সমালোচনা সাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র ধারা রয়েছে। সেই ধারা লেখককে কখনও উজ্জীবিত করে, কখনও বিমর্ষ করে দেয়। যিনি লেখক তাঁর লেখায় স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি থাকে, এই জন্যেই পাঠক লেখকের স্বতন্ত্র সত্তাকে আলাদাভাবে চিনে নিতে পারেন। আবার কোনো কোনো লেখককে সমকাল চিনতে পারে না, লেখক সবার কাছে সেইভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন না। আবার দেখা যায় উত্তরকালে কোনো কোনো পাঠক সমকালের সাথে ঐ লেখকের লেখার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পান এবং বিস্মিত হয়ে ওঠেন।
প্রেম একটি কাল্পনিক অনুভব, অনেকটা স্বপ্নদর্শনের মতো, মানুষ আসলেই প্রবৃত্তিচালিত। রোমান্টিক যুগ কিম্বা সদ্য পেরিয়ে আসা রোমান্টিক যুগে এভাবে ভাবাটা কষ্টসাধ্য ছিল। কারণ রাবীন্দ্রিক মূল্যবোধে আচ্ছন্ন ছিল পাঠক জগত। তারপরও দীর্ঘ সময় জুড়ে নিখাদ প্রেমকে অবলম্বন করে বিচরণ করেছে সাহিত্যজগত। কথাসাহিত্যের খ্যাতনামা তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে একমাত্র মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দিককার লেখাগুলি বাদ দিলে আমরা প্রবৃত্তিচালিত মানুষের সন্ধান পাই।
জগদীশ গুপ্তের গল্পে আগাগোড়াই প্রবৃত্তি চালিত মানুষের সাথে পরিচিত হই যা বর্তমান কালের মুখ ও মুখোশের অন্তরাল ভেঙে বেরিয়ে পড়ে প্রায় নগ্নভাবেই। তাই সেকালের লেখক একালে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। আর তাঁর সমকালীন সমালোচকদের সমালোচনা পড়ে মনে হয় পুস্তক সমালোচনা বিষয়টিও বড্ড আপেক্ষিক, তাই তা লেখককে এগিয়ে কিম্বা পিছিয়ে দিতে তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নয়। হ্যাঁ গঠনমূলক আলোচনার অবশ্যই একটা ভূমিকা আছে, অনেকসময় তা লেখকের কলমকে প্রদীপ্ত করে।
এতো কথার অবতারণা এজন্যেই যে, জগদীশ গুপ্ত নেতিবাচক আলোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতামত পাওয়ার জন্যে তিনি তাঁর লেখা “লঘুগুরু” উপন্যাসটি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ঔপনিষদিক মূল্যবোধে আবৃত রবীন্দ্রনাথ সেই গ্রন্থের নেতিবাচক আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ আলোচনার চতুর্থ অনুচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন — ” ‘লঘু গুরু’ সম্বন্ধে যদি জজিয়তী করতেই হয় তাহলে গোড়াতেই আমাকে কবুল করতে হবে যে, এই উপন্যাসে যে লোকযাত্রার বর্ণনা আছে আমি একেবারেই তার কিছুই জানিনে। সেটা যদি আমারই ত্রুটি হয় তবু আমি নাচার। বলে রাখছি এ দেশে লোকালয়ের যে চৌহদ্দির মধ্যে এতকাল কাটালুম এই উপন্যাসের অবলম্বিত সমাজ তার পক্ষে সাত সমুদ্র পারের বিদেশ বললেই হয়, দূর থেকেও আমার চোখে পড়ে না। লেখক নিজেও হয়তো বা অনতিপরিচিতের সন্ধানে রাস্তা ছেড়ে কাঁটাবন পেরিয়ে ও জায়গায় উঁকি মেরে বসেছেন।”
এই আলোচনায় আহত হয়েছিলেন জগদীশ গুপ্ত। তার উত্তর তিনি দিয়েছেন “উদয়লেখা” গল্পগ্রন্থের নিবেদনে। যাই হোক আপাতত সেই চাপানউতোরের প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তাঁর উপন্যাস ‘অসাধু সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসের এক অস্বাক্ষরিত নেতিবাচক আলোচনা দেখতে পাই “মানসী ও মর্মবাণী” সাহিত্যপত্রে।
লেখকের সমাজও মানুষের মনোজগতের খোপেখোপে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারকে টেনে দিবালোকে নিয়ে আসার ব্যাপারটি অনেকেরই পছন্দসই হয় নি সমালোচনা পড়েই ধরে নেওয়া যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে জগদীশ গুপ্তের শৈশব কেটেছে পতিতাপল্লীর কাছাকাছি। তাই হয়তো তিনি নারীজীবনকে দেখেছেন বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে। সেখানে কোনও ভাবালুতা কোনও মুহুর্তে তাঁর লেখনিকে আচ্ছন্ন করেনি। অর্থ ও কাম দুটোই এসেছে প্রধানত প্রান্তিক অংশের হাত ধরে।
“বোনঝি গুঞ্জমালা” গল্পে কলহরপুর গ্রামের মহেশ্বরী হাড়িনী কলহ করতে করতে হয়ে গেছে ভীষণ একা। তাকে দেখার লোক নেই, যত্ন করারও লোক নেই। সে কেমন মানুষ তা গল্পের শুরুতেই লেখক বুঝিয়ে দেন।
“কলহরপুরের মহেশ্বরী হাড়িনী তার দক্ষিণদ্বারী ঘরের বারান্দায়, বেলা আন্দাজ দশটার সময়, রৌদ্রে পিঠ দিয়া এবং ছায়ায় পা মেলিয়া বসিয়াছিল। শীতের দিনে রৌদ্রের উত্তাপভোগ আরামপ্রদ। হাতে জুতো এবং কাঁধে বোচকা একটি পথিক দিকভ্রান্তের মতো আসিয়া দাঁড়াইল..দাঁড়াইয়া সে ভুল করিল নিশ্চয় এবং আবারও সে ভুল করিল — মহেশ্বরীকে জিজ্ঞাসা করিল — হ্যাঁ গা, ইষ্টিসানে যাবো কোনদিকে?”
মহেশ্বরী তখন পিঠ চুলকাচ্ছে। পিঠ বরাবর শুকনো, খড়ি উঠছে। লোকটা তাই দেখছে। মহেশ্বরী লোকটার দিকে না তাকিয়েই বলল — “ইশটিসানে যাবে? জানিনে কোনদিকে তোমার ইশটিসান। যমের বাড়ির রাস্তা জানি — যাবে তো একটু বসো — আমার সঙ্গেই যাবে।”
লোকটি বলল — “বাবা, কী কথার কী উত্তর!”
মহেশ্বরী মুখ না ফিরিয়েই বলল — “পালা বলছি হারামজাদা মিনসে। ঝগড়া করতে এসেছিস নাকি?”
মহেশ্বরী নিজের জ্বালায় নিজেই এভাবে ঝগড়া করে বেড়ায়। সবার সাথে। যখন তার স্বামী বেঁচে ছিল তখন স্বামীকে শান্তি দিত না। মহেশ্বরীর একটা হাত অকেজো, ভালো করে কাজ করতে পারতো না। তাতে সে নিজেকে ভাবতো কুশ্রী, স্বামীকে সন্দেহ করত, স্বামীর বাড়ি ফিরতে দেরি হলে কুৎসিত গালাগাল করতো। স্বামীকে সে বসিয়েছিল শূন্যের আসনে। কিন্তু স্বামী যখন মারা গেল সে বুঝতে পারল শূন্যের গুরুত্ব। শূন্য ছাড়া যে কিছুই সম্ভব নয় তার সেই ধারণাটি এলো। মনে হলো তার একটা হাত অকেজো বলে স্বামী তাকে কত সাহায্য করতো। আজ তার পাশে কেউ নেই।
তার এক বোন আছে দূরের গ্রামে। বোনঝি আছে গুঞ্জমালা।
মহেশ্বরী এক বাড়িতে ঠিকে ঝি-র কাজ করে। তাদের কাছে সে সুখদুঃখের কথা বলে। বলে- নিজের মানুষও আজকাল পরের হয়ে গেছে। এক বোন আছে, সে-ও আজকাল খোঁজ খবর করে না। তারপর সে মিথ্যে করেই বোনের সম্পদের ব্যাখ্যানা দেয়। বোনঝি গুঞ্জমালার কথা বলে, বলে বোনঝি দেখতে ভারি সুন্দর। বরটাও দেখতে তেমনই। সবটাই বাড়িয়ে চড়িয়ে বলে। এরমধ্যে খবর এল বোন খুব অসুস্থ, তাকে দেখতে চাইছে। কিন্তু সে যাবে কি করে! এতো রাস্তা সে হাঁটতে পারে না। গরুগাড়ি তাকে নিয়ে যেতে চায় না। ঝগড়া করে করে সে মানুষের সঙ্গ পায় না। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে।
অনেক বলেকয়ে শেষ পর্যন্ত এক গাড়োয়ানের হাতেপায়ে ধরে সে বোনের গাঁয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সেখানে গিয়ে শুনল বোন মারা গেছে, তার দেহটুকুও সে দেখতে পেল না। আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে সে কাঁদল অনেক। বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা ভালো নয়। বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখল বোনের এমন কিছুই ছিল না। তার যেমন, বোনেরও তেমন। জামাইটাও পাপিষ্ঠ, অসুখের সময় একদিনও শাশুড়িকে দেখতে আসে নি।
সে বোনঝি গুঞ্জমালাকে নিয়ে ফিরল। প্রথম কয়েকদিন সে গুঞ্জমালাকে নিয়ে কাজের বাড়িতে গেল। যেমন সুন্দরী বলে সে কাজের বাড়িতে বোনঝির ব্যাখ্যা করেছিল, দেখা গেল সে তেমন কিছু নয়। তবে মাসির সঙ্গে কাজে হাত লাগাল।
মহেশ্বরী আবার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করতো। তার ছোট্ট কুঁড়েঘরটিকে সে গোবর দিয়ে নিকিয়ে গুছিয়েগাছিয়ে রাখতো। এখন সে সেই কাজটি আরও মনোযোগ দিয়ে করতে লাগলো। সে বোনঝিকে বলে –
“ভালো জায়গায় লক্ষ্মী আসেন, নোঙরা জায়গায় তিনি আসেন না। যতই ডাকো তিনি আসবেন না। গোবর দিয়ে নিকিয়ে ঘরদোর উঠোন ঝরঝরে রাখা, দেখবে লক্ষ্মীর ছিরি। তেমনই চাই শোবার জায়গা। পরিষ্কার ধপধপে। ….”
সে গুঞ্জমালার মায়ের রূপোর অলঙ্কার বিক্রি করে গুঞ্জমালার জন্যে দুটি শাড়ি কিনে আনল। একটি টিয়ে রঙের একটি মেরুন রঙের। তিন পয়সা দিয়ে লাল রঙের সাবান কিনে আনল। সে গুঞ্জের চোখের প্রশংসা করে, বোনঝিকে সাজিয়ে গুজিয়ে রাখে। লক্ষ্মী আনার জন্যে সে যে বোনঝিকে মূলধন করে নতুন ব্যবসায়ে লিপ্ত হতে চায় প্রথমে গুঞ্জমালা তা বুঝতে পারে নি। মাসির আদরে যত্নে সে ভাবে এমন মাসি সে যেন জন্ম জন্ম পায়। এদিকে মহেশ্বরী কল্পনা করে তার সব দু:খ ঘুচে গেছে, তাকে আর মানুষের অবহেলা সহ্য করতে হয় না। মহেশ্বরীর মেজাজ এখন বেশ ভালো থাকে। হাসিখুশি, দিব্যি ফুরফুরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহেশ্বরীর ব্যবসার তোড়জোড় গেল ভেঙে, গুঞ্জমালার বর এসে নানা মিথ্যে সাজিয়ে বলে বউকে নিয়ে কাকভোরে পালিয়ে গেল।
জগদীশ গুপ্তের গল্পে এভাবেই অন্ধকার উদঘাটনের ছবি দেখতে পাই। একটা মানুষ, মানবিক প্রবৃত্তি যেখানে উধাও হয়ে গেছে। সে হয়তো সম্পন্ন, হয়তো হতদরিদ্র, হয়তো পঙ্গু, এভাবে মানুষ ছিন্নভিন্ন হয়ে আসে, খন্ড বিখন্ড হয়ে আসে তার গল্পে।
অন্ধকার যেমন আছে, আলোর পথও তেমন আছে। জগদীশ গুপ্ত বেছে নিয়েছেন অন্ধকারের পথ। রবীন্দ্রনাথ এজন্যেই হয়তো বলেছেন জগদীশ গুপ্তের লোকযাত্রার জগতকে তিনি চেনেন না। না চেনারই কথা। কারণ তিনি ছিলেন “আলোর পথযাত্রী”। কিন্তু জীবন যে আলো – অন্ধকারে মেশানো! (সমাপ্ত)
তথ্যসূত্র — জগদীশ গুপ্তের গল্প। সম্পাদনা : সুবীর রায়চৌধুরী।