গত শতকের পঞ্চাশের দশকের গোড়ার কথা। মান্না দে তখন মুম্বইয়ে। একদিন তাঁকে লতা মঙ্গেশকর বললেন, ‘মান্নাদা, আমার খুব ইচ্ছে বাংলায় নন ফিল্ম গান করার। আপনি যদি ব্যবস্থা করেন, ভালো হয়।’ মান্না দে খুব উৎসাহ নিয়ে এক গীতিকারকে দিয়ে গান লেখালেন, তিনি নিজে সুর দিলেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে লতাজি আর সেই গান সময়ে রেকর্ড করতে পারলেন না। তাই সেই গান সেবার পুজোয় মান্না দে নিজেই গাইলেন। আজও সেই গান মানুষের অন্তরকে অনাবিল আনন্দে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। গান দু’টি হল, ‘হায় হায় গো রাত যায় গো, দূরে তবু রবে কি।’ অন্য গানটি হল ‘কতদূরে আর নিয়ে যাবে বল।’ কয়েক বছর পরে ১৯৫৭ সালে লতাজি পুজোয় বাংলা গান গাইলেন। কথা পবিত্র মিত্র সুর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’ এবং ‘কত নিশি গেছে নিদহারা ওগো’।
প্রতি বছর শরতের কুসুম কুসুম ভোরে বেজে উঠত মায়ের আগমনি গান। ব্রাহ্মমহূর্তে ছড়িয়ে পড়ত মন কেমন করা সুর, ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’। সারা বছর ধরে এই গানের জন্য উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করে বাঙালি। আজও সেই মুগ্ধতার রেশ কাটেনি। তবে একটা সময় ছিল, যখন এই গানের সঙ্গে আকর্ষণ ছিল পুজোর গানেরও, যাকে বলা হয় আধুনিক গান। মূলত ১৯৩০ সালে ‘আধুনিক গান’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিল আকাশবাণী। গত শতকের সাত-আট দশক ধরে সৃষ্টি হয়েছিল শত শত কালজয়ী গান। পুজো এলেই বাঙালির চাই নতুন জামা, নতুন জুতো। তেমনই একসময় ছিল নতুন গান, নতুন সাহিত্য। বাঙালির পুজো মানেই ছিল এসব কিছু নিয়ে আনন্দের একটা প্যাকেজ। পুজোর আগে থেকে একটু একটু করে আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে বাজানো হতো সেই সব গান। শ্রোতারা উদ্বেল হয়ে সেই কথা, সুর আর গায়কীর দোলায় দুলে উঠতেন।
চলত তুমুল আলোচনা। এবছর হেমন্ত কোন গান গাইলেন? কেন, শোনেননি এখনও? আহা কী গেয়েছেন? ‘দুরন্ত ঘূর্ণি এই লেগেছে পাক’ কিংবা ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা।’ শচীন কর্তার গান শুনেছো? ‘মন দিল না বঁধু’ কিংবা ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই।’ এই শুনেছো এবছর সুমন কল্যাণপুর নামে একজন গেয়েছেন, কী অসাধারণ কণ্ঠ! তেমনই গান, ‘মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে।’ যেন জ্যোৎস্না ধোয়া রাতের একান্তে মন উদাস করা গান। একবছর পুজোয় হেমা মালিনী গানের রেকর্ড করলেন। ‘কাঁদে মন পিয়াসি’ কিংবা অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের করলেন সুকান্তের ‘একটি মোরগের কাহিনি’। আর অখিলবন্ধু ঘোষের ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’, অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। নির্মলা মিশ্রের গান তো একবছর সুপারহিট হয়ে গেল। সব পুজোর প্যান্ডেলেই বাজতেই লাগল। ‘ও তোতাপাখিরে।’ মেয়েরা শোনে আর চোখ মোছে। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব?
লতা মঙ্গেশকরের ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’ বা ‘যারে উড়ে যারে পাখি।’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘ওগো মোর গীতিময়’ কিংবা ‘মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’। সত্য চৌধুরী একবার গাইলেন, ‘পৃথিবী আমারে চায়, রেখোনা বেঁধে আমায়।’ শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আরও আগে স্বাধীনতা পূর্ব সময়ের সেইসব অমর প্রেমগীতি কী ভোলা যায়? জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে মোহিনী চৌধুরীর কথায় ও কমল দাশগুপ্তের সুরে গান, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়, তুমি যে বহ্নিশিখা’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’। পরে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল সুধীরলাল চক্রবর্তীর কয়েকটি গানও। তার মধ্যে অন্যতম হল, ‘খেলাঘর মোর ভেসে গেছে’ এবং ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’।
এছাড়া দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর সেন, মৃণাল চক্রবর্তী, পিন্টু ভট্টাচার্য, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ইলা বসু, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, তালাত মামুদ, আরতি মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! লিখতে থাকলে চিত্রগুপ্তের খাতাও শেষ হয়ে যাবে। হেমন্ত সম্পর্কে সলিল চৌধুরী একবার বলেছিলেন, ‘আমরা ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শুনিনি। কিন্তু মনে হয় তিনি গান গাইলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্বরেই গাইবেন।’ সেই মায়াবী কণ্ঠ আজও আমাদের আবিষ্ট করে রেখেছে।
আজও বাঙালি সেই স্বর্ণযুগের গানের মধ্যে বেঁচে থাকে, সুখ পায়। কেমন সুখ? একদিন খুব ভোরে অনিল বাগচি এসে কড়া নাড়ছেন মান্না দের বাড়িতে। অত সকালে অনিল বাগচীকে দেখে মান্না দে অবাক। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে অনিলদা, কোনও সমস্যা?’ অনিল বললেন, ‘না না। তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে দৌড়ে এলাম। আসলে না এসে পারলাম না। তোমার ওই গানটা শুনে মন ভরে গিয়েছে। কাল রাতে কতবার যে শুনলাম। কোন গানটা বল দেখি?’ মান্না বললেন, ‘কী জানি বুঝতে পারছি না।’ অনিল বাগচী হেসে বললেন, ‘একী অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়!’
বাঙালির গানের রেকর্ডকে ঘিরেও মিশেছিল ইংরেজদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। লন্ডনে ১৮৯০ সালের পর প্রতিষ্ঠিত হল গ্রামোফোন কোম্পানি। তাদেরই রেকর্ড হিজ মাস্টার্স ভয়েস। কোম্পানি চাইছিল, সারা বিশ্বে রেকর্ডের ব্যবসা ছড়িয়ে দিতে। সেই সুবাদে তারা ভারতে এসে সমীক্ষার কাজ শুরু করে। সমীক্ষায় দেখা যায়, কলকাতার মানুষের মধ্যে গান শোনার চাহিদা বিরাট। সেটাকেই মূলধন করে এগল ইংরেজরা। ১৯০২ সালের ২৮ অক্টোবর কলকাতায় এলেন লন্ডন স্টুডিওর চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও রেকর্ডিস্ট ফ্রেড গাইসবার্গ। তার আগে ওই বছরের ১০ অক্টোবর চৌরঙ্গিতে এইচএমভি তাদের অফিস ও রেকর্ড বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে। শুরু হল কাজ। প্রথম দিকে থিয়েটারের কিছু গান রেকর্ড করে বাজারে ছাড়া হয়। তার ভালো চাহিদা তৈরি হয়। ১৯০২ সালের ৮ নভেম্বর প্রথম রেকর্ডিং হল। তখন স্টুডিও ছিল না। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের দু’টি ঘর নিয়ে তৈরি হয় অস্থায়ী স্টুডিও। গান রেকর্ড করলেন গহরজান। তখন ইলেক্ট্রিক্যাল রেকর্ডিং ছিল না। গান গাইতে হতো একটা চোঙের মধ্য দিয়ে। প্রথমে সেটা তোলা হতো মোমের চাকতিতে। তারপর তা তোলা হতো তামার চাকতিতে। সেখান থেকে হতো গালার রেকর্ড।
তখনও কিন্তু পুজোর গানের কোনও ধারণা তৈরি হয়নি। তা এসেছে বেশ কয়েক বছর পরে। ১৯১৪ সালে পুজোর আগে বাজারে আসে কয়েকটি গান। শিল্পীরা ছিলেন কে মল্লিক, মানদাসুন্দরী দাসী, বেদানা দাসী, কৃষ্ণভামিণী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ প্রমুখ। পরের কয়েক বছরে আমরা পেলাম আঙুরবালা, ইন্দুবালা, আশ্চর্যময়ী দাসী, পঙ্কজ মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কমলা ঝরিয়া, কে এল সায়গল সহ আরও কয়েকজনকে।
এরপর কয়েক বছরের মধ্যে বাজারে এসে গেল আরও কয়েকটি কোম্পনি। যেমন কলম্বিয়া, হিন্দুস্তান, মেগাফোন ইত্যাদি। চারের দশক থেকেই যেন পুজোর গানের ঢেউ লাগল। এক ঝাঁক প্রতিভা এসে হাজির। গান তখন ধনীদের মজলিশ আর বাবুদের নাচমহল থেকে নেমে এসেছে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে। তিরিশের দশকে ধীরেন্দ্রনাথ দাসের গাওয়া ‘শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে’ সুপার ডুপার হিট হল। এই ধীরেন দাসই ছিলেন অভিনেতা অনুপকুমারের বাবা।
গায়কদের সঙ্গে গীতিকার এবং সুরকারদের কথাও বলতেই হয়। অসাধারণ সব গান লিখেছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত, প্রণব রায়, অজয় ভট্টাচার্য, সুধীন দাশগুপ্ত, পবিত্র মিত্র, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অনেকেই। সুরের ডালি সাজাচ্ছেন কমল দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, শ্যামল মিত্র, সুধীরলাল চক্রবর্তী প্রমুখ। তবে একটা কথা বলতেই হয়, পরবর্তীকালে এই যে বাংলা আধুনিক গানের দীপ্তিপ্রকাশ, তার পিছনে ছিলেন দু’জন মানুষ। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল। তাঁদের গানের প্রতি মানুষের আগ্রহই সৃষ্টি করেছিল আধুনিক গানের নতুন ভুবন।
আজও পুজো আসে। নতুন পোশাক আসে। মহালয়ার ভোরে বেজে ওঠে ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’। কিন্তু মনভরানো গান আর আসে না। কোন কালা জাদুকর যেন গানের স্বর্ণখচিত জগৎটাকে একেবারে তামা-পিতলের জগৎ করে ছেড়ে দিয়েছে। আজও আমরা তাই সেই স্বর্ণযুগের গানেই কান পেতে রই। বর্তমানে কত গান তো বুদ্বুদের মতো ভেসে উঠছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে! কিন্তু হারানো যুগের পুজোর গানের হিরণ্ময় দ্যুতি এখনও ছড়িয়ে আছে মানুষের মনে। সেই গান আজও যেন বাঙালি মননের গভীরে ‘আঁধার ঘরের প্রদীপ’ হয়ে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে।