বাংলা ও বাঙালি ছাড়া মা দুর্গার যে রূপ দেখেন তা কি আর কোথাও দেখেছেন? জানি কেউ কেউ ঠোঁট উল্টে বলবেন বাঙালির আবার নিজস্ব দুর্গা হলো কবে থেকে! অনেকেই বলবেন মা দুর্গা তো সকল সনাতন ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের,কথাটা শেষ করেই কপালে বার দুয়েক হাত ছুঁয়ে বিড়বিড় করবেন কলিকাল বাবা ঘোর কলি,যে যার মতো করে লিখছে বলছে ছ্যাঁ ছ্যাঁ কি অনাচার। কেউ হয়ত পড়ে দেখতে চাইবেন লেখাটি, সে যাই হোক আমি আমার নিজের মতো করে আমার কথাগুলো বরং লিখে যাই তারপর দেখা যাবে কিছু হলো কিনা,যদি কিছু হয় তবে তা পাঠকের আর যদি প্রলাপ হয় কিংবা অধর্ম তবে তার দায় একান্ত আমার।
বাঙালি জাতি সৃষ্টিলগ্ন থেকে উৎসব প্রিয় জাতি বাঙালি তাঁর জনজীবনে দুর্গাকে দূর্গতি নাশিনীরূপে এমন একটি উচ্চতায় নিয়ে গেছে যেখানে ধর্ম ছাড়িয়ে লোকাচার বড় হয়ে ধরা দিয়েছে, ভগবানের চেয়ে চিরচেনা জীবন উঠে এসেছে। ধর্মীয় আলোকে খোঁজ খবর করলে দেখা যায় মার্কন্ডুয়ে পুরানে আছে চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা খ্রীষ্ট্রের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে ওড়িষ্যা) দশেরা নামে দূর্গা পুজা প্রচলন করেছিল। নেপালে দশেরা বা দশাইন নামেই পুজা হয়। যদিও প্রাচীন ওড়িষ্যার সাথে নেপালের পূজার যোগসূত্র আছে কিনা সে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। যারা ছ্যাঁ ছ্যাঁ করছিলেন তাদের হাসি ছড়িয়ে পড়েছে সঙ্গে পিনাপ করা আছে বিদ্রুপ আর সেখানে গুঞ্জরিত হচ্ছে-যে ভাব নিয়ে শুরু করেছিলে বাবা সেই তো রদ্দি মার্কা তথ্য ঢেলে দিলে নতুন কিছু দাও বাছাধন। নতুন কিছু দেবার মতো আদতে কিছুই নেই কেননা খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও ভারতে বৈদিক আর্যদের মধ্যে এই দেবী পূজা ছিলো না। ছান্দগ্য এবং কেনোপনিষদে রুদ্রানী, ভবানী, উমা প্রভৃতি যে নাম আছে, ঋগ্বেদরে [বেদিক সংশোধক মন্ডল সংস্করণ] ৪র্থ খন্ডে ৯৫৭। ৯৫৮ পৃষ্ঠাতে ভদ্রা “শিবা” “দূর্গা” প্রভৃতির যে উল্লেখ আছে [“সহস্র সম্মিতাং দুর্গাং জাত বেদসে সুনবাম্ সোমম্”], মুন্ডকোপনিষদে জাত বেদস্ অগ্নির, [কালী-করালী চ মনোজবাচ, সুলোহিতা যা চ সুধুম্রবর্ণা, স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচী চ দেবী লোলায়মানাইতি সপ্তজিহ্বাঃ”]-ইত্যাদি আহুতি গ্রহণে সমর্থা দ্যুতিমতী সপ্তজিহ্বার যে বর্ণনা আছে-তাই থেকে শাক্তরা উপাদান সংগ্রহ করে কালী,মা তারা, দূর্গা, যোড়শী বগলামুখী ইত্যাদি এক একটা স্বতন্ত্র দেবী বানিয়ে স্বতন্ত্র মূর্ত্তিপূজার প্রচলন করে গেছেন। বেদে উপনিষদে কিন্তু ভদ্রা দূর্গা উমা শক্তি প্রভৃতি নামগুলি একই পরমাত্মা বাচক অর্থে ব্রহ্ম বিদ্যাপ্রকাশিকা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। “দেবী” বলতে পৃথক কোন ঠাকুর নয়, পরমেশ্বরের নামই দেবী। পরমেশ্বরের নাম তিনলিঙ্গেই আছে, যথা-“ব্রহ্মচিতিরীশ্বরশ্চেতি”; যখন ঈশ্বরের বিশেষণ তখন “দেব” আর যখন চিতির বিশেষণ হবে তখন “দেবী”। জানি এও জানা তথ্য তাই নতুন কিছুই লেখার নেই তবে একটা গল্প এখানে লেখাই যায় এই গল্পের নায়ক হচ্ছেন একজন চীনা পরিব্রাজক, বৌদ্ধ পন্ডিত হিউয়েন সাং। তাঁকে নিয়ে দূর্গাপূজার একটি গল্প শোনা যায়। ৬৩০ সালে বৌদ্ধ ধর্মের মূল পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে তিনি ভারতে আসেন কেননা তাঁর মনে হচ্ছিল চীনা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাখায় বিভ্রান্তি আছে। ভারত বর্ষের নানা বিহারে বিদ্যা অর্জন করতে শুরু করেন তিনি। বিদ্যা অর্জনের সাথে সাথে ৬৩৫-৬৪৩ পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর তিনি হর্ষবর্ধনের রাজ সভায় ছিলেন। এই আটবছরের কোন এক সময়ে গঙ্গাপথে (প্রাচীন গঙ্গারিডি) এই পরিব্রাজক কোন বৌদ্ধ বিহারে যাচ্ছিলেন। পথে দস্যুর কবলে পড়লেন। দস্যুরা তাকে দেবী দূর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। যদিও কেউ মনে করেন, বন দেবী, কেউ মনে করেন কালী, কারণ প্রাচীনকালে নরমুন্ড ভোগ দেবার বিষয়টি বনদেবী বা কালী দেবীর জন্য প্রযোজ্য ছিল — যা এখন পাঠা দিয়ে পূরণ করা হয়। দূর্গা মাকে খুশী করার জন্য নরমুণ্ড ভোগ দেবার বিষয়টি ইতিহাস থেকে সেভাবে জানা যায় না তবে কোচবিহারের রাজবাড়ির পূজায় নরবলি দেবার রীতি ছিল। যাই হোক, বলির পূর্ব প্রস্ততি প্রায় শেষ, এমন সময় প্রচন্ড বেগে ঝড় উঠল। সব আয়োজন ঝড়ের কবলে লন্ডভন্ড হয়ে গেল। ডাকাতরা প্রাণ বাঁচাতে পালাতে লাগল। সেই সুযোগে হিউয়েন সাংও পালিয়ে বাঁচেন।
এই গল্প কেন বললাম কেননা যদিও সংশয় আছে তবুও অনুমান করি ঐসময়ও ভারতবর্ষে দুর্গা পূজা প্রচলিত আছে। কিন্তু তখনো বাংলায় দুর্গাপূজার তথ্য মেলে না কোথাও বাংলায় দুর্গাপূজার ইতিহাস পেতে আমাদের আরো বহুবছর অপেক্ষা করতে হয়। বাংলায় দুর্গাপূজার ইতিহাস সন্ধান করতে গেলে দেখবো মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দূর্গা পূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দূর্গার — যা সংস্কারের ফলে মূল চেহেরা হারিয়েছে। ১১শ বা ১২শ শতক থেকে এখানে কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজাও হত। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালী পূজার সাথে দূর্গা পূজা হত। ১১শ শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দূর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দূর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে ১৪শ শতকে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল কিনা ভালভাবে জানা যায় না। ঘটা করে দূর্গা পূজা চালুর আগে কিছু কিছু উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের গৃহকোণে অত্যন্ত সাদামাঠা ভাবে ঘরোয়া পরিবেশে এই পূজা চালু ছিল।
বাংলায় কবি কৃত্তিবাস ওঝা জন্ম নেন আনুমানিক ১৩৮১ খ্রিস্টাব্দে আর মৃত্যুবরণ করেন ১৪৬১ খ্রিস্টাব্দের দিকে, তাঁর সাথেই আদতে বাংলার দুর্গাপূজা ও বাঙালির নিজস্ব দুর্গা জড়িয়ে আছে! বিস্ময়ে তাকাচ্ছেন কেন? ভুল বললাম কি? এই কথা কেন বললাম তাও বিস্তারে বলছি। আপনারা জানেন জানি তবুও লিখছি অনুমান করা হয় খ্রিস্টীয় ১৪শ-১৫শ শতাব্দীতে গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবক শাহের আদেশে বাংলা ভাষায় পয়ার ছন্দে রামায়ণ লিখতে শুরু করেন কবি কৃত্তিবাস ওঝা। ‘বাল্মীকি রামায়ণ’ অনুসরণে তাঁর লেখা কাব্যটির নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ এবং বাঙালিদের কাছে সেটি ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ নামে পরিচিত। এই কাব্যের দৌলতে রাম, লক্ষ্মণ, সীতার মতো পৌরাণিক চরিত্রেরা বাংলার ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছেন। সাবলীলতার গুণে সমস্ত বঙ্গদেশ জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’। সেই তুলনায় মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় লেখা সর্ববৃহৎ রামায়ণ তত বেশি প্রচার পায়নি। সেই রামায়ণ লিখেছিলেন সাধক কবি জগৎরাম বা জগদ্রাম এবং তাঁর ছেলে রামপ্রসাদ। শ্রীরাম পাঁচালী লেখার সময় কৃত্তিবাস ওঝা তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প, বাংলা রামায়ণে ইচ্ছাকৃতভাবে (নাকি গৌড়েশ্বর বা অন্য কারো অনুরোধে?) ঢুকিয়ে বাংলা রামায়ণ আরো অধিক সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের এমনভাবে বঙ্গীকরণ বা বাঙ্গালীকরন করেন — যা পড়লে মনে হবে, রামায়নের ঘটনা তাঁর বাঙালি সমাজের আদি কাহিনী। রামায়ণের এই বাঙালিকরণের ফলে রাম,সীতা,লক্ষণ,হনুমান কিংবা রামায়ণের অন্যান্য চরিত্রগুলো ও ঘটনাক্রম যেমন বাঙালির নিজস্ব হয়ে উঠেছিল তেমনি কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাবণের সাথে যুদ্ধে যাবার আগে রাম শরতকালে করলেন মা দুর্গার আহ্বান দেবীর অকালবোধন বাঙালি জনজীবনে দূর্গতিনাশের সিম্বল হিসেবে সেই থেকে জুড়ে গেল। কবি কৃত্তিবাস কালিকা পুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দুর্গা পূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। শক্তিশালী রাবনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিজয় নিশ্চিত করতে শরৎকালে শ্রী রাম চন্দ্র কালিদহ সাগর থেকে ১০১টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে প্রাক্ প্রস্তুতি হিসাবে দুর্গা পূজা করে দুর্গার কৃপা লাভ করেন বলে কৃত্তিবাস ওঝা বর্ণনা করেছেন। সেই সময়কালের বাংলা ও বাঙালির যাপন খুঁজলে দেখতে পাই মুসলিম শাসনকাল,জাতপাত ও বর্ণের জাঁতাকলে পিষছে বাঙালি,সঙ্গে আছে নানান কুসংস্কার ও নারীর জীবনে নানা দুর্গতি এবং সতীদাহের মতো বিভৎসতা।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালির জনজীবনে নতুন একটি দিক খুলে দিল,কেন বলছি এই কথা কারণ মূল বাল্মীকির রামায়ণে, দুর্গা পূজার কোন অস্থিত্ব নাই। কিন্তু বাঙালি যে রামায়ণ পড়ে রাম কাহিনী জানলো সেই কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুর্গাপূজার অস্থিত্ব আছে। শুধু আছে তাই না এই রামায়ণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বাংলায় দুর্গা পেলেন নতুন রূপ। রূপের কথায় আরেকটু পরে আসছি তার আগে বরং ইতিহাস খুঁজে দেখি বাংলায় দুর্গা পূজার ইতিহাস কি? কিভাবে এই পূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হয়ে উঠলো। যতটুকু ইতিহাস জানা যায় তাতে দেখা যায় খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজশাহীর তাহের পুরের উদয় নারায়ণের পুত্র রাজা কংশনারায়ণ খাঁ যখন তাঁর প্রধান পুরোহিত ও সভা পন্ডিত নাটোরস্থ বাসুদেবপুর গ্রামের শাক্ত মতালম্বী রমেশ চন্দ্র শাস্ত্রীর কাছে জানলেন চার প্রকার যজ্ঞ আছে, কিন্তু রাজসূয়,বাজপেয়ি ও বিশ্বজিৎ এই তিনপ্রাকার যজ্ঞ স্বাধীন সার্বভৌম রাজচক্রবর্ত্তী দ্বিগজয়ী বীরের এবং অশ্বমেধ কলিতে অচল তাই তিনি মনস্থির করলেন মহা আড়ম্বরে যজ্ঞের অনুরূপ মহাপূজা করবেন কি সেই মহাপূজা অনেক ভেবে কিংবা কৃত্তিবাস রামায়ণ পড়ে অনূপ্রানিত হয়েছিলেন তাই রামের মতো তিনিও ঠিক করলেন দুর্গা পূজা করবেন সেই যে শুরু আজো বাঙালীরা মহা ঘটা করে দূর্গাপূজা করছে। ঐ সময় প্রায় আট লক্ষ টাকা খরচ করে তিনি পূজা করেন এবং এই পূজার নিয়ম কানুন শ্লোক (যাকে মন্ত্র বলা ঠিক নয়) সব কিছু ওই শাক্ত মতাবলম্বী রমেশচন্দ্র শাস্ত্রীর তৈরী এবং অতিঅবশ্যই বাঙালি ধরনে ও বাঙালির একান্ত নিজস্ব ধারায়। কেন এমন বলছি কারণ মার্কন্ডেয় মুনির নামে লেখা চন্ডীপুরাণ, মার্কেন্ডয় পুরাণের ৮১ থেকে ৯৩টি অর্থাৎ ১৩টি অধ্যায় মোট ৭০০টি শ্লোক নিয়ে চন্ডীপুরাণ রচিত তাকে ‘সপ্তশতী’ও বলা হয়।
শোনায় ও পাঠে আবেগ ও ভক্তি উৎপত্তি হয় ঠিকই,কিন্তু তাতে ঈশ্বরীয় ব্যাপার কিছু নেই। এর পুরো ব্যাখ্যা গোয়ালিয়র রাজ্যের ভিন্ড নামক স্থানে গবেষক দ্বারা প্রাপ্ত রাজা ভোজ দ্বারা রচিত ইতিহাস সঞ্জিবনী গ্রন্থে প্রামাণ পাওয়া যায়।
যদিও কারো কারো মতে ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দূর্গা পূজা করেন। আবার কারো মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংশ নারায়ন প্রথম দূর্গা পুজা করেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দূর্গা পূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। সঠিক তথ্য না মিললেও বাঙালির দেবী দুর্গা বাংলায় মা ও কন্যা যিনি পুত্র কন্যা সহ পূজার কয়দিন বাপের বাড়ি আসেন,এই চিরায়ত ধারনাটা বাঙালির মননে যে গভীরভাবে দাগ কেটে আছে তা হয়ত সাবর্ণ রায় চৌধুরীর দুর্গা প্রতিমা থেকেই! বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী; তার মুকুটের উপরে শিবের ছোট মুখ, দেবীর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়। তারা কার্তিকেয়র রূপ দেন জমিদারপুত্রের, যা তৎপূর্ব ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে।
দুর্গা যতটা না দেবী তারচেয়ে অনেক বেশি বাঙালির কাছে তার জনজীবনে দেখা অবহেলিত নারীটি, যিনি কন্যা, জননী, জায়া। কেননা দুর্গা পূজার বিধি খেয়াল করলে দেখবেন মহামায়া ৯টি রূপে পূজিত হন। মহামায়ার নবম রূপটি পতিতালয়ের প্রতিনিধি। একটা পুরুষ যখন পতিতার বাড়ি গিয়ে অবৈধ যৌনাচার করে তখন ঐ পুরুষের জীবনের সমস্ত পূণ্য পতিতার বাড়ির মাটিতে পতিত হয় বা পূণ্য তাকে ত্যাগ করে,বিনিময়ে ঐ পুরুষ পতিতার ঘর থেকে নিয়ে আসে সমস্ত পাপ। এরূপ বহু পুরুষের অর্জিত সমস্ত পূণ্য ত্যাগে পতিতাদের ঘরের মাটি পূণ্যময় হয় বলে মনে করা হয়,তাই পতিতার ঘরের মাটি দুর্গা পূজায় লাগে কেননা বাঙালি সমাজে সেইসময়ের চিত্র মাথায় রেখেই পূজার বিধিতে এই সংযোজন নারীর প্রতি সম্মানের সাথে পতিতার ঘরেও নারী কখনো অপবিত্র হয় না এই বার্তা দেয়া হয়েছে। দুর্গাকে বাঙালির নিজস্ব রূপদানের শেষতম সংযোজন আকাশবাণীর মহিষাসুরমর্দ্দিনী। ১৯৩২ সালের ষষ্ঠীর দিন প্রথমবার সম্প্রচারিত হয়েছিল মহিষাসুরমর্দ্দিনী। তবে ১৯৩১ সালে এই অনুষ্ঠানই বসন্তেশ্বরী নামে সম্প্রচারিত হয়েছিল। বাণীকুমার শ্রীশ্রী চণ্ডীর বেশ কিছু শ্লোক পাঠ করেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। দুর্গা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক। আকাশবাণীর এই মহিষাসুরমর্দ্দিনী তার জলন্ত উদাহরণ। অনুষ্ঠানের রিহার্সাল চলাকালীন বীরেন ভদ্র যখন বাংলা ও সংস্কৃত স্তোত্র পাঠ করছিলেন, ভাষাগত তফাৎ করতে পারছিলেন না, যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের দলে থাকা অধিকাংশ অবাঙালি মুসলিম বাজিয়ের দল। ফলে তাঁরা সব জায়গায় বাজাচ্ছিলেন। বীরেনবাবু কিন্তু তাঁদের থামালেন না। বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষ্যকেও সুর বলে বাজনার সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। এক অন্য রূপ পেল স্তোত্রপাঠ। যা আমরা আজও শুনি। উস্তাদি যন্ত্রসঙ্গীতের সুরের সঙ্গে মিলে গেল চণ্ডীপাঠের সুর। তৈরি হল এক অপূর্ব ধর্মীয় বিনিময়।
এতগুলি বছর ধরে ভোরের মহালয়া শোনা, নিষ্ঠাভরে তর্পণ, চণ্ডীপাঠ ও আবহসংগীতের মূর্ছনায় হিন্দু ধর্মীয় আবেগ উথলে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু জনপ্রিয় এই অনুষ্ঠানটির যন্ত্রানুষঙ্গে আকাশবাণী কলকাতার মুসলমান শিল্পীদের অবদান স্মরণীয়। অনুষ্ঠানে সারেঙ্গি বাজিয়েছিলেন মুনশি, চেলো বাজান তাঁর ভাই আলি, হারমোনিয়ামে ছিলেন খুশি মহম্মদ। এ ছাড়াও আকাশবাণীর আরও কয়েক জন নিয়মিত মুসলমান বাদক ছিলেন মহিষাসুরমর্দিনীর নেপথ্য শিল্পী।
কেবলমাত্র তা-ই নয়, কবি শামসুর রহমানের লেখা থেকে জানা যায় (কোন বছরের ঘটনা কবি উল্লেখ করেননি), ‘…মহালয়ার দিন প্রত্যুষে আকাশবাণী কলকাতার অনুষ্ঠানের সূচনা হত স্তোত্রপাঠ দিয়ে। সেই স্তোত্রের অবধারিত পাঠক ছিলেন বীরেন ভদ্র। অন্য কেউ তাঁর মতো স্তোত্র আবৃত্তি করতে পারতেন না। এক বার মহালয়ার স্তোত্রপাঠের নির্ধারিত সময়ে তিনি বেতারকেন্দ্রে আসতে পারেননি। রেডিওর অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে প্রচার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। নাজির আহমদ জানালেন যদি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন তা হলে তিনি স্তোত্রপাঠ করতে পারেন। অনুমতি পাওয়া গেল। ঠিক সময়মাফিক মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে স্তোত্র আবৃত্তি করতে লাগলেন তাঁর আবেগময় কণ্ঠস্বরে।
ইতিমধ্যে বীরেন ভদ্র এসে হাজির। তিনি দাঁড়িয়ে নাজির আহমদের স্তোত্রপাঠ শুনলেন নিবিষ্ট চিত্তে। কেউ কেউ নাজির আহমদকে থামানোর প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু বীরেন ভদ্র বারণ করলেন। কারণ তিনি একজন প্রকৃত গুণীর কদর করতে জানেন।
নাজির আহমদের পরিচয় দিতে গিয়ে কবি শামসুর রহমান জানাচ্ছেন, ‘… যাঁরা আকাশবাণী কলকাতার আরেকটি বিশেষ অনুষ্ঠান শুনেছিলেন বহু বছর আগে তাঁরা আজও স্মরণ করেন ‘কচ ও দেবযানী’র কথা। সেই সংলাপকাব্য নাজির আহমদ এবং নীলিমা সেনের কণ্ঠে এমনই জীবন্ত হয়ে উঠেছিল যে, যদি রবীন্দ্রনাথ শুনতেন, তা হলে তিনিও সাধুবাদ জানাতেন।
আরো অনেক বিষয় নিয়ে হয়ত লেখাই হলো না,যতটুকু লিখেছি তাতে কি বিশ্বাস জন্মায় না পরিবার সহ পিতৃলয়ে আসা কন্যা দুর্গা আদতে বাঙালির নিজস্ব সেই কন্যা কিংবা মা যার চেহারা দেখলেই সমস্ত তাপ ফুরিয়ে যায় যার কাছে সমর্পণ করতে মন চায়। বাঙালি তাঁর ঈশ্বরকেও তাঁর মতো করে গড়েছে যেখানে ঈশ্বর ও মানুষের তফাৎ ঘুচে গিয়ে পরিবারের একজন কিংবা সমাজের সেই নারীটি হয়ে উঠেছে মা দুর্গা যাকে প্রতিক্ষণ দেখে সে তার যাপনে সাদামাটা মমতাময়ী সেই নারী যে কন্যা,জননী ও জায়া।
তথ্যসূত্র :
** রামায়ণ কৃত্তিবাস বিরচিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকা সম্বলিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৫৭ সংস্করণ।
** বঙ্গভাষা ও সাহিত্য ড. দীনেশ সেন
** প্রবন্ধ শব্দাঞ্জলিতে দুর্গাপূজা, হরিপদ ভৌমিক, নতুন বাংলার মুখ পত্রিকা, আশ্বিন ১৪১৪, অক্টোবর ২০০৭, পৃ. ১৬৩ দ্রঃ
** মা দুর্গার কাঠামো, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, মহাউদ্ধারণ মঠ, কলকাতা
** পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯
** মহালয়ার ভোরে আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্তোত্রপাঠ করেন নাজির আহমদ : তপন মল্লিক চৌধুরী,পেজ ফোর,৫ অক্টোবর, ২০২১
পেজফোর-এর শারদোৎসব বিশেষ সংখ্যা ২০২৩-এ প্রকাশিত