শুক্রবার | ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:১৫
Logo
এই মুহূর্তে ::
নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (ষষ্ঠ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (পঞ্চম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (চতুর্থ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার শতবর্ষে সঙ্গীতের ‘জাদুকর’ সলিল চৌধুরী : সন্দীপন বিশ্বাস সাজানো বাগান, প্রায় পঞ্চাশ : অমর মিত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (তৃতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (একাদশ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার খাদ্যদ্রব্যের লাগামছাড়া দামে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের : তপন মল্লিক চৌধুরী মিয়ানমারের সীমান্ত ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (দ্বিতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দশম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ-র ছোটগল্প ‘পহেলি পেয়ার’ ‘দক্ষিণী’ সংবর্ধনা জানাল সাইকেলদাদা ক্যানসারজয়ীকে : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (প্রথম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (নবম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘তোমার নাম’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (অষ্টম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘হাওয়া-বদল’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার প্রবোধিনী একাদশী ও হলদিয়ায় ইসকন মন্দির : রিঙ্কি সামন্ত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার শুদ্ধতম প্রতিনিধি অন্নপূর্ণা খাঁ : আবদুশ শাকুর নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘শুভ লাভ’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বদলে যাওয়ার অসুখ : বিষ্ণু সরকার

বিষ্ণু সরকার / ১৫২ জন পড়েছেন
আপডেট রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৪

আজ বেশ ভোরে ঘুম ভেঙেছে। উঠে দেখি গত রাতের বিছানায় লেগে থাকা ঘুম, অনেকগুলি দুঃস্বপ্ন আর মোবাইল স্ক্রিন থেকে ছড়িয়ে পড়া আলোরা সব কখন মুছে গেছে। দীর্ঘ রাত পেরিয়ে এই সকাল। সময়টা খানিক বিশ্রামেরও। আর ভুলে যাওয়ার। গত দিনের সবকিছু ভুলে আজ আবার নতুন করে একটা দিন শুরু করতে যাচ্ছি।

আসলে সারাটা দিন কত যে কাজ থাকে। কত ফোন কল। কত মানুষকে হ্যান্ডেল করা। দিনের শেষে নিজের জন্য শুধু তো এইটুকু। ঘুম। কদিন ধরে তাও নেই। চোখের সামনে শুধু মোবাইল স্ক্রিনের আলো আর একটার পর একটা দৃশ্যকে পাল্টে ফেলার নেশা। কেন জানি এছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না এখন। সারাদিন কত কত মানুষকে সামলে যখন নিজের কাছে ফিরি, একমাত্র এই যন্ত্রটাকেই বড় আপন মনে হয়।

আগে অবশ্য এমনটা ছিলাম না। তখন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বুক সেলফ থেকে পছন্দের বইটা টেনে নিতাম। পড়তে পড়তে কেমন আচ্ছন্ন জড়িয়ে নিত চোখ। কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখতাম মাথার পাশে রেখে দেওয়া বই। না পড়া পৃষ্ঠাগুলি কেমন উড়ে বেড়াচ্ছে। আমার ঘর, দেওয়াল জুড়ে এখনও সেই পুরনো বুক সেলফ, পছন্দের বই, সেই সব শব্দেরা নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে। অথচ এদের দেখলে আমার কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে এখন। বমি পায়। বড় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ার আগে তবু একবার চোখ ফেরাই। দেখতে পাই আমার চারপাশে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ, কত রঙের আলো। সেই আলোয় ভেসে বেড়ানো সব দৃশ্যেরা। একসময় আমাকেও হাত ধরে টেনে নেয়। কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ভাসতে ভাসতে আমিও তখন অন্য মানুষ। তারপর শুধুই ঘুম, শান্তির ঘুম।

কখন যে ঘুমিয়ে যাই। আর কখন যে বদলে যায় সেই সব দৃশ্যেরা। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাইরে এক নতুন সকাল। সবকিছু মুছে দিয়ে ফের নতুন করে শুরু করি আবার।

অভ্যেস মত তাকিয়ে দেখি সকালটা মন্দ না। বাইরের নরম আলো, দু-একটা পাখির ডাক আর বাতাসের ভরপুর অক্সিজেন নিয়ে বেশ একটা তরতাজা ভাব। আমি যে জায়গাটায় থাকি, মানে শহরের এই দক্ষিণের দিকটায়, এদিকটায় এখনও কিছুটা সবুজ। এখনও কিছুটা না কেটে ফেলা গাছপালা। সঙ্গে একটা লেক। সেই লেককে ঘিরে সকাল-বিকেল নানা জনের পরিক্রমা। তাদের পায়ের শব্দ। চলাফেরা। সেই পায়ের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যাওয়া আরও কত পা। শব্দগুলো ঘিরে ফেলা চারপাশের এই সব প্রাচীন গাছেদের ছায়ায়। সেই সব গাছের ডালপালায়, এদিক ওদিক উড়ে বেড়ানো পাখির দল। তাদের হাঁকডাক। এমনকি এই এতদূর থেকেও স্পষ্ট শুনতে পাওয়া সেই ডাকগুলি। সেই সঙ্গে শুনতে পাওয়া এই লেকের শান্ত জলে টুপটাপ ঝরে পড়া জলের শব্দ।

আমার এই ঘর পেরিয়ে সামনে যে প্রকাণ্ড সড়ক। এখনও পর্যন্ত যে সড়ক জুড়ে গাড়ির চাপ অনেক কম। অথচ সামান্য বেলা গড়ালেই গাড়ির পর গাড়ি। বিরামহীনভাবে তাদের ছুটে চলা। চাকাগুলি পিচরাস্তায় ঘষতে ঘষতে, হর্ণের চিৎকার আর ক্রমশ ছড়িয়ে দেওয়া ধোওয়া-ধুলোয় কেমন দাপাদাপি করে এই তরতাজা সকালটাকে নষ্ট করে দেবে। আমার বাড়ির উঁচু দেওয়ালটার গায়ে এতদিনের জমে থাকা আস্তরণ। জমতে জমতে সেই সব গাড়ি এমনকি এই চারপাশের এত ধুলো এসেও সেই আস্তরণকে বাড়তে বাড়তে আরও কত মজবুত করে দেবে। ফলস্বরূপ এবছর অন্তত দুবার মিস্ত্রি ডেকে সেই সব আস্তরণ তুলে ফেলতে হবে আমাকে এবং নতুন রঙের প্রলেপ দিতে হবে আমাকে। এভাবেই অনেক রাত পর্যন্ত চারপাশে উড়তে থাকা এইসব ধোওয়া-ধুলো, যার খানিকটা বাতাসে উড়তে উড়তে কিছুটা আমার শ্বাস-প্রশ্বাস হয়ে, এখন সোজা ফুসফুসে। এমনকি প্রতিদিনের মতই রাত যত বাড়বে এভাবেই দূষিত বাতাস উড়তে উড়তে জমতে শুরু করবে আমার বুক। জমতে জমতে আরও রাত বাড়বে। ঠিক কতক্ষণ এই ব্যাপারটা চলবে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। অন্তত এই ব্যাপারটায় আমার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাই। যেমন নিয়ন্ত্রণ নেই রোজকার মত আজও। আজও এভাবেই ক্রমশ নিজেকে জড়িয়ে নেওয়া। আর আজও সকাল হলে এভাবেই আমার মুক্তি চাওয়া।

অথচ সকাল হলে সবকিছুই ভুলে যাবো আমি। আমার আর কিছুতেই মনে থাকবে না গতরাতে ঠিক কটায় বাড়িতে ফিরেছিলাম। ঠিক কটায় আমার বালিশের একপাশে উল্টে থাকা মোবাইল ফোন আর ঠোট ছুঁয়ে যাওয়া কাচের গ্লাস উঠে এসেছিল হাতে। রাত যত বেড়েছে একটার পর একটা চুমুক, সেইসঙ্গে মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠা দৃশ্যেরা কিভাবে আমাকে জড়িয়ে নিয়েছিল। সারাদিনের কল লিস্ট, ই- মেল, হোয়াটসঅ্যাপ যা আমাকে প্রতিমুহূর্ত ব্যস্ত করে রাখে, সে-সব ঝেড়ে ফেলে কখন কিভাবে আমি চলে গিয়েছিলাম অন্য জগতে। কিভাবে সেই ভেসে আসা গন্ধ। সেই পোশাক খুলে গিয়ে ক্রমশ ফর্সা চামড়া। আর চামড়ার ভেতরে কারুকাজ। প্রাচীন কোন গুহাচিত্রের আদল। সেই দৃশ্য আর ভেসে আসা গন্ধে চরম উত্তেজনায় কখন আমি কিভাবে যে নিজেকে নিয়ে বিভোর ছিলাম। আর অবধারিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। কখন যে আমার পোশাক খুলে গিয়ে সেই সব গুহা চিত্রের ছাপ লেগেছিল। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল অনন্ত অন্ধকার। একসময় সজোরে ধাক্কা। ঠিক মৃত্যুর মত। কোনদিকে যে ছিটকে গড়িয়ে পড়েছিলাম। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারব না, কখন কিভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম বিছানায়। কিভাবে জড়িয়ে ধরা ঘুম। এমনকি মোবাইলের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার পরও, চলতে থাকা ছবি ও শব্দেরা, তাদের অনবরত ঘুরপাক থেমে গিয়েও। কখন যে আমার হাত থেকে খসে যাওয়া সেই কাচের গ্লাস, মেঝেতে গড়িয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গুড়িয়ে যাবে। আমার কিছুতেই মনে থাকবে না কত রাত আমি তাপসীকে পাই না আর।

অথচ সাত বছর হয়ে গেল আমরা যে একসঙ্গে ঘুমোই না আর, আমাকে দেখে কিন্তু একবারও মনে হবে না। সেই যে সকাল হলে নিয়ম করে বাজার করে আনা। অফিসে যাওয়ার আগে অন্তত ঘণ্টাখানেক তাপসীকে সময় দেওয়া। ওর পাশে বসে থাকা শান্ত, একান্ত অনুগত হয়ে। যেন তাপসী ছাড়া আমার আর কেউ নেই এজীবনে। এমনকি এমাসের ইলেকট্রিক বিল, পলিসির টাকা জমা দেওয়ার শেষ তারিখটা পর্যন্ত ঠিকঠাক মনে থাকবে আমার। এমনকি হাতে সেই মোবাইলটা তুলে নিয়ে একেবারে নির্ভুল পেমেন্ট মিটিয়ে তাপসীকে দেখিয়ে নেওয়া পর্যন্ত। তখন মনে হবে এই তাপসীর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। সবকিছু। এমনকি তাপসী যদি একবার বলে ফেলে, ‘কতদিন আমাদের পাহাড়ে যাওয়া হয় না।’ অমনি আমি তাপসীর জন্য ট্রেনের টিকিট, হোটেলের রুম, এমনকি সাইট সিন ঘুরে দেখার জন্য একটা ড্রাইভার পর্যন্ত ঠিক করে রাখবোই রাখবো।

এই তাপসীর ভালোবাসায়ও এতটুকু খামতি দেখবো না যখন অফিস থেকে বেরোবার ঠিক মিনিট পনেরো আগে নিয়ম করে ফোন আসবে একবার, ‘কিগো বেড়িয়েছো এবার? মনে আছে তো আজ তৃষার জন্মদিন। ওকে কি যেন দেবে বলেছিল?’

আমিও কি আশ্চর্য তাপসীর কথা মত ঠিক তখনই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়বো। অফিস থেকে বেরিয়ে এসে তৃষার জন্য একটা পছন্দের গিফট কিনবো। তারপর বাড়ি ফিরে এসে সোজা দরজায় টোকা দেবো। সারাটা সন্ধ্যে ওকে সঙ্গে নিয়ে কেক কাটবো, বেলুন ওড়াবো, সেলফি তুলবো। অর্ডার দিয়ে বাইরে থেকে খাবার আনাবো। সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাবো। এমনকি সারাটা সন্ধ্যে জুড়ে দারুণ হইচই করবো সেই রাত হওয়া পর্যন্ত। তারপর ঘুমতে গিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসবো আবার। নিজের সেই অন্ধকার ঘরে।

আমার হাতে কখন যে কিভাবে উঠে আসবে মোবাইল ফোন। জ্বলে উঠবে নানা রঙের আলো। কিভাবে যে আমিও সেই সব আলোয় নিজেকে বদলাতে শুরু করবো। এবং একসময় সত্যি সত্যিই সমস্ত দৃশ্য বদলে ফেলবো। আমার সামনে তখন শুধুই ফর্সা চামড়া। গুহাচিত্র। আর পোশাক খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই অদ্ভূত ভেসে আসা গন্ধ। আমাকে কেমন যে নেশায় বুঁদ করে নেবে। তারপর তো দীর্ঘ সময় এক উত্তেজনায় ডুব দেওয়া। একসময় কাচের গ্লাস তুলে নিয়ে চুমুক দেওয়া এবং শেষে যথারীতি হাত ফসকে পাথরের মেঝেতে সাজোরে ধাক্কা। মৃত্যুর মত নিজেকে চুরমার হতে দেখবো আমি।

তাপসীও দেখবে। এমনকি ওর সামনেই তো একদিন সেই রাতে আমাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলার পর। সেই আমার শরীর জুড়ে জড়িয়ে থাকা অন্ধকার। তাপসী এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল যে, সেই নগ্ন সাদা চামড়াকে পর্যন্ত সরিয়ে ফেলতে পারিনি। এমনকি পাশের ঘরে তৃষা ঘুমিয়ে আছে বলেই হয়তো এতটুকু চিৎকার-চেঁচামেচি করেনি তাপসী। শুধু ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে একবার শব্দটা ছুড়ে দিয়ে বলে গিয়েছিল, ‘ছিঃ।’

এত ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে তাপসী। পরদিন সকালে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, ‘আজ অফিস বন্ধ রেখো, ওবেলা তোমাকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে যাবো।’

আমি পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আসলে আমি তো তখন অন্য মানুষ। রাতের সেই মানুষটার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি তো তখন স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম সবকিছু। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম কি ভীষণ অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছি আমি। অফিসের কলিগ, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি, যারা আমায় রোজ দেখে, এমনকি বাজারের অচেনা সেই মানুষজন পর্যন্ত, যারা আমাকে দেখে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারবে না, যে এমন একটা ঘটনা আমি আদৌ কখনও ঘটাতে পারি। তাপসীর কাছে লজ্জায় অপমানে এতটাই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম যে দুপুরে ভাত খেতে গিয়েও কেমন চুপ হয়েছিলাম। তাপসীর কথা শুনে শুধু মাথা নাড়িয়েছিলাম, যেন উত্তর দেওয়ার শক্তিগুলি হারিয়ে ফেলেছিলাম কোথাও।

বিকেলে তাপসী আমাকে সঙ্গে নিয়ে আরও অনেক গাড়ির ভিড় কাটিয়ে, পিচ রাস্তা ঘষে চলা চাকায় চেপে পৌঁছেছিল ডাক্তারবাবুর চেম্বারে।

ডাক্তারবাবু সরাসরি জানতে চেয়েছিলেন, ‘ঠিক কতদিন ধরে ব্যাপারটা হচ্ছে বলুন তো?’

আমি তাপসীর দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাতে পারিনি। শুধু মাথা নীচু করে জবাব দিয়েছিলাম, ‘বেশ কয়েকদিন। তাও মাস ছয়েক তো হবেই।’

ডাক্তারবাবু আরও জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনারা কি দ্বিতীয় সন্তানের জন্য ট্রাই করেছিলেন?’

—না। আমরা তৃষাকে নিয়েই ভালো আছি!

—তাহলে এসব নিয়ে ভাবলেন কিভাবে? মানে ভাবনাটা এলো কিভাবে? কোন মুহূর্তে?

আমি তাপসীর দিকে তাকাই। ওর আশ্চর্য চোখ। শান্ত ঠোট। কতদিন এই ঠোট ছুঁতে পারিনি।

ডাক্তারবাবু ফের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বলুন, তাহলে কখন? কিভাবে?’

আমি আরও শান্ত হয়ে জবাব দিয়েছিলাম, ‘ঠিক ঘুমতে গেলে। ঘুমবার সময়। মনে হয় পাশে কেউ নেই। ভীষণ খালি। ফাঁকা বিছানাটা কেমন ভেতর থেকে জড়িয়ে ধরে।’

—আপনারা একসঙ্গে শোন না?

ডাক্তারবাবুর এই প্রশ্নের জবাবে কেন জানি আমার মুখ চেপে ধরেছিল কেউ। আমার ঠোঁট। সেই চেপে ধরা মুখ খুলে বলতে পারিনি, ‘ঘুমোই। কিন্তু ওকে পাই না। মানে তাপসীর এসব ভালো লাগে না আর।’

ডাক্তারবাবু আমাকে বাইরে বসতে দিয়ে তাপসীর সঙ্গে কি সব কথা বলে নিয়েছিল। তারপর প্রেসক্রিপশন বাড়িয়ে লিখে দিয়েছিল কয়েকটা ওষুধ।

ফিরে আসবার সময় আমরা কেউই কথা বলতে পারিনি আর। এমনকি ডাক্তারবাবুর সেই ধরিয়ে দেওয়া প্রেসক্রিপশন, ওষুধ কিনতে গিয়ে ঠিকমত বুঝে নেওয়ার পরও। আমি শুধু জানলার বাইরে তাকিয়েছিলাম। সন্ধ্যের মুখে শহরের বদলে যাওয়া দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু পরেই রাত নামবে। চারদিকে জ্বলে ওঠা আলো, রাস্তাকে ঘিরে দোকানগুলোর সেজে ওঠা, একটু দূরে বাইপাস ছাড়িয়ে উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর কেমন সেজে ওঠা।

আমার মনে পড়ে যায় বিয়ের পরপর এরকমই এক রাতে, তাপসীকে নিয়ে প্রথমবার পাহাড়ে যাওয়া। সেই শীত রাতে তাপসীর হঠাৎ জড়িয়ে ধরা। আমার শিহরিত সারা শরীর। ওর শরীর ঘিরে উত্তাপ। তাপসী বলেছিল, জানো আমরা চাইলেও হয়তো আর কোনদিন আলাদা হতে পারব না! তখন যে কেন কথাটা বলেছিল তাপসী? তৃষা হবার আরও বছর দেড়েক পর সেই তাপসীকে ছুঁতে গিয়ে প্রথম টের পেয়েছিলাম, কেমন শান্ত ভাবে হাতটাকে সরিয়ে নিয়েছিল। তারপর তো আমাদের দুজনের পাশাপাশি ঘুমোবার ঠিক মাঝে এসে পড়েছিল তৃষা। একসময় সেই তৃষাকে নিয়েই তাপসীর অন্য ঘরে সরে যাওয়া। ক্রমশ একা হচ্ছিলাম আমি।

সে রাতেই রাত নেমেছিল। একেবারে মোবাইল ছুঁইয়ে। ছড়িয়ে গেছিল গোটা ঘর, গোটা বিছানায়। সেই আলোর ভেতর কত যে পথ। কত গলি, অন্ধকার। অথচ কত সহজেই পৌঁছে গিয়েছিলাম তার কাছে। হাত বাড়িয়েই ছিল সাদা চামড়া। আমি আলত করে ছুঁতেই একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার উপর। আমার মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তারপর আরেকবার ছুঁতেই খুলে গেছিল ওর সমস্ত পোশাক। আমিও তখন সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢেকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে। আমার লকলকে জিভ বেয়ে ঝড়ে পড়ছিল বিষাক্ত লালা। সেই লালায় জড়িয়ে নিয়েছিলাম ওর জিভ। একবার, দুবার, তিনবার। শেষবার সেই যে আমায় গলা জড়িয়ে নিল, আমি দেখলাম ধীরে ধীরে কেমন এক বাঁধনে বন্দী হয়ে যাচ্ছি। কেমন যেন আমার আর পালিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। এমনকি আমার শ্বাস আটকে আসছে, অথচ কিছুতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছি না। দেখলাম একসময় প্রায় জ্ঞান হারিয়ে গড়িয়ে পড়ছি একদিকে। যেদিকে আমার বিছানা, বালিশ, একপাশে রাখা কাচের গ্লাস। যেদিকে এই ঘর, আমার আর তাপসীর মাঝে গড়ে ওঠা দেওয়াল। মুহূর্তেই যেন সবকিছু ঝনঝন করে ভেঙে একেবারে চূড়মাড় করে দিচ্ছিল। ঠিক তখনই মনে হল তাপসীর হাত। অস্পষ্ট আলোয় দেখলাম আমার হাত থেকে মোবাইলটা সরিয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালাম।

যখন সকাল হল, সেই রাতটাকে ভুলে গেলাম আমি। ভুলে গেলাম গত রাতের যাবতীয় যা কিছু। এমনকি ফর্সা চামড়ার পোশাক খুলে যাওয়ার পরের দৃশ্যগুলিও। আমি এখন সকালটাকে দারুণভাবে উপভোগে ব্যস্ত। ব্যস্ত একটু একটু করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে ফের একটা নতুন দিন শুরু করার জন্য। ভাঙা কাচের টুকরো গুছিয়ে নিয়ে টেবিলে ফের একটা নতুন গ্লাস রেখে এসেছি এইমাত্র। মোবাইলটাকে চার্জে বসিয়েছি যাতে অন্তত অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ব্যাটারি ফুল করে নিতে পারি।

বাড়ি থেকে আমার অফিস মেরেকেটে মিনিট কুড়ির রাস্তা। রাস্তা পেরোলেই মেট্রো রেলের ভূগর্ভস্থ পথ। সিড়ি দিয়ে নেমে গেলে সোজা প্লাটফর্ম। নটা দশের গাড়ির তিননম্বর বগির প্রথম গেট। দরজা খুলে গিয়ে সামনের ফাঁকা সিট। তিনটে স্টেশন পেরোতে না পেরোতেই নেমে গিয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা।

আমি জানি এখান থেকে আরও মিনিট দুই হেঁটে গেলে আমার অফিস। অফিসের ঘড়িতে এখনও দশটা বাজতে মিনিট পাঁচেক বাকি। আমার বসার টেবিল, সামনের ল্যাপটপ, ফাইলপত্র গুছিয়ে নিয়ে প্রিন্ট-আউট, মেল, হোয়াটসঅ্যাপ, মোবাইল স্ক্রিন জুড়ে কললিস্ট ভেসে ওঠা। একটার পর একটা ফোন, ম্যাসেজ সামলানো। আমি রাত আটটা পর্যন্ত এভাবেই নিজেকে কাজের দেশে ডুবিয়ে রাখবো। এই সময় এমনকি মাঝের টিফিনের সময়টুকু বাদ দিলে আমার সঙ্গে ঠিকমত কথা পর্যন্ত বলতে পারবে না কেউ। আর অন্যকিছু নিয়ে ভাবার তো প্রশ্নই আসবে না।

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন