আমাদের অতি পরিচিত এই পটুয়াপাড়া। বিশেষ করে দেশ বিদেশের চিত্রগ্রাহকদের কাছেও এই কুমোরটুলি একটি অতি পরিচিত নাম। সর্বক্ষণই এই এলাকার চারপাশে কিছু না কিছু ঘটে চলেছে। গতিময় সব দৃশ্যরূপ — যা থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল।
একটা সময়ে পুজোর মাস তিনেক আগে থেকেই আর দশজনের মতো আমিও প্রায় বডি ফেলে দিতাম এই কুমোরটুলিতে। দুর্গাপুজোর উৎসবের থেকেও আমার কাছে এই কুমোরটুলির আকর্ষণটা যেন অনেক অনেক বেশি ছিল।
প্রায় বছর দুয়েক হতে চলল করোনা অতিমারীর দৌলতে এই কুমোরটুলীতে আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে এই না যাওয়াটার আরও একটা প্রচ্ছন্ন কারণ ছিল। বছর তিনেক আগে কয়েক বার গিয়ে দেখি ছবি তুলবো কী, মোবাইল ফোনে লোকজনের ছবি তোলার যা তাড়াহুড়ো, তাই দেখে আমি নিজেই একপ্রকার হীনমন্যতায় ভুগতে থাকলাম। — পারলে অসুর, সিংহের মুখের ভেতরেও মোবাইল ঢুকিয়ে দেয় আর কী! এছাড়া নানা জনের রকমারি সাজপোশাকে ফটোসেশন তো আছেই। এই সবই দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিলাম। কিছুটা খারাপই লাগছিল। কিন্তু কিছু করারও নেই!
পরিচিত শিল্পী দুলাল পাল বলেন, ‘দাদা, কি উৎপাত ভাবতে পারবেন না। ছবি তুলতে গিয়ে কত যে ঠাকুরের আঙুল ভেঙ্গে দিয়েছে তারও কোন ঠিক নেই। বায়না করার লোকজনদের থেকে ফটোগ্রাফার বেশি। এমনিতেই থিম পুজোর ঠ্যালায় আমরা বেশ চাপে পড়ে গিয়েছি। তার মধ্যে এইসব!’
কয়েকজন শিল্পীর ঘরের সামনে দেখলাম, বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। সামনে কাগজের বোর্ডে লেখা টাঙ্গিয়ে রাখা আছে — ‘শিল্পীদের ঘরের ভেতরে ফটোগ্রাফারদের ঢোকা বারণ।’ — আসলে সময় ও পরিস্থিতি কখনো কখনো বুঝিয়ে দেয় — ‘এ জায়গা আর তোমার জন্য নয়!’
এখন এই অতিবৃষ্টি আর বিষণ্ণ সময়ে ঘরে থাকলেও পুজোর আগে এই চরম মূহুর্তে কুমোরটুলির ব্যস্ততার বিভিন্ন ইমেজ চোখের সামনে যেন আপনা হতেই ভেসে ওঠে!
নয় নয় করে সেই ৮৫-৮৬ সাল থেকে আমার এখানে আসা শুরু হয়েছিল। খুব কমই হয়েছে, যে কোনো বছরে এখানে আসা হয়নি। এখানে আসবো বলে পুজোর আগে অন্য কোথাও যেতেও মন চাইত না। অলস দুপুরে এদিক সেদিকে ঘোরাঘুরি, গঙ্গার পাড়ে চায়ের দোকানে আড্ডা — সবই চলত রমরমিয়ে। এই গঙ্গা দিয়েই এখনো নৌকা করে কুমোরটুলির জন্য বাঁশ, মাটি, খড় নিয়ে আসা হয়।
এই এলাকার লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করেও বেশ ভাল লাগত। নিজেদেরই লোক মনে হত। ওদের ঘর কাম স্টুডিওতে বসে আড্ডা, গল্পগুজব সবই চলত। এক এক শিল্পীর সব ভিন্ন ভিন্ন গল্প।
এক সময়ে ওপার বাংলার ঢাকা, বিক্রমপুর থেকে আসা মূর্তি তৈরির কারিগরেরাও এদিক সেদিক করে, এই কুমোরটুলিতে এসে ঠাঁই নেন। বেশির ভাগেরই বাবা ঠাকুর্দারা দেশভাগের সময়ে এক বস্ত্রে বা তারও আগে এখানে চলে এসেছেন। সে এক দীর্ঘ জীবন-সংগ্রামের পথ চলার ইতিহাস!
হুগলী নদীর তীরে, কলকাতার উত্তর প্রান্তে চিৎপুর রোডের গা ঘেঁষে এই কুমোরটুলি এলাকা। কিন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করা সত্ত্বেও এই কুমোরপাড়ার মধ্যে একটা মফস্বলী চরিত্র এখনো রয়ে গিয়েছে। উনুনের ধোঁয়া, পুরনো বাড়িঘর, রাস্তার ধারে তাসের আড্ডা, দোকানপাট, গলির মুখে কলতলায় পাড়ার মহিলাদের খুনসুটি, ঝগড়া সবই আছে। কিছু দিন আগেও দেখেছি, মাথায় মাটির বড় মালসায় করে ছাঁচে তৈরি চন্দ্রপুলি, নারকেল নাড়ু, শোনপাপড়ি ফেরি করে বেড়াতেন একজন বয়স্ক লোক — এখানকার গলি, তস্য গলিপথে। এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চা, ঘুগনি, পাঁউরুটি, কচুরী, পেঁয়াজি আর ডিম টোস্ট এর দোকান। কয়েক বছর হল চোখে পড়ছে, মোমো চাউমিনও ক্রমশ ডজ করে, এখানে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। আর আম পাবলিক ও শিল্পীদের জন্য পাইস হোটেল তো আছেই। বছর পাঁচেক আগেও ১৫ টাকায় ডিম ভাত ও ২০ টাকায় মাছ ভাতের মিল সেখানে পাওয়া যেত।
এখানকার সঙ্কীর্ণ গলিপথের দুধারে নানা আকারের স্টুডিও গুলোর অবস্থান। সবক’টাই অনেক বছরের পুরনো। এই স্টুডিওগুলো মূলতঃ বাঁশ, বেড়া, টালি, টিন, কাঠ, প্লাস্টিক — এসব দিয়ে তৈরি। সেই ভাবে উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও এখানে এসে কড়া নাড়েনি। কথা প্রসঙ্গে সমর পাল একদিন বলছিলেন, ‘বুঝলেন দাদা, সব পার্টিই আমাদের সামনে উন্নয়নের গাজর ঝুলিয়ে রেখে ভোট গুলো নিয়ে গেছে। কুমোরটুলির জন্য কেউই আর কাজ করেনি। শুধু খান দুয়েক পাকা ইউনিয়নের অফিস ঘর হয়েছে। এই দুটোতেই আবার সারা বছর আকচাআকচি, লাঠালাঠি। আর আমাদের হাতে শুধু ফুঁটো বাটি! কী বুঝলেন? — আর হবেই বা কী করে, আমরা নিজেরাই তো ঠিক নেই। সেই সুযোগটাই তো এই পার্টির লোকেরা নেয়!’
প্রতি বছর পুজোর ৫-৬ দিন আগে থেকেই উত্তর চব্বিশ পরগণার থেকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মূর্তি বহন করার দল এসে হাজির হয়ে যায় এই কুমোরটুলিতে। এক একটা দলে কম করে ১৫-২০ জনের মত লোক থাকে। এরা দেশ থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে, খুব মোটা মোটা পোক্ত বাঁশ, শক্ত দড়ি আর বড় বড় ভাতের হাঁড়ি কড়াই। এদের কাজ থাকে, কুমোরটুলি থেকে দুর্গা প্রতিমা বহন করে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে ও ক্লাব প্রাঙ্গণে পৌঁছে দেওয়া। সত্যি অবাক হয়ে দেখতাম, কি অসাধারণ দক্ষতা ও পরিশ্রমের সঙ্গে এইসব স্টুডিওর স্বল্প পরিসরে ও সংকীর্ণ গলিপথ দিয়ে এই বড় বড় ঠাকুর গুলো তারা বের করে নিয়ে আসে, সেই প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে। আমার তো প্রতি মূহুর্তেই মনে হতো এই বোধহয় হাতের আঙুল বা গলা ভেঙ্গে না বসে!
এক সপ্তাহের মতো এই ঠাকুর ওঠানামার কাজ করে এই দলের এক এক জন ১৫-১৬ হাজার টাকার মতো বাড়ি নিয়ে যেতে পারে। এদের বাবা কাকারও নাকি এক সময়ে কুমোরটুলিতে এসে এই কাজটি করতেন। আর বছরের অন্য সময়ে গ্রামে কৃষি কাজে বা অন্য খেপ কাজে ব্যস্ত থাকতেন।
মহালয়ার দিন দুয়েক পর থেকেই ঠাকুর নিয়ে যাওয়া শুরু হয়ে যায়। এই সময় বিশেষ কিছু ‘সমাজসেবীর’ দেখা মেলে। চোখে রঙিন চশমা, গলায় মোটা সোনার চেন, মুঠোয় ধরা থাকে একলাখি ফোন। আগে এদের হাতে 555 বা ক্ল্যাসিক সিগারেটের প্যাকেট শোভা পেত। এখন সেই জায়গাটা নিয়েছে পানপরাগ। উনি সুগন্ধি ছড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন, পেছনের সঙ্গী চ্যালারা আবার জলের বোতলে রেডিমিক্স বয়ে নিয়ে চলেছে। কারণ, বসের কখন মর্জি হবে কে জানে! বসে’র শরীরের অতিরিক্ত মেদ আর মধ্যাঞ্চল যেন সাদা পোশাক ফেটে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। হ্যাঁ, বিশেষ কিছু ক্লাবের ‘নক্ষত্র’ কর্মকর্তা এঁরা!
যত রাত বাড়ে এলাকাটি ঠাকুর নিতে আসা ছেলেপুলে, ট্রাক, ম্যাটাডোরে প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে যায়। তখন চিৎকার চেঁচামেচি, মাতালের উৎপাতে কান পাতা দায়। সারারাত চলে উল্লাস। এই সব সামলাতে গিয়ে পুলিশদেরও পাগল হয়ে যাবার জোগাড় হয়। ভোরের দিকে এলাকা শান্ত হয়!
এরপর পুজোর দিন যত এগিয়ে আসে, কুমোরটুলির ব্যস্ততাও ক্রমশ কমতে থাকে। এক এক করে শিল্পীদের ঘর শূন্য করে দিয়ে প্রায় সব ঠাকুরই নির্দিষ্ট স্থানে চলে যেতে থাকে। পঞ্চমীর দিন তো একেবারে যেন শুনশান – শ্মশানের নিস্তব্ধতা। এদের পোষ্য কুকুরগুলোরও যেন মন খারাপ। এদিক সেদিকে বসে ঝিমোচ্ছে সব! আজ আর কোনো ঝামেলা, কোনো আওয়াজও নেই।
তবে এই কুমোরটুলিতে আমার একটা বিশেষ টানও আছে। এই প্রসঙ্গে এই এলাকার একজনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আমাদের দীর্ঘদিনের শিল্পী বন্ধু সমীরদা- সমীর ভট্টাচার্য। ৯০ সালে আমরা বোম্বেতে এক সঙ্গে কত জলতরঙ্গের সন্ধ্যা কাটিয়েছি আরেক শিল্পী বন্ধু মানসদা’র বাড়িতে। সে সব ফেলে আসা স্মৃতি।
সমীরদা এই কুমোরটুলি এলাকারই ছেলে। নিজের মতো করেই ছবির সঙ্গে যাপন করে চলেছে। এক বর্ণময় চরিত্রও বটে। গঙ্গার পারে হটাৎ দেখা হয়ে গেলে তো কথাই নেই! প্রথমেই, দু’চার অক্ষরের কিছু মধুর সম্ভাষণ দিয়ে স্বাগত জানাবে। এর পরে চা সহযোগে শুরু হবে আড্ডা। ঘটক থেকে গোপাল ঘোষ আবার হাওয়াই চপ্পল থেকে হনুমান সবই আছে সেই আলোচনায়! আমি শুনতামই বেশি। কেননা সমীরদার ঝুলি যে শেষ হবার নয়! মাঝেমধ্যে আমি একটু উস্কে দিতাম, — ‘কি গো সমীরদা, অনেক তো হলো, এবার তুমি গঙ্গার লিজ’টা অন্তত ছাড়ো!’ আবার সমীরদার “পুষ্পবর্ষণ” শুরু হয়ে যেত আমার ওপরে!
সমীরদা’র মতো লোকদের দেখলে মাঝেমধ্যে খুব হিংসেও হয়! সামনে পেছনে না তাকিয়ে, জীবনটাকে প্রায় তুড়ি মেরে কাটিয়ে দিচ্ছে!
মাঝেমধ্যে ভাবি, আসলে এই সমীরদার মতো লোকজনই এই শহরের আত্মা! এই ধরনের কিছু লোকজন এখনো আছে বলেই এই শহরটাকে এখনো এতো ভালো লাগে। যা অন্য পাঁচটা শহর থেকে এই মহানগরকে আলাদা করে রাখে। মাঝেমধ্যে খারাপ লাগা সত্ত্বেও এই শহরটাকে ভালো না বেসে যেন পারা যায় না!
সেই উদ্দেশ্যেহীন ঘোরাঘুরি’র সময়ে তোলা কুমোরটুলির কিছু ছবি।
ছবি : বিজয় চৌধুরী।
১-১০-২০২১