শনিবার | ৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:১৪
Logo
এই মুহূর্তে ::
গানের ভিতর দিয়ে দেখা পুজোর ভুবনখানি : সন্দীপন বিশ্বাস নবদুর্গা নবরাত্রি : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সাদা কালোয় কুমোরটুলি : বিজয় চৌধুরী জেল খাটাদের পুজো, মাইক আসছে মাইক, ছুটছে গ্রাম : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কাশ্মীর নির্বাচনে বিপুল সাড়ার নেপথ্যে কি ৩৭০ বিলোপের জবাব : তপন মল্লিক চৌধুরী তর্পণের তাৎপর্য : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় মহালয়ার চন্ডীপাঠ মন্ত্র, মহিষাসুরমর্দিনী স্তোত্র : বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৪ সুকুমার রায় মানেই শৈশব ও কৈশোর : রিঙ্কি সামন্ত অমৃতা প্রীতম-এর অনুবাদ গল্প ‘বুনোফুল’ মিল অমিলের মানিক ও মার্কেজ : রাজু আলাউদ্দিন কলকাতা ছিল একসময় ভেড়াদের শহর : অসিত দাস নিরাপদর পদযাত্রা ও শিমূলগাছ : বিজয়া দেব তোলা বন্দ্যো মা : নন্দিনী অধিকারী বাংলার নবজাগরণ ও মুসলমান সমাজ : দেবাশিস শেঠ সৌরভ হোসেন-এর ছোটগল্প ‘সালাম’ বঙ্গের শক্তি-পূজা : সুখেন্দু হীরা পুজোর পরিবর্তন, পরিবর্তনের পুজো : সন্দীপন বিশ্বাস পিতৃপক্ষের মধ্যে পালিত একাদশী — ইন্দিরা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত অরণ্যের অন্তরালে তাম্বদি সূরলা : নন্দিনী অধিকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেন : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র, পূর্ব পুরুষের ভিটে আজও অবহেলিত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব সুধীর চক্রবর্তী স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার : দীপাঞ্জন দে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে দুর্গা রূপে আরাধনা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালির নিজস্ব দুর্গা : শৌনক দত্ত সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার : দিলীপ মজুমদার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘প্রাতঃভ্রমণ’ বন্যায় পুনর্জীবন বেহুলার : রিঙ্কি সামন্ত গরানহাটা কি ছিল ভেড়ার হাট : অসিত দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই পিতৃপক্ষের সমাপ্তি মাতৃপক্ষের শুভ সূচনা-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

মিল অমিলের মানিক ও মার্কেজ : রাজু আলাউদ্দিন

রাজু আলাউদ্দিন / ৪৯ জন পড়েছেন
আপডেট সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আমাদের হীনম্মন্যতা সীমাহীন। যে কারণে বিদেশি ভাষায় স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের উচ্চতর প্রতিভাকে উচ্চতর বলার মতো আস্থা আমরা খুঁজে পাই না। আমাদের সমালোচনা সাহিত্যের পঙ্গুত্ব ও বামনত্ব এতই প্রকট যে বৃহতের ধারণাটিই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে বাংলা সাহিত্য থেকে। তাই জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমকালে উপেক্ষিত থেকেছেন বহুদিন। মৃত্যুর বহুকাল পর আজ আমরা বুঝতে পারছি, তাঁরা পৃথিবীর যেকোনো মহৎ প্রতিভার সঙ্গেই তুলনীয়।

এবং এটা আমরা বুঝতে পারি নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে নয়, বরং কোনো সাহেব যদি আমাদের বলেন, তবেই। দুজনই এখন আমাদের তুমুল আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা গবেষণা কম হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে যে দুটি আলোচনা আমাদের সমালোচনা সাহিত্যে সর্বোচ্চ মিনার হিসেবে দৃশ্যমান, তার একটি আহমদ ছফার ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি চরিত্র (১৯৭৩)’, অন্যটি আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘পদ্মা নদীর দ্বিতীয় মাঝি (আনুমানিক ১৯৭৩/৭৪)’। দুটো আলোচনাই মূলত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’কে কেন্দ্র করে। দুজনই এই উপন্যাসটিকে কেন্দ্র করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পীসত্তার সর্বোচ্চ প্রকাশকে যে গভীর অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন, তা আর কোনো সমালোচক করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

কিন্তু মানিকের এই উপন্যাসটিকে আরো নানা প্রেক্ষিতে দেখার সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেখা দরকার, যে কারণে পৃথিবীর মহান সাহিত্যকর্মগুলো প্রশংসা করি, তার সঙ্গে এর মিল বা অমিল কোথায় এবং কেন। যে প্রসারিত প্রেক্ষাপটে মানিককে পাঠ করতে পারতাম এবং সেই পাঠের ফল কী হতে পারত সে সম্পর্কে আমরা একরকম বিমুখতার পরিচয় দিয়ে এসেছি। অথচ যেকোনো সাহিত্যের অর্থের বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধি ঘটে, অন্য ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে যদি তা মিলিয়ে পাঠ করা যায়। সাঁত বভ এর ভাষায় যাকে বলা হয়ে থাকে এনলার্জমেন্ট অব টেঙ্ট।

কলম্বীয় লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’র সঙ্গে বাংলাভাষী পাঠকরা কমবেশি পরিচিত ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে। দুই দিগন্তের, দুই ভাষার এই দুই লেখকের প্রধান দুটি উপন্যাসকে পাশাপাশি রেখে পাঠের মাধ্যমে আমরা দেখতে চাই দুজনের শিল্পীচরিত্রের মিল ও অমিলগুলো।

স্বল্পায়ু মানিক (জন্ম ১৯ মে, ১৯০৮ মৃত্যু ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬) এর সঙ্গে দীর্ঘায়ু মার্কেসের (৬ মার্চ, ১৯২৭) যে বিষয়ে প্রথমেই মিলগুলো আমাদের নজরে পড়বে তা হলো দুজনই ছিলেন বাম রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ। দুজনেরই সৃষ্টিসত্তার মূল ভূখণ্ড গল্প ও উপন্যাস। ১৯৫২ থেকে মানিকের জীবনে যে আর্থিক সংকট চরমে ওঠে, তা মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৫৬) বজায় ছিল। অন্যদিকে ১৯৫৪ সালে কলম্বীয় স্বৈরশাসক পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে মার্কেসের জীবনে শুরু হয় আর্থিক দুর্ভোগ এবং প্যারিসে তিন বছর চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে দুঃসহ সংগ্রামে তাঁর জীবন প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রায় একই সময়ে দুজনই জীবনের চরম আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়ে একজন এগিয়ে যান মৃত্যুময় পরিণতির দিকে, আর অন্যজন সংকট উতরে জীবনের প্রাচুর্যের দিকে।

জীবনের এই খণ্ডকালীন সাযুজ্য ছাড়াও অন্য যে জায়গাটিতে তাদের মিল আরো বেশি আমাদের নজর কাড়ে সেটি হলো তাঁদের প্রধান দুটি রচনাকর্ম। মার্কেসের ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’র সঙ্গে মানিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র বেশ কিছু প্রবণতার সমান্তরাল গতি, তবে অমিলও আছে বিস্তর। আমরা মিল এবং অমিলগুলো পাশাপাশি রেখে এই দুই শিল্পীর ঐক্য ও যোগসূত্রের অর্থ আলোচনার চেষ্টা করব।

মোটা দাগের যে তথ্যগুলো প্রথমেই আমাদের হাতের কাছে রাখা দরকার তা হলো আমরা সবাই জানি, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালের ২৮ মে। পরে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে ১৯৪৮ সালের মে মাসে মুম্বাইয়ের কুতুব পাবলিশার্স থেকে Boatman of the Padma নামে প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে Cien A’os de Soledad বা শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা বুয়েনেস আইরেসের এদিতোরিয়াল সুদামেরিকানা থেকে ১৯৬৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়। কালের এই দূরত্ব সত্ত্বেও আশ্চর্য এই যে ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’ প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন প্রচ্ছদে রয়েছে বনের মাঝে একটি স্প্যানিশ গ্যালেওন (অভিযাত্রীদের বড় নৌকাবিশেষ) এর ছবি। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র প্রচ্ছদ প্রথম থেকে শুরু করে আজ অবধি নৌকার ছবিই প্রধান। আর উভয় উপন্যাসে জনপদের কাছেই রয়েছে নদী। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে তা একেবারেই লাগোয়া আর ‘শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা’য় মাকোন্দোর কাছেই : প্রাগৈতিহাসিক ডিমের মতো সাদা ও বিশাল, মসৃণ পাথরগুলোর অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত স্বচ্ছতোয়া নদীর পাশে মাটি ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে তৈরি গোটা বিশেক বাড়ি নিয়ে মাকোন্দো গ্রাম।(Cien A’os de Soledad, G. M. Marquez, Alfaguara, Espa’a, 2007, P 9)। এই সাযুজ্য ছাড়াও আমরা আরো কতগুলো গৌণ সাদৃশ্যের দিকে তাকাতে পারি, সেগুলো হচ্ছে উভয় লেখকেরই উপন্যাস দুটোর স্থান ও প্রধান দুই চরিত্রের নামের আদ্যক্ষর : মাকোন্দো ময়নাদ্বীপ এবং হোসেন (মিয়া) হোসে (আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া)। তবে এই সাদৃশ্যগুলো নিতান্তই গৌণ, হয়তো নিছকই কাকতালীয়। কিন্তু সাদৃশ্যের হাত ধরে আরো ভেতরে প্রবেশ করলে দেখতে পাব, এই দুজনের শিল্পীমনের এমন কিছু প্রবণতা যা রচনা দুটির ঐক্যের মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

চরিত্র, ঘটনা পরম্পরার প্রেক্ষাপট ও বিভিন্ন অনুষঙ্গের বিস্তার এবং তার কৌশলগুলোকে যদি আমরা একটু সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করি, তাহলে আমরা কিছু ঐক্যের বিন্দু চিহ্নিত করতে পারব। মারিও বার্গাস য়োসা শতবর্ষের নিঃসঙ্গতাকে বলেছিলেন : ‘মানের দিক থেকে সমপরিমাণ জটিলতা ও বিশালতা এবং প্রাণশক্তির ইমেজের মুখোমুখি হয়ে বাস্তবের সঙ্গে সমানতালে প্রতিযোগিতায় নামে।’ যেখানে ‘ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, আঞ্চলিকতা ও বিশ্বজনীনতা, কল্পনা ও বাস্তবতা।’ ব্যক্তি ও যৌথ, কিংবদন্তি ও ইতিহাস, দৈনন্দিন ও পুরাণ এক দেহে হলো লীন। ৪৭১ পৃষ্ঠার দীর্ঘ উপন্যাসে সাত প্রজন্মের দীর্ঘ আখ্যানের মধ্যে আপাতভাবে পরস্পরবিরোধী এ বিষয়গুলো বুননের যৌক্তিক পরম্পরার মাধ্যমে উপস্থিত হতে দেখি। অতিপ্রাকৃতিক, কুহক আর বুননের মুনশিয়ানা একে করে তুলেছে এক অসাধারণ সাহিত্যকৃতি। পার্থিব জীবনের সব স্তরে যা কিছু ঘটে, তার সামগ্রিক রূপটিকেই যেন মার্কেজ এই উপন্যাসে ধরার চেষ্টা করেছেন। মানব জীবনের প্রায় সব ধরনের প্রকাশের এক শিল্পীত রূপ হয়ে উঠেছে এই বই।

অন্যদিকে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ কাল এবং প্রেক্ষাপটের দিক থেকে হয়তো এতটা বিস্তৃত নয়। ঘটনার চাকচিক্যে ঠাসা নয় এর আখ্যান কিংবা বহু চরিত্রের সমাগমে তা হয়তো জনাকীর্ণও নয়। কিন্তু ‘ঐতিহ্য ও আধুনিকতা’, ‘আঞ্চলিকতা ও বিশ্বজনীনতা’, ‘কল্পনা ও বাস্তব’, ‘ব্যক্তি ও যৌথ’ এবং ‘কিংবদন্তি ও ইতিহাস’ এর পারস্পরিক বিনিময় এই উপন্যাসকে অসাধারণ এক মাত্রায় নিয়ে গেছে। এ উপন্যাসে কেতুপুর জনপদটি যদি হয় ‘ঐতিহ্য’, তাহলে ময়নাদ্বীপ হচ্ছে তার ‘আধুনিকতা’। কেতুপুরের মানুষ যদি হয় ‘যৌথ’, তাহলে হোসেন মিয়া হচ্ছে আধুনিক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সেই স্বাপি্নক ‘ব্যক্তি’। আবার এই ‘ব্যক্তি’টি বহু স্বরের (Polyphonic) এক সমাহারও। কেতুপুর যদি হয় ‘আঞ্চলিকতা’, তাহলে ইতিহাস ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সুগভীর প্রজ্ঞা দিয়ে এই স্বাপি্নক ব্যক্তিটি ময়নাদ্বীপকে ‘সার্বজনীন’ এক কল্পরাজ্যে উত্তীর্ণ করে দিতে চেয়েছেন। ‘গার্সিয়া মার্কেসের বুয়েন্দিয়া পরিবার কলম্বিয়ার জঙ্গলে খুঁজে পেয়েছিলেন বিপন্ন সেই আর্কেডিয়া, যেখানে লাতিন আমেরিকার স্বর্ণযুগের অতীত এবং ইউরোপীয় প্রগতিমুখী ইউটোপিয়া ভয়ংকর চেহারায় পরস্পরকে সন্দর্শন করছে। (কার্লোস ফুয়েন্তেস, অনু. : মুহম্মদ মুহসিন, সিন্দাবাদ, ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃ. ১৬)।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ময়নাদ্বীপও কি সেই আর্কেডিয়া নয়, যেখানে সমুদ্রবেষ্টিত প্রাগৈতিহাসিক কুমারী অতীতের মধ্যে হোসেন মিয়ার মাধ্যমে প্রবেশ করে ইউরোপীয় প্রগতিমুখী ইউটোপিয়া?” যে যন্ত্রবিজ্ঞানের প্রসাদে এবং প্রকৃতিবিষয়ক জ্ঞানের সাহায্যে একসময় ইউরোপীয় ভৌগোলিক অভিযাত্রীর দল আমেরিকা থেকে মেরু প্রদেশ অবধি অভিসার যাত্রা করেছিল, হোসেন মিয়া সে কলম্বাস, ক্যাপ্টেন কুকেরই বঙ্গীয় সংস্করণ। (বাঙালি মুসলমানের মন, আহমদ ছফা, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কম্পানি, ২০০৯, পৃ. ৪২)।

বলা হয়ে থাকে এবং তা সত্যিও যে শতবর্ষের নিঃসঙ্গতাকে বাইবেল, পুরাণ, ইতিহাস আবার একেবারে নিছক আখ্যান হিসেবে পাঠ করা যায়; কারণ এই বিশাল আখ্যানের ঘটনাপুঞ্জের মধ্যে স্তরে স্তরে প্রবিষ্ট হয়ে আছে এসব। ‘মার্কেজ এটা (অর্থাৎ বাইবেল) দেখিয়েছেন স্বর্গীয় দম্পতি হোসে আর্কেদিয়ো ও উরসুলার মধ্য দিয়ে। তারা তাদের পাপের পুরনো পৃথিবী ছেড়ে এসেছে এবং অনেক শঙ্কা ও সম্ভাবনা নিয়ে রচনা করছে দ্বিতীয় স্বর্গ মাকোন্দো। (কার্লোস ফুয়েন্তেস, সিন্দাবাদ, ১ বর্ষ ২০১০, পৃ. ২২)।’ তার মানে, মার্কেজ বাইবেলের আদম হাওয়ার গল্প বলছেন। আবার এই গল্পের মধ্যে রয়েছে ইউরোপের সেই ইতিহাসের গল্প, অর্থাৎ যে ইউরোপে ইউরোপীয়রা পাপের এবং ক্লেশের স্বর্গ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে খুঁজে পেয়েছে নতুন পৃথিবী অর্থাৎ আমেরিকা, অর্থাৎ মার্কেসের মাকোন্দো যার একটি মিনিয়েচার। পদ্মা নদীর মাঝিতে এতটা স্পষ্টভাবে না হলেও, খানিকটা প্রচ্ছন্নভাবে এ ঘটনার একটা সমান্তরাল আমরা দেখতে পাব। ‘কেতুপুর’ নামক স্বর্গ থেকে কিংবা ঐতিহাসিক অর্থে ইউরোপ থেকে পাপ অথবা অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য ময়নাদ্বীপের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় কুবের ও কপিলা। মার্কেসের মতো মানিকও এখানে পুরাণের সঙ্গে ইতিহাস মিশিয়ে দিয়েছেন। ঘটনার সমান্তরাল আমরা আরো একটি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও পাব। শতবর্ষের প্রধান দুই চরিত্র হোসে আর্কাদিয়ো এবং উরসুলা, যারা সম্পর্কে একই বংশলতিকার হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই সম্পর্কের কারণে ভবিষ্যতে তাদের বংশে কোনো এক সন্তান শুয়োরের লেজ নিয়ে জন্মাবে বলে আশঙ্কা করে। লেজওয়ালা সন্তান জন্মদানের আশঙ্কা এড়ানোর জন্য দৈহিক মিলন থেকে দীর্ঘদিন বিরত থাকলেও পরে তারা ঠিকই দৈহিকভাবে মিলিত হয়। এই সংসর্গের ফল যে শুয়োরের লেজওয়ালা শিশু, তা ভাবার পরও তারা সেটা সম্পাদন করে। ‘কারণ যে শিশুই হোক, পৃথিবীটি তো টিকিয়ে রাখতে হবে।’ ময়নাদ্বীপে এ রকম ঘটনা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নয়, বরং আরো দুঃসাহসী জায়গা থেকে আমরা ঘটতে দেখব, বৃদ্ধ বয়সিয়ের যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে যুবক এনায়েতের অবৈধ সম্পর্ককে হোসেন মিয়া অনুমোদন করে। কারণ ময়নাদ্বীপকে মানুষে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে তার কল্পরাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কাল, সংস্কৃতি, ভাষা ও ভৌগোলিক দূরত্বকে ভেদ করে দুজন লেখকই দৃষ্টিভঙ্গির অভিন্ন বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছেন এইভাবে।

মাকোন্দো এবং ময়নাদ্বীপের একটা বড় সাযুজ্যের জায়গা হচ্ছে এর স্থানের নিঃসংগতা। মাকোন্দো তার স্বর্গোপম বিচ্ছিন্নতা নিয়েই এক নিঃসঙ্গ জায়গায় স্থাপিত। জেনেসিসের পৌরাণিক কাব্যিক ভাষায় মাকোন্দোর দূরবর্তিতার বর্ণনায় মার্কেজ এক প্রাচীনতার আবহ তৈরি করেন। ময়নাদ্বীপ যেহেতু সমুদ্রবেষ্টিত একটি দ্বীপ, সমাজ ও সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, মাকোন্দোর মতোই এক নিঃসঙ্গ জায়গায় তা স্থাপিত। দুটো জনপদই সভ্যতার সঙ্গে, ইতিহাসের সঙ্গে বা আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করছে মেলাকিয়াদিস ও হোসেন মিয়ার মাধ্যমে। মানবজাতির অগ্রসর অংশের চিন্তা চেতনা, জীবন অভীপ্সায় সমৃদ্ধ ‘হোসেন নিজের জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন মানব সভ্যতার সৃষ্টি করতে যাচ্ছে একাকী।’ (বাঙালি মুসলমানের মন, আহমদ ছফা, খান ব্রাদার্স, এপ্রিল ২০০৯, পৃ. ৪২)। হোসে আর্কাদিও ও হোসেন মিয়ার মতোই পুরোপুরি জীবন অভীপ্সায় পূর্ণ। মেলকিয়াদেস এর কাছ থেকে পাওয়া বহির্বিশ্বের উন্নত জ্ঞান বিজ্ঞানের (যেমন চুম্বক, আতশকাচ) সাহায্যে সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন গোটা পরিবারের জীবনমানকে সে উচ্চতর জায়গায় নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। উপন্যাসের শুরুর দিকে আমরা দেখব যে মেলকিয়াদেস এর কাছ থেকে পাওয়া পর্তুগিজ মানচিত্র, নৌ বিদ্যার যন্ত্রপাতি, অ্যাস্ট্রোলেব, কম্পাস ও সেঙ্টান্ট নিয়ে উঠে পড়ে লাগে। মাসের পর মাস এসব নিয়ে পরীক্ষা করার পর সে নক্ষত্রের গতিবিধি, সময় নির্ণয়ের সঠিক পদ্ধতি, সাগরে পথ চিনে চলার কৌশলগুলো রপ্ত করে ফেলে। এই হোসে আর্কাদিওকে দেখলে মনে হয় সে যেন পদ্মা নদীর মাঝির হোসেন মিয়ার দূরবর্তী রক্ত ও স্পন্দনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্বরলিপি। কারণ মানিকের ভাষায়, ‘হোসেন মিয়া যে কত বড় দক্ষ নাবিক, দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের বুকে তাহার নৌকা পরিচালনা দেখিয়াই তাহা বোঝা গেল। সামনে একটা কম্পাস রাখিয়া সে হাল ধরিয়া বসিল, নৌকার ছয়জন মাঝি টানিতে লাগিল দাঁড়। (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০ মে ১৯৯৮, পৃ. ৭১)।’ হোসেন মিয়াকে কখনো কখনো মনে হয়, হোসে আর্কাদিও এবং মেলকিয়াদেস এর যোগফল বা উল্টোভাবে বলা যেতে পারে, হোসে আর্কাদিও ও মেলকিয়াদেস হচ্ছে হোসেন মিয়ারই দুই অপভ্রংশ।

আহমদ ছফা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে “আসলে ‘হোসেন মিয়া’ চরিত্রটিকে লেখক মানিকবাবু মানুষের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার অনেকগুলো পর্যায়েরই ঘনীভূত রূপ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩)।”

অন্যদিকে, বার্গাস য়োসা কিংবা ফুয়েন্তেসও আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে শতবর্ষের নিঃসংগতাকে নানাভাবে পাঠ করা যায়। এটি যেন বাইবেলীয় পুরাণের অন্যপাঠ, তেমনি এটি ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বপ্ন এবং বাস্তবতার এক পাঠান্তর। ইউরোপের ঔপনিবেশিক অভিযাত্রীদের মাধ্যমে কিভাবে ইউরোপীয় আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটছে, তারও এক প্রচ্ছন্ন রূপ আমরা খুঁজে পাব শতবর্ষের নিঃসংগতায়। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কেতুপুরকে যদি আমরা ইউরোপ মহাদেশ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে ময়নাদ্বীপ হচ্ছে তার আমেরিকা। আর হোসেন মিয়া আমাদের ক্রিস্তোবাল কোলন বা ফের্নান্দো দে মাগেইয়ান। এমন বিবেচনা যে মোটেই কষ্টকল্পিত নয়, তার একটা নজির আমরা দেখতে পাব এই উপন্যাসের মাঝামাঝি, যখন হোসেন মিয়া কুবেরকে নিয়ে প্রথমবার কেতুপুর থেকে ময়নাদ্বীপে যাচ্ছে। এই যাত্রার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে : “ম্যাপ দেখে যাত্রাপথ নির্ণয়, ‘বিয়ালি্লশ ডিগ্রি কোণ ধরিয়া পূর্ব দক্ষিণে নৌকা’ চালনা, ‘সামনে একটি কম্পাস রাখিয়া’ হাল ধরে থাকা।” তার পরও ‘সারা দিন নৌকার অবস্থান বুঝিতে পারা যাইবে কি না সন্দেহ। অপেক্ষা করিতে হইবে রাত্রির জন্য। রাত্রে তারা উঠিলে ওই যে অদ্ভুত যন্ত্রটা আছে হোসেনের, ওই যন্ত্রের ভিতর দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া তবে হোসেন বলিতে পারিবে কোন দিকে কতদূর ধনমানিক দ্বীপ লুকাইয়া আছে।’ ক্রিস্তোবান কোলন বা ফের্নান্দো দে মাগেইয়ানের ঘনীভূত ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা হোসেন মিয়ার সীমান্তভেদী চরিত্রটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন মানিক বলেন, ‘বড় বড় জাহাজ চালাইয়া হোসেন এখন পৃথিবী ঘুরিয়া আসিতে পারে।’ নতুন পৃথিবীতে দেখা অদ্ভুত দর্শন প্রাণীগুলোর কথা বাদ দিলে এ যেন আন্তোনিও পিগাফেত্তারই বর্ণনা।

‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে আমরা দেখতে পাই, কেতুপুরের মানুষকে নানা রকম সমস্যা থেকে উদ্ধার করে এই হোসেন মিয়া। উঁচু সমাজের কারোর সঙ্গে দরকারী যোগাযোগ থাকলেও বসবাস করে এই নীচু জাতের ধীবরদের সঙ্গেই। মেলকিয়াদেসের চরিত্রের গড়নটিও অনেকটা হোসেন মিয়ার মতোই। আমরা আগেই দেখেছি, নানা রকম জিনিসপত্র দিয়ে সে হোসে আর্কাদিওকে সাহায্য করেছে। এমনকি মাকোন্দোতে যখন অনিদ্রার মহামারী দেখা দেয়, তখনো সে এই জনপদকে রক্ষা করে এক ধরনের তরল প্রতিশেধক দিয়ে। সিঙ্গাপুরে এক মহামারীতে মরে যাওয়ার পরও মৃত্যুর নিঃসংগতা সহ্য করতে না পেরে বুয়েন্দিয়া পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য ফিরে আসে সে। মাকোন্দো জনপদের নিয়তি যেমন অনেকটাই নির্ভর করে মেলকিয়াদেসের ওপর, তেমনিভাবে কেতুপুর ও ময়নাদ্বীপের মানুষের নিয়তিও নির্ভরশীল হোসেন মিয়ার ওপর।

তবে চরিত্র হিসেবে, শতবর্ষের নিঃসংগতায় যদিও অসংখ্য চরিত্র রয়েছে সাত প্রজন্মের বিশাল পটভূমিতে, কিন্তু কোনোটিই হোসেন মিয়ার মতো প্রজ্ঞা, মানবিকতা ও সৃজনশীলতায় এতখানি উচ্চতাকে স্পর্শ করতে পারেনি। হোসেন মিয়ার মধ্যে আমরা দেখতে পাব বহু ব্যক্তিত্বের সমন্বয়। রাষ্ট্রভাবনার স্পষ্টতা, নিখুঁত প্রযুক্তিজ্ঞান এবং সৃজনশীলতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি চরিত্রও নেই, (শতবর্ষে) যেটি মহাকাব্যিক মহীমায় গরীয়ান হয়ে উঠতে পারে। বিচ্ছিন্নভাবে কেবল এই গুণগুলো বিভিন্ন চরিত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শতবর্ষের যে চরিত্রটি মহাকাব্যিক উচ্চতায় সবচেয়ে দৃশ্যমান সে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া। কিন্তু হোসেন মিয়ার সংযম, সুস্থিতি, বুদ্ধিমত্তা, অবিচলতা এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির থাকার মতো চারিত্রিক সংহতি আউরেলিয়ানোর মধ্যে নেই। আউরেলিয়ানো উত্তাল তরঙ্গের মতো, অন্যদিকে হোসেন মিয়া শান্ত; কিন্তু অভিযান প্রিয়, কর্মচঞ্চল তবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অবিচল।

আগেই বলেছি যে ‘শতবর্ষে’ বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার এক অসাধারণ মিলন ঘটেছে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তেও কি সে রকম কিছু ঘটেছে? এর উত্তর হ্যাঁ ও না দুটোই। হ্যাঁ, এই জন্য যে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে আখ্যানে নয়, এই ব্যাপারটা ঘটেছে কেবল হোসেন মিয়া নামক চরিত্রটির মধ্যে। সে ইতিহাস, বাস্তবতা এবং কল্পনার এক মিশ্র চরিত্র। আহমদ ছফা ঠিকই বলেছেন :

‘যুগ যুগান্তরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার প্রতিভূ হিসেবে হোসেনকে উপস্থাপন করেছেন বলেই… যতটা চেনা পোশাকে দেখা দিক না কেন, হোসেন মিয়া চরিত্রের কোন বাস্তবতা নেই।’ আর ‘না’ এই কারণে যে উপন্যাসটির বাকি সব চরিত্র এবং এর আখ্যানরীতি বাস্তবানুগ। ‘শতবর্ষের’ মতো তা একই সঙ্গে বাস্তব এবং বাস্তব বিদীর্ণ ফ্যান্টাসি, কুহক, চোরাগুপ্তা ঠাট্টায় ও কমিকে ঠাসা নয়। শতবর্ষে চরিত্রগুলোর চেয়ে বরং আখ্যান, আখ্যানের ভেতরকার ঘটনাবলি এবং এর বুনন কৌশলের মাধ্যমে রয়েছে কল্পনার বিস্তার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে মানিক ঠিক তার বিপরীত। বিপরীত এই অর্থেতে তিনি ট্র্যাজিক চেতনার প্রতিভূ নন। মানিকের পক্ষে তা হওয়াও সম্ভব ছিল না এই উপন্যাসে। সেটা করতে গেলে হোসেন মিয়াকে চরিত্র হিসেবে দাঁড় করানো সম্ভব হতো না। কারণ উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে মানিক যে আকাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করতে চেয়েছিলেন তা ট্র্যাজিক চেতনার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। সেটা করতে গেলে হোসেন মিয়া চরিত্রটিকে বদলে ফেলতে হতো।

এটা ঠিক, পদ্মা নদীর মাঝির তুলনায় ‘শতবর্ষ’ অনেক বেশি বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে। অনেক কিছুকে এটি একসঙ্গে আগলে ধরে রেখেছে। ঘটনার ডালপালাময় বিস্তার যতটা ‘শতবর্ষে’ রয়েছে, পদ্মা নদীতে তা নেই। গতির চাঞ্চল্যে আখ্যান আগাগোড়া উত্তাল এবং কুহকী ও অস্বাভাবিক আচরণের উচ্ছ্বাসে কাহিনী হয়ে উঠেছে চপল। না, পদ্মা নদীর মাঝি’র কাহিনীতে এই ‘উত্তাল’ ‘চপলতা’ নেই। শিল্পরীতির দিক থেকেও এরা পরস্পর আলাদা। গোটা ইউরোপীয় উপন্যাসের ধারাটিকেই শতবর্ষ চ্যালেঞ্জ করেছে তার অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মাধ্যমে। জাদুবাস্তবতা, ফ্যান্টাসি তো আছেই পাশাপাশি ইউরোকেন্দ্রিক উপন্যাসের ধারার বাইরে গিয়ে অসম্ভব সূক্ষ্মতায় তিনি একে করে তুলেছেন কমিক্যাল : আয়রনি, হিউমার ও জোক এর পাতায় পাতায় ট্র্যাজিক চেতনার সহচর। আর অপ্রাকৃত সব অভিব্যক্তির মাধ্যমে পশ্চিমের র‌্যাশানালিস্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি ছুড়ে দিয়েছে এক চ্যালেঞ্জ। এ সব কিছু মিলিয়ে তিনি শতবর্ষের এক নতুন ধরনের শিল্পরীতির প্রবর্তন করেছেন। এই অর্থে মানিক কোনো নতুন শিল্পশৈলী প্রবর্তন করেননি। মার্কেজ যদি নতুন শিল্পরীতি ও সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য উত্তরাধুনিক হয়ে থাকেন তাহলে মানিক ছিলেন রীতির দিক থেকে ইউরোপীয় উপন্যাসশৈলীর অনুসারী। শিল্পরীতির নতুন কোনো ধরন নয়, তিনি মনোযোগী ছিলেন নতুন জীবনরীতি প্রবর্তনে।

উপন্যাসের জন্য নতুন ও জটিল শিল্পরীতির উদ্ভাবনের পক্ষে মার্কেসের জন্য যে আনুকূল্য বিরাজমান ছিল, মানিকের তা ছিল না। স্প্যানিশ ভাষায় উপন্যাসের শুরু যদি ‘দোন কিহোতে’ দিয়ে হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয়, স্প্যানিশ আমেরিকান উপন্যাসের ঐতিহ্যের বয়স আজকে ৪০০ বছরেরও ওপরে, কারণ দোন কিহোতে বেরিয়েছিল ১৬০৫ সালে। আর শুধু ‘কিহোতে’ই নয়, সে ভাষায় একের পর এক যুক্ত হয়েছেন আধুনিক যুগের অসাধারণ সব ঔপন্যাসিক ও গল্পকার যেমন পেরেস গালদোস, বাইরে ইনক্লান, রোমুনো গাইয়েগোস, হোমে মারিয়া আর্গেদাস, হুয়ান রুনফো, মিগেল আনহেন আস্তুরিয়ান্স, আলেহো কাপেন্তিয়ের, হোর্হে লুইস বোর্হেস, হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি, হোসে লেসামা লিমা কিংবা মাসেদোনিও ফের্নান্দেসের মতো অদ্ভুত ও অসাধারণ সব কথাসাহিত্যিক। বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বিশাল এই প্রেক্ষাপট মার্কেসের জন্য এক বিরাট উদ্দীপক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ এই দীর্ঘ ঐতিহ্যের ভাণ্ডার জ্ঞাতে অজ্ঞাতে তাঁর লেখক সত্তাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে নিশ্চয়ই। অন্যদিকে মানিকের পেছনে ছিল মাত্র ১০০ বছরের অদীর্ঘ ঐতিহ্য, বঙ্কিম কিংবা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা উপন্যাসে উল্লেখ করার মতো কেউ ই ছিলেন না তাঁর সামনে। এমনকি এই বঙ্কিম এবং রবীন্দ্রনাথও উপন্যাসের ক্ষেত্রে বড় কোনো মোচড় নয়। তাঁরা উল্লেখ্য এই জন্য যে বাংলা ভাষায় সবেমাত্র উপন্যাস লেখা হচ্ছে বলে। তাঁরা কেউ ই উপন্যাস বা গল্পের ক্ষেত্রে সের্বান্তেস, কার্পেন্তিয়ের, বোর্হেস, রুলফো, আস্তুরিয়াস কিংবা মাসেদোনিও ফের্নান্দেসের মতো নতুন কোনো শৈলীর প্রবর্তক বা পরীক্ষা নিরীক্ষাকারীর ভূমিকায় ছিলেন না। ফলে মার্কেজ যে উর্বর ও প্রস্তুত ক্ষেত্র পেয়েছেন, মানিক তা পাননি। মানিক প্রায় শূন্য ভূমিতে একাকী বুনেছিলেন তাঁর প্রতিভার নিজস্ব বীজ। ঐতিহ্যের সংকীর্ণ প্রেক্ষাপটের কথা মাথায় রাখলে মানিকের কৃতিকে এক বিরাট উল্লম্ফন বলেই মনে হবে।

তার পরও ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ‘শতবর্ষের নিঃসংগতা’র শৈল্পিক উচ্চতাকে ধরতে পারেননি এটা খুবই পরিষ্কার আমাদের কাছে। তবে মানিক এই অনুচ্চতাকে পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এই উপন্যাসে হাজির করে। এক ধর্ম, অন্যটি হচ্ছে কল্পরাজ্যের প্রধান উপাদান প্রেম। লাতিন আমেরিকার লেখক হওয়ার ফলে নেরুদা থেকে শুরু করে মার্কেজ পর্যন্ত ইতিহাসের কাছে তাঁদের সমাজ ও জনগণের কাছে যে দায়বদ্ধতা এবং অঙ্গীকারের কথা বলেন, সেই অঙ্গীকারকে মানিক পূরণ করার চেষ্টা করেছিলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে। যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রসংগের কথা বলেছি, মানিকের আগে বঙ্কিমচন্দ্র তা হাতে তুলে নিয়েছিলেন; কিন্তু ‘সীতারাম’ এ ধর্মকে নির্বিষ করতে গিয়ে আনন্দমঠ এ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি ধর্মীয় উন্মাদনার সেই বিষ। মানিকের আগেই বঙ্কিম একটি আদর্শ কল্পরাজ্যের কল্পনা করলেও শেষ পর্যন্ত ‘সীতারাম’ এ তা ব্যর্থ হন। বঙ্কিম যা পারেননি মানিক তা অসাধারণ নিরপেক্ষতায় পদ্মা নদীর মাঝিতে সফল করে তুলেছেন। তাঁর সাফল্যের জায়গাটিকে চিহ্নিত করার আগে মার্কেসের সঙ্গে তাঁর পার্থক্যটিকেও বিবেচনায় আনতে চাই। ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা পশ্চিমে কিংবা লাতিন আমেরিকায় অতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু ভারতবর্ষে এটি এখনো এক প্রধান সমস্যা। আজকের দিনে, এই মৌলবাদের যুগে তা আরো বেশি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে উঠেছে। আজ মার্কেসের সমাজে ধর্ম এতটা স্পর্শকাতর বিষয় নয়, যা নিয়ে কোনো প্রতিকূল মন্তব্য ভয়ংকর বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তার পরও শতবর্ষে ধর্ম মার্কেসের প্রচ্ছন্ন ঠাট্টার উপাদান হিসেবে হাজির হয়েছে। বিস্মৃতির মহামারী থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে মাকোন্দোর প্রবেশের প্রধান সড়কে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এই বাণী যে ‘ঈশ্বর আছেন’। বঙ্কিম ধর্মানুভূতির সমাধান দিতে গিয়ে ধর্মের তরবারিতে খণ্ডিত করেছেন ভারতকে এবং একক জাতিসত্তাকে। মানিক আমাদের বঙ্কিম বা মার্কেসের বাইরে তাঁর কল্পরাজ্যকে সফল করে তোলার স্বার্থে এমন এক জায়গায় আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে ধর্মকে তিনি শৈল্পিক যুক্তির পরম্পরায় গৌণ করে নিয়ে এসেছেন।

১. ধর্ম যতই পৃথক হোক, দিন যাপনের মধ্যে তাহাদের বিশেষ পার্থক্য নাই। সকলেই তাহারা সমভাবে ধর্মের চেয়ে এক বড় অধর্ম পালন করে দারিদ্র্য। (পৃ. ৩১, প্রাগুক্ত।)

২. কী ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ভাঙার গ্রামে যাহারা মাটি ছানিয়া জীবিকা অর্জন করে তাহাদের মধ্যে ধর্মের পার্থক্য থাক, পদ্মা নদীর মাঝিরা সকলে একধর্মী। (পৃ. ৬৮, প্রাগুক্ত।)

৩. হোসেন মিয়া বলে, ময়নাদ্বীপি মোল্লা পামু কই? রাজবাড়ীর আজীজ হাসান ছাহাব কন, ময়নাদ্বীপি শও জনা মানুষ হলি আর মসজিদ দিলি আর হিঁদুরে জমিন না দিলি গিয়া থাকতে পারেন। তা পারুম না মিয়া। হিঁদু না নিলি মানুষ পামু কই? হিঁদু নিলি মসজিদ দিমু না। ক্যামনে দিমু কও? মুসলমানে মসজিদ দিলি, হিঁদু দিব ঠাহুর ঘর না মিয়া, আমার দ্বীপির মদ্যি ও কাম চলব না। (পৃ. ৭০, প্রাগুক্ত)

মার্কেসের ‘শতবর্ষে’ ধর্ম এসেছে মিহি ঠাট্টা (God exist) হিসেবে। কিন্তু মানিকের কাছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতপাতহীন উদার ধর্মের প্রশ্নে লাতিন আমেরিকার তুলনায় এই ভূ ভারতের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন জিনিস। ধর্মকে কেন্দ্র করে একই জাতিকে এবং ভূখণ্ডকে কেটে ফেলার মতো রাজনীতির বীজকে মানিক যেমন বেড়ে উঠতে দেখেছেন, তেমনি বঙ্কিমের হাতে ধর্মীয় উপাদানের অসতর্ক ব্যবহারের ঝুঁকির বিষয়টি তিনি নিশ্চয়ই জানতেন। মানিকের কাছে তাই ধর্মের প্রতি পক্ষপাতহীনতাকেই ঐক্যের জন্য দরকারি মনে হয়েছে। অন্তত ভারতের মতো জাতপাত, বর্ণ ও বর্ণবাদী সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে ময়নাদ্বীপ প্রতিষ্ঠার জন্য এর কোনো বিকল্প ছিল না। ফলে সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণেই ধর্মের প্রতি এই দুই লেখকের মনোভাবের দুটি ভিন্ন চেহারা আমরা দেখতে পাই।

‘শতবর্ষ’ পাঠের শেষে আমরা দেখতে পাই, মাকোন্দো শেষ পর্যন্ত একটা ভুতুড়ে জনপদে পরিণত হয়। ‘মাকোন্দো ততক্ষণে বাইবেলীয় হারিকেনের রুদ্ররোষে ঘুরপাক খাওয়া ধুলোবালি আর ধ্বংসস্তূপে পরিণত’ বত্রিশটা যুদ্ধ এই মাকোন্দোকে রক্ষা করতে পারেনি, কারণ যুদ্ধগুলো আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিল না। ভালোবাসার যে সম্পর্ক সংহতির জন্ম দিতে পারত, যে সংহতি বাস্তবায়িত করতে পারত কল্পরাজ্যের সম্ভাবনাকে, তাও কার্যত নিঃসংগতার (Soledad) অন্য রূপ হয়ে ওঠে মাত্র। আখ্যানের দুই চরিত্র আউরেলিয়ানো এবং আমারান্তা উরসুলা ‘নিঃসংগতা ও প্রেম এবং প্রেমের নিঃসংগতার এমন এক ঘরে তারা বন্দি হয়ে পড়ে, যেখানে লাল পিঁপড়ের উৎপাতে ঘুমানো প্রায় অসম্ভব (La nueva novela hispanoamericana, Corlos Fuentes, Mexico 1980, p : 61 62 )।

মানিক তাঁর ময়নাদ্বীপকে সফল করার জন্য ভালোবাসার ভিতকে প্রথম থেকেই সযত্নে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। ময়নাদ্বীপ যদি প্রতীকী অর্থে একটি সফল জনপদের কল্পনা হয়ে থাকে, তাহলে এই জনপদের মূল উপাদান প্রেম প্রতীকায়িত হয়ে উঠেছে কপিলা কুবেরের প্রেমের মাধ্যমে। উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায় হোসেনের প্রকাণ্ড নৌকাটি যখন ময়নাদ্বীপের উদ্দেশে রওনা হবে তখন

‘ছইয়ের মধ্যে গিয়া সে (কুবের) বসিল। কুবেরকে ডাকিয়া বলিল, আমারে নিবা মাঝি লগে?

হ, কপিলা চলুক সঙ্গে। একা অতদূরে কুবের পাড়ি দিতে পারিবে না।’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ২০ মে, ১৯৯৮, কলকাতা, পৃ. ৯৭)।

এই নিবন্ধের শেষে আমাদের মনে পড়বে মার্কেজ তাঁর নোবেল বক্তৃতায় এক কল্পরাজ্যের কথা বলেছিলেন ‘যেখানে কেউ অন্যদের মৃত্যুর ধরন ঠিক করে দেবে না, যেখানে ভালোবাসা হয়ে উঠবে সত্য এবং সুখ হবে সম্ভব, যেখানে নিঃসংগতার দণ্ডপ্রাপ্ত জাতিগুলো সর্বশেষ চিরকালের জন্য পৃথিবীতে দ্বিতীয় সুযোগ পাবে।’

মানিক বন্দ্যোপাধায় তাঁর উপন্যাসে Foreshadow করেছিলেন মার্কেসেরই কল্পরাজ্যের, যা মার্কেসের নিজের উপন্যাসে অদেখাই থেকে গেছে। কিন্তু মার্কেজ বাস্তবে যা আকাঙ্ক্ষা করেছেন মানিক, তা ই পূরণ করে রেখেছিলেন মার্কেসের বহু আগেই, অন্য নামে, ময়নাদ্বীপ এ।

‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে কুবের ও কপিলার প্রেমের সংহতির মাধ্যমে এই কল্পরাজ্যের দ্বিতীয় সুযোগটি আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন বাংলা ভাষার মহান ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আজ থেকে ১০৩ বছর আগে।

পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন