কেমন ছিল সেকালের কলকাতা, কেমন ছিল তার সংস্কৃতি, শিক্ষাদানের কৌশলই বা কেমন ছিল ? রামতনু লাহিড়ীর জীবনচরিত নির্মাণ-সূত্রে শিবনাথ এসব বিষয় চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন আলোচ্য গ্রন্থে। নিচের উদ্ধৃতি পঞ্চকের মাধ্যমে তৎকালীন কলকাতাকে শিবনাথ যেন আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন :
ক.
ধনী গৃহস্থগণ প্রকাশ্যভাবে বারবিলাসিনীগণের সহিত আমোদ-প্রমোদ করিতে লজ্জা বোধ করিতেন না। তখন উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্য ভারতবর্ষ হইতে এক শ্রেণীর গায়িকা ও নর্তকী সহরে আসিত, তাহারা বাঈজী এই সম্ভ্রান্ত নামে উক্ত হইত। নিজ ভবনে বাঈজীদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া আনা ও তাহাদের নাচ দেওয়া ধনীদের একটা প্রধান গৌরবের বিষয় ছিল। কোন্ ধনী কোন্ প্রসিদ্ধ বাঈজীর জন্য কত সহস্র টাকা ব্যয় করিয়াছেন সেই সংবাদ সহরের ভদ্রলোকদিগের বৈঠকে বৈঠকে ঘুরিত এবং কেহই তাহাকে তত দোষাবহ জ্ঞান করিত না। এমনকি বিদেশিনী ও যবনী কুলটাদিগের সহিত সংসৃষ্ট হওয়া দেশীয় সমাজে প্রাধান্য লাভের একটা প্রধান উপায়স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল। ৮
খ.
এই সময়ে সহরের সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ভদ্র গৃহস্থদিগের গৃহে ‘বাবু’ নামে এক শ্রেণীর মানুষ দেখা দিয়েছিল। তাহারা পারসি ও স্বল্প ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে প্রাচীন ধর্ম্মে আস্থাবিহীন হইয়া ভোগসুখেই দিন কাটাইত। ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিঞ্চিৎ বর্ণনা করিব ? মুখে, ভ্রূপার্শ্বে ও নেত্রকোলে নৈশ অত্যাচারের চিহ্নস্বরূপ কালিমা রেখা, শিরে তরঙ্গায়িত বাউরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে ফিনফিনে কালাপেড়ে ধুতি, অঙ্গে উৎকৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে উত্তমরূপে চুনট করা উড়ানী ও পায়ে পুরু বগল্স সমন্বিত চিনের বাড়ীর জুতা। এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার এসরাজ বীণ প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি হাপ-আকড়াই পাঁচালী প্রভৃতি শুনিয়া, রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত; এবং খড়দহের মেলা ও মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইত। ৯
গ.
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হইতে সহরে হরু ঠাকুর ও তাঁহার চেলা ভোলা ময়দা, নীলু ঠাকুর, নিতাই বৈষ্ণব প্রভৃতি কবিওয়ালাগণ প্রসিদ্ধ হইয়াছিল। যে সময়ের কথা বলিতেছি তখনো সহরে অনেক বিখ্যাত কবিওয়ালা ছিল। ইহাদের লড়াই শুনিবার জন্য সহরের লোক ভাঙ্গিয়া পড়িত। কবিওয়ালাদিগের দলে এক একজন দ্রুতকবি থাকিত; তাহাদিগকে সরকার বা বাঁধনদার বলিত। বাঁধনদারেরা উপস্থিত মত তখনি তখনি গান বাঁধিয়া দিত। বঙ্গের প্রসিদ্ধ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিছুদিন কোনও কবির দলে বাঁধনদারের কাজ করিয়াছিরেন।… সে সময়ে আন্টুনী ফিরিঙ্গী নামে একজন কবিওয়ালা ছিল। আন্টুনী ফরাসডাঙ্গাবাসী একজন ফরাসীর সন্তান; বাল্যকালে কুসঙ্গে পড়িয়া বহিয়া যায়; ক্রমে প্রতিভাবলে কবিওয়ালা হইয়া উঠে। আন্টুনী নিজে একজন দ্রুতকবি ছিল। ১০
ঘ.
…কলিকাতার কতিপয় ভদ্র ইংরাজ-মহিলা সমবেত হইয়া তদানীন্তন গবর্নর জেনেরাল লর্ড আমহার্স্টের পত্নী লেডী আমহার্স্টকে আপনাদের অধিনেত্রী করিয়া স্ত্রীশিক্ষার উন্নতিবিধানার্থ বেঙ্গল লেডীস্ সোসাইটি (Bengal Ladies Society) নামে এক সভা স্থাপন করিলেন। এই সভার মহিলা সভ্যগণের উৎসাহে ও যত্নে নানা স্থানে বালিকা বিদ্যালয় সকল স্থাপিত হইতে লাগিল। অল্পকালের মধ্যেই ইঁহারা সহরের মধ্যস্থলে একটি প্রশস্ত স্কুলগৃহ নির্মাণ করিবার সংকল্প করিলেন। কিছুকাল পরে মহিলাগণ মহাসমারোহে গৃহের ভিত্তিস্থাপন পূবর্বক গৃহনির্ম্মাণে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ গৃহ নির্ম্মাণকার্য্যের সাহায্যার্থে রাজা বৈদ্যনাথ বিংশতি সহস্র মুদ্রা দান করিয়াছিলেন। ইহাতেই প্রমাণ, স্ত্রী-শিক্ষা প্রচলন বিষয়ে মহিলাগণ এদেশীয় অনেক ভদ্রলোকের উৎসাহ ও আনুকূল্য প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। ১১
ঙ.
তখন জলের কল ছিল না, প্রত্যেক ভবনে এক একটি কূপ ও প্রত্যেক পল্লীতে দুই-চারিটি পুষ্করিণী ছিল। এই সকল পচা দুর্গন্ধময় জলপূর্ণ পুষ্করিণীতে কলিকাতা পরিপূর্ণ ছিল।… এই পুষ্করিণীগুলি জলের উৎসস্বরূপ ছিল। এতদ্ভিন্ন গবর্নমেন্ট স্থানে স্থানে কয়েকটি দীর্ঘিকা খনন করিয়াছিলেন, তাহাতে কাহাকেও স্নান করিতে দিতেন না; সেইগুলি লোকের পানার্থ ছিল।… এখনকার ফুটপাতের পরিবর্ত্তে প্রত্যেক রাজপথের পার্শ্বে এক একটি সুবিস্তীর্ণ নর্দ্দমা কর্দ্দম ও পঙ্কে এরূপ পূর্ণ থাকিত যে, একবার একটি ক্ষিপ্ত হস্তী ঐরূপ একটি নর্দ্দমাতে পড়িয়া প্রায় অর্দ্ধেক প্রোথিত হইয়া যায়, অতি কষ্টে তাহাকে তুলিতে হইয়াছিল। এই সকল নর্দ্দমা হইতে যে দুর্গন্ধ উঠিত তাহাকে বর্দ্ধিত ও ঘনীভূত করিবার জন্যই যেন প্রতি গৃহেই পথের পার্শ্বে এক একটি শৌচাগার ছিল। তাহাদের অনেকের মুখ দিনরাত্রি অনাবৃত থাকিত। নাসারন্ধ্র উত্তমরূপে বস্ত্র দ্বারা আবৃত না করিয়া সেই সকল পথ দিয়া চলিতে পারা যাইতো না। মাছি ও মশার উপদ্রবে দিন-রাত্রির মধ্যে কখনই নিরুদ্বেগে বসিয়া কাজ করিতে পারা যাইত না। ১২
— উপরের উদ্ধৃতি পঞ্চকের মাধ্যমে উনিশ শতকের কলকাতা শহরের নানামাত্রিক ছবি পাঠকের চোখের সামনে তুরে ধরেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ‘ক’ সংখ্যক উদ্ধৃতিতে কলকাতাসমাজে বারবণিতাচর্চা কীভাবে জেঁকে বসেছিল তার রূপ অঙ্কিত হয়েছে। ‘খ’ সংখ্যক উদ্ধৃতিতে কলকাতাসমাজে ‘বাবু’দের দুরবস্থা ও বারাঙ্গনাচর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত-লেখক দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায় ইতোপূর্বে লিখেছেন — ‘সন্ধ্যার পর রাত্রি দেড় প্রহর পর্যন্ত বেশ্যালয় লোকে পূর্ণ থাকিত। বিশেষত পবের্বাপলক্ষ্যে সেথায় লোকের স্থান হইয়া উঠিত না। লোকে পূজার রাত্রিতে যেমন প্রতিমা দর্শন করিয়া বেড়াইতেন, বিজয়ার রাত্রিতে তেমনি বেশ্যা দেখিয়া বেড়াইতেন।’ ১৩ এই গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রীর পর্যবেক্ষণ কার্ত্তিকেয়চন্দ্রের পর্যবেক্ষণেরই প্রতিধ্বনি যেন। ‘গ’ সংখ্যক উদ্ধৃতিতে কলকাতার সমাজজীবনে সাংস্কৃতিক অবস্থার দৈন্যের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। অশ্লীল কবিগানের প্রতি সেকালের মানুষ যে কীরূপ আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল, এ অংশ থেকে তা অনুমান করা যায়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় নারীশিক্ষার একটি বিশ্বস্ত চিত্র পাওয়া যায় ‘ঘ’ সংখ্যক উদ্ধৃতি থেকে। কলকাতার পয়ঃপ্রণালি, পানীয় জলের উৎস ইত্যাদি প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে ‘ঙ’ সংখ্যক উদ্ধৃতিতে। শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লেখা এসব চিত্র তৎকালীন কলকাতার একটা সামগ্রিক রূপ পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরে।
রামতনু লাহিড়ীর ব্যক্তিজীবন উপস্থাপন-সূত্রে এই গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী বঙ্গীয় রেনেসাঁসের মৌল বৈশিষ্ট্য এবং পুরোধা ব্যক্তিবর্গের অবদান সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। বাংলার সমাজ-বিবর্তনের ধারায় তাঁর এসব মূল্যায়ন ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে উত্তরকালে স্বীকৃতি লাভ করেছে। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন, রাজকৃষ্ণ সিংহ, মথুরনাথ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, ডেভিড হেয়ার, হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও প্রমুখের অবদান ও ভূমিকা শিবনাথ শাস্ত্রী ঈর্ষণীয় নৈপুণ্যে তুলে ধরেছেন তাঁর গ্রন্থে। নবজাগরণের এসব পুরোধা ব্যক্তির দু-একজন সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রীর মূল্যায়ন এখানে স্মরণ করা যায় :
ক.
রামমোহন রায়
রামমোহন রায় ১৮২৩ সালে লর্ড আমহার্স্টকে যে পত্র লেখেন তাহাকেই এই নবযুগের প্রথম সামরিক শঙ্খধ্বনি মনে করা যাইতে পারে। তিনি যেন স্বদেশবাসীদিগের মুখ পূবর্ব হইতে পশ্চিম দিকে ফিরাইয়া দিলেন। তবে ইহা স্মরণীয় যে, তাঁহাতে যাহা ছিল অপর কোনও নেতাতে তাহা হয় নাই। তিনি নবীনের অভ্যর্থনা করিতে গিয়া প্রাচীন হইতে পা তুলিয়া লন নাই। হিন্দুজাতির কোথায় মহত্ব তিনি তাহা পরিষ্কাররূপে হৃদয়াঙ্গম করিয়াছিলেন এবং তাহা সযত্নে বক্ষে ধারণ করিয়াছিলেন, অথচ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, পাশ্চাত্য নীতি ও পাশ্চাত্য জনহিতৈষণাকে অনুকরণীয় মনে করিয়াছিলেন। ১৪ (ক্রমশ)