ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) // কার্ল মার্কসের পরমাত্মীয়
রক্তের সঙ্গে যার সম্পর্ক আছে, তাকেই আমরা সাধারণত আত্মীয় বলি। ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে মার্কসদের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। না থাকুক, তবু এঙ্গেলস কার্ল মার্কসের পরমাত্মীয়। তিনি মার্কসের সবচেয়ে বড় বন্ধু। বন্ধু কে? রাজদ্বারে, শ্মশানে যে সঙ্গী হয়, সেই বন্ধু। সবচেয়ে বড় বন্ধু তিনি, যিনি দুঃখের ভাগ নিতে পারেন, সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দিতে পারেন। ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস শুধু কার্ল মার্কসের মতাদর্শের সমর্থক ছিলেন না, তিনি অর্থনৈতিকভাবেও নানা সময়ে সাহায্য করেছেন তাঁকে। আবার শুধু কার্ল মার্কস নয়, তাঁর সন্তান-সন্ততিকেও নানাভাবে সাহায্য করেছেন।
প্রাশিয়ার রাইন প্রদেশের বার্মেন শহরে জন্মগ্রহণ করেন এঙ্গেলস। তাঁর বাবা ছিলেন এক কারখানার মালিক। বার্মেনের বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন এঙ্গেলস। ১৮৩৪ সালে ভর্তি হন জিমনাসিয়ামে। উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত না করেই বাবার নির্দেশে এক সওদাগরি অফিসে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। তবে বাণিজ্যিক কাজকর্মের মধ্যেও তিনি বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন।
১৮৪২ সালে তাঁর সঙ্গে ‘রাইনিশে সাইতুং’ পত্রিকার যোগাযোগ হয়। এই সময়ে তিনি ম্যাঞ্চেস্টারে শ্রমিকদের শোচনীয় অবস্থা লক্ষ্য করেন। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরবর্তীকালে তিনি লেখেন ‘ইংল্যাণ্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’ বইটি। ১৮৪৪ সালে প্যারিসে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কার্ল মার্কসের। অবশ্য তার আগে চিঠিপত্রের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে পরোক্ষ যোগাযোগ হয়েছিল। তাঁরা দুজনেই ফরাসি সমাজতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হন। দুই বন্ধু একত্রে লেখেন ‘পবিত্র পরিবার অথবা সমালোচনামূলক সমালোচনার সমালোচনা’। মার্কস ও রুগের ‘জার্মান-ফরাসি পত্রিকায়’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘অর্থশাস্ত্র বিষয়ে সমালোচনামূলক নিবন্ধ’। এতে সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল ঘটনাগুলিকে দেখা হয় ব্যক্তি মালিকানার অনিবার্য পরিণাম হিসেবে।
১৮৪৫ থেকে ১৮৪৭ পর্যন্ত এঙ্গেলস ব্রাসেলস ও প্যারিসে ছিলেন। গুপ্ত জার্মান সমিতি ‘কমিউনিস্ট লিগে’র সঙ্গে কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলসের যোগাযোগ হয়। সমিতির সদস্যদের জন্য সমাজতন্ত্রের মূলনীতি রচনার ভার দেওয়া হয় তাঁদের। এভাবেই জন্ম হয় ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ বা ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে’র। প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালে।
১৮৪৮ সালের যে বিপ্লব প্রথমে শুরু হয়েছিল ফ্রান্সে, তা পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশেও বিস্তৃত হয়। মার্কস-এঙ্গেলস দেশে ফেরেন। প্রাশিয়ার রাইন অঞ্চলে কলোন থেকে প্রকাশিত ‘নয়া রাইনিশে সাইতুং’ পত্রিকার পরিচালনা ভার গ্রহণ করেন তাঁরা। সমস্ত বিপ্লবী–গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টার প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠেন তাঁরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, ‘নয়া রাইনিশে সাইতুং’ নিষিদ্ধ হয়, মার্কসকে দেশান্তরী হতে হয়, এঙ্গেলস সশস্ত্র গণবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন এবং বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পরে তিনি সুইজারল্যাণ্ড হয়ে লণ্ডনে চলে যান।
এঙ্গেলস লণ্ডনে এসে ম্যাঞ্চেস্টারের সেই সওদাগরি অফিসে কেরানির কাজ গ্রহণ করেন। মার্কসের সঙ্গে চিঠিপত্রে তাঁর যোগাযোগ থাকে। ১৮৭০ সালে এঙ্গেলস চলে আসেন লণ্ডনে। মার্কসের কাজে তিনি যেমন সাহায্য করেন, তেমনি নিজেও একের পর এক রচনা করে যান ‘ডুরিং-এর বিরুদ্ধে তর্কমূলক রচনা’, ‘পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উদ্ভব’, ‘লিউদভিগ ফয়েরবাখ’, ‘বাসস্থান সমস্যা’ প্রভৃতি। মার্কসের মৃত্যুর পরে ‘পুঁজি’র ২য় ও ৩য় খণ্ড গুছিয়ে তোলা ও প্রকাশের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সর্বহারার আন্তর্জাতিক ঐক্যের ব্যাপারে তিনি সজাগ ও সক্রিয় ছিলেন। জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের সুবিধাবাদী নীতির সমালোচনা করেছেন, ফরাসি শ্রমিক পার্টিকে সুসংহত করার চেষ্টা করেছেন, ইতালিতে মার্কসবাদের সাফল্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। ১৮৯৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
সমাপ্ত