মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর বলিউড নায়িকা হেমা মালিনী বলেছিলেন, ‘উত্তমকুমারের ‘নায়ক’ ছবিটি দেখে আমি মুগ্ধ। ইচ্ছে ছিল হিন্দিতে ছবিটি হলে উত্তমকুমারের বিপরীতে আমি শর্মিলা ঠাকুরের চরিত্রে অভিনয় করব। সেটা একবার উত্তমকুমারকে বলেওছিলাম। বলিউডে উত্তমকুমার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষলগ্নে। আরও আগে পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু পাননি। তার কারণ ছিল বলিউডের রাজনীতি।’ আজ ২৪ জুলাই, উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন। মৃত্যুর এতদিন পরেও তাঁর জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। আজও তিনি মহানায়ক এবং নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনিই হলেন বাংলা চলচ্চিত্রের শেষ ‘মহানায়ক’ ও একমাত্র ’গুরু’।
উত্তমকুমার ছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে বিনোদনের সেরা উপহার। বলা যায়, তিনিই হলেন বাংলা ছায়াছবির ইতিহাসের প্রচ্ছদ চিত্র। সেটা একদিনে গড়ে ওঠেনি। পতন, অভিঘাত এবং লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন। উত্তমকুমার মানেই ভিনি, ভিডি, ভিসি নয়, আমৃত্যু অবিরাম লড়াইয়ের নাম উত্তমকুমার। পাশাপাশি ছিল ব্যক্তিগত জীবনের ঝড়-ঝঞ্ঝা। কিন্তু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ‘লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরা— অ্যাকশন’ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে উঠতেন সৃষ্টির এক স্বপ্নময় ফেরিওয়ালা।
সেই অবস্থানে পৌঁছতে নিজেকে বারবার ভেঙে তৈরি করেছেন এক একটি চরিত্র। রোম্যান্টিক হিরো থেকে নেগেটিভ হিরো, জমিদার থেকে পরিচারক, কোনও কিছুতেই তাঁকে রোখা যেত না। প্রথম কয়েকটি ছবিতে গতানুগতিক ধারা মেনে অথবা পরিচালকের নির্দেশে তাঁকে এক ধরনের স্টিরিও টাইপ অভিনয় করতে হয়েছিল। তখন পর্দার অভিনয়ের সঙ্গে মঞ্চের অভিনয়ের বিশাল পার্থক্য তেমন ছিল না। ১৯৫৩ সালে তিনি স্টার থিয়েটারে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে ‘শ্যামলী’ নাটকে অভিনয় করলেন। তখন থেকেই ভাবতে শুরু করলেন, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে মঞ্চের অভিনয় করা চলবে না। চরিত্রের রেখাগুলিকে আরও সূক্ষ্মতর করে তুলতে হবে। চরিত্রকে আরও বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তার প্রমাণ দিলেন ১৯৫৪ সালে রিলিজ করা ছবি ‘অগ্নিপরীক্ষা’তে। বাংলা ছবিতে আধুনিক অভিনয়ের সূচনা হল বলা যায়। পরের বছরটিও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তি পেল সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। বাংলা ছবিতে মনস্তত্ত্বমূলক অভিনয়ের সূচনা অবশ্যই উত্তমকুমারের মধ্য দিয়ে। নতুন যুগের নতুন হাওয়া তাঁর মধ্যে আরও বেশি করে দায়বদ্ধতা তৈরি করেছিল। তখন প্রতিষ্ঠিত নায়ক হিসাবে বাংলা ছবিকে তিনি নেতৃত্ব দিতে শুরু করলেন। শুরু করলেন ধরে ধরে চরিত্রের আরও জটিল স্তরগুলিকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা। সেই সময় প্রচুর ইংরেজি ছবি দেখে আধুনিক অভিনয়ের ঘরানাকে রপ্ত করার চেষ্টা করতেন তিনি। পর পর দেখছেন হলিউডের মার্লেন ব্র্যান্ডো, ক্যারি গ্র্যান্ট, বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার, গ্যারি কুপার, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার ছবি। দেখা আর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আরও পরিশীলিত করে তুলছেন নিজেকে। সেই সাধনা থেকে তিনি কোনওদিন বিচ্যুত হননি। প্রতিভার সঙ্গে সাধনার যোগ হলে স্রষ্টা অমর হয়ে যান। এভাবেই তিনি তৈরি করেছিলেন অভিনয়ের নিজস্ব সিগনেচার।
ধর্মতলার সিনেমা হলগুলিতে একটা সময় পর্যন্ত শুধু ইংরেজি ছবিই রিলিজ করত। সেই প্রথা প্রথম ভাঙল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। প্যারাডাইস হলে মুক্তি পেয়েছিল সেটি। কয়েক বছরের মধ্যে আরও দু’টি বাংলা ছবি মুক্তি পেল। ১৯৫৬ সালে নিউ এম্পায়ারে মুক্তি পেল ‘চিরকুমার সভা’। পরের বছর মেট্রোয় মুক্তি পেল ‘চন্দ্রনাথ’। উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, এই তিনটি ছবিরই নায়ক উত্তমকুমার। আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করতেই হয়। উত্তমকুমারের বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মেট্রো সিনেমা হলের চিফ প্রজেকশনিস্ট। কর্মসূত্রে নিজের ছেলের ছবি চালালেন। তাঁর চোখে জল এসে গেল। প্রেক্ষাগৃহে মানুষের ভালোলাগার সেই অনুভূতি বাবার বুকের ভেতর গিয়ে স্পর্শ করছিল। পুত্রের কাছ থেকে পাওয়া এটাই তো সেরা উপহার।
স্বাধীনতা, দেশভাগ, বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলায় উত্থান হল এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির একেবারে কাছের মানুষ হয়ে গেলেন তিনি। তরুণীর প্রেমিক, তরুণের কাছে আদর্শ দাদা, প্রবীণ ও প্রবীণাদের কাছে আদর্শ পুত্র। গ্ল্যামার চুঁইয়ে পড়া ইমেজের বাইরেও তিনি ছিলেন আমাদের পরিবারেরই অন্যতম সদস্য।
১৯৭৫ সালে হিন্দি ছবি হিসাবে রিলিজ করেছিল ‘শোলে’, ‘জয় সন্তোষী মা’, ‘দিওয়ার’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘জুলি’, ‘খেল খেল মে’, ‘গীত গাতা চল’, ‘খুশবু’, ‘জমির’, ‘আঁধি’, ‘মিলি’ সহ অনেকগুলি হিন্দি ছবি। উল্লেখিত ছবিগুলি সবক’টিই সুপারহিট। ‘শোলে’ তো সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। হিন্দির এতগুলি সুপারহিটের মধ্যেও জয়যাত্রা অব্যাহত থেকেছে উত্তমকুমারের। সেই বছর উত্তমকুমারের মুক্তিপ্রাপ্ত সুপারহিট ছবিগুলির মধ্যে ছিল ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘অগ্নিশ্বর’, ‘মৌচাক’, ‘আমি সে ও সখা’, ‘বাঘবন্দি খেলা’। ‘সন্ন্যাসী রাজা’ একটানা ১২৬ দিন চলেছিল। ‘মৌচাক’ একটানা চলেছিল ১১৯ দিন। উত্তমকুমারের যে কোনও ছবি মানেই একশো দিনের সেঞ্চুরি। এটাই ছিল তাঁর গ্যারান্টি। এখনকার পরিচালক ও তথাকথিত নায়করা এসব স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। এখন বাংলা ছবি অবশ্য ভাঙা ক্র্যাচ নিয়ে তাঁকে অতি উত্তম সাজিয়ে মুনাফা লোটার চেষ্টা করছে। তাঁর বেশ কিছু ছবিকে রিমেক করার চেষ্টা হচ্ছে। উত্তমের এই বিনির্মাণ মিমিক্রির মতো মনে হয়।
তাঁর ছবির অন্যতম উপাদান রোমান্স। ছবিতে তা ছড়িয়ে থাকত একটা অদৃশ্য সম্মোহনের মতো। সেই রোমান্সের মূল শক্তি যদি হয় তাঁর অভিনয়, তাহলে অন্যটি ছিল তাঁর হাসি ও গ্ল্যামার। একবার জহর রায় মজা করে বলেছিলেন, ‘অমন ভুবনমোহিনী হাসি দেখলে মেয়েরা প্রেমে পড়বেই। আমি তো পুরুষ হয়েও প্রেমে পড়েছি।’ কথাটা শুধু কৌতুক বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। তাঁর রোমান্স ও প্রেম, তাঁর অভিনয় ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ছিলেন পুরুষ দর্শকরাও। তাঁরাও প্রেমিক হিসাবে উত্তমকুমার হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন ছবিতে প্রেমের বিভিন্ন সত্তা ও স্তরকে তিনি ধীরে ধীরে নানা রূপে উন্মোচিত করেছেন। ‘সাগরিকা’র প্রেম আর ‘সপ্তপদী’র প্রেম এক নয়। ‘হারানো সুর’ এবং ‘পৃথিবী আমারে চায়’ ছবির প্রেম এক নয়, ‘সবার উপরে’ কিংবা ‘শাপমোচন’ ছবির রোমান্স এক নয়, ‘লালপাথর’ আর ‘স্ত্রী’ ছবির প্রেমও ভিন্ন। ‘বিপাশা’র প্রেম এবং ‘দেয়া নেয়া’র প্রেমও আলাদা। ‘পথে হল দেরি’ ছবিতে প্রেম যেখানে ত্যাগের মধ্য দিয়ে মিলনের পথে এগয়, ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির প্রেম সেখানে পৃথক মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘মেমসাহেব’ ছবিতে উত্তমকুমারের প্রেমের যে নাব্যতা, ‘শুন বরনারী’ ছবির প্রেমের সাম্পান সেই নদীতে ভাসে না। ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ কিংবা ‘আমি সে ও সখা’ ছবির প্রেমও ভিন্নমুখী। আবার ‘সোনার খাঁচা’ ছবির প্রেম যেন দমবন্ধ করা এক অত্যাচার হয়ে ওঠে। ‘শেষ অঙ্ক’ ছবির প্রেমের রূপ যখন সত্যিই প্রকাশ পায়, তখন দর্শক চমকে ওঠে। খ্যাতির মধ্যগগনে থেকেও এমন অ্যান্টিহিরোর অভিনয় করা মুখের কথা নয়। বলতে হয় ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবির কথা। প্রেমিক হিসাবে নিজেকে ভেঙেছেন দ্বৈত সত্তায়। এইসব ছবিতে দ্বিমাত্রিক ব্যঞ্জনার ভিতরে ফ্রয়েডিয় তত্ত্বের জটিলতা উঁকি মারে। প্রেমের বহুমুখী নির্যাস তাঁর ছবিতে ভরপুর। সেই প্রেম কিংবা প্রেমহীনতাকে স্থায়ী এবং সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। তিন দশক ধরে তিনি ছিলেন ‘কিং অব রোমান্স’। পাশাপাশি ‘সপ্তপদী’, ‘যদুবংশ’, ‘জতুগৃহ’, ‘বিচারক’, ‘নগর দর্পণে’, ‘বাঘবন্দি খেলা’ ছবিগুলির মধ্য দিয়ে চরিত্রের অসংখ্য স্তর ও মাত্রাকে প্রকাশ করেছেন। সত্যজিতের পরিচালনায় ‘নায়ক’ কিংবা ‘চিড়িয়াখানা’র কথা বলতেই হয়। ‘নায়ক’ ছবিতে বহু কাজ সত্যজিতের নির্দেশ ছাড়াই তিনি অভিনয়ে যুক্ত করেছেন। খুঁতখুতে সত্যজিৎ রায়ও তা মেনে নিয়েছেন। কমেডি চরিত্র হিসাবে ‘ধন্যি মেয়ে’ ‘মৌচাক’, ‘ছদ্মবেশী’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আজও শিক্ষণীয় নতুন শিল্পীদের কাছে। তিনি দেখিয়েছেন ভাঁড়ামো না করেও কীভাবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বেদম হাস্যরস তৈরি করা যায়।
তিনি আরও কিছুদিন জীবিত থাকলে আরও ভিন্নতর অভিনয়ের স্বাদ আমরা পেতাম। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। মহানায়কের মতোই তিনি বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁর মূল্যায়ন করতে গিয়ে একবার মাধবী মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘উত্তমকুমারের অভিনয়ের রেঞ্জটা ছিল বিশাল। সেটা মাপার মতো কোনও ফিতে আজও তৈরি হয়নি।’
শুধু কী অভিনয়! মনটাও ছিল অনেক বড়। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যামেরার বাইরেও তিনি বড়দাদার ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। সব সময় তিনি খোঁজ করতেন, কোন কোন কলাকুশলী বসে আছেন বা দীর্ঘদিন কাজ পাননি। পরিচালক, প্রযোজকদের অনুরোধ করতেন তাঁদের কাজ দেওয়ার। দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য গড়েছিলেন ‘শিল্পী সংসদ’। হয়ে উঠেছিলেন লার্জার দ্যান লাইফ। কিন্তু লজ্জার কথা, কেন্দ্রের কোনও সরকারই আজ পর্যন্ত তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার কথাটা বিবেচনা করেনি। আসলে তিনি যে কোনও পুরস্কারের থেকে অনেক বড়। এই সত্যটা এতদিনে প্রতিষ্ঠিত।