বৃহস্পতিবার | ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:৪৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (ষষ্ঠ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (পঞ্চম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (চতুর্থ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার শতবর্ষে সঙ্গীতের ‘জাদুকর’ সলিল চৌধুরী : সন্দীপন বিশ্বাস সাজানো বাগান, প্রায় পঞ্চাশ : অমর মিত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (তৃতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (একাদশ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার খাদ্যদ্রব্যের লাগামছাড়া দামে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের : তপন মল্লিক চৌধুরী মিয়ানমারের সীমান্ত ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (দ্বিতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দশম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ-র ছোটগল্প ‘পহেলি পেয়ার’ ‘দক্ষিণী’ সংবর্ধনা জানাল সাইকেলদাদা ক্যানসারজয়ীকে : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (প্রথম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (নবম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘তোমার নাম’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (অষ্টম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘হাওয়া-বদল’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার প্রবোধিনী একাদশী ও হলদিয়ায় ইসকন মন্দির : রিঙ্কি সামন্ত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার শুদ্ধতম প্রতিনিধি অন্নপূর্ণা খাঁ : আবদুশ শাকুর নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘শুভ লাভ’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’

জয়া মিত্র / ১২০ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ছক ভাঙার ছক অথবা নানারকম গাছপালা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন

এই হচ্ছে ছবিটা। বাচ্চা ছেলে, ফুলো ফুলো হাতের উলটোপিঠে আঙুলের গাঁটগুলো টোপটোপ, গালের পাহাড়ি গোলাপিতে ময়লার ছোপ, গাঢ় মেরুন রঙের শার্টের কাঁধছেড়া— ঝুলছে। হাতে ধরা প্রায় গোটা একটা পরোটা, মুখটা হাঁ করা— মুখের মধ্যেও খানিকটা। ক্যামেরার দিকে সোজা তাকিয়ে থাকা কালো চোখ।

কোন ট্যুরিস্টের তোলা ছবি? এটা তো স্পষ্টই যে তিনি ফটোগ্রাফার। না হলে, এমনকী ভালো ছবি হলেও তা ফটোগ্রাফিক সালোতে পৌঁছত না, মানে দেবার কথা মনেও পড়ত না। তাহলে তাঁকে কি বলা যাবে? ট্যুরিস্ট, না বেড়াতে আসা ফটোগ্রাফার? কিংবা হয়তো ঠিক বেড়াতে আসা নয় হয়তো কোনো একটা সিরিজ করছেন তিনি শিশুদের ওপর কি পাহাড়ের লোকজনের ওপর। রঙিন স্লাইডে বাচ্চাটার গাঢ়রঙের জামার ব্যাকগ্রাউন্ডে পরোটার হালকা আভাময় সমৃদ্ধ রং চমৎকার এসেছে, কালার ট্রান্সপারেন্সিতে আরো উষ্ণ। গোলাপি ঠোটের ফ্রেমে একটা হাঁ তার প্রায় সমস্তটাই পরোটার রঙে ভরতি। একটু চটকানো, হতে পারে বাচ্চাটা মুখের খাবারটা একবার চিবিয়ে ফেলেছে। পরোটার, মানে খুব রিফাইন্ড ওয়েতে তৈরি ময়দার পরোটার বিশুদ্ধ রং, নিশ্চয়ই স্বাদে লোভনীয়, ঠাণ্ডা বা একটু বাসি হলেও তার স্বাদ বাচ্চার মুখের উষ্ণ লালার সঙ্গে মিশে—

চুলগুলোও অনেকটা ওই রঙেরই, আরো একটু গাঢ়, তামাটে-তেলহীন। না আঁচড়ানো, অপরিষ্কার, কপালের কিছু কিছু অংশ, দেখা যাওয়া একটা কানের প্রায় সমস্তটাই ঢেকে ফেলা চুল। বাচ্চাটার পেছনে, অফ্‌ ফোকাস পাহাড়ের ঢালু সবুজ দেখা যাচ্ছে।

সমতল থেকে আসা ফটোগ্রাফার। আসলে সমতল থেকে অর্থাৎ দূর থেকে না এলে তো কোনো জায়গায় নতুন হয় না। আর নতুন না হলে তার একটি খণ্ডকাল কি ঘটনা কি চরিত্র সাবজেক্ট হয়ে উঠবে কি করে? এই যেমন কলকাতার ফুটপাথের সংসারের ছবি টপাটপ তোলেন তো শাহেব ট্যুরিস্টরা, নিজেদের ম্যান হাটানের স্লাম কি নিউইয়র্কের পুলের তলা বা ব্ল্যাকটাউনের ছবি তো বিশেষ তোলেন না! তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে দূর কোনো দেশ থেকে অর্থাৎ অ-পাহাড়ি সমতল থেকে এসেছিলেন ফটোগ্রাফার।

আসলে এই দূর থেকে দূরদেশে আসার এক বিপুল মজা আছে। এ যেন শুধু স্থান কি কালের পরিবর্তন নয়, এক বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে অন্য এক বাস্তবতায় প্রবেশ করা। যা কিনা অন্যদের কাছে অভ্যস্ত ও দৈনন্দিন হলেও বহিরাগতের কাছে প্রায় এক কল্পবাস্তব বলে প্রতিভাত হয়। নিজেদের ভিতরে ভিতরে পুষে রাখাকেই সব সাধ আহ্লাদকে ট্যুরিস্ট বাংলোর কি হোটেলের লনে, ফুলের কেয়ারির পাশে সব বিচিত্র, কৃত্রিম ভঙ্গিতে ছবিতে দলিলভুক্ত হতে সে বহুবার দেখেছে। যাদের ছবি তোলা হচ্ছে তাদের রঙিন জাম্পার, মাথায় বাঁধা স্কার্ফ ও একটু আড়ষ্ট জিনসের অতি ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনের ভঙ্গির মতো একই রকম অবাস্তব ও কৃত্রিম যে তুলছে তার ভঙ্গিসমূহ, কখনো ক্যামেরা নিয়ে শুয়ে ঘাসে প্রায় গাল রেখে একটি পা কীই বা কারণে প্রায় সমকোণে তুলে দিয়ে, কখনো লাফ দিয়ে উঠে রেলিংয়ে এক পা রেখে রোখা নায়কের গলাবুক খোলা উইন্ড চিটার ওড়ানো ভঙ্গিতে ডায়লগ বলতে বলতে তারা ক্যামেরার শাটার টেপে। অর্থাৎ আনন্দ কেমন হবে, কিভাবে প্রকাশ করতে হবে তার একটি মোটামুটি নির্দিষ্ট ছক ধরা আছে। সেই ছকের মধ্যে শব্দের একটা খুব বড় জায়গা, চিৎকার, জনপ্রিয় ফিমের সব মারকাটারি অংশের ডায়ালগ, টেপরেকর্ডারের শীৎকার ও চিৎকার এবং নাচ, মানে সেই নাচ যার শরীরী বিক্ষেপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে আলাদা নাড়ানো, যা দেখতে কিছু হয়তো আদিম মানুষদের শিকার নৃত্যের মতো শুধু তার সঙ্গে শিকার বা অন্য কোনো শ্রমেরই কোনো যোগ নেই। বেড়াতে আসা, অপরিচয়ে আসা— বহুপরিচিত ফুলবাগানের মধ্যে দিয়ে ছুটে ছুটে যাবার, চীর জঙ্গলের মধ্যে গান গেয়ে এসে আলিঙ্গিত হওয়ার দৃশ্যের মধ্যে আসা। জানলা বন্ধ পরদাটানা ভিডিও কোচে প্যাকেজ ট্যুরের মতো, টিন কি পলিথিন বন্ধ ফাস্টফুডের মতো এই রেডিমেড আনন্দের প্যাকেজও সে অনেকবার দেখেছে অবশ্য। প্রথম প্রথম প্রায় রাগই হয়ে যেত। যেমন সেবার ইলোরায়— কৈলাশ মন্দিরের পাথর কেটে বার করা সেই স্তম্ভিত সুবিশাল সৌন্দর্য যখন একতলার চাতাল থেকে দোতলার উপাসনা কিংবা সমিতিকক্ষের দিকে উচ্ছ্ৰিত ‘ডার্লিং-হুইই’ ইত্যাকার রবে উঠোনে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙেছিল অথবা ঈষৎ অন্ধকার করিডোরের শেষে পাথরের প্যানেলে উৎকীর্ণ পার্বতীর সলজ্জ চিবুক বিশাল শিবের নেত্রপাতে নম্রতম হয়ে ওঠার মুহূর্তে তীব্র গানের হুল্লোড় করে উঠেছিল টেপরেকর্ডার। তেতলার এবড়োখেবড়ো পাথরকাটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবার মুখে দোতলায় খুশিমান কয়েকজন তাকে ওপরে দেখবার মতো কিছু আছে কি না শুধোলে সে শুধু না বলে চলে এসেই যেন তেতলার অন্ধকার বিশাল ঘরগুলির দেওয়ালে উৎকীর্ণ নিস্তব্ধ গম্ভীর সব মূর্তির সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারে। কৌশানির চীর জঙ্গলে ঘেরা গান্ধি আশ্রমের বিরাট বাগানে সূর্যোদয় দেখতে সমবেত ট্যুরিস্টদের মধ্যে অনেকে যখন পাঞ্চোলির মাথার ওপর আদি সু-বর্ণ সূর্যকে উঠে আসতে দেখে শত্রুঘ্ন সিনহা-অমিতাভ মারপিটে নায়কের শেষ বিজয় দেখার উচ্ছ্বাসময় হাততালিতে ফেটে পড়েন, তখন পিছনে বাগানের আধো-অন্ধকার থেকে তাঁদেরই কারো কারো আগের রাত্রের ফূর্তির অবশেষ কিনে আনা মাংসের ঝোলমাখা ভাঁড় ও ভাঙা বোতল জড়ানো খবরের কাগজের কুশ্রীতাকে বৃদ্ধ আশ্রমরক্ষক আস্তে আস্তে ফুলগাছের ঝরাপাতার সঙ্গে কুড়িয়ে নিচ্ছিলেন, তাঁর মুখে ক্রোধ নয়, ব্যথার রেখা পড়েছিল— এও দেখেছে। বাইরে আসা অর্থে ফূর্তিতে আসা— এবং অতি নির্দিষ্ট সেই ছক ভাঙা ফূর্তির ছক, যেখানে বাহির কেবল ট্যুরিস্ট স্পট— এক প্যাটার্ন থেকে বেরিয়ে অন্য এক প্যাটার্নে ঢোকা।

কিন্তু এই বাচ্চার ছবিটা তো তা নয়। যত্নে তোলা একটি শান্ত ছবি, বাচ্চার সরলতা ও সৌন্দর্য যার বিষয়বস্তু, দূরদেশে অচেনা একটি দরিদ্র বাচ্চার সৌন্দর্য। তাহলে এই ছবিটাই তার মাথার মধ্যে এরকম পুঁতে গেল কি করে তাও তো সে বুঝতে পারে না। সালোঁতে আরো তো অনেক ছবি ছিল। সাধারণ মানুষদের, গ্রামের মানুষজনের জীবন যাত্রার ছবিও। সাঁওতাল পল্লীর চিত্রিত দেওয়ালে আলো পড়ে মোরগের ডাকে সকাল জেগে ওঠার ছবি, লোলচর্ম বৃদ্ধার মুখের অদ্ভুত ক্লোজআপ, এমনকী শিশু ও বৃদ্ধ ভিখারির আক্রান্ত ছবিও। তবু সব ছাপিয়ে ওই ছোট গোলাপি ঠোঁটের ফ্রেমে আটকানো একটু চিবিয়ে ফেলা পরোটা—

একথা সহজবিদিত যে ওই খাবারটা বাচ্চাটাই পাবে। ছবি তোলা হয়ে গেলে সুভদ্র ফটোগ্রাফার, যাঁর মনে নিশ্চয়ই এই সুন্দর দেখতে দরিদ্র বাচ্চাটির জন্য, আহা, করুণা জেগে উঠেছে, খাবারটা ফিরিয়ে নেবার কথা চিন্তাও করবেন না। এমনকী হয়তো ছবি তোলার কথা ভাববার আগেই তিনি বাচ্চাটাকে পরোটার টুকরো কিংবা আস্ত একটা পরোটাই দিয়েছেন। তা কি সম্ভব? নাকি একটি সুন্দর শিশুর সঙ্গে মানানসই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যপট যেখানে সে জন্মেছে, তার সঙ্গে যেভাবে সে বেড়ে উঠেছে সেই দারিদ্র্যের চিহ্নময় অসঙ্গতিই প্রথমে ছবির বিষয় বলে প্রতিভাত হয়েছিল পরে শিশুটিকে আকৃষ্ট করার জন্য কিছু একটু খাবারের কথা এসে পড়ে? এ তো জানাই কথা যে এই দেশের দরিদ্র শিশুকে আকৃষ্ট করতে গেলে খাবার, যে কোনো খাবারের টুকরোই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়, কোনো শিশুসুলভ খেলনা নয় এবং তার জন্য সে শিশুর ভিখারি হবার দরকার হয় না। যদিও এর আগে রামনগর কোলিয়ারিতে যেখানে তার বোন কোলিয়ারি ওয়েলফেয়ার স্কিমে প্রাইমারি স্কুলে মালকাটাদের বাচ্চাদের টিচার ছিল সে দেখেছে যে খাবারটা বাচ্চারা তাড়াতাড়ি মুখে পুরে ফেলতে পারে না পরে চেটে চেটে খাবে বলে ধরে রাখে সেটা হাত থেকে নিয়ে ঝুড়িতে তুলে দোকানে ফিরিয়ে দেওয়া হতে। খাবার বলতে এখানে লালরঙ করা বড় বড় জিলিপিকে বোঝানো হচ্ছে যা কিছু সময় পরে দোকানে ফেরত দিলে কেবল ক-পয়সা করে ভাড়া লাগে এবং যা কিনা হেড অফিস থেকে ইন্‌সপেকশান টিম আসবার নোটিশ থাকায় আনিয়ে ঝুড়ি করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। টিমের গাড়ি মেনগেটে এসে পৌঁছলে তাড়াতাড়ি বাচ্চাদের হাতে একটুকরো করে পাউরুটির সঙ্গে সেইসব লাল বড় বড় জিলিপির আশ্চর্যও ধরিয়ে দেওয়া হয়। টিমের সদস্যরা ক্লাসঘরের দরজা পর্যন্ত এসে বাচ্চাদের গায়ে খুব কোঁচকানো নতুন জামা, সামনে প্লেট, হাতে জিলিপি পাউরুটি দেখে অতীব পরিতুষ্ট হয়ে ফিরে যান। অফিসঘরে তাঁদের চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। এ ছাড়া বিশ্রী ভাঙা রাস্তা দিয়ে জিপে করে ফেরার ব্যাপারে ওয়েলফেয়ার অফিসার উদ্বিগ্ন ছিলেন। সেই সামান্য তাড়াহুড়োর কারণেই হতে পারে তাঁরা খেয়াল করতে পারেন না ওয়েলফেয়ার স্কিমে দেওয়া বাচ্চাদের স্কুল ইউনিফর্মের এখনো জল না পড়া নতুন জামা এত কুঁচকনো কেন। এছাড়া এটা তাঁরা চাকরির অঙ্গ হিশেবে ট্যুরে এসেছিলেন, এ তো সুপার-এইট ও টেপরেকর্ডার নিয়ে শহরের নিকটবর্তী সাঁওতাল পল্লীতে বেড়াতে যাওয়া নয় যেখানে সর্ব বিষয়ে আগ্রহী থাকাটাই রীতি, এটা ছিল নিতান্তই অফিসের রুটিন ইন্‌সপেকশান যার পরে কমেন্টস্ লিখে দিলেই বাকি ফাইলকিপিংয়ের কাজ অন্যান্যরা ছক মাফিক করে নেবেন। হয়তো এসব কারণে কৌতূহলের সজাগতা না থাকার হেতু তাঁরা অফিসঘরের মসৃণ আবহাওয়াতে বন্দী চিন্তার আওতাতেও আনতে পারেন না এইকথা যে দুবছর আগে এই জামাগুলো প্রথম যখন ‘ইস্যু’ করা হয় তখন থেকেই একটা বড় থলিতে ভরে অফিসগুদামের দেওয়ালে গাঁথা একটা গজালে ঝোলানো থাকে, পনেরোই আগস্ট ও ছাব্বিশে জানুয়ারি বার করে পরিয়ে বাচ্চাদের পতাকা উত্তোলন সমারোহের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য। আজকের উপলক্ষটা নতুন, এটা বার্ষিক হিশেবের মধ্যে ছিল না। আর, একটা জামাতেই যখন চলে যায় তখন পরের পরের বছর নতুন জামা ইস্যু করে বাহুল্য বাড়ানো দরকার কি এমত বিবেচনায় দোকানের কাপড় দোকানে টাকাটা নির্দিষ্ট হিশেবে ভাগ হবে, ছোটবড় নানান পকেটে নিরুপদ্রব রয়ে যায়।

কিন্তু এই ছবিতে যে বাচ্চাটিকে দেখা যাচ্ছে ছবিতোলা শেষ হয়ে গেলেও খাবারটা সে-ই পাবে একথা নিশ্চিত করার জন্য খাবারটা মুখে পুরে চিবিয়ে ফেলার দরকার নেই, এমনকী হাতে ধরে রাখলেও সে ওটা পেত। তবে সে ক্ষেত্রে তো ছবিটা হত না মানে অন্তত এভাবে নিশ্চয়ই হত না, অর্থাৎ রঙের লোকে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে নেয় মানে নিতে অভ্যস্ত হয়। কনকনে জানুয়ারির সোনালি রোদ্দুরে ভরা ছুটির সকালে স্কেচ করার জন্য শীর্ণকায় পেশাদার মডেলের খোলা গায়ের সৌন্দর্যের পণ্য নাটকীয়তার উচ্চকিত প্রশ্ন নয় সর্বদা। আসলে জীবনযাপনের মতো আনন্দ কী সৌন্দর্যবোধেরও কিছু ছক আছে সামাজিক ভাবনাচিন্তায়— যেখানে থাকে উচ্ছিন্ন মানুষজনের ঘরসংসারের স্মৃতি বিরহিত মুকুটমণিপুরের পিকনিক স্পট, গালের ওপর চোখের জল শুকিয়ে থাকা কচি ছেলের ব্লো আপ পোস্টার, ঠোঁটের পাশে শাদা খড়ি ওঠা নিরন্ত আদিবাসী গ্রামের আদিম জীবনযাপনের শিল্পসৌকর্য, আগ্রহী ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে দিয়েও খাওয়া বন্ধ করে রাখা বর্ণসুষম ছবি এইসব সূক্ষ্মতর সৌন্দর্যবোধের গড়ে তোলা বৃত্তান্ত। অথচ মানুষ, তার মুখ, সে যে সহজেই সুন্দর, চীনা দোকানে কুঁদে না তুললেও। যেমন সে প্রতিদিন তার জীবনে, মনোযোগে, পরিশ্রমে। কত মুখ তো দেখা হল এ জীবনে, এমনকী অন্যমনস্কতাতেও দেখা হল, অনবধানে, পাহাড়ের সুন্দর প্রতিবেশের বাচ্চাটি থেকে ধীরে তার মনে পড়ে একেবারে অন্য দুটি ছেলেকে, ধুলো আর রুক্ষতার মধ্যে কালো খড়ি ওঠা চেহারার দুটি কিশোরকে।

সেদিন বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়া যাবার বাস ভাঙ্গা গ্রামের হাট ছেড়ে চলতে শুরু করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাসের ভেতরে একটা গোলমাল শুরু হয়েছিল। দ্রুত সেটা এতটা ছড়ায় যে তার জানলা দিয়ে অন্যমনস্ক বাইরে তাকিয়ে থাকাও আকৃষ্ট হয়। রোজকার কন্ডাক্টর কোনো কারণে আসে নি, গেটে ঝুলতে থাকা যে খালাসী অন্যদিন ‘বাঁকুড়া বাঁকুড়া হুড়া হুটমুড়া’ বলে চিৎকার করে লোক জড়ো করে সেই যে টিকিট কাটছিল আর কন্ডাক্টরের দায়িত্ব ও পদমর্যাদার প্রতীক চামড়ার ব্যাগটি তার সঙ্গেই সেদিন বাসে অনুপস্থিত ছিল এই সবকিছু কেবল তখনই স্পষ্ট বোঝা গেল যখন সেই খালাসী মানে তখনকার মতো যে কন্ডাক্টর সে বাজারের থলির মতো একটা ছোট কাপড়ের থলি তুলে তুলে ধরে সকলকে দেখাচ্ছিল, যে থলির একটা পাশ ছিল লম্বা করে কাটা আর সেই কাটার ভেতর দিয়ে থলির ভেতরের শূন্যতাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সেই সাময়িক কন্ডাক্টর কপাল চাপড়াচ্ছিল তার সঙ্গে সেই ছেলেটিও যে সেদিন খালাসীর কাজ করতে গেটে দাঁড়িয়েছিল, ড্রাইভারের মুখ অবশ্য দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু সে কি যেন বলে কন্ডাক্টরকে বকছিল। কন্ডাক্টরের ব্যাগের টাকা মানে সেদিনকার টিকিটের প্রায় পুরো টাকাটাই খোয়া যাবার স্পষ্ট মানে ছিল তাদের সকলের আজকের মজুরি খোয়া যাওয়া তো বটেই, মালিকের আজকের টাকা বাকি পড়া যেটা ড্রাইভার, সেই সাময়িক কন্ডাক্টর ও সাময়িক খালাসীর অন্যদিনের মজুরি থেকে কাটা যাওয়া। লোকজনদের কথা থেকে অচিরে বোঝা গেল সমস্ত ঘটনাটা অভ্রান্তভাবে নির্দেশ করছে সেই শুকনো চেহারার দুটো ছেলেকে যারা ঠেলাঠেলি করে ভাঙরা মোড়ে নেমে গেল। এইসব কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ বাস থামিয়ে ড্রাইভার শুকনো মুখে প্যাসেঞ্জারদের কাছে মিনতি করেছিল তাকে যদি অনুমতি দেওয়া হয় সে বাস ঘুরিয়ে নিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখবে, এতে যে সময় নষ্ট হবে সেটা অবশ্যই ‘মেকাপ’ করে দেবে। তার মতো পরিচ্ছন্ন দুরস্ত পোশাক পরা লোকজনের সংখ্যা বাসে বেশি ছিল না। আসলে লোকজনই বোধহয় একটু কম ছিল তখন, শেষ ভিড়ের অংশ নেমে গিয়েছিল ভাঙরা আর তার আগের গ্রাম কড়চাতেই। তবু যারা ছিল তাদের কাছে খুব কাতরভাবে অনুরোধ করেছিল কন্ডাক্টর। কেউই আপত্তি করে নি বিশেষত ড্রাইভার যখন ঠিক সময়েই বাঁকুড়া থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ধরিয়ে দেবে বলে কথা দিয়েছিল। তাছাড়া এইভাবে বাস নিয়ে তাড়া করে গিয়ে চোর ধরার ঘটনার মধ্যে একটা রোমাঞ্চকর উত্তেজনাও ছিল। যদিও প্রায় সবাই জানত যে নেমে গিয়ে টাকাটা সঙ্গে করে চোরেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে এই সম্ভাবনা খুবই কম তবু বাস্তবে সেটাই দেখা গেল। দাঁড়িয়ে নয় বসেছিল ছেলেদুটো, মোড়ের একমাত্র চা মিষ্টির দোকানটাতে। সামনে কাঠের উঁচু বেঞ্চির টেবিলে সিঙাড়া, মিষ্টি, শালপাতার ঘুগনি, ছোট ছোট কাচের গ্লাশে চা। হঠাৎ উলটোদিক থেকে বাসটার অতিদ্রুত এসে দাঁড়ানো, হইহই করে লোকজনদের নেমে আসা— হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জিপরা ছেলেদুটো কিরকম হতভম্ব ভাবে নিজেদের মুখ কিংবা শরীর নয় বেঞ্চের ওপর ঝুঁকে পড়ে প্রথমেই বাঁচানোর চেষ্টা করে মিষ্টির প্লেটদুটো যেন একবাস লোকের মার খেয়ে যেতেও ওরা রাজি আছে কিন্তু মিষ্টিগুলো যাতে মাটিতে পড়ে দলে না যায়, খাবার উপযুক্ত থাকে। কিংবা অধিকতর সম্ভব যে এসব কিছুই ভাবে নি শুধু খাদ্যকে রক্ষা করার সংস্কারেরই মাথা ও পিঠ অনাবৃত ছেড়ে দিয়েছিল। পাশে বেঞ্চের ওপর নোংরা কাপড়ের গিঁট দেওয়া পমটলিতে টাকাটা রাখা ছিল। ততক্ষণে সে ও তার মতো দুচারজন যাত্রীর ভেতরে ভেতরে একটা প্রস্তুতি তৈরি হয়ে গিয়েছে— এরপরই সেই অরুচিকর ব্যাপারটা ঘটবে, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে ছেলেদুটোর ওপর। অবশ্য যাতে একেবারে মরে-টরে না যায় কেন না এসব ক্ষেত্রে তো ‘চোর’ শুনলেই উপস্থিত বাসযাত্রীরা ছাড়া আশপাশের লোকজনও জুটে যাবে— সেরকম হলে মাঝে পড়তেই হবে শেষকালে, কিন্তু এইভাবে একেবারে ব্যাগটা কেটে তিনটি লোকের সারাদিনের রুজি রোজগার বের করে নেওয়া— পেশাদার হলে অবশ্য সরে পড়ত এলাকা থেকে— দ্রুত এইসব ভাবনা ও তার অন্তর্নিহিত মারের যুক্তি ইত্যাদি মানে এসব ক্ষেত্রের যা নিশ্চিত সম্ভাব্যতা তার সমস্ত ধরণটাই ভেঙে পড়ে এরপর। টাকাটা তুলে বারো-চোদ্দ টাকা কম গুনে নেবার পর শ্রীহীন শীর্ণ চেহারার প্রৌঢ় ড্রাইভার যখন কন্ডাক্টরকে বলে— টাকাটো ঘুইরে পাব এমন তো ভাবি নাই, দিয়ে দে কেনে ইয়ারকে আরো পাঁচটো টাকা— পেটটো ভইরে খাবেকেই তো— মনে রইবেক হুঁ একদিন খায়েছিলি। ফ্যাকাশে বুদ্ধিহীন হয়ে যাওয়া ছেলেদুটোর মুখে খুব আস্তে আস্তে স্থিতি ফিরে এলে তাদের আশপাশে সেই ড্রাইভার আর ‘হুঁ হুঁ’ করে সম্মতি জানাতে থাকা মানুষজনকে বিকেলের ধুলোভরা আলোতে কিরকম শালজঙ্গলের মতো দেখিয়েছিল। এবং অফ্ ফোকাসে কোনো পাহাড়ের ঢালু অংশ না থাকলেও এই জঙ্গলসম দৃশ্য শেষ বেলার ধুলোটে আলোয় সেই করুণাময় পরমাশ্চর্য বিভা অর্জন করে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন