এই লক্ষণটিকে পাথেয় করেই এর পথচলা। তাঁদের নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য ছিল পূর্ব থেকেই। নির্দিষ্ট লক্ষ্য ব্যতীত লিটল ম্যাগাজিনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব বেশি দিন সম্ভব নয়।সেই ম্যাগাজিন গুলিই দীর্ঘস্থায়ী হয়, যাদের রয়েছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য। ২০১০ সাল থেকে শুরু হয় পত্রিকার বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা। ২০১২ সালে জীবনানন্দ সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের ছোটো কাগজের মানচিত্রে সাড়া ফেলে দিল -যার নাম ছিল ‘আমাদের জীবনানন্দ’। প্রায় প্রতিটি খবরের কাগজেই এর সম্পর্কে লেখালিখি হয়েছিল। ২০১৩ সালে করিমপুরে প্রথম আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হল এই পত্রিকার ব্যবস্থাপনায়।বাংলাদেশ থেকেও বহু কবি-সাহিত্যিক এই কবিতা উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন। তারপর ‘মাঝি’,’বৃষ্টি’, ‘সুনীল আকাশ’, ‘ছুটি’ ২০১৫ তে ‘শিশু উৎসব সংখ্যা’, ২০১৬ তে ‘মেরুদণ্ড সংখ্যা’, ২০১৭-র জানুয়ারিতে বইমেলা সংখ্যা (এই সংখ্যার মূল আকর্ষণ ছিল সার্ধশতবর্ষে, নীলরতন মুখোপাধ্যায় ও তাঁর চন্ডীদাস পদাবলী’), ২০১৭-র মার্চে ‘অমর একুশে’ সংখ্যা, ২০১৮ তে ‘অণুকবিতা: কবিতার পরমাণু’ সংখ্যা, এপ্রিল-২০২১-এ ‘বর্ষবরণের কবিতা’ সংখ্যা, জুলাই-২০২১-এর বিষয় ভাবনা ‘আমার দেখা প্রথম কবি’, জানুয়ারি ২০২২ এ করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে বিশেষ সংখ্যা ‘কেমন আছেন আপনি’? ২০২২-এর ডিসেম্বরে “দর্পণ”-এর পরিচালনায় ‘করিমপুর লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও শিল্প উৎসব’-এ প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যা ‘হাট’ সংখ্যা। বিষয় বৈচিত্র্যের ডালি সাজিয়ে যেভাবে এই ক্ষুদ্র পত্রিকাটি পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যান্য রাজ্য তথা দেশে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তাতেই বোঝা যায় লিটল ম্যাগাজিন নামে ‘লিটল’ হলেও কাজে কিন্তু লিটল নয়, তা ‘গ্রেট’ই। শুধু পত্রিকা প্রকাশই নয়, এই পত্রিকার উদ্যোগে কেন্দ্র করে প্রতি মাসে একটি করে সাহিত্যবাসর অনুষ্ঠিত হয়, প্রতিবছর শারদীয়াতে পুজো পরিক্রমা করা হয় এবং শ্রেষ্ঠ পুজোকে পুরষ্কৃত করা হয় পত্রিকাটির তরফ থেকে। তা তাছাড়া ২০২১ সাল থেকে এই পত্রিকার তরফ থেকে করিমপুরে এককভাবে লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও শিল্প উৎসব এর আয়োজন করা হয়।একক কাব্যগ্রন্থের জন্য একজনকে যতীন্দ্রমোহন স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত করা হয় পত্রিকাটির পক্ষ থেকে। সব মিলিয়ে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সগৌরবে এই পত্রিকাটি তার বিজয় রথের চলাকে অব্যাহত রেখেছে।তার সাথে আর একটি কথা না বললেই নয়, এ যাবৎকাল করিমপুর থেকে যতগুলো ছোটো কাগজ প্রকাশিত হয়েছে তারমধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে অবশ্যই ‘দর্পণ…মুখের খোঁজে’ পত্রিকা।
আরো কয়েকটি পত্রিকা এই সময় বিশেষ নাম করেছিল। যেমন-পশুপতি মন্ডল সম্পাদিত ‘কবিতা কুটীর’, ডঃ কুমারেশ দে ও প্রভাত ঘোষ সম্পাদিত ‘পত্রপুট’ (২০০৪)। ওই বছরই গৌরব বিশ্বাস ও হিমাদ্রী শংকর মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় করিমপুর থেকে প্রকাশিত হয় ‘রুদ্ধমনন’ নামক পত্রিকা। এই পত্রিকাটিও তরুণদের কবিতা মক্সো করার জায়গা হিসেবে বিবেচিত হত। তাছাড়া ২০০৬ সালে প্রতীম সাহা সম্পাদিত ‘রুদ্ধ কোরক’ পত্রিকা (উল্লেখযোগ্য বিশেষ সংখ্যা ‘ডাকঘর’ সংখ্যা), বিশ্বজিৎ সাহার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সাহিত্যবাসী’, তাছাড়া ‘আঁখিপট’, ‘সাহিত্যবীথি’ পত্রিকাগুলিও সেই সময়ে বেশ নামকরা পত্রিকা ছিল।
২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বেশ কিছু পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে অশোক কুমার সাহার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সবুজের কবিতা’ পত্রিকা।এই পত্রিকাটি একটি মাসিক পত্রিকা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’-এর উপরে পত্রিকাটি একটি বিশেষ সংখ্যা করেছিল। তাছাড়া এই বছরই প্রকাশিত হয় হিমাদ্রী শংকর মুখার্জির সম্পাদনায় ‘ভাঙ্গন’ এবং অতনু সরকারের সম্পাদনায় ‘যাত্রা’ পত্রিকা,পরিমল বিশ্বাস সম্পাদিত বার্ষিক পত্রিকা ‘দ্যাখো’।২০০৬ এ বার্ষিক পত্রিকা ‘পরম্পরা’ প্রকাশিত হয় পলাশীপাড়া থেকে। এর সম্পাদক ছিলেন পল্লব মাহান্ত।তারপর এই একই বছরেই তেহট্ট থেকে প্রকাশিত হয় বার্ষিক পত্রিকা ‘অন্বয়’ ভক্তরাম বিশ্বাসের সম্পাদনায়। তারপর করিমপুর থেকে ২০০৭ সালে ‘ভোরের আলো’ প্রকাশিত হয় বিশ্বজিৎ দাসের সম্পাদনায়। ২০০৭ সালেই করিমপুর থেকে প্রকাশিত হয় ষাণ্মাসিক ‘বেপরোয়া’ পত্রিকা কৌশিক বিশ্বাসের সম্পাদনায়। তারপর ২০০৮ সালে করিমপুর থেকে প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘অন্যমুখ’। যার সম্পাদক ছিলেন অনিমেষ প্রামাণিক। ওই একই বছরে ‘কষ্টিপাথর’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় প্রিয়ম বিশ্বাসের সম্পাদনায়। এটি একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা, যেটা করিমপুর থেকে প্রকাশিত হয়।২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় এস আকবর আলী সম্পাদিত ‘পঞ্চব্রত’ পত্রিকা এবং শুভ ও প্রীতম সম্পাদিত ‘প্রত্যয়’ পত্রিকা, ‘সমাজের প্রতিবিম্ব’ পত্রিকার প্রকাশিত হয় সৌতভক দত্তের সম্পাদনায় করিমপুর থেকে।এটি একটি ষাণ্মাষিক পত্রিকা।
একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে থেকে আজ পর্যন্ত তেহট্ট মহকুমায় প্রচুর পত্রপত্রিকার জন্ম হয়।এর মধ্যে অনেকগুলো নিয়ে আমি ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি। এছাড়াও আরও কিছু পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয় যেগুলিও প্রচারের আলোতে এসেছে। এর মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় রঞ্জন গোলদার সম্পাদিত ‘আজকের কুরুক্ষেত্র’ পত্রিকাটির কথা। ২০১৬ সালে পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। শুরুতে এটি ছিল একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা। এর কার্যকারী সম্পাদক জয়ব্রত বিশ্বাস। তবে ২০২২ সাল থেকে শারদীয়া সংখ্যা হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে। এটি মূলত ‘কবিতা প্রধান সাহিত্য পত্রিকা’। অন্যান্য বাণিজ্য সফল পত্রিকার মতো এতে বিনোদনের মাধ্যম নেই। এটি নিছকই সাহিত্য-গুণান্বিত পত্রিকা। প্রচুর কবিতা, প্রবন্ধ, বিশিষ্ট কবি প্রাবন্ধিক ও শিল্প-সাহিত্য- সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার এতে ছাপা হয়। শ্যামল কান্তি দাশ, কবি সুবোধ সরকার সহ বিশিষ্ট কবিদের সাক্ষাৎকার এতে পূর্বের সংখ্যাগুলিতে ছাপা হয়েছে। প্রথম দিকে কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা করা হয়েছিল কিন্তু এখন সাধারণ সংখ্যা হিসাবেই আত্মপ্রকাশ করে। পত্রিকার সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক দুজনেই করিমপুরের মানুষ হলেও পত্রিকাটি মূলত কলকাতা কেন্দ্রিক।কারণ পত্রিকাটি দপ্তর-গণপতি আবাসন (চার নম্বর ফ্ল্যাট), ১১০, নর্থ স্টেশন রোড, পো:-আগরপাড়া, জেলা-উত্তর ২৪ পরগনা, পিন নম্বর- ৭০০১০৯। তাই কলকাতা ও আশেপাশের যারা নামজাদা কবি, প্রাবন্ধিক তাদের লেখাও এই পত্রিকাটিতে ছাপা হয় এবং অনেকে এই পত্রিকায় লিখে মানসিক তৃপ্তিও পান। রীতিমতো বাণিজ্য সফল পত্রিকাগুলির মতো আকার, প্রচ্ছদ, লেখার মান দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। তবে কলকাতা কেন্দ্রিক হলেও করিমপুরের বুকে এই পত্রিকাটিও উৎসাহী কবি,লেখক, প্রাবন্ধিকবৃন্দের কাছে রীতিমতো গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধুসূদন কর, প্রভাত চৌধুরী, অংশুমান কর, অরু চট্টোপাধ্যায়, মোনালিসা চট্টোপাধ্যায়, অয়ন বন্দোপাধ্যায়, গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল কান্তি দাশ, জয়নাল আবেদিন, তৈমুর খান, তুলসীদাস ভট্টাচার্য, জনসন সন্দীপ, অমৃতা খেটো, দেবজ্যোতি রায়, হরিৎ বন্দোপাধ্যায়, চৈতন্য দাশ, রবীন বসু প্রমুখ নাম গুলো দেখলেই বোঝা যায় পত্রিকাটি কাদের লেখায় সমৃদ্ধ।
নদিয়া জেলার তেহট্ট মহকুমার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি ছোটো গ্রাম বেতাই।এখান থেকে প্রকাশিত একটি সৃজনশীল লিটল ম্যাগাজিন ‘স্বপ্নের ভেলা’। ২০১৭-র ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় এর পথ চলা। ছোট্ট এই ম্যাগাজিনটি প্রথম সম্পাদনা করেন সমীরণ পাল। দ্বিতীয় সংখ্যাটি যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেন সমীরণ পাল ও বিশ্বজিৎ সরকার। এটি একটি বার্ষিক পত্রিকা। কবি ও লেখকদের সাম্মানিক হিসাবে একটি করে সৌজন্য সংখ্যা প্রদান করে পত্রিকাটি ও সেটি বিনামূল্যে ডাকযোগে কবি বা লেখকের ঠিকানায় প্রেরণ করা হয়। অণুকবিতা, দীর্ঘকবিতার পাশাপাশি অণুগল্প ও প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। তবে বিশেষ কোনো সংখ্যা এখনো পর্যন্ত হয়নি। করোনা মহামারির কারণে ২০১৯-এর পর আর কোনো সংখ্যা প্রকাশ হয়নি। তবে খুশির খবর সম্প্রতি তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হল ২০২৩-এ।
প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল — “শেষের কবিতার নায়কের মুখ দিয়ে কবিগুরু বলেছেন, ‘কমল হীরের পাথরটিকেই বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার।’ কালচার বা সংস্কৃতির মধ্যে বিচ্ছুরিত হয় মন ও মনন, বোধ ও বোধি, চেতনা ও চৈতন্যের আলো। জাগরিত হয় অফুরন্ত আনন্দ বেদনার রহস্য নিবিড় শিহরণ। আর এই সংস্কৃতি যখন বিপন্ন হয় তখন হারিয়ে যায় মূল্যবোধ, পঙ্কিল স্রোতে আবর্তিত হয় জীবন। ভোগবাদী সংস্কৃতি, অন্তর্জালের অশ্লীলতা, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, শিল্প সাহিত্যের নন্দন চত্বরে একদল উন্মাদের উল্লম্ফনে বিপর্যস্ত আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
অপসংস্কৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত গ্রামীণ সংস্কৃতির দীপবর্তিকা। আট থেকে আশি, গৃহবধূ থেকে পরিচারিকা মুঠোফোন আর মেগা সিরিয়ালের জাদুতে পা রাখছে চোরাবালিতে। আত্ম সুখের আশায় বেছে নিচ্ছে আত্মহরনের পথ। সংস্কৃতির এই সংকটকালে “স্বপ্নের ভেলা” হয়ে উঠুক মুক্তির ঠিকানা, তারুণ্যের স্বপ্ন, মান-অভিমান, ভালবাসার এক অভিজ্ঞান।” [ক্রমশ]