স্বামীজ্ঞানলোকানন্দজি এত ছোট হেডমাস্টার কে দেখে অবাক হলেও, নিরাশ করেননি মোটেও। প্রথম দিনই তিনি বাবরকে প্রবল উৎসাহ যুগিয়ে তাকে উপহার দিয়েছিলেন ‘সবার স্বামীজি’ বইটি। সেই বইটা এত বছর বাদে একটু জীর্ণ হলেও আজও বাবরের তা নিত্য সঙ্গী। যখন তখন বার করে সেটি সে মাথায় ঠেকায় আর দিনে একবার কিছুটা সময় হলেও পড়ে। স্বামী জ্ঞানলোকানন্দজির কাছে বাবরের আর্জি ছিল একটি ব্ল্যাকবোর্ডের এবং কিছু বই খাতা ও পেন্সিলের, যা অচিরেই পূরণ হয়েছিল।
স্বামীজি কথাও দিয়েছিলেন তিনি বাবরের স্কুলে আসবেন। সে কথা তিনি রেখেও ছিলেন, একবার নয় বারংবার।
বাবরের এবার মনে হল, স্কুলকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দরকার সরকারি সাহায্যের। এই উদ্যোগ নিয়ে বহরমপুর অভিযান করল বাবর। তখন অতিরিক্ত জেলা শাসক ছিলেন জীবনকৃষ্ণ সাধুখাঁ। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য স্লিপ পাঠালো বাবর।
কিছুক্ষণ বাদে চাপরাশি এসে বলল, ‘আনন্দ শিক্ষা নিকেতনের প্রধান শিক্ষক আসুন’।
কাঁধে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে স্কুল ড্রেস পরে ১৩ বছরের বাবর এলো সাহেবের সাথে দেখা করতে। ছোট ছেলেটাকে দেখে সাহেব বিরক্ত হলেন। চাপরাশিকে বলল, ‘কাকে এনেছো? আমি তো হেডমাস্টারকে ডেকেছি।’
বাবার বলল, ‘স্যার আমি হেডমাস্টার’।
স্যারও প্রথমে অবাক হলেন, তারপর হেডমাস্টারের বক্তব্য শুনলেন। সবশুনে বললেন, দেখি কিছু করা যায় কিনা। এরপর এসডিও সাহেব কে আচমকা পাঠালেন স্কুল পরিদর্শন করতে, এসে তিনি অবাক হলেন। দেখলেন স্কুল চলছে, হেডমাস্টারও আছে, প্রতারণার কোন জায়গা নেই। সরকারি সাহায্য না পেলেও বহু বিশিষ্ট মানুষজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল বাবরের স্কুলের জন্য।
২০০৮ সালে বহু চেষ্টার পর বেলডাঙ্গা শাখার (তখন ছিল ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বর্তমানে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক) প্রবন্ধক শ্রী আশীষ রায়ের তত্ত্বাবধানে এবং প্রাক্তন শাখা আধিকারিক গৌড় গোপাল মন্ডলের সহায়তায় প্রায় ১১০ জন ছাত্রছাত্রীর একাউন্ট এবং বিদ্যালয়ের নামে প্রয়োজনীয় একাউন্ট খোলা হয়। ব্যাংকের ইতিহাসে সম্ভবত এটি প্রথম অ্যাকাউন্ট ছিল যেখানে ১৪ বছরের একজন হেডমাষ্টারের সাক্ষরে খোলা হয়েছিল।
এবার বাবর লালগোলা এক্সপ্রেস ধরে রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে। বাবরের প্রার্থনা শুনলেন মুখ্যমন্ত্রী। নবীন হেডমাস্টারটি বলল, ‘স্যার আমার স্কুলে ৬০০ জন ছাত্র কিন্তু এক পয়সাও সরকারি সাহায্য নেই। এভাবে আর কতদিন চলবে?’
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘তোমার স্কুল কি সরকারি অনুমোদিত?’
বাবরের জবাব, না স্যার। মুখ্যমন্ত্রী পরামর্শ, ‘তুমি লিখিতভাবে জানও কি সাহায্য চাও, আমি দেখছি সরকারি অনুদান দেওয়া যায় কিনা’
বাবর সাদা কাগজে খসখস করে লিখে তুলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী-র পিএ-র কাছে। পারিবারিক বার্ষিক আয় ৬০ হাজার টাকার কম অথচ মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে নম্বর ভালো ৫৩ জন ছাত্রছাত্রীর হাতে ভর্তির খরচ চালাতে ৫০০০ টাকার চেক তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
একটি কথা না বললেই নয়, কোন ভালো কাজ শুরু করে একজন ঠিকই কিন্তু তার চারপাশের মানুষ অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করে। বাবরের বিদ্যালয় তৈরি করতে তেমনই একজন ছিলেন টুলু মাসি। অক্ষর চেনেন না তিনি, রুজির টানে দিনভর গ্রামের পাড়ায় মাছ বিক্রি করেন। কিন্তু রাস্তায় এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো ছেলেপুলে দেখলেই হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ ছেলে ধরা।
‘স্কুলে যাস না কেন রে?’
চার আনার লজেন্স কিনে ভুলিয়ে ভালিয়ে স্কুল ছুটদের ফের হাত ধরে পৌঁছে দেন স্কুলের উঠানে। মুর্শিদাবাদে বেলডাঙার নতুন মহুলা গ্রামের টুলু দাসী হাজরা এভাবেই ছিলো ‘নিরক্ষরদের বাতিওয়ালা’।
আর তার হাত ধরে স্কুলে আসা সেই সব ছেলেমেয়েদের ঠিকানা বাবর স্যারের আনন্দ শিক্ষা নিকেতন ।কয়েক বছরে এভাবেই অন্তত জনা সত্তর শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে দিয়েছেন টুলু দেবী। তিনি বলেছেন, নিজে নাই বা লেখাপড়া জানলাম, তা বলে গাঁয়ের ছেলেপুলেগুলো রাত দিন খেলে বেড়াবে তা দেখতে পারবো না, তাই ওদের স্কুলে পৌঁছে দিয়েই শান্তি। শুধু তাই নয়, দিনান্তে তাদের ফের রাস্তা পার করিয়ে গ্রামে পৌঁছে দেওয়াও ছিলো তার কাজ।
বর্তমানে বাবরের সেই স্কুল বাড়ির পিয়ারাতলায় আর নেই, ছাত্রছাত্রীদের রোদের তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য মায়ের শাড়ি আর প্রয়োজন পরে না। গ্রামের এক প্রান্তে ধানক্ষেতের গা ঘেঁষে শঙ্কর পাড়া গ্রামে তৈরি করা হয়েছে তিনতলা বিশিষ্ট এক বিশাল স্কুল বিল্ডিং, যার নাম ‘আনন্দ শিক্ষা নিকেতন’। যার প্রায় প্রতিটি কক্ষেই টাঙ্গানো আছে স্বামী বিবেকানন্দের বিশাল ছবি। ২০১৪ সালে তৈরী হতে শুরু করে স্কুল এবং ২০১৫ সালের ১৫ই নভেম্বর উদ্বোধন করা হয় “আনন্দ শিক্ষা নিকেতন”-এর।
বাবরের এই পুরো প্রচেষ্টাতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দেশের ও বিদেশের বহু বিশিষ্ট মানুষজন কারণ বিদ্যালয়টি সরকারি অনুমোদন পেলেও আজ অব্দি পায়নি কোন সরকারি অনুদান। স্কুলের সামনে রাস্তা দিয়ে কাদামাখা বর্ষায় হাঁটু জল সমান তাতে অবশ্যই ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহের ভাটা পড়েনি। প্রবল বর্ষাতেও তারা কাদা পায়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, ছাতা মাথায় বহু পথ হেঁটে স্কুলে আসে। কারন হেডমাস্টার যে তাদের বড় আপন মানুষ। তার শিক্ষার ধরন ভালবাসা ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে দৃঢ় বন্ধনের সৃষ্টি করেছে। তাই স্কুল ছুটির পরও তারা সহজে বাড়ি যেতে চায়না, হেডমাস্টারে বকুনি খেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি যেতে হয়।
স্কুলটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনুমোদন পেয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়ানো হয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এই স্কুলেরই প্রাক্তন ছয়জন ছাত্র-ছাত্রী বর্তমানে এই স্কুলের শিক্ষক। মোট শিক্ষকের সংখ্যা দশ। বর্তমানে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় চারশো। এখন অব্ধি প্রায় ৮ হাজার ছাত্রছাত্রী এই স্কুল থেকে পাশ করে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা কিম্বা চাকরি করছেন।
একটা সময় এসেছিল বাবরের কাছে ভয়ংকর দুঃসময়। বহু লোক তার সাহায্যের হাতগুলোকে ভুল বোঝানোর জন্য দাঁড়িয়ে গেছিল। স্কুলের জন্য ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেট, পাঠ্যপুস্তক, মিড ডে মিল সবকিছুতেই হয়রানির শেষ ছিল না। চারিদিকে যখন মিড ডে মিল চলছে, ছাত্র-ছাত্রীদের ধরে রাখা বেশ মুস্কিল হয়ে যাচ্ছিল। বিডিওর কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল অন্তত কিছুদিনের জন্য মিড ডে মিলে ব্যবস্থা করার জন্য। রাষ্ট্রসঙ্ঘর নির্দেশেই সর্বশিক্ষার উদ্যোগ কিন্তু অজ্ঞাত কারণেই বিডিও সাহায্য করলেন না।
ছোট ছেলেটির কৃতিত্বে ঈর্ষান্বিত হয়ে অনেকেই তাকে হয়রানি করতে থাকে। লোকজন সরকারি চাকরির জন্য তার কাছে যেতেন, অপ্রয়োজনীয় বাধা ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতেন। এমনকি স্থানীয় অসামাজিকদের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকিও পান তিনি। বাবরকে পুলিশের নিরাপত্তায় কলেজের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। বাবর ইংরেজি এবং ইতিহাসে ডাবল মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
বহু বাধা অতিক্রম করে বাবর আলির পরিচিতি আজ সারা বিশ্বময়। এমনকি বিদেশেও তার নাম ছড়িয়ে গেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত স্কুল স্তরের একটি ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ্যপুস্তকে বাবরের সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ানো হয়।
২০০৯ সাল থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হতে আরম্ভ করেন বাবর। ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে মাত্র ১৬ বছর বয়সী বাবর আলিকে বিশ্বের কনিষ্ঠতম প্রধানশিক্ষক (Youngest Headmaster of the world) হিসেবে সম্মানিত করে বিবিসি (BBC)। ২০১২ সালে গিয়েছিলেন আমির খানের ‘সত্যমেব জয়তে’-তে’ও। ফোর্বস এশিয়ার ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’র তালিকাতেও নিজের জায়গা করে নেন তিনি। আমির খানের কাছ থেকে সিএনএন আইবিএন রিয়েল হিরো অ্যাওয়ার্ড পান বাবর। তাকে নিয়ে লেখার জন্য বিবিসি তার গ্রামে গিয়েছিলো। তিনি একজন TED ফেলো হয়েছিলেন, এবং NDTV-এর মতো সংবাদ সংস্থাগুলিও তাঁকে সম্মানিত করেছিল।
শান্তিনিকেতনের একটি অনুষ্ঠানে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে শিক্ষা সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছে বাবর। প্রণয় রায়ের এনডিটিভি আয়োজিত বছরের সেরা ১০ জন ভারতীয় হিসেবে অমিতাভ বচ্চন, নীতিশ কুমার, ভারতের নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বাবরও সম্বর্ধনা লাভ করেছে। রাষ্ট্রপতি ভবনেও নিমন্ত্রিত হয়েছে, ভারতের প্রায় সব রাজ্য থেকে ডাক পেয়েছেন কর্ণাটক, কেরল, তেলেঙ্গানা, অন্ধপ্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যের শিক্ষা মহলে বাবর এখন সুপরিচিত নাম। কর্ণাটক সরকার প্রথম বর্ষের পিইউ কোর্সের জন্য নির্ধারিত ইংরেজি পাঠ্যে বাবরের গল্প অন্তর্ভুক্ত করেছে। এমনকি, সিবিএসই বোর্ডের দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকেও জায়গা করে নিয়েছে বাবর আলির কাহিনী।
২০২০ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের মুখেও শোনা গিয়েছিল বাবরের সুখ্যাতি।
“ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামো না।” বিবেকানন্দের করা উপনিষদের বিখ্যাত এই লাইনটি বাবরের পথপ্রদর্শক হয়ে রয়েছে। বাবর বিশ্বাস করেন, “সার্ভিস টু ম্যান, সার্ভিস টু গড”। পরম শক্তির কাছে প্রার্থনা একটি, তার সৃষ্টি “আনন্দ শিক্ষা নিকেতন” যেন সুস্থ সমাজ পরিবেশের সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বিরাজমান থাকে। আজীবন মানুষ ও সমাজে কল্যাণ করুক বাবর, তার এই মহৎ প্রয়াস যেন বন্ধ না হয়।।
Eto valo laglo..eder kotha janle koto inspiration pawa jaay
একদম। বাবর আলি সমাজের কাছে অনুপ্রেরণার নাম।
ভালো লাগলো। আদর্শ শিক্ষক এর জীবনী।
অনেক ধন্যবাদ
এমন প্রতিভাবান একজন শিক্ষক কে খুঁজে যিনি এই সময় দাঁড়িয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে নিজের অধ্যবসায়🙏🙏🙏,,,,এনারা আছেন বলেই সমাজ বলে কিছু আছে,,, ধন্যবাদ আপনাকে এনার মতন মানুষকে আপনার লেখার মাধ্যমে আমরা2জানতে1পারলাম👌👌👌
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।