এটা আনকাট দিচ্ছি। এরকম বর্ণনা কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা ছাড়া আর কোথাও পাব না। টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলাল-এর কিছু বর্ণনা এক কাছাকাছি থাকবে। ১৬৪ বছর পার করেও এই লেখা এতটাই জীবন্ত যে মোহিত হতে হয়।
“দুর্গোৎসব বাঙ্গালা দেশের পরব, উত্তরপশ্চিম প্রদেশে এর নামগন্ধও নাই; বোধ হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দরের আমল হতেই বাঙ্গালায় দুর্গোৎসবের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। পূর্ব্বে রাজা-রাজড়া ও বনেদী বড় মানুষদের বাড়ীতেই কেবল দুর্গোৎসব হত, কিন্তু আজকাল অনেক পুঁটে তেলীকেও প্রতিমা আনতে দেখা যায়; পূৰ্ব্বেকার দুর্গোৎসব ঔএখনকার দুর্গোৎসব অনেক ভিন্ন।
ক্রমে দুর্গোৎসবের দিন সংক্ষেপ হয়ে পড়লো; কৃষ্ণনগরের কারিগরেরা কুমারটুলী ও সিদ্ধেশ্বরীতলা জুড়ে বসে গেল। জায়গায় জায়গায় রং-করা পাটের চুল, তবলকীর মালা, টীন ও পেতলের অসুরের ঢাল-তলওয়ার, নানারঙ্গের ছোবান প্রতিমার কাপড় ঝুলতে লাগলো; দর্জ্জিরা ছেলেদের টুপি, চাপকান ও পেটী নিয়ে দরোজায় দরজায় বেড়াচ্চে; ‘মধু চাই। শাঁকা নেবে গো!’ বোলে ফিরিওয়ালারা ডেকে ডেকে ঘুরছে। ঢাকাই ও শান্তিপুরে কাপুড়ে মহাজন, আতরওয়ালারা ও যাত্রার দালালেরা আহার-নিদ্রে পরিত্যাগ করেচে। কোনখানে কাঁসারীর দোকানে রাশীকৃত মধুপক্কের বাটী, চুমকী ঘটি ও পেতলের থালা ওজন হচ্ছে। ধূপ-ধুনো, বেণে মসলা ও মাখাঘষার একষ্ট্রা দোকান বসে গেছে। কাপড়ে মহাজনেরা দোকানে ডবল পর্দ্দা ফেলেচে; দোকানঘর অন্ধকারপ্রায়, তারি ভিতরে বসে যথার্থ ‘পাই-লাভে’ বউনি হচ্ছে। সিন্দুরচুপড়ী, মোমবাতি, পিঁড়ে ও কুশাসনের অবসর বুঝে দোকানের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার ধারে ‘অ্যাকুডক্টের’ উপর বার দিয়ে বসেচে। বাঙ্গাল ও পাড়াগেঁয়ে চাকরেরা আরসি, ঘুনসি, গিণ্টির গহনা ও বিলাতী মুক্তো একচেটেয় কিনচেন; রবরের জুতো, কনফরটার, ষ্টিক ও ন্যাজওয়ালা পাগড়ী অগুন্তি উঠচে; ঐ সঙ্গে বেলোয়ারি চুড়ী, আঙ্গিয়া, বিলাতী সোনার শীল আংটী ও চুলের গার্ডচেনেরও অসঙ্গত খদ্দের। এত দিন জুতোর দোকান ধূলো ও মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু পূজোর মোর্সমে বিয়ের কনের মত কেঁপে উঠছে, দোকানের কপাটে কাই দিয়ে নানা রকম রঙ্গিণ কাগজ মারা হয়েচে, ভিতরে চেয়ার পাতা, তার নীচে একটুকরা ছেঁড়া কারপেট। সহরে সকল দোকানেরই, শীতকালের কাগের মত চেহারা ফিরেছে। যত দিন ঘুনিয়ে আসছে, ততই বাজারের কেনা-বেচা বাড়চে; কলকেতা তত গরম হয়ে উঠছে। পল্লীগ্রামের টুলো অধ্যাপকেরা বৃত্তি ও বার্ষিক সাধতে বেরিয়েচেন; রাস্তায় রকম রকম তরবেতর চেহারার ভিড় লেগে গেছে।
কোনখানে খুন, কোনখানে দাঙ্গা, কোথায় সিঁধচুরি, কোনখানে ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয়ের কাছ থেকে দু ভরি রূপো গাঁটকাঁটায় কেটে নিয়েছে; কোথাও কোন মাগীর নাক থেকে নথটা ছিঁড়ে নিয়েছে; পাহারাওয়ালারা শশব্যস্ত, পুলিস বদমাইস্ পোরা চোরেরা পূজোর মোর্সমে দেদার কারবার ফালাও কচ্চে। “লাগে তা না লাগে তুক্কো” “কিনি তে হাতী লুটি তো ভাণ্ডার” তাদের জপমন্ত্র হয়েচে; অনেকে পার্ব্বণের পূর্ব্বে শ্রীঘরে ও বাঙ্কুলে বসতি কচ্চে; কারো পুজোয় পাথরে পাঁচ কিল; কারো সৰ্ব্বনাশ। ক্রমে চতুর্থী এসে পড়লো।
এবার অমুক বাবুর নতুন বাড়ীতে পূজার ভারী ধূম! প্রতিপদাদিকল্পের পর ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের বিদায় আরম্ভ হয়েচে, আজও চোকে নাই—ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বাড়ী গিস্গিস্ কচ্চে। বাবু দেড়ফিট উচ্চ গদীর উপর তসর কাপড় পরে বার দিয়ে বসেচেন, দক্ষিণে দেওয়ান টাকা ও সিকি আধুলির তোড়া নিয়ে খাতা খুলে বসেচেন, বামে হবীশ্বর ন্যায়ালঙ্কার সভাপণ্ডিত অনবরত নস্য নিচ্চেন ও নাসা-নিঃসৃত রঙ্গিণ কফজল জাজিমে পুঁচ্চেন। এদিকে জহুরী জড়ওয়া গহনার পুঁটুলী ও ঢাকাই মহাজন ঢাকাই শাড়ীর গাঁট নিয়ে বসেচে। মুন্সি মোশাই, জামাই ও ভাগনেবাবুরা ফর্দ্দ কচ্চেন, সামনে কতকগুলি প্ৰিতিমে-ফেলা দুর্গাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণ, বাইয়ের দালাল, যাত্রার অধিকারী ও গাইয়ে ভিক্ষুক ‘যে আজ্ঞা’ ‘ধৰ্ম্ম অবতার’ প্রভৃতি প্রিয় বাক্যের উপহার দিচ্চেন; বাবু মধ্যে মধ্যে কীরেও এক আধটা আগমনী গাইবার ফরমান কচ্চেন। কেউ খোসগল্প ও অন্য বড়মানুষের নিন্দাবাদ করে বাবুর মনোরঞ্জনের উপক্রমণিকা কচ্চেন–আসল মতলব দ্বৈপায়ন হ্রদে রয়েচে, উপফুক্ত সময়ে তীরস্থ হবে। আতরওয়ালা, তামাকওয়ালা, দানাওয়ালা ও অন্যান্য পাওনাদার মহাজনেরা বাইরের বারাণ্ডায় ঘুরচে, পূজো যায় তথাচ তাদের হিসেব নিকেস হচ্ছে না। সভাপণ্ডিত মহাশয় সরপটে পিরিলীর বাড়ীর বিদেয় নেওয়া বিধবা-বিবাহের দলের এবং বিপক্ষপক্ষের ব্রাহ্মণদের নাম কাটচেন, অনেকে তার পা ছুঁয়ে দিব্বি গালচেন যে, তাঁরা পিরিলীর বাড়ী চেনেন না; বিধবা-বিয়ের সভায় যাওয়া চুলোয় যাক, গত বৎসর শয্যাগত ছিলেন বল্লেই হয়। কিন্তু বানের মুখের জেলেডিঙ্গীর মত তাদের কথা তল্ হয়ে যাচ্চে, নামকাটাদের পরিবর্তে সভাপণ্ডিত আপনার জামাই, ভাগনে, নাত-জামাই, দোত্তুর ও খুড়তুতো ভেয়েদের নাম হাসিল কচ্চেন; এদিকে নামকাটারা বাবু ও সভাপণ্ডিতকে বাপান্ত করে, পৈতে ছিঁড়ে, গালে চড়িয়ে শাপ দিয়ে উঠে যাচ্চেন। অনেকে উমেদারের অনিয়ত হাজরের পর বাবু কাকেও ‘আজ যাও’ ‘কাল এসো’ ‘হবে না’ ‘এবার এই হলো’ প্রভৃতি অনুজ্ঞায় আপ্যায়িত কচ্চেন–হজুরী সরকারের হেক্মত দেখে কে! সকলেই শশব্যস্ত, পূজার ভারী ধূম!
ক্রমে চতুর্থীর অবসান হলো, পঞ্চমী প্রভাত হলেন—ময়ররা দুর্গোমণ্ডা বা আগাতোলা সন্দেশের ওজন দিতে আরম্ভ কল্লে। পাঁঠার রেজিমেণ্টকে রেজিমেণ্ট বাজারে প্যারেড কত্তে লাগলো, গন্ধবেণেরা মসলা ও মাথাঘষা বেঁধে বেঁধে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। আজ সহরের বড় রাস্তায় চলা ভার, মুটেরা প্রিমিয়মে মোট বইচে; দোকানে খদ্দের বসবার স্থান নাই। পঞ্চমী এইরূপে কেটে গেল। আজ ষষ্ঠী; বাজারের শেষ কেনাবেচা, মহাজনের শেষ তাগাদা—আশার শেষ ভরসা। আমাদের বাবুর বাড়ীরও অপূৰ্ব্ব শোভা; সব চাকর-বাকর নতুন তক্মা, উর্দ্দী ও কাপড় পোরে ঘুরে বেড়াচ্চে, দরজার দুই দিকে পূর্ণকুম্ভ ও আম্রসার দেওয়া হয়েচে; ঢুলীরা মধ্যে মধ্যে বোশনচৌকী ও শানাইয়ের সঙ্গে বাজাচ্চে; জামাই ও ভাগনেবাবুরা নতুন জুতো নতুন কাপড় পোরে ফর্রা দিচ্চেন, বাড়ীর কোন বৈঠকখানায় আগমনী গাওয়া হচ্ছে, কোথাও নতুন তাসজোড়া পর্কান হচ্ছে, সমবয়সী ও ভিক্ষুকের ম্যালা লেগেছে, আতরের উমেদাররা বাবুদের কাছে শিশি হাতে করে সাত দিন ঘুরচে; কিন্তু বাবুদের এমনি অনবকাশ যে, দুফোঁটা আতর দানের অবকাশ হচ্ছে না।
এদিকে সহরের বাজারের মোড়ে ও চৌরাস্তায় চুলী ও বাজান্দারের ভিড়ে সেঁধোনো ভার। রাজপথ লোকারণ্য; মালীরা পথের ধারে পদ্ম, চাঁদমালা, বিল্লিপত্র ও কুচো ফুলের দোকান সাজিয়ে বসেচে। দইয়ের ভার, মণ্ডার খুলী ও লুচি কচুরীর ওড়ায় রাস্তা জুড়ে গেছে; রেয়ো ভাট ও আমাদের মত ফলারেরা মিমো করে নিচ্ছে–কোথা যায়?
ষষ্ঠী সন্ধ্যায় শহরের প্রতিমার অধিবাস হয়ে গেল; কিছুক্ষণ পরে ঢোল ঢাকের শব্দ থামলো। পূজো বাড়ীতে ক্ৰমে ‘আন রে, এটা কি হলো,’ কত্তে কত্তে ষষ্ঠীর শর্ব্বরী অবসন্না হলো; সুখতারা মৃদুপবন আশ্রয় করে উদয় হলেন, পাখীর প্রভাত প্রত্যক্ষ করে ক্রমে ক্রমে বাস পরিত্যাগ কত্তে আরম্ভ কল্লে; সেই সঙ্গে সহরের চারিদিকে বাজনা-বাদ্দি বেজে উঠলো, নবপত্রিকা স্নানের জন্য কর্ম্মকর্ত্তারা শশব্যস্ত হলেন—ভাবুকের ভাবনায় বোধ হতে লাগলো যেন সপ্তমী কোরমাকান নতুন কাপড় পরিধান করে হাসতে হাসতে উপস্থিত হলেন। এদিকে সহরের সকল কলাবউয়ের বাজনা-বাদ্দি করে, স্নান কত্তে বেরুলেন, বাড়ীর ছেলেরা কাঁসর ও ঘড়ী বাজাতে বাজাতে সঙ্গে সঙ্গে চল্লে : এদিকে বা কলাবউয়েরাও স্নানের সরঞ্জামে বেরুলো; আগে আগে কাড়া, নাগরী, ঢোল ও সানাইদারেরা বাজাতে বাজাতে চল্লো; তার পেছনে নতুন কাপড় পোরে আশাশোঁটা হাড়ে বাড়ীর দরোয়ালেরা; তার পশ্চাৎ কলাবউ কোলে পুরোহিত, পুঁথি হাতে তন্ত্রধারক, বাড়ীর আচার্য্য বামন, গুরু ও সভাপণ্ডিত; তার পশ্চাৎ বাবু। বাবুর মস্তকে লাল সাটিনের রূপোর রামছাতা ধরেচে! আশে-পাশে ভাগনে, ভাইপো ও জামাইয়েরা; পশ্চাৎ আমলা ফয়লা ও ঘরজামাইয়ে ভগিনীপতিরা, মোসাহেব ও বাভে চলে তার শেষে নৈবিদ্ধ, লাণ্টন ও পুষ্পপত্রি, শখ, ঘণ্টা ও কুশাসন প্রভৃতি পূজোর সরঞ্জাম মাথায় মালী। এই সকল সরঞ্জামে প্রসন্নকুমার ঠাকুর বাবুর ঘাটে কলাবউ নাওয়াতে চড়েন; ক্রমে ঘাটে পৌঁছিলে কলাবউয়ের পূজো ও আনের অবকাশে হুজুরও গঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করে নিয়ে, শুব পাঠ কত্তে কত্তে অনুরূপ বাজনা-বাৰ্দির সঙ্গে বাড়ীমুখো হলেন। পাঠকবর্গ! এ সহরে আজকাল দু-চার এজকেটেড ইয়ংবেঙ্গলও পৌত্তলিকতার দাস হয়ে, পূজো-আচ্ছা করে থাকেন; ব্রাহ্মণভোজনের বদলে কতকগুলি দিলদোস্ত মদে ভাতে প্রসাদ পান; আলাপি ফিমেল ফ্রেণ্ডেরাও নিমন্ত্রিত হয়ে থাকেন। পূজোরো কিছু রিফাইণ্ড কেতা। কারণ, অপর হিন্দুদের বাড়ী নিমন্ত্রিত প্রদত্ত প্রণামী টাকা পুরোহিত-ব্রাহ্মণেরই প্রাপ্য; কিন্তু এদের বাড়ী প্রণামীর টাকা বাবুর অ্যাকাউন্টে ব্যাঙ্কে জমা হয়, প্রতিমের সামনে বিলাতী চরবীর বাতী জ্বলে ও পূজোর দালানে জুতা নিয়ে ওঠবার এলাওয়েন্স থাকে। বিলেত থেকে অর্ডার দিয়ে সাজ আনিয়ে প্রতিমে সাজান হয়–মা দুর্গা মুকুটের পরিবর্তে বনেট পরেন, স্যাণ্ডউইচের শেতল খান, আর কলাবউ গঙ্গাজলের পরিবর্তে কাৎলীকরা গরম জলে স্নান করে থাকেন। শেষে সেই প্রসাদী গরম জলে কর্ম্মকর্ত্তার প্রাতরাশের টী ও কফি প্রস্তুত হয়।
ক্রমে তাবৎ কলাবউয়েরা স্নান করে ঘরে ঢুকলেন। এদিকে পূজো ও আরম্ভ হলো, চণ্ডীমণ্ডপে বারকোসের উপর আগাতোলা মোণ্ডাওয়ালা নৈবিদ্দ সাজান হলো। সঙ্গতি বুঝে চেলীর সাড়ী, চিনির থাল, ঘড়া, চুমকী ঘটী ও সোণার লোহা; নয় ত কোথাও সন্দেশের পরিবর্তে গুড় ও মধুপর্কের বাটীর বদলে থুরী ব্যবস্থা। ক্রমে পূজো শেষ হলো, ভক্তেরা এতক্ষণ অনাহারে থেকে পূজোর শেষে প্রতিমারে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। বাড়ীর গিন্নীরা চণ্ডী শুনে জল খেতে গেলেন, কারো বা নবরাত্রি। আমাদের বাবুর বাড়ীর পূজোও শেষ হলো প্রায়, বলিদানের উদযোগ হচ্ছে; বাবু মায় ষ্টাফ আদুড় গায়ে উঠানে দাঁড়িয়েচেন, কামার কোমর বেঁধে প্রতিমের কাছে থেকে পূজো ও প্রতিষ্ঠা করা খাড়া নিয়ে, কাণে আশীৰ্ব্বাদী ফুল গুঁজে, হাড়কাঠের কাছে উপস্থিত হলো, পাশ থেকে একজন মোসাহেব ‘খুঁটি ছাড়!’ ‘খুঁটি ছাড়!’ বোলে চেঁচিয়ে উঠলেন; গঙ্গাজলের ছড়া দিয়ে পাঠাকে হাড়কাঠে পুরে দিয়ে, খিল এঁটে দেওয়া হলো; একজন পাঠার মুড়ি ও আর একজন ধড়টা টেনে ধল্লে, অমনি কামার “জয় মা! মাগো!” বোলে কোপ তুল্লে; বাবুরাও সেই সঙ্গে “জয় মা! মাগো!” বলে, এতিমের দিকে ফিরে চেঁচাতে লাগলেন, দুপ্ করে কোপ পড়ে গেল—গীজা গীজা গীজা গীজা, নাক টুপ টুপ টুপ, গীজা গীজা গীজা গীজা নাক টুপ টুপ টুপ শব্দে ঢোল, কাড়ানাগর ও ট্যামটেমী বেজে উঠলো; কামার সরাতে সমাংস করে দিলে, পাঁঠার মুড়ির মুখ চেপে ধরে দালানে পাঠানো হলো, এদিকে একজন মোসাহেব সন্তর্পণে খর্পবের সরা আচ্ছাদিত করে প্রতিমের সম্মুখে উপস্থিত কল্লে। বাবুরা বাজনার তরঙ্গের মধ্যে হাততালি দিতে দিতে, ধীরে ধীরে চণ্ডীমণ্ডপে উঠলেন। প্রতিমার সামনে দানের সামগ্রী ও প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হলে আরতি আরম্ভ হলো; বাবু স্বহস্তে ধবল গঙ্গাজল-চামর বীজন কত্তে লাগলেন, ধূপ-ধূনোর ধোঁয়ে বাড়ী অন্ধকার হয়ে গেল। এইরূপ আধঘণ্টা আরতির পর শাঁক বেজে উঠলো—সবাবু সকলে ভুমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে বৈঠকখানায় গেলেন। এদিকে দালানে বামুনেরা নৈবিদ্দ নিয়ে কাড়াকাড়ি কত্তে লাগলো। দেখতে দেখতে সপ্তমী পূজো ফুরালো! ক্রমে নৈবিদ-বিলি, কাঙ্গালীবিদায় ও জলপান বিলানোতেই সে দিনের অবশিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেল; বৈকালে চণ্ডীর গানওয়ালারা খানিকক্ষণ আসর জাগিয়ে বিদায় হলো-জঙ্গী স্যাকরা চণ্ডী গানের প্রকৃত ওস্তাদ ছিল। সে মরে যাওয়াতেই আর চণ্ডীর গানের প্রকৃত গায়ক নাই; বিশেষতঃ এক্ষণে শ্রোতাও অতি দুর্লভ হয়েচে।
ক্রমে ছটা বাজলো, দালানের গ্যাসের ঝাড় জেলে দিয়ে প্রতিমার আরতি করে দেওয়া হলো এবং মা দুর্গার শেতলের জলপান ও অন্যান্য সরঞ্জামও সেই সময়ে দালানে সাজিয়ে দেওয়া হলো-মা দুর্গা যত খান বা না থান, লোকে দেখে প্রশংসা কল্লেই বাবুর দশ টাকা খরচের সার্থকতা হবে। এদিকে সন্ধ্যার সঙ্গে দর্শকের ভিড় বাড়তে লাগলো। বাঙ্গাল দোকানদার, ঘুস্কী ও কসবী, ক্ষুদ ক্ষু. ছেলে ও আইসি ছোঁড়া সঙ্গে খাতায় খাতায় প্রতিমে দেখতে আসতে লাগলো। এদিকে নিমন্ত্রিত লোকেরা সেজেগুঁজে এসে টন্যাৎ করে একটা টাকা ফেলে দিয়ে প্রণাম কল্লে, অমনি পুরুত একছড়া ফুলের মালা নেমন্তুন্নের গলায় দিয়ে টাকাটা কুড়িয়ে ট্যাঁকে খুঁজলেন, নেমন্তন্নও হন্ হন্ করে চলে গেলেন। কলকেতা সহরে এই একটি বড় আজগুবি কেতা, অনেকস্থলে নিমন্ত্রিতে ও কর্ম্ম কর্ত্তায় চোরে কামারের মত সাক্ষাৎও হয় না, কোথাও পুরোহিত বলে দেন, “বাবুরা ওপরে; ঐ সিঁড়ি মশাহ যান না। কিন্তু নিমন্ত্রিত যেন চিরপ্রচলিত রীতি অনুসারেই “আজ্ঞে না, আরো পাঁচ জায়গায় যেতে হবে, থাক” বলে টাকাটি দিয়েই অমনি গাড়ীতে ওঠেন; কোথাও যদি কর্ম্মকর্ত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তবে গিরগিটির মত উভয়ে একবার ঘাড় নাড়ানাড়ি মাত্র হয়ে থাকে—সন্দেশ মেঠাই চুলোয় যাক, পান তামাক মাথায় থাক, প্রায় সর্ব্বত্রই সাদর-সম্ভাষণেরও বিলক্ষণ অপ্রতুল; দুই এক জায়গায় কর্ম্মকর্ত্তা জরির মহল পেতে, সামনে আতরদান, গোলাবপাস সাজিয়ে, পয়সার দোকানের পোদ্দারের মত বসে থাকে। কোন বাড়ীর বৈঠকখানায় চোহেলের রৈ রৈ ও হৈচৈয়ের তুফানে নেমন্তুন্নেদের সেঁদুতে ভরসা হয় না-পাছে কর্ম্মকর্ত্তা তেড়ে কামড়ান। কোথায় দরজা বন্ধ, বৈঠকথানা অন্ধকার, হয় ত বাবু ঘুমুচ্ছেন, নয় বেরিয়ে গেছেন। দালানে জনমানব নাই, নেমনে কার সম্মুখে যে প্রণামী টাকাটি লেবন ও কি করবেন, তা ভেবে স্থির করতে পারেন না; কর্ম্মকর্ত্তার ব্যাভার দেখে এতিমে পর্য্যন্ত অপ্রস্তুত হন, অথচ এ রকম নেমন্তন্ন না কল্লেই নয়। এই দরুণ অনেক ভদ্দরলোক আজকাল আর ‘সামাজিক’ নেমন্তন্নে স্বয়ং যান না, ভাগ্নে বা ছেলেপুলের দ্বারাতেই ক্রিয়েবাড়ীর পুরুতের প্রাপ্য কিম্বা বাবুদের ওৎকরা টাকাটি পাঠিয়ে দেন; কিন্তু আমাদের ছেলেপুলে না থাকায় স্বয়ং গমনে অসমর্থ হওয়ায়। স্থির করেছি, এবার অবধি প্রণামীর টাকার পোষ্টেজ ষ্ট্যাম্প কিনে ডাকে পাঠিয়ে দেব; তেন তেমন আত্মীয়স্থলে (সেফ এরাইভ্যালের জন্য) রেজেষ্টরী করে পাঠান যাবে; যে প্রকারে হোক, টাকাটি পৌঁছান নে বিষয়। অধ্যাপক ভায়ারা এ বিষয়ে অনেক সুবিধা করে দিয়েছেন, পূজো ফুরিয়ে গেলে তাঁরা প্রণামীর টাকাটি আদায় কত্তে স্বয়ং ক্লেশ নিয়ে থাকেন; নেমন্তন্নের পূর্ব্ব হতে পূজোর শেষে তাদের আত্মীয়তা আরও বৃদ্ধি হয়; অনেকের প্রণামী চাইতে আসাই পূজোর প্রুফ।
মনে করুন, আমাদের বাবু বনেদী বড়মানুষ; চাল স্বতন্তর, আরতির পর বেনারসী জোড় পরে সভাসদ সঙ্গে নিয়ে দালানে বার দিলেন; অমনি তক্মপরা বাঁকা দরওয়ানেরা তলওয়ার খুলে পাহারা দিতে লাগলো; হরকরা, হুঁকোবরদার, বিবির বাড়ীর বেহারা মোসাহেবের ঘোড়হস্ত হয়ে দাঁড়ালো, কখন কি ফরমাস হয়! বাবুর সামনে একটা সোণার অলিধোলা, ডাইনে একটা পান্না বসান সি, বায়ে একটা হীরে বসান টোপদার গুড়গুড়ি ও পেছনে একটা মুক্তো বসান পেঁচুয়া পড়লে : বার আঁস্তা কুড়ের কুকুরের মত ইচ্ছা অনুসারে আশে পাশে মুখ দিচ্চেন ও আড়ে আড়ে সামনে বাজেলকর ভিড়ের দিকে দেখচেন-লোক কোনটার কারিগরীর প্রশংসা কচ্চে; যে রকমে হোক লোককে দেখান চাই যে, বাবুর রূপো, সোণার জিনিষ অঢেল, এমন কিছু বসাবার স্থান থাকলে আরও দুটো ফুরসি বা গুড়গুড়ি দেখান যেতো। ক্রমে অনেক অনেক অনাহুত ও নিমন্ত্রিত জড় হতে লাগলেন, বাজে তোকে চু প পুরে গেল, জুতোচোরে সেই লাঙ্গা-তলোয়ারের পাহারার ভিতর থেকেও দুকু জুতো সহিতে কেলে। কচ্ছ জলে থেকেও ডাঙ্গা ডিমে প্রতি যেমন মন রাখে, সেইরূপ অনেকে মনে হলে বাবুর সঙ্গে কথাবার্ত্তার মধ্যেও আপনার জুতোর ওপোরও নজর রেখেছিলেন। কিন্তু উঠবার দেখেন যে, জুতোরাম ভাঙ্গা ডিমের খোলার মত হয় ত একপাটী ছেঁড়া চটি পড়ে আছে।
এদিকে দেখতে দেখতে গুড়ুম করে নটার তোপ পড়ে গেল; ছেলেরা ‘ব্যোমকালী কলকেত্তাওয়ালী’ বোলে চেঁচিয়ে উঠলো। বাবুর বাড়ীর নাচ, সুতরাং বাবু আর অধিকক্ষণ দালানে বোসতে পাল্লেন না, বৈঠকখানায় কাপড় ছাড়তে গেলেন, এদিকে উঠানের সমস্ত গ্যাস জ্বেলে দিয়ে মজলিসের উদ্যোগ হতে লাগলো, ভাগ্নেরা ট্যাসল দেওয়া টুপী ও পেটী পোরে ফোপরদালালী কত্তে লাগলেন। এদিকে দুই-এক জন নাচের মজলিসি নেমন্তন্নে আসতে লাগলেন। মজলিসে তরফা নাবিয়ে নেওয়া হলো। বাবু জরি ও কালাবং এবং নানাবিধ জড়ওয়া গহনায় ভূষিত হয়ে, ঠিক একটি ‘ইজিপশন মমী সেজে’ মজলিসে বাস দিলেন—বাই, সারঙ্গের সঙ্গে গান করে, সভাস্থ সমস্তকে মোহিত কত্তে লাগলেন।
নেমন্তন্নেরা নাচ দেখতে থাকুন, বাবু ফর্রা দিন ও লাল চোখে রাজা উজীর মারুন–পাঠকবর্গ একবার সহরটার শোভা দেখুন, প্রায় সকল বাড়ীতেই নানা প্রকার রং-তামাসা আরম্ভ হয়েচে। লোকেরা খাতায় পাতায় বাড়ী বাড়ী পূজো দেখে বেড়াচ্চে। রাস্তায় বেজায় ভিড়! মারওয়াড়ী খোট্টার পাল, মাগীর খাতা ও ইয়ারের দলে রাস্তা পুরে গেচে। নেমন্তন্নের হাতলণ্ঠনওয়ালা, বড় বড় গাড়ীর সইসেরা প্রলয় শব্দে পইস পইস কচ্চে, অথচ গাড়ী চালাবার বড় বেগতিক। কোথায় সখের কবি হচ্চে; ঢোলের চাটী ও গাওর চীৎকারে নিদ্রাদেবী সে পাড়া থেকে ছুটে পালিয়েছেন; গানের তানে ঘুমন্তো ছেলেরা মার কোলে ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছে। কোথাও পাঁচালি আরম্ভ হয়েচে, বওয়াটে পিলইয়ার ছোকরারা ভরপুর নেশায় ভো হয়ে ছড়া কাটচেন ও আপনা আপনি বাহবা দিচ্চেন; রাত্রিশেষে শ্রাদ্ধ গড়াবে, অবশেষে পুলিসে দাক্ষিণা দেবে। কোথাও যাত্রা হচ্চে, মণিগোঁসাই সং এসেচে ছেলেরা মণিগোঁসাইয়ের রসিকতায় আহ্লাদে আটখানা হচ্ছে; আশে পাশে চিকের ভিতর মেয়েরা উঁকি মাচ্চে, মজলিসে রামমসাল জ্বলচে; বাজে দশর্কদের বাযুক্রিয়ায় ও মসালের দুর্গন্ধে পূজাবাড়ী তিষ্ঠান ভার! ধুপ-ধুনার গন্ধও হার মেনেচে। কোনখানে পূজোবাড়ীর বাবুরাই খোদ মজলিস রেখেচেন–বৈঠকখানায় পাঁচো ইয়ার জুটে নেউল নাচানো, ব্যাং নাপানো, খ্যামটা ও বিদ্যাসুন্দর আরম্ভ করেচেন; এক একবারের হাসির গর্রায়, শিয়াল ডাকে ও মদন আগুনের তানে–দালনে ভগবতী ভয়ে কাঁপচেন, সিঙ্গি চোরকে কামড়ান পরিত্যাগ করে, ন্যাজ গুটিয়ে পলাবার পথ দেখচে, লক্ষ্মী সরস্বতী শশব্যস্ত। এদিকে সহরের সকল রাস্তাতেই লোকের ভিড়, সকল বাড়ীই আলোময়।
এই প্রকার সপ্তমী, অষ্টমী ও সন্ধিপূজো কেটে গেল; আজ নবমী, আজ পূজোর শেষ দিন। এত দিন লোকের মনে যে আহ্লাদটি জোয়ারের জলের মত বাড়তেছিল, আজ সেইটির একেবারে সারভাটা।
আজ কোথাও ভেড়া, মোষ, কোথাও নব্বইটা পাঁটা, সুপারি আখ, কুমড়ো, মাগুরমাছ ও মরীচ বলিদান হয়েচে; কর্ম্মকর্ত্তা পাত্র টেনে পাঁচোইয়ারে জুটে নবমী গাচ্চেন ও কাদামাটী কচ্চেন; ঢুলীর ঢেলে সঙ্গত হচ্ছে, উঠানে লোকারণ্য, উপর থেকে বাড়ীর মেয়েরা উঁকি মেরে নবমী দেখছেন। কোথাও হোমের ধুমে বাড়ী অন্ধকার হয়ে গেছে; কার সাধ্য প্রবেশ করে-কাঙ্গালী, রেয়োভাট ও ভিক্ষুকের পূজোবাড়ী ঢোকা দূরে থাকুক, দরজা হতে মশাগুলো পর্য্যন্ত ফিরে যাচ্চে। ক্রমে দেখতে দেখতে দিনমণি অস্ত গ্যালেন, পূজোর আমোদ প্রায় সম্বৎসরের মত ফুরালো! ভোরাও ওক্তে ভয়রো রাগিণীতে অনেক বাড়ীতে বিজ্ঞয়া গাওনা হলো; ভক্তের চক্ষে ভগবতীর প্রতিমা পরদিন প্রাতে মলিন মলিন বোধ হতে লাগলো, শেষে বিসর্জ্জনের সমারোহ শুরু হলো—আজ নিরঞ্জন।
ক্রমে দেখতে দেখতে দশটা বেজে গেল; দইকড়মা ভোগ দিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হলো; আরতির পর বিসর্জ্জনের বাজনা বেজে উঠলো। বামুনবাড়ীর প্রতিমারা সকলেই জলসই। বড়মানুষ ও বাজে জাতির প্রতিমা পুলিসের পাশ মত বাজনা বাদ্দির সঙ্গে বিলৰ্জন হবেন—এ দিকে এ কাজে সে কাজে গির্জ্জার ঘড়ীতে টুং টাং টুং টাং করে বারটা বেজে গেল; সূর্য্যের মৃদুতপ্ত উত্তাপে সহর নিমকি রকম গরম হয়ে উঠলো; এলোমেলো হাওয়ায় রাস্তার ধুলো ও কাঁকর উড়ে অন্ধকার করে তুল্লে। বেকার কুকুরগুলো–দোকানের পাটাতনের নীচে ও খানার ধারে শুয়ে জীব বাহির করে হাঁপাচ্চে, বোঝাই গাড়ীর গরুগুলোর মুখ দে ফ্যানা পড়চে-গাড়োয়ান ভয়ানক চীৎকারে “শালার গরু চলে না” বলে ন্যাজ মোলচে ও পাচলবাড়ি মাচ্চে; কিন্তু গরুর চাল বেগড়াচ্চে না, বোঝাইয়ের ভরে চাকাগুলি কোঁ কোঁ শব্দে রাস্তা মাতিয়ে চলেছে। চড়াই ও কাকগুলো বারান্দা আলম্বে ও নলের নীচে চক্ষু মুদে বসে আছে। ফিরিওয়ালারা ক্রমে ঘরে ফিরে যাচ্চে; রিপুকৰ্ম্ম ও পরামাণিকেরা অনেকক্ষণ হলো ফিরেচে; আলু পটোল! ঘি চাই! ও তামাকওয়ালারা কিছুক্ষণ হলো ফিরে গেছে। ঘোল চাই! মাখন চাই! ভয়সা দই চাই! ও মালাই-দইওয়ালারা কড়ি ও পয়সা গুণতে গুণতে ফিরে যাচ্চে। এখন কেবল মধ্যে মধ্যে পানিফল! কাগোজ বদল! পেয়ালা পিরিচ! ফিরিওয়ালাদের ডাক শোনা যাচ্চে–নৈবিদ্দি-মাথায় পূজোবাড়ীর লোক, পুজুরী বামুন, পটো বাজন্দার ভিন্ন রাস্তায় বাজে লোক নাই, গুপুস করে একটার তোপ পড়ে গেল। ক্রমে অনেক স্থলে ধুমধামে বিসর্জ্জনের উদযোগ হতে লাগলো।
হায়! পৌত্তলিকতা কি শুভ দিনেই এ স্থলে পদার্পণ করেছিল। এতে দেখে শুনে, মনে স্থির জেনেও আমরা তারে পরিত্যাগ কত্তে কত কষ্ট ও অসুবিধা বোধ কচ্চি; ছেলেবেলা যে পুতুল নিয়ে খেলাঘর পেতেছি, বৌ বৌ খেলেছি ও ছেলে-মেয়ের বে দিয়েছি, আবার বড় হয়ে সেই পুতুলকে পরমেশ্বর বলে পুজো কচ্চি, তার পদার্পণে পুলকিত হচ্চি ও তার বিসর্জ্জনে শোকের সীমা থাকচে না–শুধু আমরা কেন, কত কত কৃতবিদ্য বাঙ্গালী সংসারের ও জগদীশ্বরের সমস্ত তত্ত্ব অবগত থেকেও, হয় ত সমাজ, না হয় পরিবার পরিজনের অনুরোধে, পুতুল পুজে আমোদ প্রকাশ করেন, বিসর্জ্জনের সময় কাঁদেন ও কাদা রক্ত মেখে কোলাকুলি করেন; কিন্তু নাস্তিকতায় নাম লিখিয়ে বনে বসে থাকাও ভাল, তবু “জগদীশ্বর একমাত্ৰ” এটি জেনে আবার পুতুলপূজায় আমোদ প্রকাশ করা উচিত নয়।
ক্রমে সহরের বড় রাস্তা চৌমাথা লোকারণ্য হয়ে উঠলো, বেশ্যালয়ের বারাণ্ডা আলাপীতে পূরে গেল; ইংরাজী বাজনা, নিশেন, তুরুকসোয়ার ও সার্জ্জন সঙ্গে প্রতিমার রাস্তায় বাহার দিয়ে বেড়াতে লাগলেন–তখন ‘কার প্রতিমা উত্তম’ ‘কার সাজ ভাল’ ‘কার সরঞ্জাম সরেস’ প্রভৃতির প্রশংসারই প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু হায়! ‘কার ভক্তি সরেস’ কেউ সে বিষয়ের অনুসন্ধান করে না–কর্ম্মকর্ত্তাও তার জন্য বড় কেয়ার করেন না! এদিকে প্রসন্নকুমার বাবুর ঘাট ভদ্দরলোক গোচের দর্শক, ক্ষুদে ক্ষুদে পোষাক পরা ছেলে, মেয়ে ও ইস্কুলবয়ে ভরেরে গেল। কর্ম্মকর্ত্তারা কেউ কেউ প্রতিমে নিয়ে বাচখেলিয়ে বেড়াতে লাগলেন—আমুদে মিনষেরা ও ছোঁড়ারা নৌকার ওপর ঢোলের সঙ্গতে নাচতে লাগলো, সৌখীন বাবুরা খ্যামটা ও বাই সঙ্গে করে বোট, পিনেস ও বজরার ছাতে বার দিয়ে বসলেন—মোসাহেব ও ওস্তাদ চাকরেরা কবির সুরে দু-একটা রংদার গান গাইতে লাগলো।
গান
“বিদায় হও মা ভগবতি। এ সহরে এসো নাকো আর।
দিনে দিনে কলিকাতার মর্ম্ম দেখি চমৎকার।।
জষ্টিসেরা ধৰ্ম্ম-অবতার, কায়মনে কচ্চেন সুবিচার।
এদিকে বুলোর তরে রাজপথেতে চেঁচিয়ে চেয়ে চলা ভার।।
পথে হাগা মোতা চলবে না, লহরের জল তুলতে মানা,
লাইসেন্সটেক্স মাথটচাঁদা, পাইখানায় বাসি ময়লা রবে না।
হেলথ অফিসর, সেতখানার মেজেষ্টর, ইনকমের আসেসর সাল্লে সবারে।
আবার গবর্ণরের গুয়ে দষ্টি, সৃষ্টিছাড়া ব্যবহার।
অসহ্য হতেছে মাগো! অসাধ্য বাস করা আর।।
এই জীয়ন্তে এই ত জ্বালা মাগো!—মলেও শান্তি পাবে না,
মুখাগ্নির দফা রফা কলেতে করবে সৎকার।
হুতোমদাস তাই সহর ছেড়ে আসমানে করেন বিহার॥”
এ দিকে দেখতে দেখতে দিনমণি যেন সম্বৎসরের পূজোর আমোদর সঙ্গে অস্ত গেল। সন্ধ্যাবধূ বিচ্ছেদ-বসন পরিধান করে দেখা দিলেন। কর্ম্মকর্ত্তারা প্রতিমা নিরঞ্জন করে, নীলকণ্ঠ শঙ্খচিল উড়িয়ে ‘দাদা গো দিদি গো’ বাজনার সঙ্গে ঘট নিয়ে ঘরমুখো হলেন। বাড়ীতে পৌঁছে চণ্ডীমণ্ডপে পূর্ণঘটকে প্রণাম করে শান্তিজল নিলেন; পরে কাঁচাহলুদ ও ঘটজল খেয়ে পরস্পর কোলাকুলি কল্লেন। অবশেষে কলাপাতে দুর্গানাম লিখে সিদ্ধি খেয়ে বিজয়ার উপসংহার হলো। ক’দিন মহাসমারোহের পর আজ সহরটা খাঁ খাঁ কত্তে লাগলো—পৌত্তলিকের মন বড়ই উদাস হলো, কারণ, যখন লোকের সুখের দিন থাকে, তখন সেটির তত অনুভব কত্তে পারা যায় না, যত সেই সুখের মহিমা, দুঃখের দিনে বোঝা যায়।”