। আমাদের ছায়া কখনও দীর্ঘ হলো, কখনও হলো উধাও। আমরা কোনও কথা বললাম না। জয়তী আর আমি পাশাপাশি হেঁটে চললাম শুধু। পেভমেন্টের ব্লকগুলো একের সঙ্গে অন্যটা অদ্ভুত ঘোরপ্যাঁচ দিয়ে আটকানো। একদিক থেকে একরকম তো আরেক দিক থেকে একেবারে আলাদা। আমি নকশাটা অনুসরণ করতে চেষ্টা করছিলাম। কিছুতেই মাথার মধ্যে বাগে আনতে পারলাম না। নিজের অজান্তে একেকটা ব্লকে একেক পা দিয়ে এগোচ্ছিলাম। যেন জোড়ার উপরে কিছুতে পা না পড়ে। ফুটপাথে হাঁটতে গেলেই এই খেলায় পেয়ে বসে আমাকে। পাশে জয়তীর পদক্ষেপের দিকে চোখ পড়ল; এলোমেলো, একবার কোনও ব্লকের মাঝখানে তো একবার জোড়ায়। পা থেকে চোখ উঠিয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম—পৃথিবীর কোনও ভাবনা তার চোখে যেন খেলছে না।
কফিতে চুমুক দিয়ে জয়তী কাপের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। চোখে অশ্রু ঘোলা কাচের মতো হয়ে থমকে আছে। আমি নিশ্চিত কাপের উপরে লেখা Dome শব্দটা সে আগে থেকে না জানলে কিছুতেই পড়তে পারতো না। ডোম আমাদের প্রিয় কফিশপ। জয়তী আগে যখন সিডনিতে থাকতো তখন বহুবার আমরা এখানে একসঙ্গে বসে কফি খেয়েছি। তবে তার ছেলে অয়ন থাকতো না। কথাপ্রসঙ্গে কখনও ‘অয়ন কই’ বা ‘অয়নকে কার কাছে রেখে এলে’ জাতীয় প্রশ্ন করলে জয়তী এটা-সেটা বলে এড়িয়ে যেতো। মনোভাব বুঝতে পেরে আমি সেসব প্রশ্ন করা বন্ধ করেছিলাম।
টিস্যুর কোণে চোখে জমা পানি মুছল জয়তী। মনে হলো স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে। ঠোঁটের উপরে কফির ফেনাটুকু মুছে নিয়ে এমনভাবে বলতে শুরু করলো যেন কথাগুলো এই প্রথম বলছে। খানিক আগে অয়নের স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আমাকে যা যা বলেছিল, সব আবার নতুন করে বলল। হয়তো নিজেকে বিশ্বাস করাবার জন্য, হয়তো সে বিশ্বাস থেকে সান্ত্বনা পাবার জন্য। আমিও তার সান্ত্বনায় অংশ নিলাম। এমন ভাব দেখাতে লাগলাম যেন এই প্রথম শুনছি।
‘দেখলাম আমি অয়নকে। দেখলাম যা দেখতে এসেছিলাম এত দূর থেকে,’ জয়তী বলল।
‘সেটাই। দেখাটা তো অন্তত হলো!’
‘হলো আর কী। তবে সেই অয়ন নয়।’
আমি চুপ করে থাকলাম।
‘বুটের হালুয়া এনেছিলাম, বুঝেছ? আমার হাতে একটা বক্স দেখেছিলে না? ওটাতে। অয়ন খুব পছন্দ করতো। বানালে বরফি কাটার আগেই গরম গরম খেতে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলতো। মানা করলেও শুনতো না। কিন্তু আজ দেখে মনে হলো না সে তেমন খুশি হয়েছে। খাবে কি না কে জানে,’ জয়তী চিন্তায় পড়ে ঠোঁট ওলটালো।
‘খাবে না কেন? নিশ্চয়—’
‘না মানে, যখন বক্সটা খুলে তার সামনে ধরলাম, সে অচেনা জিনিস দেখার মতো করে এক ঝলক তাকালো। আমি আশা করেছিলাম দেখলেই দু-তিনটা তুলে নেবে… নিলো না।’
‘ও হয়তো এখানকার খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, জয়তী। খায় না ওরা, ওই যে বারবিকিউ চিকেন আর অ্যাভাকাডো স্যান্ডুইচ? কিংবা ধরো, দুর্গন্ধময় ভেজিমাইট খাওয়া ধরিয়ে দিতে পারে অয়নকে!’ হাসতে গিয়েও কেন যেন হাসতে পারলাম না। জয়তী কফির কাপের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আমিও একটু গম্ভীর ভাব এনে বললাম, ‘পরে যখন বাকসো খুলে মুখে দেবে, তখন নিশ্চয় খেয়ে নেবে। তুমি ভেবো না।’
‘আমার আর ভাবনার কী আছে, বলো!’ জয়তীর চোখে পানি।
টেবিলের উপরে রাখা জয়তীর হাতের উপরে আমি হাত রাখলাম। সামান্য হেসে তাকে ভরসা দিতে চাইলাম। সে-ও যেন হাসতে চাইল। হাসিটা দেখালো কান্নার মতো।
‘আমার আসলেই ভাবনার কিছু নেই। অয়ন এখন চুপটি করে বসতে শিখেছে। অল্পসময়ের জন্য হলেও চোখে চোখে তাকিয়েছে একবার। সবচেয়ে বড়ো কথা অয়ন এখন কথা বলতে শিখেছে, পলি! ভাবতে পারো তুমি? পারো ভাবতে? আমার অয়ন কথা বলছে! আমরা তো তাকে বাংলা শেখাতে পারিনি, অথচ দেখো, ওরা ওকে ঠিকই ইংরেজি শিখিয়ে ফেলেছে। আরও কী কী শিখিয়েছে কে জানে। আশ্চর্য, আমার অয়ন কিনা আমাকে বলল, হু আর ইউ?’
জয়তীর দুই চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি ওর হাতের উপরে হাত রেখে ছোটো একটা চাপ দিলাম, ‘প্লিজ জয়তী, টেক ইট ইজি।’
‘আই টেক ইট ইজি। সত্যি। কথা তো শিখেছে, তাই না? গলাটা মিষ্টি। হয়তো অনেক কথা বলতে পারে। হয়তো কতো জনকে কতো কিছু বলে। যেমন, আমাকে বলল, হু আর ইউ?’
জয়তী আবারও কেঁদে ফেলল। আমি কফির কাপে মনোযোগ দিলাম। জয়তী বলে চলল, ‘দেখো, নীল টপ পরে এসেছি আমি। অয়নের প্রিয় রঙ। না, মানে, ওর যে প্রিয় রঙ নীল, এমন কথা তো আর সে আমাকে বলেনি বা বলতে পারেনি। কিন্তু আমি জানতাম। জানব না, ওর সঙ্গে এত বছর থাকলাম যে! দেয়ালে হোক কি কাগজে, আঁকিবুকি করতে হলে সে নীল পেনসিলই প্রথমে হাতে তুলে নিতো। অয়নের ছবিতে গাছ, গাড়ি, রাস্তা, সমস্ত কিছুই নীলের বিচিত্র শেড হয়ে যেতো। কখনও ড্রয়ার ঘেঁটে একটা নীল গেঞ্জি বের করে পরতো। ভরদুপুরে উদাস হলে কেবল আকাশের দিকে তাকাতো… এই সব দেখে বুঝে নিয়েছি যে নীলই তার পছন্দের রঙ।’
‘তাই?’
‘হুম। ভাবলাম এই রঙে আমাকে দেখে তার ভালো লাগবে।’
‘তা লেগেছে নিশ্চয়।’
‘কী করে বলি, সে কি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে? সে তাকিয়ে ছিল আমার জুতোর দিকে। বড়োজোর আমার হাঁটু পর্যন্ত তার দৃষ্টিতে পড়েছে। সে মেঝের দিকে কিংবা গেস্ট রুমের জানালার বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আমি তার মাথায় হাত রাখতে চেয়েছিলাম, সে মাথা সরিয়ে নিয়েছে। আমি আসলে তাকে একটা বার একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে…’
জয়তী আবারও কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতেই কফিতে চুমুক দিলো। আমি বুঝতে পারলাম এমনই চলতে থাকবে। শান্ত গলায় বললাম, ‘এসব কিন্তু তোমার জানা, জয়তী। মানে, অনেক আগে থেকেই জানা। আর তোমার মুখ থেকে আমিও জেনেছি। এখন এতদিন পরে নতুন করে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ কেন বলো তো?’
গাল মুছে নিয়ে সে আমার দিকে তাকালো। ভিতরে ভিতরে নিজেকে গোছাচ্ছে, বোঝাচ্ছে— টলটলে পানির নীচে তার চোখে তা ধরা পড়ল। তার চোখে-মুখে গভীর বেদনা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ানোর সংকল্প দেখতে দেখতে আমার অনেক আগের দিনের কথা মনে পড়ল।
গ্ল্যানফিল্ডের সরকারি স্পোর্টস সেন্টারের সুইমিং পুলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমি সাঁতার কাটতে যেতাম। সেখানেই জয়তীর সঙ্গে আমার পরিচয়। তার ছেলে অয়নকে সাঁতার শেখার কোর্সে দিয়েছিল। প্রতি সপ্তাহে আসত অথচ দু-মাসের কোর্সের মধ্যে মাস দেড়েকের মাথায়ও সাঁতার শেখা কিছু এগোলো না। কী করে এগোবে, সাঁতার যখন শেখানো হচ্ছে, অয়ন তখন অন্য কোনওদিকে তাকিয়ে আছে কিংবা পানি দিয়ে খেলছে। নিয়ম না-মানা ছেলেটার প্রতি আমার খানিকটা কৌতূহল হলো। তার মুখটাও অন্যদের থেকে একটু আলাদা। চোয়াল নীচের দিকে বেশ অনেকটা ঝোলানো। দলের মধ্যে অয়নের চেয়ে অনেক ছোটো বাচ্চারা দু-দিনেই অনায়াসে পুলের এ-মাথা ও-মাথা সাঁতরে বেড়াচ্ছে। অয়ন হয়তো তখন অঞ্জলি ভরে পানি নিয়ে পানির উপরে ফেলছে আর দুর্বোধ্য কিছু শব্দ করে হাসছে। সাঁতারের শিক্ষক কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে মাঝে মধ্যে পুলের পাশে বসে থাকা জয়তীর দিকে তাকাতো। অয়ন যে লাইন ছাড়িয়ে পুলের অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটা জয়তী লক্ষ করছে কিনা বুঝতে চাইতো। জয়তী বুঝতো যে শিক্ষক তার দিকে তাকিয়ে। সে না দেখার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমি সাঁতারের ফাঁকে ফাঁকে তাদের দুজনকে লক্ষ করতাম। তৃতীয় সপ্তাহে শিক্ষক অবশ্য জয়তীকে বলেই ফেলল, ‘ইয়োর কিড ডাজন্ট ফলো ইনস্ট্রাকশন। হি নিডস এ স্পেশাল ট্রেইনার।’ জয়তী তখন পুলের চারদিকে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে অয়নকে আদেশনির্দেশ দিতে লাগল। সেসবে কখনও হঠাৎ কাজ হয়েছিল বটে, তবে বেশিরভাগই অয়নের কানে ঢুকেছে বলে মনে হয়নি। ঢুকল আমার কানে, দেখলাম জয়তী বাংলায় কথা বলছে, ‘ওদিকে যাও, এদিকে এসো না, ওই যে সবাই ওদিকে…’ লম্বা একহারা চেহারা আর টিকোলো নাক দেখে দক্ষিণ ভারতীয় বলে মনে করেছিলাম তাকে। কথার টানে বুঝলাম কলকাতার হবারও সম্ভাবনা নেই, পুরোপুরি বাংলাদেশি। আগবাড়িয়ে কথা বলতেই সে চমকে উঠল। বলল সে-ও আমাকে ভারতীয় ভেবেছিল। সপ্তাহান্তে সুইমিং পুলে অয়নের সাঁতার শেখা হলো না ঠিকই, কিন্তু জয়তীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
বাধাধরা রুটিনের জীবনে পরিচিতদের সঙ্গে তেমন সময় কাটানো হতো না আমার। বলতে গেলে অন্যদের অবসরের সঙ্গে আমার অবসরের মিল হতো না। কিন্তু জয়তী যেহেতু চাকরি-বাকরি করতো না, তাই তাকে প্রায়ই সুবিধামতো পাওয়া যেতো। আমরা একসঙ্গে কফি খেতাম, এটা-সেটা কেনাকাটা করতাম, মাঝেমধ্যে কাঁচাবাজারও করতাম। আমার বাড়িতে আমি একাই। তাই কখনও ঘোরাঘুরির পরে জয়তীকে ধরেবেঁধে নিয়ে আসতাম, রেঁধে খাওয়াতাম। জয়তী পরিবারের সঙ্গে থাকতো, আমাকে কখনও সেখানে আসতে বলা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সে কখনও তা করতো না। প্রায়ই আমাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াতো। ভাবতাম বিদেশে এসে কতজনই তো রান্নাবান্নার ঝামেলার ধারেকাছ দিয়ে যেতে চায় না। জয়তী হয়তো তেমন। মনে মনে ভাবতাম আমি নিশ্চয় এতদিনে বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের মতো হয়ে গেলাম; পরিচয় হওয়ামাত্র বাড়িতে ডেকে রান্নাবান্না করে এলাহি কান্ড কারখানা করার রীতি হয়তো স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়েছি। রীতিটা এমন যে সিঙ্গাড়া থেকে রসমালাই পর্যন্ত, সমস্ত কিছু বানিয়ে না খাওয়ানো পর্যন্ত শান্তি নেই। জয়তীর কাছে আমি তেমন আশা করছি ভেবে মনে মনে হাসলাম একদিন। সে তো অমন না-ও হতে পারে। এমনিতে অবশ্য তাকে ঘরোয়া বলেই মনে হতো। রেস্টুরেন্টে বসে বিশেষ কোনও খাবারের স্বাদ বা রান্নার রেসিপি বিষয়ে আমাদের বেশ অনেক বার কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু সে যদি নিজে থেকে আমাকে বাড়িতে নিয়ে না যায় তবে আমি জোর করতে পারি না। বাড়িতে যাবার কথা জয়তী ওঠায়নি। অয়নের বিষয়েও কোনও কথা বলেনি। জয়তী নিজে থেকে না বললে কী করে জানতে চাই। কী করে বলি, অয়নকে আমার চোখে স্বাভাবিক লাগল না যে?
একদিন সেই প্রশ্নটা এসেই গেল। বিকেলে এম-ফাইভ রাস্তায় গাড়ির বাম্পারের সঙ্গে বাম্পার ছুঁয়ে ট্রাফিক জ্যাম হলো। অফিস শেষ করে জয়তীর সঙ্গে বেরিয়েছিলাম আমি। অফিসের পরপর বড়ো রাস্তায় ওরকম জ্যাম একটু আধটু হতো, তবে সেদিন ছুটির আগের দিন বলেই হয়তো ছিল অতিরিক্ত। শহর থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ির চাপ। ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেল লম্বা রাস্তাটার বেশিরভাগ পেরোতে। জয়তীকে বললাম, ‘রাত তো অনেক হলো, তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।’ আমার কথা শুনে জয়তী আঁতকে উঠল, ‘না না, তুমি গ্ল্যানফিল্ডের এক্সিট ছেড়ে ইংগেলবার্ন পর্যন্ত যাবে কেন? এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আমাকে স্টেশনে নামিয়ে দাও।’ তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘গেলামই না হয় তোমার জন্য, ওদিকে তো আর বড়ো রাস্তার মতো জ্যাম হবে না। আর তাছাড়া, দেরি হলে কী, কাল ছুটি। আর তোমার বাড়ির মতো আমার বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করছে না, বুঝলে?’ জয়তী বলল, ‘একা থাকতে তোমার খারাপ লাগে না?’ আমি হাসলাম। ‘একা কোথায়, বই-গান-সিনেমা আর দিনের বেলায় চাকরি, আমার তো সময়ই নেই!’ কথায় কথায় গ্ল্যানফিল্ডের রাস্তা পিছনে ফেলে এলাম। জয়তী কেন যেন কাঠ হয়ে বসে থাকল। মাঝেমধ্যে আমার কথায় জোর করে মুচকি হাসল। একসময় কাছাকাছি এলে ডান-বাম দেখিয়ে দেখিয়ে বাড়ির গেটে এনে উপস্থিত করলো। গাড়ি থামলে হয়তোবা বাধ্য হয়েই জয়তী বলল, ‘আসো না, এক কাপ কফি হয়ে যাক? বহুক্ষণ ধরে গাড়ি চালাচ্ছো।’ জয়তীর অস্বস্তি ছাড়া আমার মানা করার কোনও কারণ নেই। এমনিতে গাড়ি চালানো কিংবা রাতের গভীরতা আমাকে ক্লান্ত করতে পারে না। তা ছাড়া, জয়তীর সংসার দেখার কৌতূহল ভদ্রতা করে ‘না না ঠিক আছে’ কিংবা ‘আজ থাক, পরে কখনও’ বলতেও বাধা দিচ্ছিল। পরে যদি আর এমনটা না হয়? জয়তীর কাঁচুমাচু মুখটা ওই মুহূর্তে আমি আমলে নিলাম না। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললাম, ‘বেশ তো! জাঁকিয়ে শীত পড়েছে আজ। কফি হলে দারুণ হয়।’
একতলা ভিলা। ড্রাইভওয়েতে পা দিতেই উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল। দু-দিকে ঘাসের লন। এলোমেলো ঘাস, ফাঁকফোঁকরে আগাছা—অন্তত মাসদুয়েক কাটা হয়নি। কোথাও কোথাও ন্যাপিয়ার ঘাসের মতো লম্বা হয়ে উঠেছে। ইংগেলবার্নের সারিবাঁধা সবুজ ঘাসের গালিচাওলা পরিপাটি বাসাগুলোর পাশে জয়তীর বাসা বেশ বেমানান। বারান্দায় কিছু নেই। মনে হলো রিয়েল এস্টেট এজেন্টের সঙ্গে নতুন বাড়ি দেখতে এসেছি। মানুষ থাকলে চিহ্ন থাকে—ফুলের টব কি লতানো একটা পাতাবাহার, জুতোর র্যাক কি ছোটো একটা পাথুরে ঝরনা। যা হোক, চাবি ঘুরিয়ে জয়তী দরজা খুলল। বসার ঘরে সোফায় বসে টিভি দেখছেন জয়তীর বর। আমাকে জয়তীর সঙ্গে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। অচেনা অতিথি দেখে মানুষ যেমন হাসি হাসি মুখ করে, মুখটা তেমনই করে ফেললেন।
‘এই হলো পলি, যার সঙ্গে প্রায়ই বেড়াতে যাই,’ আমার দিকে ইশারা করে জয়তী বলল।
ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ‘ও আচ্ছা, আমি শুভ।’
‘তোমরা কথা বলো, আমি কফি করে আনি,’ বলে জয়তী ভিতরে চলে গেল।
নির্ভেজাল ঘর। কেবল সোফা, ছোটো-বড়ো তিনটা টেবিল আর টেলিভিশন। পাশের খোলা স্পেসটাতেও তাই। ডাইনিং টেবিল আর দেয়াল ঘেঁষে একটা মাত্র আসবাব। দেয়ালগুলো খাঁ খাঁ করছে, না কোনও পারিবারিক ছবি, না কোনও শিল্পকর্ম। ঘরের ভিতরে যা না হলেই নয় ঠিক ততটুকু রাখা। বাসা দেখে বোঝা যায় তত গুছিয়ে বসা নয়। তবে জয়তীর কাছে জেনেছিলাম, এক বছরের বেশি হলো তারা সিডনিতে এসেছে। বাড়িঘর দেখে তেমন লাগল না। বরং মনে হলো অস্থায়ী আবাস। যা হোক, বসবাসের আরামের ব্যাপারে যার যার আলাদা রুচি থাকে।
‘কোথায় থাকছেন আপনি?’ শুভ জানতে চাইলেন।
‘এই তো পাশের সাবার্ব, গ্ল্যানফিল্ড।’
‘ওহ একদম কাছে।’
‘হ্যাঁ। আগে সিটিতে ছিলাম। ওদিকটা এত গ্যাঞ্জাম হয়ে গেছে আজকাল তাই দূরে চলে এলাম।’
‘এদিকে নতুন এসেছেন বুঝি?’
‘না না, বছর দশেক হলো। এসেছিলাম মাকে নিয়ে। মা আর নেই, আমি একাই থেকে গেলাম।’
‘ও আচ্ছা।’
‘বাড়িতে আসুন না একদিন। জয়তী কয়েক বার গেছে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ। আমি খুব ব্যস্ত থাকি। আসল কথা হলো সিডনিতেই থাকি না। তবে উইকএন্ডে চলে আসব একদিন।’
‘সিডনিতে থাকেন না?’ প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক বলেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
‘নাহ্, আমি থাকি ক্যানবেরায়। ওখানে বাংলাদেশ হাই কমিশনে কাজ করছি। শুক্রবার অফিস করে এখানে চলে আসি। চলে যাই রোববার রাতে।’
‘তাই নাকি! তবে জয়তী কেন খামোখা একা একা এখানে…’
আমার কথা শেষ হতে পারল না। তার আগেই ভিতরের দিকের কোনও ঘরে ধড়াম করে কিছু পড়ে গেল। পরমুহূর্তে তার চেয়ে জোরে কিছু। তারপর দাপাদাপি আর চিৎকার। শুভ আমাকে বিস্মৃত হয়ে শব্দ অনুসরণ করে ছুটে গেলেন। শুভ যাবার পরে আরও অনেক রকমের শব্দ হতে থাকল। কার্ডবোর্ডের দেয়ালওলা বাড়ির কোনও ঘরের বড়ো শব্দ অন্য ঘরে গোপন থাকে না। চিৎকার, দুর্বোধ্য শব্দ আর সঙ্গে শুভর অনুনয়, ‘বাবা, এই তো, এটা চেয়েছ? এই নাও…’ ধড়াম!… ‘এটা না? ওই লালটা? আচ্ছা, কোনটা চাও আমাকে দেখাও দেখি…’ ধড়াম!
অস্বস্তিতে গুটিশুটি হয়ে বসার ঘরে বসে থাকলাম। আগ্রহ করে এসে কোনও ঝামেলায় ফেললাম নাকি তাদের কে জানে। ওদিকে ধুড়–ম ধাড়াম চলছে আর এদিকে শান্ত ভঙ্গিতে ট্রে হাতে জয়তী উপস্থিত। ওদিকে চেঁচামেচি এদিকে ধীরে ধীরে জয়তী ট্রে থেকে কফির মগ তুলে আমার হাতে দিলো। তাকে দেখে মনে হলো শব্দ শুনতে পাচ্ছি কেবল আমি। শুভর মগটা হাতে নিয়ে শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে তাকিয়ে সে একটু দ্বিধায় ভুগল। মগটা আবার ট্রেতে রেখে নিজেরটা তুলে নিলো। পাশের সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিয়ে মেঝের দিকে তাকালো। অদ্ভুত শান্ত দেখালো জয়তীকে। কফি হাতে আমি বসে থাকলাম, কী করব বুঝতে পারলাম না। জয়তী বলল, ‘আমার ছেলে, অয়ন। ওকে তো তুমি দেখেছ।’
‘হ্যাঁ, তাই তো, ভাবছিলাম অয়নের কথা জিজ্ঞাসা করব। কিছু নিয়ে জেদ করছে বুঝি?’
‘সে জেদের মধ্যেই থাকে। নিজের চাওয়া-পাওয়া বোঝাতে পারে না তো। তাই জেদ কখনও ফুরোয় না।’
‘তুমি চাইলে দেখো না গিয়ে, আমি বসছি।’
‘নাহ্, মোস্তফা আছে, ওর বাবা আছে। ওরা সামলাক। আমার আর ভালো লাগে না।’
জয়তী হতাশ নাকি বিরক্ত বোঝা গেল না। মোস্তফা কে তা-ও বুঝলাম না। তবে এসব পাশ কাটানোর অভ্যাসটা লুকালো না জয়তী। তাই আমিও প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইলাম, ‘তুমি তবে একাই থাকো এখানে, তোমার বর তো শুনলাম…’
‘হ্যাঁ, শুভ ক্যানবেরায়। দেখা যাক আর কতদিন থাকতে হয়। এমনিতে বছর তিনেকের আগে ট্রান্সফার হবার কথা নয় অবশ্য। তবে আমাদের কাজ তার আগে হয়ে গেলে…’
জয়তীর কথা শেষ হবার আগেই করিডোর থেকে অয়ন বেরিয়ে এলো। আগের চেয়েও বড়ো লাগল তাকে দেখতে। বাড়ন্ত বয়স, এরই মধ্যে খানিক লম্বা হয়ে গেছে হয়তো। দুমদাম ছুটে এসে সে আমার আর জয়তির মাঝখানের টেবিলের উপর দিয়ে এক লাফে চলে গেল। টেবিলে রাখা শুভর কফির মগটা নড়ে উঠল। পড়তে পড়তে কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ‘এই অয়ন, স্টপ, অয়ন..,’ জয়তী নিজের মগ বাঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল। আমি বললাম, ‘হ্যালো, অয়ন।’ অয়নের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। তার এক হাতে লাল আরেক হাতে নীল ফিতা। ফিতা উড়িয়ে উড়িয়ে সে টেবিলকে কেন্দ্র করে কয়েকটা পাক খেলো। এর মধ্যে করিডোর থেকে বেরিয়ে এলো শুভ। তাকে বিধ্বস্ত দেখালো। পিছনে পিছনে সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে এলো আরেক জন। মধ্যবয়সি, খোঁচা দাড়ির ঘেরে মুখটায় সাধারণ বাঙালি ছাপ। এই লোকটাই হয়তো মোস্তফা, যার কথা জয়তী বলছিল। শুভ বিব্রত হাসি হেসে পাশের সোফায় বসল। মোস্তফা লোকটি পিছনে পিছনে ছুটল, ‘বাবু, ওখানে ওঠে না, পড়ে যাবে পড়ে যাবে..’ লোকটা দু-হাত মেলে রাখল অয়নের পাশে পাশে। অয়ন হয়তো তার থেকে একটু লম্বাই হবে। সে তার কথায় পাত্তা দিলো না। সমস্ত সোফার হাতল আর হেলান দেওয়ার জায়গাটার উপর দিয়ে হেঁটে নিয়ে, টিভিটাকে জোরে একটা ধাক্কা মেরে আরেক করিডোরের দিকে চলে গেল অয়ন। মোস্তফাও গেল তার পিছনে পিছনে। টিভিটা এদিক ওদিক দুলে থামল। ঘরটাতে মুহূর্তে শান্তি নেমে এলে দেখলাম শুভ আর জয়তী যে যার মতো কফিতে চুমুক দিচ্ছে।
‘খুব চঞ্চল, না? সুইমিং পুলে যখন দেখেছিলাম এতটা ছিল না মনে হয়,’ আমি বললাম।
‘না, আসলে পানিতে ছিল তো, তুমি বুঝতে পারোনি। আর এটা ঠিক চঞ্চলতা নয়, হাইপারঅ্যাক্টিভিটি। অ্যাটেনশন দিতে পারে না। তা ছাড়া, অয়ন অটিজমে ভুগছে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘ব্যাপারটা একটু সহজ হতো যদি স্পিচ আসত। কিন্তু পনেরো হয়ে গেল, এখনও কথা বলেনি।’
আমার মনে পড়ল সুইমিং পুল থেকে বেরোনোর সময়ে আমি হাই-হ্যালো বলেছি কয়েক বার। অয়ন অন্য দিকে তাকিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম কত বাচ্চাই তো থাকে, মিশতে চায় না, নাম জানতে চাইলে বিরক্ত হয়। অয়ন তেমন হবে হয়তোবা। কিন্তু সে যে কথাই বলতে পারে না, আমি ভাবিনি। পাশের ঘর থেকে আগের মতোই চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। হয়তো অয়নের কারণে জয়তী আমাকে বাসায় আনতে চায়নি। বুঝতে পারার পরে অস্বস্তি বাড়ল, মায়াও লাগল। জয়তী আমার মনের কথা টের পেলো যেন, ‘বাসায় সারাক্ষণ সার্কাস, এজন্যে কাউকে ঘরে আনি না, বুঝলে? নইলে তোমাকে সেই কবেই…’
‘এ তো হতেই পারে, জয়তী। যার সমস্যা সে জানে। আমি তো বাইরে থেকে দেখছি। আমার অনুভূতি কেবল খারাপ লাগার। কিন্তু তোমরা জানো তোমরা প্রতিদিন কীসের ভিতর দিয়ে যাও।’
বড়ো বড়ো চোখ থেকে টপটপ করে দু-ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল জয়তীর গালে। শুভ অস্থির হয়ে এগিয়ে এসে ঘেঁষে বসল, ‘আহা, কাঁদছ কেন!’
‘সত্যি, পলি, আমরা যে কীসের মধ্যে দিয়ে বছরের পর বছর যাচ্ছি কেউ বুঝবে না। এমন নয় যে বাচ্চাটার শারীরিক কোনও অসুস্থতা আছে, এমন নয় যে তার শরীর বাড়ছে না। সে বেড়ে উঠছে অথচ মানসিকভাবে সে ডুবে আছে নিজের জগতে। সে জগতে সে যা চায় তাই করে। একই বাড়িতে থাকি, কিন্তু তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। সে যে কমিউনিকেট করতে পারে না,’ চোখ মুছে নিয়ে জয়তী বলল।
‘আমি বুঝতে পারছি, জয়তী। থাক, এসব ভেবে নতুন করে মন খারাপ কোরো না আর,’ আমি সান্ত্বনা দিতে চাইলাম।
‘আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, জানো? সরকারি চাকরি করতাম। সচিবালয়ে ছিলাম। ভাবলাম দেখি, চাকরি-বাকরি করে সময় নষ্ট না করে অয়নের পিছনে থাকি, ও মানুষ হোক। কিন্তু আমার দিনরাতের পরিশ্রমের পরেও সে বাড়ির একটা ফার্নিচারের মতো হয়ে থাকল।’
‘নিজেকে দোষ দিও না। প্রকৃতিতে অসামঞ্জস্য থাকে, মেনে নাও।’
‘নিয়েছি। আমি বহু আগেই মেনে নিয়েছি। ঢাকায় একটা স্পেশাল স্কুলে যেতো অয়ন। লাভ হলো না কোনও। স্পিচ থেরাপিস্টের দরকার ছিল। পাইনি। দেখো না, তারপর মোস্তফার হাতে দিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। কিংবা আমি সত্যিই পারিনি। সবাই হয়তো সব কিছু পারে না। আমি আসলে হতাশ হয়ে গেছি। গত বছর পাঁচেক ধরে মোস্তফা ওর দেখাশোনা করছে। তা ছাড়া, অয়নের শরীরটা বড়ো হয়ে গেছে, আমি সামলাতে পারি না। এখন সিডনিতে পড়ে আছি ওকে একটা বোর্ডিং স্কুলে দেবো বলে। অটিস্টিক বাচ্চাদের স্কুল।’
‘ও আচ্ছা, তাই বুঝি এখানে থাকতে হচ্ছে তোমাদের?’
‘হ্যাঁ, সেটাই। ডিপ্লোম্যাটদের বাচ্চা ছাড়া ওরা নেবে না। অনেক ধরাধরি করে তাই শুভর পোস্টিং নিতে হলো এখানকার হাই কমিশনে। দুশ্চিন্তা আমার চেয়ে শুভরই বেশি। ভাইবোনদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না। তাই শুভর দিনরাত এক চিন্তা, আমরা দুজন মারা গেলে কে দেখবে অয়নকে? না জানি কার বোঝা হয়ে যাবে বাচ্চাটা আমার, তারপর অনাদরে…’
‘বাদ দাও এসব, জয়তী। এখন তো এখানেই দেবে তাই না?’
‘সেই চেষ্টাই চলছে। স্কুল থেকে ওরা প্রতি পনেরো দিনে এসে একবার দেখে যায়। রিপোর্ট লেখে। আরও মাসছয়েক নাকি এরকম চলবে। তারপর সিদ্ধান্ত জানাবে। যাকে নেয়, চিরজীবনের জন্য নিয়ে নেয়। তারপর ট্রেনিং দেয়। তাতে উন্নতি হলে হলো, না হলেও বাচ্চাটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে না। ওখানেই বড়ো হবে। কাউন্সিল তার দায়িত্ব নেবে। স্কুলটার কথা শোনার পর থেকেই আমরা এখানে আসার চেষ্টা করছিলাম। এখন এই স্বপ্ন নিয়ে বসে আছি।’
তারপর, অল্পদিনে জয়তীর স্বপ্ন সফল হলো। পরের ছয় মাস না যেতেই স্কুল থেকে অয়নকে নিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব এলো। অয়নের নতুন জীবন শুরু হলো। নতুন জীবন শুরু হলো জয়তী আর শুভরও। তাদের চেহারা বদলে গেল। দুজনের মুখের উপর থেকে বিষণ্ণতার সাইনবোর্ড উধাও। সেখানে দেখলাম হাসি-তামাশার উজ্জ্বল একটা পরত সেঁটে গেল। মোস্তফাকে তাদের আর প্রয়োজন পড়ল না। তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। অয়ন স্কুলে ঠিকঠাকমতো থাকতে পারছে কি না দেখার জন্য জয়তী অবশ্য সিডনিতেই পড়ে থাকল। তবে জয়তী আর শুভ হুট করে ঝাড়া হাত-পা হয়ে গেল। কফি বা রাতের খাবার খেতে আগে আমার সঙ্গে কেবল জয়তী আসত, তখন সাপ্তাহিক ছুটির সময়টাতে শুভও আসতে লাগল। জয়তীর ওরকম উচ্চস্বর আর অট্টহাসির শব্দ আগে আমি শুনিনি। যেন কী একটা দুশ্চিন্তা নেমে গেছে মাথা থেকে যা তাদের তিল তিল করে ক্ষয় করছিল। আর তখন প্রায় কথার শেষে বলতে শুরু করলো, ‘এখন আমরা শান্তিতে মরতে পারব, পলি!’ শুনে আমি অবাক হয়ে হাসতাম। অয়নকে দূরে পাঠানোর জন্য তাদের খামোখা আবেগে ভাসতে দেখছি না, এটা আমার কাছে তখন ভালোই লাগল। বাস্তবতাকে সহজে গ্রহণ করলো তারা। দেখতে ভালো লাগত যখন বাড়ি ফেরার সময়ে শুভ জয়তীর ঘাড় জড়িয়ে ধরতো, জয়তী ধরতো শুভর কোমর। তারপর হেলেদুলে, কোনওদিন খানিকটা ড্রিংক করে গাড়িতে উঠতো। সিডনির শীতের রাতে হাসির দমকে মুখ থেকে শীতল বাষ্প বের করে দিতে দিতে তারা গাড়ির দিকে এগোতো। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে দেখতাম। দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পরে যেন দুজন মানুষের নতুন মধুচন্দ্রিমা শুরু হয়েছে। মনে মনে বলতাম, সুখী হোক ওরা।
মাঝে মাঝে দুপুর বেলায় উত্তেজনায় ফোন করতো জয়তী, ‘আজ অয়নের স্কুলে গেছিলাম, বুঝলে?’
‘তাই? কী দেখলে?’
‘দূর থেকে দেখলাম। অয়ন হ্যান্ডবল খেলছে। বলের দিকে তাকায় না ঠিকমতো অথচ বল সুযোগমতো মারে। অদ্ভুত ব্যাপার! নিজে নিজে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে, খাবার খাচ্ছে… কত্তকিছু শিখে ফেলছে!’
‘সব শিখে ফেলবে, জয়তী। এখানকার একটা সাধারণ স্কুলেও স্পেশাল নিডের বাচ্চাদের জন্য স্পেশাল কেয়ার নেওয়া হয়। একটা বাচ্চাকে মারাত্মক বিহেভিওরাল ডিসঅর্ডার থাকা সত্ত্বেও চমৎকারভাবে বেড়ে উঠতে দেখেছি আমি। আর অয়নের স্কুল তো স্পেশাল বাচ্চাদের জন্যই। একদম অন্যরকম হয়ে যাবে, দেখো।’
‘তাই যেন হয়,’ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলতো জয়তী।
হয়েছিলও অন্যরকম। শুভর চাকরির মেয়াদ শেষ হতে হতে অয়ন আমূল বদলে গিয়েছিল। খুব কমই অকারণ ছটফট করতো। চোখে চোখ রেখে তাকাতে চেষ্টা করতো। হুট করে কখনও এক ঝলক তাকিয়ে ফেলতো। জয়তী আর শুভ সিডনি ছাড়ার পরে লোকাল গার্ডিয়ান হিসেবে আমি কয়েক বার অয়নকে দেখতে গিয়েছিলাম। অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আচ্ছা, অয়ন আমার দিকে তাকায় না কেন?’ তিনি মিষ্টি করে হেসে বলেছিলেন, ‘মানুষ আর জিনিসের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, তাই আই কন্ট্যাক্ট করে না।’
‘আচ্ছা, তবে কি পরে দেখলে চেনা মানুষকে আইডেন্টিফাই করতে পারবে?’
‘বলা মুশকিল। কেউ কেউ স্পিচ আসার আগের কথাও পরে বলতে পারে। একেবারে ফটোগ্রাফিক মেমোরির মতো। কেউ আবার যা দেখে কিছুই মনে রাখতে পারে না।’
আমার কেমন যেন ভয় করতো। জয়তী চলে যাবার ঠিক আগের দিনে অয়নকে দেখতে গিয়েছিল। অয়ন গেস্টরুমে থাকতেই চাচ্ছিল না। আমাদের উপস্থিতিতে খুব বিরক্ত হচ্ছিল। আমার তখনই মনে হয়েছিল পরে এমন একটা কিছু হবে। অয়ন হয়তো বদলে যাবে। তবে শুভর ব্যাপারটা আমি একদমই ধরতে পারিনি। মধ্যবয়সি তরতাজা শুভ দেশে ফেরার আট মাসের মাথায় টুপ করে মরে গেল। খবরটা পেয়ে স্তম্ভিত বসে থেকেছিলাম কিছুক্ষণ। সে কি আগেই জানতো যে এত অল্পবয়সে মারা যাবে? না-হলে অয়নকে চিরকালের বোর্ডিঙে দেবার জন্য এত উতলা হয়েছিল কেন! আচমকা ঘোর ভাঙলে জয়তীকে ফোন করেছিলাম।
‘কীভাবে?’ আমার কৌতূহল জয়তীর পরিস্থিতির ধার ধারেনি।
‘কিছুই বুঝলাম না, পলি। কাল বুকে একটু ব্যথা ছিল। ডাক্তারের কাছে যাওয়াতে তিনি বললেন ইসিজি করতে। ভাবলাম এই শুক্রবারে যাব, কিন্তু কাল রাতেই হঠাৎ…’ জয়তী আর বলতে পারল না। আমার উৎকণ্ঠা কমলো। বললাম, ‘থাক। তুমি নিজের খেয়াল রাখো। আমি না হয় পরে…।’ আমার কথা থামিয়ে দিয়ে জয়তী বলল, ‘আমি এখন একা একা কী করে থাকব, পলি? কী করব এখন আমি?’
মাস ছয়েক গেলে জয়তীকে বলেছিলাম, ‘সত্যিই তো, কী করবে ওখানে একা? এখানে চলে আসো। একটা কোনও পড়াশোনা কি স্কিলড মাইগ্রেশন? ট্রাই করে দেখো না। অয়নের কাছে থাকলে, তাকে মাঝেমধ্যে দেখলে, চাও না?’
‘চাই, পলি। ওখানেই চলে যেতে চাই। তুমি তো আছ।’
‘হ্যাঁ, সোজা আমার এখানে এসে ওঠো। এটাই ফাইনাল।’
জয়তী সেই এলো আরও বছর দেড়েক বাদে।
কফিশপ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমরা ঠিক করলাম, কাল আবার যাবো অয়নের কাছে। জয়তী বলল, সে তার অনেক আগের কাপড় আর অয়নের সঙ্গে তোলা কিছু ছবি সঙ্গে এনেছে। কাল চেনা কাপড় পরে এলে অয়ন যদি তাকে চিনতে পারে, ছবি দেখে যদি কিছু তার মনে পড়ে! আমি বললাম, আমিও কাল স্কুলের ভিতরে যাবো তার সঙ্গে। অয়নের আঙুলের ডগা দিয়ে আঁকা একটা ছবি ছিল আমার কাছে। ঠিক করলাম সেটা হাতে নিয়ে যাবো।
রাতটা কাটল হা-হুতাশের মধ্যে দিয়ে। জয়তীর কান্নাকাটি নয়তো আফসোস, ‘এই ছেলের জন্য আমি ক্যারিয়ারকে তুচ্ছ করেছিলাম। চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমি ভেবেছিলাম তাকে ঠিক করে ফেলব।’
‘চেষ্টা তো করেছিলে, জয়তী,’ ঘুম ঘুম চোখে সান্ত্বনা দিলাম।
‘এই ছেলের জন্য আমি শুভর সঙ্গেও যা-তা ব্যবহার করেছি কত সময়।’
আমি চুপ করে থাকলাম। জয়তী বলতে লাগল, ‘জানো আমি চাকরি ছাড়ার বছর দুয়েক পরে একদিন শুভর প্রোমোশন হলো। সে ফোনে কিছু না বলে বাড়িতে এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। মিষ্টিটিস্টি নিয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল প্রোমোশনের কথা। কিন্তু..’
‘কিন্তু কী?’
‘শুভ বলল, আমি যতটা খুশি হবো বলে সে ভেবেছিল, ততটা নাকি হইনি।’
জয়তী থামল। আমিও চুপ করে থাকলাম। উপশহরে মধ্যরাতের চূড়ান্ত নিস্তব্ধতা আমাদের মাঝখানে অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ালো। স্তব্ধতার মধ্যে আমি ফট করে বলে বসলাম, ‘সত্যিই কি তুমি তখন খুশি হওনি, জয়তী?’
জয়তী আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে থাকল। তার চোখে দ্বিধা দেখলাম পরিষ্কার। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থাকার পরে বলল, ‘কেউ আমাকে কখনও এত সরাসরি প্রশ্ন করেনি। করলেও আমি উত্তর দিতাম না।’ তারপর একটু থেমে নিয়ে মাথাটা নিচু করে বলল, ‘শুভর প্রোমোশনের খবরে সত্যিই আমি খুশি হইনি তখন। আমার মনে হয়েছিল, আজকে এই সৌভাগ্য তো আমারও হতে পারতো! ওর জায়গায় আমি থাকতে পারতাম কিংবা আমার জায়গায় সে। আবার ধরো, অয়ন আমাদের মাঝখানে না-ও থাকতে পারতো।’
এই কথার পরে তাকে সান্ত্বনা দেয়াটা বাহুল্য মনে হলো। জয়তীই নানান কথা বলে চলল। অয়নকে ওই বোর্ডিঙের আনন্দময় জগতে রেখে লাভ হলো না ক্ষতি, এই হিসেব কষতে কষতে রাত কাবার। পরদিন সকালে টলতে টলতে অফিসে গেলাম। সন্ধ্যার আগেই জয়তী হাজির। চলে গেলাম অয়নের স্কুলে।
অয়ন আমাদের দিকে তাকালো না। ইস্ত্রি করা সাদা শার্টের উপরে জলপাইরঙা ভি-গলার সোয়েটার আর গলার কাছে টকটকে লাল টাইয়ের গিঁটে তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিল। অয়ন কি টাই বাঁধাও শিখে গেছে? প্রশ্নটা করতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু কেন যেন গলার কাছে কান্না হয়ে থেমে থাকল। দেখলাম, জয়তীর চোখ দিয়ে নিঃশব্দে পানি পড়ছে। অয়নের সামনে নিজেদের ছবিগুলো মেলল সে। অ্যালবামের পাতার পর পাতা ওলটালো, ‘এই যে বাবা, এই যে আমরা হাইড পার্কে গেছিলাম… এই দেখো, তোমার বাবার পাশে তুমি। অয়ন তোমার বাবা না আর নেই।’ অয়ন অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল। মাঝেমধ্যে তার মুখে অস্বস্তি দেখলাম। যেন তাকে ওই ঘরে আনা হয়েছে বলে জোর করে বসে থাকতে হচ্ছে। জয়তী চোখ মুছে আবারও শুরু করলো, ‘এই দেখো, মিউজিয়ামে তুমি। ওই যে হাইড পার্কের পাশের মিউজিয়ামটা, মনে আছে? এই দেখো, কত্তোবড়ো ডাইনোসরের কঙ্কাল! তুমি তার নীচে দাঁড়িয়ে আছ, দেখেছ?’
অয়ন হাত দিয়ে অ্যালবাম সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সতেরো বছরের লম্বাচওড়া যুবক। অয়নকে আমি কখনও হাসতে দেখিনি। কাঁদতেও দেখিনি বলতে গেলে। অয়ন দাঁড়ালো কিন্তু চলে গেল না। আবেগ নেই, স্মৃতি নেই কিন্তু তারপরেও কিছু যেন একটা আছে যা তাকে তখন ওই ঘরে আটকে রাখল। আমি সেই কিছু একটা বোঝার জন্য তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সেখানে ভাবলেশহীন দুর্বোধ্য ছায়া ছাড়া আর কিছু পেলাম না।
‘আই… ডোন্ট… নো ইউ’, হঠাৎ ভাঙা ভাঙা উচ্চারণ শুনলাম। চমকে উঠে বললাম, ‘অয়ন, প্লিজ ট্রাই টু রিমেমবার, শি ইজ ইয়োর মাদার।’ হাতে দুলিয়ে ছোটোবেলায় অয়নের আঙুলের ডগা দিয়ে আঁকা ছবিটা দেখালাম, যদি কিছু মনে পড়ে! অয়ন বিরক্ত হলো। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আই… অ্যাম… অয়ন।’
বলার পরে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। হনহন করে বাইরে চলে গেল। কেউ একজন দরজার বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। অয়ন তার সঙ্গে বিস্তৃত মাঠের মাঝখানে বয়ে চলা লাল ইটের রাস্তা ধরে যেতে লাগল। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি আর জয়তী। অয়ন যখন মাঠের আরেক মাথায় রাস্তার শেষ প্রান্তে চলে গেছে, আমার পাশ থেকে জয়তীর দৃঢ় গলা শুনতে পেলাম, ‘আমি এখানে আবার আসব। আসতেই থাকব।’
সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৮ পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত