বৃহস্পতিবার | ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:৫৭
Logo
এই মুহূর্তে ::
নানা পরিচয়ে গৌরী আইয়ুব : গোলাম মুরশিদ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় কেন বারবার মণিপুরে আগুন জ্বলে আর রক্ত ঝড়ে : তপন মল্লিক চৌধুরী শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (শেষ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ হাইপেশিয়া — এক বিস্মৃতপ্রায় গনিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (ষষ্ঠ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (শেষ পর্ব) : বিজয়া দেব শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (পঞ্চম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (চতুর্থ পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার শতবর্ষে সঙ্গীতের ‘জাদুকর’ সলিল চৌধুরী : সন্দীপন বিশ্বাস সাজানো বাগান, প্রায় পঞ্চাশ : অমর মিত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (তৃতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (একাদশ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার খাদ্যদ্রব্যের লাগামছাড়া দামে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের : তপন মল্লিক চৌধুরী মিয়ানমারের সীমান্ত ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্যোগ : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (দ্বিতীয় পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (দশম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার বুদ্ধদেব গুহ-র ছোটগল্প ‘পহেলি পেয়ার’ ‘দক্ষিণী’ সংবর্ধনা জানাল সাইকেলদাদা ক্যানসারজয়ীকে : দিলীপ মজুমদার শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর রামতনু লাহিড়ী (প্রথম পর্ব) : বিশ্বজিৎ ঘোষ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (নবম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘তোমার নাম’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (অষ্টম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-র ছোটগল্প ‘হাওয়া-বদল’ কার্ল মার্কসের আত্মীয়-স্বজন (সপ্তম পর্ব) : দিলীপ মজুমদার প্রবোধিনী একাদশী ও হলদিয়ায় ইসকন মন্দির : রিঙ্কি সামন্ত সেনিয়া-মাইহার ঘরানার শুদ্ধতম প্রতিনিধি অন্নপূর্ণা খাঁ : আবদুশ শাকুর নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘শুভ লাভ’
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

ননী ভৌমিক-এর ছোটগল্প ‘ধান-কানা’

ননী ভৌমিক / ১৬৬ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০২৪

তেরশ পঞ্চাশ গেল। ধানকাটার সময় লোক পাওয়া যায় নি৷ এমন কি পশ্চিম থেকে পূর্ণিয়া কাটিহার থেকেও লোক এল না। দেশের চারিদিকে রাস্তাঘাট হচ্ছে, ফৌজে কুলী খেটে মজুরী মিলছে ছাপান নোটে— তাই টান পড়ল লোকের। একান্ন সালও গেল। কিন্তু তৃতীয় বছরে, ধানকাটার সময় লোক এল আবার। সৈন্যদের জন্যে রাস্তা তৈরীর প্রয়োজন এখন নেই আর। এরোড্রমের জমিতে কুলীর দরকার নেই। আসামের জঙ্গল থেকে লড়াই-খালাস মজুররা ফিরে এসেছে ম্যালেরিয়া নিয়ে।

ধানকাটার সময় বড়ো বড়ো জোতদারের খালানে এসে জুটল বেহারী জোত-মজুররা। কুটোকাটা নিয়ে আগুন জ্বালাল শীত এড়াতে। গাছের তলে রান্না ক’রে খেয়ে দেয়ে কালিপড়া মাটির হাড়ি পাতিল বেঁধে রাখল আমগাছের ডালে৷

আর কাজ পেল সবাই— ধানকাটার কাজ।

বেহারী লোকজনের সঙ্গে কোথা থেকে ফিরে এল আঁধারু উত্তরবঙ্গে তার এই নিজের জেলাতেই। একটা ছেঁড়া ঝুলিঝুলি কোট গায়ে দিয়েছে ও; গায়ের আন্দাজে কোটটা বড়ো— পিঠ আর ঘাড়ের জায়গাটা ছিড়ে গিয়ে আরো খানিকটা বড় দেখাচ্ছে। কোটের নিচে ময়লা চাদর গায়ে জড়ানো; তারই একটা ভাঁজ তল থেকে তুলে এনে কান যার মাথা ঢেকেছে! যে কাপড়টুকু নেংটি করে পরেছে তা কোটের লম্বা ঝুল পেরিয়ে উরুর নিচে নামেনি। শীতে আর ধূলোয় হাতে পায়ে একটা ফাটা ফাটা ভাব এসেছে, গায়ের স্বাভাবিক বাদামী রঙটা মিশ কালো হ’য়ে গেছে সেখানে।

উত্তর বঙ্গের ‘পোলিয়া’ জাতের মানুষ। সাঁওতাল নয়, তা বোঝা যাবে শুধু ওর অপরিচ্ছন্ন বেশভূষায়; মুখের রঙটা হাতপায়ের মতো অতো কালো নয়; বাঁকা ভাবে বসান লম্বা ধাঁচের চোখ; ঠোটের ওপর পাশুটে রঙের অল্প একটু মোচ৷

ডিষ্টাক্ট বোর্ডের রাস্তা মেরামত করার কাজে জনচারেক বুড়ো জোয়ান বেহারী মজুর জোগাড় করা গেছে বহু কষ্টে। আরো লোক চাই৷ তাই বেশি করেই মজুরী কবুল করেন ঠিকাদার বাবু। একহাতে সাইকেল আর এক হাতে আঁধারুকে চেপে ধরে টেনে নিয়ে এলেন হাফ প্যান্ট পরা ভদ্রলোকটি— নে, খেটে দে; কোদাল চালিয়ে হাট পৰ্যন্ত এই রাস্তাটা ঠিক করে দে বাপু।

আঁধারু তবু দাঁড়িয়ে থাকে।

সারারাত গাছতলায় পড়ে থেকে শীত করেছে বলে এখনো অমনি কাঠের মতো অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, না আদপে লোকটা একটা জরদ্গাব বোঝা যায় না।

কি, খাটবি কি খাটবি না— সাইকেল হাতে করে ঠিকাদার বাবু মরীয়া হ’য়ে জিজ্ঞেস করেন।

কেনে খাটিম না? তবে কতো দিগার সেইটা ক’হে দাও—

পিঠের ওপর লাঠিতে বাঁধা লম্বাটে পোঁটলাটা নড়িয়ে আঁধর একটু কুঁজো হয়ে দাড়ায়।

ঐ ঐ একটাকা। কজন হলি পাঁচজন? রাস্তাটা আধাআধি শেষ করে ফেলতে হবে কিন্তু। সন্ধে বেলা এসে মিটিয়ে দেব—

কাজ সুরু করবার আগে অন্য চারজন বেহারী মজুর অলস হয়ে দাড়িয়েছিল। এবার প্রতিবাদ করল।

নাই হোবে বাবু— অতোখানি রাস্তা ঠিক নাই হোৰে-

হবে, হবে— ঠিকাদার বাবু সাইকেলে চেপে চলে যান।

লাঠির ডগায় বাঁধা পোঁটলাটা থেকে আঁধার একটা কোদাল বার করে। ছেঁড়া কোটটা খুলে নেয়।

হবে গো লাগাও— অসন্তুষ্ট ভাবে বিড়বিড় করে বকতে বকতে ঠিক হ’য়ে নেয় অন্য কয়েকজনও।

তারপর কোদাল চালায় ঝপঝাপ, করে; মাটি তুলে দেয় রাস্তায়। কেন না পুরো একটাকা করে মজুরী কম নয়।

ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে সেতাবগঞ্জের ঘাটে।

দুপাশে শুয়ে-পড়া পাকা ধানখেতের ওপর রোদ্দুর পড়েছে। শালিখ আর চড়ুই পাখির ঝাঁক তার ভেতর ঠোকর মারছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সরষে ক্ষেতে শুকিয়ে এসেছে হলদে ফুলগুলো। খেসারী কলাইয়ের শুকনো ঝাড়গুলো আলগা বাতাসে খস্ খস্ করে নড়ে উঠছে। চারিদিককার খানিকটা মেটে বাদামী শুকনো আবহাওয়ায় তামাকের চারাগুলো হঠাৎ বড়ো বেশি সবুজ দেখায়৷

মনের ভেতর একটা শক্ত জায়গা উঁচু হ’য়ে ওঠে। কোদাল চালান থামিয়ে গল্প করতে ইচ্ছে করে।

রানিয়াগঞ্জ থানার দিকে ধানী জমিতে আখচাষ দেয় মানুষ; বলে, ধান গাড়লে পেটে খাবো; আখ দিলে পয়সা আসবে— আঁধারু ধান খেতের দিকে তাকিয়ে বলে৷

আধবুড়ো শক্ত চেহরার বেহারী মানুষটা অন্যকথা ভাবে: লড়াই শেষ হল তো বহু মানুষ ফিরছে ঘরে। ভাবছে, কি ধানকাটার জন্যে লোক লাগবে তো এক-এক করে এদিকে এসে যাচ্ছে সবাই।

আনিয়াগঞ্জ থানার দুই লম্বর রিউনিয়ন দুগাপুর; ওতি হামার বাড়ি- আঁধারু বলে।

হাটের পথে খালি গরুর গাড়ীগুলো সারি বেঁধে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। পাতলা শাদা ধূলো উড়ে উড়ে গিয়ে জমছে দুপাশের আসাম লতার গায়ে। ধূলো পেয়ে খেয়ে পাতা-ঝোঁপের ওপরটা পাঁশুটে হয়ে গেছে, তলের দিকটা এখনও মেটে সবুজ। বেঁটে বেঁটে ঘোড়ায় চেপে মাঝে মাঝে খালি বস্তা বেঁধে নিয়ে লাল সবুজ আলোয়ান গায়ে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পাইকাররা। একটা নেউল ছর ছর করে রাস্তা থেকে নেমে ছুটে পালল।

কাঁচা পাতায় তামাক মুড়ে আগুন ধরিয়ে বেহারী লোকটা কড়া ধোঁয়া টানে।

আঁধারু বললে— দুটো ধান কাটা হয়ে গেল তো এই আর একটা ধান কাটা এল!

প্রায় একই রকম চিন্তা করে আধবুড়ো লোকটা— আমার ঐ ব্যাটা দেশে ফিরতে বড়ো নারাজ৷ বলে, যেখানে কাজ সেখানে যাবো; নয়ত আথকলে কাজ নেবো।

আচমকা প্রশ্ন করে আঁধারু। বিষণ্ণ ভাবে বলে— দেশে জমি আছে তোমার?

চট করে উত্তর দেয় না আধবুড়ো লোকটা। কড়া ধোঁয়া টেনে গলার শিরা ফুলে ওঠে। বার কয়েক থুথু ফেলে অন্য দিকে তাকায়৷ তারপর বলে— না, জমি নেই। কিন্তু একটা নিয়ম আছে কি জমিদারের ক্ষেতে খাটলে ফসলের একটা ভাগ পাওয়া যায়। তো সেটাও জমি চাষ করাই তো হল?

তারপর আর গল্প করতে ইচ্ছা করে না৷ অকারণে ভার হয়ে আসে বুকের ভেতরটা। পরিশ্রম করলে এই যন্ত্রণা-বোধটা টের পাওয়া যাবে না।

কোদাল চালাতে চালাতে এক সময় কোমরে হাত দিয়ে সিধে হয়ে দাড়ায় আঁধারু— এই কোদাল চালাও, এর খাটুনীটা একরকম। আবার ধান কাটো, তে! সে খাটুনীটা অন্যরকম!

অন্যরকম— নিজের মধ্যে ডুবে থেকে সায় দেয় লোকটা৷

বিকেল বেলা হাফপ্যান্ট পরা লোকটা এল। মাটি চাপান রাস্তাটা দেখে সন্তুষ্ট হয় নি, এই ভাবটা প্রকাশ করার চেষ্টা করল নানারকমে। তারপর পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বললে— কালকে এরচেয়েও ভাল করে কাজ করতে হবে।

কিন্তু পরের দিন সকালে ছেঁড়া কোটটা গা থেকে খুললো না আঁধারু। চ্যাপ্টা পুটলিটায় কোদালটা ঢুকিয়ে নিয়ে লাঠি সমেত ঘাড়ে করে হাটতে সুরু করল রাস্তা দিয়ে— না, খাটবেনা ও।

কিন্তু মজুরীটা খানিক বেশী ছিল কি ছিল না?

থাকুক— হঠাৎ ঝগড়া করার ঝোঁক আসে আঁধারুর। রাস্তার উপর ফিরে দাড়িয়ে হাত টান করে চিৎকার করে— মানুষটা কহছে কি খাটি যাও বারে। নাই খাটিম। পল্টনে কেমন মাটি কাটিনম কি নাই কাটিনম সেইটা কহো। তো ফিরি আসিনম্ কেনে সেইটা কহো—

আধবুড়ো লোকটা ঝগড়া করে না। তাকিয়ে থাকে; কিন্তু কি করবে আঁধারু ধান কাটিম্!

কেমন একটু ঈর্ষাভরা চোখে সেইটা ব’লে যাক?— কেনে,

মাটি কাটার চেয়ে ধান কাটতে ভালো লাগবে। ভোর রাতের শীতে ছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে হিমে ভেজা ধানের গোছায় হাত দিয়ে অস্পষ্ট সুখ পাওয়া যাবে। আর তা শীতের জন্য নয়— অন্য কি একটা আশ্চর্য স্পর্শের জন্যে।

সব ধান কাটা হয়নি এখনও। একটা চওড়া নীচু কাঁদরের পাড়ে দাঁড়িয়ে লোভীর মত তাকায় আঁধারু— ধান তো এলায় কাটিবা

বাকি আছে?

আছে— ধান কাটতে কাটতেই নিচু হয়ে একটা লোক উত্তর দেয়।

ঘাড় থেকে লাঠিতে বাঁধা লম্বাটে পোটলাটা নামিয়ে রেখে লোভীর মতো নিঃশব্দে হাসে আঁধারু— ধান কাটার জন্যে একটা দুটো লোক তাহলে দরকার হতে পারে?

লোকটার মুখ কঠিন হয়ে আসে— কালি জোতদারের সাত বিঘে জমি ‘আধি’ করছি আমি। তো খাওয়া-পরা দিয়ে একটা মানুষ রাখলে আমার খালানে কবিশ ধান উঠবে?

কিন্তু ধরো এতো বড় গাঁ— তো কোন লোক বুড়ো হয়ে গেছে, কি অসুখে পড়েছে, কি একলা সমস্ত ধান কেটে তুলতে পারবে না —অনেক জমি আছে তার— তেমন কোনো লোকের তো দুটো চারটে পাইট দরকার হতে পারে?

আধিয়ারটার চোখ হঠাৎ নরম হয়ে আসে। বিলাপের মতো করে বলে— হামার গাঁওত নাই। হামার গাঁওত, তেমন চাষী নাই একটাও।

না, এ গাঁয়ে কাজ মিলবে না। তবু ভালো লাগে। তামাকের ক্ষেত থেকে একদলা মাটি তুলে নিয়ে আঁধারু পরখ করে ঝাহু চাষীর তামাকের চারাগুলো লক্ষ্য করে উঁচু হয়ে বসে: তেমন তাজা হয়নি। সারি সারি চারার মাঝে আলগা চাষ দিতে হয়েছে নতুন করে৷

এই মাঘ মাসে একটা বৃষ্টি হলে এতদিন এতটা বড়ো হয়ে যেত চারা গুলো— গোড়ালির ওপর হাত দিয়ে আয়তন বোঝাতে হয়।

ঘাড় বেঁকিয়ে হুকো টানতে টানতে ক্ষেতের মালিক সায় দেয়— উঠত! আলগা চাষের মাটিটা-আঙ্গুল দিয়ে নাড়ে আঁধারু— এই চাষটা দেয়া হয়েছে তো গাছ ঠিক হয়ে যাবে এবার—

মাঘ মাসে এখনও বৃষ্টি হল না! অস্পষ্ট আশংকায় মন্তব্য করে মানুষটা।

অদ্ভুত ভালো সেই আশংকা। সারা বছর ধরে একটা মৃদু মাটির স্বপ্ন। আমন উঠে গেলে রবিশস্য। ‘ভাদই’ উঠে গেলে পাট। পাট উঠে গেলে সরষে— প্রত্যেকটি ফসলে ছড়িয়ে আছে নতুন ফোটা অঙ্কুরের মতো প্রত্যাশিত বিস্ময়।

পোঁটলাটা ঘাড়ে করে আবার উঠে দাড়ায় আঁধারু, তবু চলে যেতে পারে না। নিকোনো তক্ তকে খালানে মড়াই বাঁধা হয়েছে। উঁচু উঁচু মড়াইয়ের ওপর, শীর্ষ সমেত পাকা ধান সাজিয়ে দেয়া হয়েছে মুকুটের মতো। নোলক পরা, বুকে কাপড় জড়ানো চাষীবউ ধানের গোছা আছাড় মেরে মেরে ঝাড়াই করছে। গুঁড়ো গুঁড়ো খড় উড়ে পড়েছে তার সারা গায়ে।

কিন্তু মেয়েটিকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে না।

—তোমার খামারেই আমি থাকব আজ রাতটা?

—ভালো কথা।

সন্ধে বেলা ধানকাটার শেষে পেট পুরে খেতে হবে। মোটা মোটা লাল লাল ভাত মটর শাকের ঝোলের সঙ্গে দলাপাকিয়ে খেয়ে তৃপ্ত দেখায় সবাইকে। তাই খালানে এসে কাঁথা জড়িয়ে বসে। পাটশলা পুড়িয়ে দাশুন জ্বালায়। হাত পা সেঁকে, আর গল্প করে।

দূর থেকে আরও একটা গাঁয়ের মাদলের শব্দ ভেসে আসে, সাঁওতালী মাদল।

খুব নাচগান লাগিয়েছে ওরা—

কালি জোতদার খবর পেয়ে গিয়েছিল। তো ওরা তীর-ধনুক নিয়ে ধান আগলে বসে রইল। ফিরে এসেছে কালি জোতদার— কিছু বলে নি।

ওই গায়ের সাঁওতাল আধিয়াররা ধান কেটে নিজেদের খালানে তুলেছে; জোতদারকে সাফ বলে দিয়েছে যে ধান ওরা নিজেরাই ভাগ করবে। সুদ দেবে না, আবোয়াব দেবে না— ভারই গল্প। অমনি সাহস আর খানিকটা বোকামি যাদের নেই, তারা মুগ্ধ হয়ে শোনে।

কালি জোতদার ছাড়বে না। থানা পুলিশ করবে। সে নাকি দেখেছে, কালি জোতদার কোটে বোতাম লাগিয়ে নতুন কেনা লাল-সাদা টাটু ঘোড়াটায় চেপে থানা বলে রওনা দিয়েছে—

সারা বছর ধরে ধান গাছ বড় করে তুলে, সেই ধান ফলানোর গল্প। নতুন জ্বালানী চাপিয়ে ফুঁ দেয় আগুনে; লাল আভায় চিক্ চিক্‌ করে চোখ।

সাঁওতালরা বিষ মাখিয়ে রেখেছে তীরের ফলায়—

কি ভেবে আঁধারু জিজ্ঞেস করে— আইনটা তাহ’লে কার পক্ষে? জোতদারের পক্ষে।

মোকদ্দমায় ডিগ্রি হবে ওর। কিন্তু সাঁওতালরা তবু বলে, নাই ছাড়বো ধান-

কে একজন কীর্তনের গান ধরে। অন্য সবাই চুপ করে যায়৷ চুপ করেও কিন্তু ভাবে ধান কেটে তোলার কথাই। ইংরেজী জানা উকিল আমলারা যে সব গোপন শক্তির কথা জানে— সেই আইনের কথা। অনেকক্ষণ গানের পর একজন বুড়ো চাষী বিষণ্ণভাবে মাথা ঝাঁকায়— গোটা গাঁকেই উচ্ছেদ করবে কালি জোতদার। নোতুন লোককে আধি দেবে—

ঘুম আসে না। বিচালি বিছিয়ে খালানে শুয়ে রইল আধার। ধান খেতে আর নিচু জায়গায় ভিজে কাপড়ের মতো পুরু কুয়াসা জমেছে।

সকাল বেলা উঠে আঁধারু চলে যাবে অন্য জায়গায় কাজের সন্ধানে। অন্য লোকেরা যাবে ধান কাটতে। আগুন জ্বালিয়ে নেংটি-পরা মনুষগুলো রাত আরো একটু ফর্সা হওয়ার অপেক্ষা করে।

আমার পাঁচ বিঘা জমি ছিল, তো বিচে দিলাম। অকালে দুটো ছাওয়াল মরে গেল, তো বিচে দিলাম— আঁধারু উৎসুক ভাবে জানাল, কেউ উত্তর দিল না।

বিচে দিলে জমি ফিরিবা নয়?— উৎসুক ভাবে প্রশ্ন করে আঁধারু। যা জিজ্ঞেসা করেছে তা ছাড়াও হয়তো, আরো কি জানতে চায়।

ফিরিবা নয়— বিষণ্ণ ভাবে উত্তর দেয় বুড়ো চাষীটা।

এক টুকরো জমি। সারা বছর কেটে তাতে ফসল ফলানো। সেই রক্ষা করার জন্য রক্তাক্ত লড়াই— একটা ঝাপসা স্বপ্ন আবৃত করে ফেলেছে আঁধারুকে। অসুস্থের মত ধান কাটার কাজ খুঁজে বেড়ায় গাঁ-ছাড়া মানুষটা।

—ধান তো এলায় কাটিবা বাকি আছে?

পনের বিশটে মৌজে পেরিয়ে একটা গাঁয়ে ধান কাটা হয়নি এখনও৷ ক্ষেতে ক্ষেতে শুয়ে আছে পাকা সোনা হলুদ ধান। গরু বাছুর পায়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে।

—আছে না? আগৎ কাটিবা দিছে জমিদার? লম্বা পাকানো চেহারা একজন বুড়ো চাষী পাল্টা প্রশ্ন করল আঁধারুকে৷

তাই সেখানে থেকে গেল আঁধারু। ধান কাটল ভোর রাত্রি থেকে সন্ধ্যে পর্য্যন্ত। ছোট ছোট ন্যাংটা ছেলেরা থালায় করে ভাত নিয়ে এল মাঠে। মেয়েরা কাটা ধানগাছের শীষ মাথায় বয়ে নিয়ে গেল খামারে। দুপুরে বাশের কঞ্চি পুতে ছেঁড়া কাপড় টাঙ্গিয়ে সেই ছায়ায় শুইয়ে রেখে দিল কোলের ছেলেদের।

অস্পষ্টভাবে মাথা ঝিম ঝিম করে আঁধারুর। ধান কাটতে কাটতে কেমন একটা গোঁ এসে গেছে ওর— নিহত খরগোসের বুক আচড়ে রক্ত খাওয়া সুরু করলে এটাসের সমস্ত শরীর যেমন টান টান হয়ে ওঠে তেমনি। শক্ত দুই পা ফাক করে নিচু হয়ে আলগা ধানের গোছা টেনে ধরছে বাঁহাতে— ঘসা লেগে গরম হ’য়ে উঠেছে কান্তে।

—ছ বিশ ধান পাকা!

—ছ বিশ!

পন্ধেবেলা আগুন জ্বালিয়ে গান গল্প। আঁধারু বলে— আনিয়াগঞ্জ থানার দুই লম্বর রিউনিয়ন দুর্গ,গাপুর-উতি আমার বাড়ী।

থালায় করে পান সুপুরি আর চুণ নিয়ে আসে মণ্ডলের ব্যাটার বউ। বাঁশের ছোট চৌকিটা টেনে রসিকতা করে আঁধারুর সঙ্গে— খাটে ৰসি খাও ভাত!

রসিকতা করে হাসে আর সারাদিন খাটুনির পর ক্লান্ত দেখায় না চাষী বৌ-কে!

গল্প করতে করতে আঁধারু বলে— আমার কাছে দু’কুড়ি তিন কুড়ি টাকা আছে। তা সেতাবগঞ্জ হাটে গরু বিক্রি হচ্ছে কি দরে?

—সাত কুড়ি আট কুড়ি।

কি রকম নিভে যায় আঁধারু, কথা বলে না। অন্যেরা গল্প করে।

—এখন তো ধান কাটা হয়ে যাচ্ছে; চাষীরা বলবে যাই গরু কিনি এক জোড়া; গিরন্তি করতে হবে না?

—তো গরুর দাম সাত কুড়ি, আট কুড়ি। পশ্চিমা গরু, চাই দেশী গরু৷

—ধানের দর নামি গিছে।

—নামি গিছে তো চাষী মরিল; উঠবি তো খাবি জোতদার!— তো চাষী মরিল!

গল্প শেষ করে শুয়ে পড়ে দু চারজন। পাটকাটির আগুন পুড়ে যার ঝপ ঝপ করে। শাদা হালকা ছাই উড়ে যায় ঠাণ্ডা হাওয়ায়।

শোবার আগে একটু ইতস্তত করে আবার জিজ্ঞেস করে আঁধারু কিন্তু শস্ত। হতে পারে? এই হাট তার মগের হাটেই গিয়েছিল লোকটা। এই হাটে হয়ত শন্তা হতে পারে৷

—কি?

—শত্তা হবার নয়, শক্ত ভাবে মাথা ঝাঁকায় লোকটা।

বিচালির ভেতর খুঁশে খুঁশে শুয়ে থেকে ঘুম আসে না। একটা ‘ধোকর’ গায়ে দিয়ে হঠাৎ এক তরফা বকতে শুরু করে আঁধার— পাঁচ-বিঘা জমি আছিল হামার। পালি আসিনম্ কিন্তু জমিটা বিচিলম্ নাই কেনে? না জমি বিচি দাও তো ফিরৎ নাই। তাই বন্ধক থুছি জমি। এলায় তো ফির গিরস্তি করা লাগিবে……

মিথ্যে বকে চলে আঁধারু আপন মনে।

সপ্তাহখানেক ধরে ধান কেটেছে আঁধার। মুখের ওপর থেকে দিনমজুরদের স্বাভাবিক খড়ি খড়ি ভাবটা কেটে গিয়ে কেমন একটা শ্যাওলার মতো মসৃণতা এসেছে। বাঁকাভাবে বসানো চোখ দুটোতে ধানের কোনের মতো একটা স্বপ্ন শক্ত হয়ে উঠেছে কেমনধারা।

আমার পাওনা মিটিয়ে দাও— তেমনি অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থেকে আঁধারুকে বললে হঠাৎ।

কিন্তু ধান ঝাড়াই হল না, মাড়াই হল না এখন চলে গেলে চলবে কেন? ধান দিয়ে দাও, নয়তো টাকা মিটিয়ে দাও, ঝোঁক ধরল আঁধার, কেনে, হামার গিরত্তি করা লাগে কি না লাগে? দুবছর রাস্তা কটিনম্ কি না কাটিনম্? তো ফিরি আসিনম্ কেনে সেইটা কহো।

অবুঝ লোকটা তার পাওনা ধান যা পারল আদায় করে বেচে দিয়ে গেল জোতদারের গোলায়। নিজের তৈরী মিথ্যাকেই কখন বিশ্বাস করে ফেলেছে।— কুণ্ঠে যাছো বা-রে?

পিঠে ছেলে বেঁধে ইউনিয়ন বোর্ডের ভাঙ্গা রাস্তায় দাড়িয়ে চাষী বৌটা ডাকল আঁধারুকে। মুখে তেল মেখেছে, খাড়ে কাচা কাপড় পড়েছে। হাটে বেগুন বেচতে যেতে মেয়েটা অবাক হয়ে দাড়িয়েছে আঁধারুকে দেখে৷

—চলি যাছ কেনে?

খুশী হয়ে উঠে আধার। কৈফিয়ৎ দেবার মতো করে বলে হারামারা চারো পাক দেখি ঠিক করিনম্ কি গরু এলায় কিনি না!


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন