শিক্ষকেরা আমাদের সমাজের মেরুদন্ড। তাঁরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার মূল কারিগর। শিক্ষক দিবসে আজ বলবো লন্ডনের ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (বিবিসি) স্বীকৃতি প্রাপ্ত বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষকের কথা। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা গ্রামের এই শিক্ষকের নাম বাবর আলি (Babar Ali)।
স্বামীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত বঙ্গের এই শিক্ষকের জীবনের মূল মন্ত্রটি হলো ‘সবার জন্য শিক্ষা… কেবল শিক্ষা শিক্ষা, শিক্ষা’। এই আদর্শকে সামনে রেখে মাত্র নয় বছর বয়সে বাবর গড়ে তুললো একটি স্কুল, নাম — আনন্দ শিক্ষা নিকেতন।নয় বছর বয়সের অঙ্কুরিত স্বপ্ন আজ নবযৌবনপ্রাপ্ত। তার গড়া ‘আনন্দ শিক্ষা নিকেতন’ ২৪ বছরের শাখায় পুষ্পে ফলে শিকড়ে আজ মহীরুহ।
সামাজিক, অর্থনৈতিক হাজার বাঁধার মধ্যেও অদম্য মনের জোরে কিভাবে মানবসেবায় নিজেকে সঁপে দিতে হয়,তার জ্বলন্ত উদাহরণ বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষক বাবর আলি। বাবরের কঠিন লড়াইয়ের কাহিনী চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। আজকে তাঁর সেই যাত্রার কাহিনী বলবো।
এবছরের মে মাস বাবরের সাথে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। বাবরের যাচ্ছিল চেরাপুঞ্জি, মেঘালয়। সেখানে সোহরা রামকৃষ্ণ মিশনে শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে তাঁকে প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। যাত্রার আগের দিন আমাদের দমদম আবাসনে মাষ্টারমশাই ডক্টর সনৎ শাসমলের অতিথি হিসেবে বাবর এসেছিল। হঠাৎই দুপুরবেলায় সনৎদা এসে বললেন বাবরের কথা।বিকালে বাবর রোজা ভাঙবে। সামান্য কিছু আয়োজন করে আমরা গেলাম বাবরের সঙ্গে দেখা করতে।
বিশ্বজোড়া যার নাম খ্যাতি, সম্মান, অসংখ্য পুরস্কার, অন্যরাজ্য এবং বিদেশের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত বাবরের জীবনী, অথচ কি নম্র বিনয়ী ভদ্র একটি ছেলে। ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ম’ বাবরের মধ্যে এটি যেন সর্বদা বিদ্যমান।
বাবরের মুখ থেকেই শুনলাম কত দুর্গম গিরি সংকট পার হাওয়ার গল্প। বহুবার অনেকের কাছ থেকে পাওয়া লাঞ্ছনা, সংকীর্ণতা মনকে প্রবল আঘাত করেছে, তবু ভেঙে পড়েনি বাবর। সমস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক বাধাকে তুচ্ছ করে বহু ঝড় ঘাত প্রতিঘাতকে অতিক্রম করে আজকের মহীরুহ গড়ে তুলেছে বাবর।
১৯৯৩ সালের ১৮ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার অন্তর্গত ভাবতা’র গঙ্গাপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে বাবর আলীর জন্ম। পিতার নাম মহম্মদ নাসিরুদ্দিন এবং মায়ের নাম বানুয়ারা বিবি।
২০০২ সাল, তখন বাবর নয় বছরের বালক, পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। রোজ যখন স্কুলে যেত বা ফিরতো পিঠে ব্যাগ বা কোনও কোনওদিন হাতে টিনের বাক্স নিয়ে তখন দেখতে পেত যে তার বন্ধুদের মধ্যে বা আশেপাশের চেনা পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই হয়তো মাঠে খেলে বেড়াচ্ছে, কাগজ কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে বা পরিবার পালনের উদ্দেশ্যে ছোট বয়সেই বিড়ি বাঁধতে যাচ্ছে।
মেয়েদের অবস্থাতো ছিল আরও করুন। এমনিতেই গ্রামে মেয়েদের পড়াশোনার চল প্রায় ছিল না বললেই চলে, হয়তো কিছু পরিবার তাদের ছেলেদের স্কুলে পাঠাতো আর মেয়েরা যেতো লোকের বাড়ি কাজ করতে, মাঠে পাট তুলতে। খুব ছোট বয়সেই এসব পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়াও হতো। বাবরের বাবা-মা অত্যন্ত প্রগতিশীল বলে বাবর স্কুলে যেতে পারছে না হলে তার অবস্থা অন্য ছেলেদের মতোই হত। বাবরের বাবা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন এই ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিলেন, তাঁর ছেলেমেয়েদের যতদূর সম্ভব তিনি পড়াবেন ।
স্কুলে যাওয়ার পথে বাবরের একটি কথাই বারে বারে মনে হতো ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কিভাবে বিনা পয়সায় তাদের পড়ানো যায়। কিন্তু সে নিজেই তো ছোট তখন সবে মাত্র ক্লাস থ্রী তে পড়ে। বাবর স্থির করল সে রোজ স্কুলে গিয়ে যা পড়বে বা পড়া শিখবে, সেগুলো দিয়েই সে তার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াবে। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ।
মায়ের সক্রিয় আর বাবার নিরব সমর্থন পেল বাবর। বাবা নাসিরুদ্দিনের একটি আশঙ্কা ছিল, যদি এসব করতে গিয়ে বাবরের নিজের পড়াশোনা ক্ষতি হয়। এনিয়ে বকাবকিও চলতো। বাবার বকুনির হাত থেকে বাঁচতে প্রথম প্রথম বাবর বাড়ির কাছে একটি জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় লুকিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতো। কিন্তু মা জানতে পেরে এগিয়ে আসে সহায়রূপে।
মায়ের পূর্ণ সমর্থনে বাধাহীন বাবর কাজে লেগে পড়লো। স্কুল তৈরি হল বাড়ির উঠানে পেয়ারা গাছের তলায়।মায়ের পড়া শাড়িগুলো ব্যবহার হতে লাগলো রোদের তাপ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বাঁচবার জন্য।
বাবরের তৈরী স্কুলের প্রথম ছাত্রী ছিল তার নিজের পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট বোনটি আমিনা খাতুন। পরে তার দুই ভাই নজরুল ও ফারুক ও একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। আমিনা এখন স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনা শেষ করে ‘আনন্দ শিক্ষা নিকেতন’র শিক্ষিকা।
বাবরের স্কুল শুরু হলো মায়ের কাছ থেকে সামান্য কিছু পয়সা নিয়ে কিনে আনা হলো ব্ল্যাকবোর্ড, চক খড়ি আর কিছু ছোট ক্লাসের (প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর) বই দিয়ে। কিন্তু স্কুলে আসবে কে?
ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করতে যেসব বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের স্কুলে যায় না তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুরু হলো ধর্না দেওয়া। সবাইকে বুঝিয়ে বলা হতো।শেষ পর্যন্ত জোগাড় হল গোটা আটেক ছাত্র-ছাত্রী। এসব পরিবারেরগুলি এতটাই গরীব ঘরের ছেলেদের বই পত্র খাতা পেন্সিল কিছুই কিনে দেওয়ার ক্ষমতাও ছিল না।
তাতে কি? প্রথম প্রথম পড়া বলতে অক্ষর চেনা আর ধারাপাত। বাবর নিজে ছাত্র হিসেবে স্কুলে যায় আর বাকি সময় মাস্টারমশাই। প্রতিদিন বাবর স্কুলে যায় ৮ কিলোমিটার বাসে আর দু-কিলোমিটারের পথ পায়ে হেঁটে। বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে তার স্কুল শুরু করতো। নিজের স্কুলে পড়ানোর সময় দিদিমণিরা যে চকগুলো ফেলে দিতেন সেই ভাঙা চকগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আসতো বাবর তার নিজের স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার জন্য।
নিজের স্কুলের মাস্টার মশাইদের নকল করে বাবর পড়া ধরে, আর না পারলে বকুনি। পড়া পড়া খেলার মজা পেয়ে ধীরে ধীরে ছাত্র-ছাত্রীরাও আসতে লাগলো স্কুলে। ক্রমে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যাও বাড়তে লাগলো।
কিন্তু সমস্যা হল এত বই কোথায় পাবে বাবর ? প্রথম প্রথম নিজের বই দিয়ে ছাত্র পড়ানো শুরু হলো। এরপর পুরনো বইপত্র যোগাড় করার কাজ শুরু হল কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটল না। এরপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাবর তার দলবল নিয়ে চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হলো। প্রত্যেক পরিবারে যাওয়ার সময় একটি বস্তা নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে যে যার সাধ্যমত এক মুঠো, দু-মুঠো চাল তাকে ঢেলে দিত। সেই চাল একটি মুদি খানায় বিক্রি করে যে টাকা যোগাড় হতো তাই দিয়ে কেনা হতো বর্ণ পরিচয়। যা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা হতো।
তখন চালের দাম ছিল ১০ টাকা কেজি আর বর্ণপরিচয়ের দাম ছিল এক টাকা। একবার বাবর কুড়ি কেজি চাল বিক্রি করে কিনতে পেরেছিল কুড়িটা বর্ণ পরিচয়।
কিন্তু স্কুল চালাতে গেলে তো আরো অনেক জিনিসের সাহায্যের দরকার। সেই সময় বাবর প্রায়ই শুনত যে রামকৃষ্ণ মিশন অনেক ক্ষেত্রে সাহায্য করে। তার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশন তার স্কুলকেও সাহায্য করবে। ন-বছর বয়সে বাবর তার কিছু সঙ্গীর সাথীকে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে হাজির হলো সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী জ্ঞানলোকানন্দজীর অফিসে।
খুবই ভালো লাগলো।
আদর্শ শিক্ষক বাবার আলি।
থ্যাঙ্ক ইউ 🙏
সাবাশ ! বাবর আলি সাবাশ! ধন্য তোমার মা , ধন্য তোমার বাবা । দৈনন্দিন জীবনে শহুরে চাকচিক্য , গ্লানি , জটিলতা , বিলাসবহুল জীবনযাপন । দারিদ্র্য , অভাব , দুঃখ – কষ্ট কখনও এরা অনুভব করেনা। শহর থেকে দূরে লোকচক্ষুর আড়ালে হত – দরিদ্র পরিবারের একজন শিশু সবার মতো একটু বড় হয়েই জীবিকার জন্য , পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে , নিজের উদর পূর্তির জন্য পড়াশোনা বর্জন করে । এহেন পরিস্থিতির গর্ভ ফুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়ালো বিস্ময় বালক বাবর আলি । বাবর কোথা থেকে পেলো এমন মনের জোর , জীবনী শক্তিতে ভরপুর মশাল জ্বেলে শিক্ষার আলো দেখাতে , দরিদ্র ঘরের শিশুদের শিক্ষা দিতে নেমে পড়লে গ্রামের মধ্যে , এমন দুঃসাহস কোথা থেকে পেলো , নবছরের প্রধান শিক্ষকের প্রথম ছাত্রী ছোট বোন, তারপর ছোট ভায়েরা। স্কুলের ফেলে দেয়া চক নিয়ে এসে নিজেই ব্ল্যাক বোর্ড কিনে শুরু করে দিলে শিক্ষা প্রদানের কাজ । স্কুল তৈরি করলে । আজ সেই স্কুল ফুলে – ফলে , শাখা – প্রশাখায় পল্লবিত । নবজীবনের অগ্রদূত , মশালচি তুমি বিশ্বমাঝারে আজ বন্দিত। তোমাকে অসংখ্য স্যালুট , তোমার মা বাবাকে ও আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই । সর্বোপরি , রিঙ্কি দিদিভাই এমন একজন সাহসী সেনাপতির সাহচর্যে এসেছেন যা দেখে ভীষন গর্বিত । বাবর আলির রূপকথার মতো জীবন যেভাবে তুলে ধরেছেন তাতে ভীষন আপ্লুত হয়েছি । আপনাকে শুভেচ্ছা ও অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই ।
প্রথমেই আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই 🙏
প্রার্থনা এটুকুই, আমাদের স্নেহের ইয়ংগেষ্ট মাস্টারমশাই যেন সুস্থ সমাজ পরিবেশে তার সৃষ্টি আনন্দ শিক্ষা নিকেতন” কে সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে ।