চতুর্থীর রাত থেকেই আমাদের বাড়ির সামনের পুজোপ্যান্ডেলে ‘জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার’। ফ্ল্যাটের ব্যালকনি বা ঘরের জানলা থেকেই পুজোর ফ্যাশন, সাজগোজের চলমান দৃশ্য। এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার ফ্যাশন শপের দোকান কখনো তার ঝাঁপ কখনো বন্ধ করে না, দুর্গাপুজো আর দীপাবলীতে তারা আরো ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অনলাইন বাজারের আগে পিতৃপক্ষে ছত্তীশগঢ়ে মেয়ের জামা কিনতে গিয়ে খুব আশাহত হতাম। কোনো নতুন স্টক, কেনাবেচা প্রায় বন্ধ তখন। দীপাবলীর ঠিক আগে আগে ওখানকার দোকানগুলো সেজে উঠত। তার আগে নয়।
আমাদের ‘পুজোয় চাই নতুন জামা’র ঘরেবাইরে শ্লোগান নবরাত্রি পুজোয় নেই। তার বদলে অফিসে, বাসে, ট্রেনে, অটোতে ন’দিনের ন’টা কালার থীম।
ন’দিনের উৎসবে শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী সাজবেন নানা বর্ণচ্ছটায়। দেবীমাহাত্ম্যে নবরাত্রির ন’টি রঙ তাৎপর্যময়। সাদা রঙে আধ্যাত্মিক পবিত্রতা। দেবী কাত্যায়নীর উজ্জ্বল কমলাবস্ত্র উষ্ণতার প্রতীক। শৈলপুত্রীর রক্তাম্বরে সাফল্য আর স্বর্গীয় সুষমা। তাঁর সবুজ বস্ত্র উর্বর পৃথিবী আর জীবনের জয়গান গায়। গোলাপী, আকাশি, ধূসর, নীল রঙেরাও দেবীর আশীর্বাদ পেয়ে মহিমান্বিত।
জগজ্জননীর সন্তানদের ওয়ার্ডরোবে যে সব পোশাক অনাদরে অবহেলায় পড়ে থাকে, তাদের মধ্যে কিছু অন্তত এই ন’দিনে মুক্তির আনন্দ পায়। নটি রঙ আনন্দে খোলা হাওয়ায় পাখনা মেলে।
বাঙালির পুজোর জামাকাপড়ে রঙ আর ডিজাইন তো আছেই। এছাড়াও স্পর্শ, গন্ধ, ঈর্ষা, আনন্দ সব কিছুর মিশ্র অনুভব। কোন শাড়িতে ধুনোর গন্ধ পাবেন, কোন শাড়িতে শিউলি ফুলের কোমল স্পর্শ বিজ্ঞাপন সব জানিয়ে দেবে। যে পোশাক নবমীর রাতে তারার মত আপনাকে উজ্জ্বল করবে বা সিঁদূরখেলার সময় পবিত্র দেখাবে, সেটি না কিনলে আমার/আপনার চলবেই না। ডিজাইনার ব্লাউজে, কস্টিউম জুয়েলারিতে, ধুতির পাড়ের ধাক্কায়, ব্যুটিকের এমব্রয়ডারি পাঞ্জাবিতে আমরা যদি অন্যের ঈর্ষার কারণ না হয়ে উঠি, তাহলে আর পুজো কি?
বাঙালির পুজোর পোশাকের এই বাহার কিন্তু আজকের নয়। ষোলো-সতেরো শতকের কবি মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলে ফুল্লরার ঘরে নিত্য অভাব। পুজোয় তার নতুন শাড়ি না জুটলেও সাধারণ মানুষের বেশভূষার বর্ণনা দিয়ে সে বলেছে, “উত্তম বসনে বেশ করয়ে বণিতা”।
দীনেন্দ্রকুমার রায় তাঁর পল্লীচিত্রে লিখেছেন, পুজোর সময় গ্রামের বাজারেও বিক্রি হয় জরি মোড়া টুপি। তাইতো রবিঠাকুরের ‘পূজার সাজ’ কবিতায় মধুর গরীব বাবার কিনে দেওয়া ছিটের জামা পছন্দ হয় না। রায় বাবুদের গুপির জরির টুপি আর ফুল কাটা সাটিনের জামা দেখে সে বায়না করে। তার ঠিক ঐরকমটাই চাই।
গ্রামের দোকানে পুজোর সময় কাঁচের আলমারিতে সাজানো থাকে ছেলেদের কামিজ, বেলোয়ারী চুড়ি, এসেন্স। বাঁশের সেল্ফের ওপর সারি সারি জুতো। দীনেন্দ্র কুমার রায় লিখছেন — “বৈকালে কাপড়ের দোকানে অত্যন্ত ভীড়। এদিকে হাট বাজারের মধ্যেও রাস্তার দুইপাশে জোলারা মোটা সূতার নানা রঙের দেশী ধুতি, শাড়ি ও পাঁচরঙার গামছার মোট খুলিয়া বিক্রয় করিতে বসিয়া গিয়াছে। তাহাদের দোকানের চারিদিকে চাষার দল বসিয়া ক্রয় করিতেছে। দর্জিরা মোটা লং ক্লথ ও বাজে ছিটের ফতুয়া, কামিজ, মেরজাই টাঙ্গাইয়া চাষার ছেলেদের উদভ্রান্ত করিয়া তুলিতেছে।
ছেলেরা দলে দলে জুতোয় জামায় সজ্জিত হইয়া এক এক রেজিমেন্ট শিশু কার্তিকের মত রাস্তায় রাস্তায় বাজারের মধ্যে ঘুরিতেছে, হাসিতেছে, গল্প করিতেছে।
চাষার ছেলেরা ‘বুলু’ দেয়া কাপড় পরিয়া কোমরে কল্কাপেড়ে চাদর জড়াইয়া ঠাকুর দেখিতে আসিতেছে।”
এ তো গেল গ্রামবাংলার পুজোর বাজারের কথা, এবার শহরের পুজোর সাজপোশাকের দিকে তাকানো যাক।
১৮-১৯ শতকে বাড়ির মেয়েরা অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন। তাই বাড়িতে পুজোর সময় নতুন জিনিসের পসরা নিয়ে তাঁতিনী, চুড়িওয়ালি, জহুরী, দর্জি, মালিনী, চীনেম্যান জুতোওয়ালা ও বিদেশী আতরওয়ালা আসত।
কলকাতার রক্ষণশীল সমাজের অন্যতম নেতা ‘নববাবু বিলাসে’র লেখক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গোৎসবকে আঠেরো শতকেই স্ত্রী গহনার উৎসব বা বস্ত্রোৎসব বলে ব্যঙ্গ করেছেন।
ধনী পরিবারে ছোটদের সঙ্গে মেয়েরাও নতুন শাড়ির জন্য কর্তাদের দপ্তরে ফরমাশ দিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। কলকাতা বা ঢাকা থেকে আসতো বুটিদার ঢাকাই, কলকাপেড়ে শান্তিপুরী, চুলপেড়ে গরদ, মটকার থান। কাশী থেকে আসত বেনারসি আর বোম্বে থেকে পারসি শাড়ি।
ছেলেদের জন্য জরির কাজ করা সার্টিনের জামা বা আদ্দির পাঞ্জাবি। ধুতি ও হাফ প্যান্ট যাকে দড়ি বাঁধা ইজের বলা হত, তার চলনও ছিল।
তাঁতিনীদের কাছ থেকে কেনা হত নীলাম্বরী, গঙ্গা যমুনা, সিঁথের সিদুর, ভোমরা পাড়, কোকিলপাড়, চাঁদের আলো বা গান লেখা পাড়ের শাড়ি। মেয়েদের শাড়ির সঙ্গে প্রসাধনী হিসেবে থাকত একশিশি আতর, আলতা, সিঁদুর ও শাঁখের শাঁখা।
অবস্থাপন্নদের বাড়িতে পুজোর রাতে মেয়েদের পরনে দিনেন্দ্রকুমার রায়ের ভাষায়, “উজ্জ্বল বেনারসি বা রঙিন পারসী শাড়ি, পায়ে ডায়মন্ড কাটা মল, হাতে বালা ও চুড়ি সেমিজের ওপর সুচিক্কণ কারুকার্য খচিত জাপানি সিল্কের বডিস। কাহারো উপর হাতে ডায়মন্ড-কাটা অনন্ত ও তাবিজ শোভা পাইতেছে। কানে দুল দুলিতেছে। কাহারো কানে কান। তাহার সহিত কনকলতায় আবদ্ধ সোনার পরী-যুবতীর সযত্ন-রচিত সুরভিত সুদৃশ্য খোঁপায় অঙ্গ ঢালিয়া সোনার বাঁশি ওষ্ঠে স্পর্শ করিয়া সুবর্ণের জয় ঘোষণা করিতেছে।”
সেকালের মেয়েদের পুজোর আগে পার্লারে যাবার উপায় না থাকলেও কেশবিন্যাসে তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। বেনেবাগান, মন ভোলানো, ফাঁশ জাল, বিবিয়ানা, বেড়া খোঁপা, চালচিত্তির খোঁপা, মৌচাক খোঁপার ফ্যাশন ছিল। কপালের ওপর চুলের পাতা কাটার বাহার সেকালের সিনেমায় আমরা অনেকবার দেখেছি।
মধ্যবিত্তের মেয়েরা কাঁচের বা গালার চুড়ি, পাথর বসানো নাকছাবি, খোঁপায় দেয়া রূপোর ফুল, কমপক্ষে একগাছা সোনার চুড়ি বা বালা, গলায় মটর মালা বা বিছেহার, উপর হাতে বাজু বা তাগা ও কানে ফুল পরতেও ভুলতো না।
হুতোম প্যাঁচার নকশায় পুজোর বাজারের ছবিতে রকমারি জিনিস আর ব্যঙ্গোক্তি হাত ধরাধরি করে আছে, — “দর্জিরা ছেলেদের টুপি চাপকান ও পেটি নিয়ে দরজায় দরজায় ব্যাড়াচ্চে। ‘মধু চাই! শাঁকা নেবে গো’ বলে ফেরিওয়ালারা ডেকে ডেকে ঘুচ্চে। ঢাকাই ও শান্তিপুরে কাপুড়ে মহাজন, আতর ওয়ালা ও যাত্রার দালালেরা আহার নিদ্রে পরিত্যাগ করেছে। ধূপধুনো, বেনে মশলা ও মাথাঘষার এক্সট্রা দোকান বসে গেচে। কাপড়ের মহাজনেরা দোকানে ডবল পর্দা ফেলেচে। দোকানঘর অন্ধকার প্রায়, তারই ভেতর বসে যথার্থ পাই লাভে বউনি হচ্চে। বাঙ্গাল ও পাড়াগেঁয়ে চাকরেরা আরশী, ঘুনসি, গিলটির গহনা ও বিলাতি মুক্তো একচেটেয় কিনচেন। রবারের জুতো, কম্ফরটার, স্টিক ও ন্যাজওয়ালা পাগড়ী অগুন্তি উঠচে; ঐ সঙ্গে বেলোয়াড়ি চুড়ি, আঙ্গিয়া, বিলিতি সোনার শীল আঙটি ও চুলের গার্ড চ্যেনেরও অসঙ্গত খদ্দের। অ্যাত দিন জুতোর দোকান ধুলো ও মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু পুজোর মোর্সমে বিয়ের কনের মতো ফেঁপে উঠচে। দোকানের কপাটে কাই দিয়ে নানা রকম রঙিন কাগজ মারা হয়েছে। ভেতরে চেয়ার পাড়া তার নিচে এক টুকরো ছেঁড়া কারপেট। শহরের সকল দোকানেরই শীতকালের কাগের মতো চেহারা ফিরেছে। যতই দিন ঘুনিয়ে আসচে ততই বাজারের কেনাবেচা বাড়চে ততই কলকেতা গরম হয়ে উঠচে।”
পুরুষ মানুষ পুজোয় পরছেন ধুপছায়া চেলীর (দোরঙা, ময়ূরকন্ঠী সূক্ষ্ম বস্ত্র) জোড় ও কলার কপ ও প্লেটওয়ালা (caller, cuff ও pleat)
কামিজ ও ঢাকাই কাজের চাদর। রুমালটি কোমরে বাঁধা আছে। সোনার চাবির শিকলি কোঁচা কামিজের ওপর ঘড়ির চেনের অফিসিয়েট হয়েছে। কানে আতরের তুলো গুঁজেছেন।
রাতে বাবুরা সার্টিনের চাপকান, পায়জামা, ট্যাসল দেওয়া টুপি, মুখে পমেটম, ল্যাভেন্ডারের গন্ধ ছড়িয়ে যাত্রা দেখতে চলেছেন।
এই বাবুদের সাজ দেখে ছড়া কাটা হ’ল,
‘জ্যাকেট প্যান্টুলেন আঁটা, কোঁকড়া চুলে বাঁকড়া কাটা
এলেন যেন বিলাত থেকে, চিনে উঠা ভার।
গলে চেইন ,রুমাল হাতে, শীল আংটি সব আঙ্গুলেতে
পা পড়ে না পৃথিবীতে, এমনি অহংকার।।”
যে বাবুদের নতুন কাপড় জোটেনি, তারা কোঁচানো ধুতি, ধোপদুরস্ত কামিজ ও ডুরে শান্তিপুরী উড়ুনি ধোপাবাড়ি থেকে ভাড়া নিয়েছে। ধোপারাও এই সুযোগে দু’পয়সা রোজগার করে নিল।
এতো গেল একটি সময়ের দুর্গোৎসবের সাজগোজের কথা। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের শ্রেষ্ঠ উৎসবে বেশভূষার বহু পরিবর্তন এসেছে।
যাঁকে ঘিরে সেই উৎসব, সেই মৃন্ময়ী প্রথমে মাটির সাজেই সেজে উঠতেন। তাঁর শাড়ি গয়না সব ছিল বাংলার নরম মাটি দিয়ে তৈরি। তাঁকেই আমরা উমা বলে ঘরের মেয়ে করে আগমনী গেয়েছি।
সাহেবদের পা চাটা পরাধীন বাঙালি একসময়ে দেবীমূর্তি গড়তে চেয়েছে ভিক্টোরিয়ার মত। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যঙ্গর্থে লিখেছেন, — “হলুদপানা, দশহেতে, তেচোকো (ত্রিনয়নী) দুর্গার বদলে মহারানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি গড়িয়া দিতে বলেছি। কেবল পোশাকটা ইংরেজি ধরনের না করিয়া শাড়ি জামা ওড়না দিয়া সাজাইয়া দিবে। সিংহকে একটা পোশাক পরাইয়া দিতে বলিয়াছি আর অসুরের গা খোলা না থাকে তাহাও বলিয়াছি। সাপের গায়ে একটা সার্টিনের ওয়ার পড়ানো থাকিবে।”
এরপরেও জনপ্রিয় সিনেমার নায়িকার আদলে দুর্গার মুখশ্রী বানানো এবং সমালোচনা হয়েছে।
আমরা জগজ্জননীকে সাজিয়েছি ডাকের সাজে। জরিচুমকি দিয়ে শোলার গহনায়। নানা আঙ্গিকে, নানা বেশভূষায়। মহার্ঘ্য সোনার অলঙ্কারে।
দেশভক্ত বাঙালি মাকে একসময় কল্পনা করেছিল দেশমাতৃকারূপে। ‘আমার দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত বলছেন, — “চিনিলাম এই আমার জননী জন্মভূমি। এই মৃন্ময়ী মৃত্তিকা-রূপিণী। অনন্ত রত্ন ভূষিতা। এক্ষণে কালগর্ভে নিহিতা। রত্ন মন্ডিত দশভুজ দশ দিকে প্রসারিত। তাহাতে নানান আয়ুধ রূপে নানা শক্তি শোভিত।। পদতলে শত্রু বিমর্দিত। বীরজন কেশরী শত্রু নিষ্পীরণে নিযুক্ত।”
আমাদের প্রার্থনা, ঘরের মেয়ে উমা আবার সেই শক্তিরুপিণী হয়ে বিরাজিত হোক। কবি বাসবদত্তা মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতা বড় মনে ধরল। সেই কবিতার কয়েকটি পংক্তি দিয়ে এ লেখা শেষ করি, —
“তুমি তো জন্ম নিলে পরাজিত পুরুষের কল্পনায়।
দানব নরখাদক যখন তার নখ দন্ত বিস্তার করে,
সকল শুভ চিন্তা মার খেতে খেতে
সমানে মরে যেতে থাকে,
পিছু হটতে হটতে
লুকিয়ে পড়ে কোন কানা গলিতে
অথবা হয়ত বিশ্বাস করতে থাকে আপন দীন দাসসত্ত্বায় —
তখন ই এলে তুমি।
***
তুমি প্রতি বছর আসো…
তুমি এলে কেমন যেন বিশ্বাস জেগে ওঠে ভালোর…
প্রতি ভোরের নরম আলোয়
আমরা গান গেয়ে উঠি…এখন আর দেরী নয়
ধর গো তোরা-হাতে হাতে ধর গো….”
দারুন লাগল।