বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বা স্পেশাল ক্যাটাগরি স্টেটাস (এসসিএস) জাতীয় রাজনীতিতে ফের একবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে চাইছে। রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা কিংবা বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার দাবি তুলেছেন কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ শরিক তেলুগু দেশম পার্টি এবং জনতা দল ইউনাইটেড-এর তরফে যথাক্রমে অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। ওঁরা দুজনেই দীর্ঘ দিন ধরে তাঁদের রাজ্যকে বিশেষ রাজ্যের তকমা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। এবার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কেন্দ্রে সরকার গড়তে বিজেপিকে এই দুই দলের সাহায্য নিতে হয়েছে। জেডিইউ-র নীতীশ কুমার ও টিডিপি-র চন্দ্রবাবু নাইডু তৃতীয় দফার মোদি সরকারের গুরুত্বপুর্ণ শরিক। দুই দলের সম্মিলিত সদস্যের সংখ্যা ২৮। সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য যা একান্তই জরুরি। ফলে এই দুই শরিকের বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার দাবি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা পদ্মশিবিরের পক্ষে কঠিন। সে কারণে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা পেতে নীতীশ-নাইডু কী মোদী সরকারকে চাপে ফেলতে চাইছে? সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন, মোদী সরকার বিহার ও অন্ধ্র প্রদেশের তরফে এই দাবি কী মেনে নেবে?
বিহারকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার দাবি দীর্ঘদিনের। ২০০৫ সাল থেকে নীতীশ কুমার কেন্দ্রের কাছে এই দাবি জানিয়ে আসছেন। ফের তিনি বিহার রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা কিংবা বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ দেওয়ার দাবি তুলেছেন। জেডিইউ-র জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এই মর্মে একটি প্রস্তাবও পাস করা হয়েছে। অন্ধ্র প্রদেশেরও বিহারের মতো একই দাবি। ২০১৪ সালে অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্য ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্য গড়ে তোলার পর থেকে অন্ধ্র প্রদেশের জন্য বিশেষ মর্যাদার দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। চন্দ্রবাবু নাইডু অমরাবতীতে রাজ্যের নতুন রাজধানী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন; কিন্তু মোদী সরকার তাঁর সেই বিশেষ মর্যাদার দাবি পূরণ না করায় ২০১৮ সালে চন্দ্রবাবু নাইডু কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে সমর্থন তুলে নেন। ফের চব্বিশের লোকসভার পর সেই বিজেপির সঙ্গে নতুন করে সখ্যতা স্থাপন করেন। তাঁর দল বিপুল ভোটে জেতায় তিনি ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। সেই নির্বাচন প্রচারে বিশেষ মর্যাদার দাবিটি ছিল অন্যতম। নীতীশ ও চন্দ্রবাবুর দল তৃতীয় দফার মোদি সরকারের গুরুত্বপুর্ণ শরিক হয়ে ফের একবার নতুন করে নিজেদের রাজ্যের জন্য বিশেষ মর্যাদার দাবি তোলায় মনে করা হচ্ছে, দুই দলই চাপের রাজনীতি শুরু করল।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষে নীতীশ-নাইডুর চাপের কাছে নতি স্বীকার করা কঠিন হবে। কারণ, মোদীর আমলেই বিশেষ মর্যাদার বিষয়টি খারিজ করে দিয়ে চতুর্দশ অর্থ কমিশন রাজ্যগুলির জন্য কেন্দ্রীয় রাজস্ব বণ্টনের পরিমাণ ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪২ শতাংশ করে দেয়। সেই সঙ্গে নতুন করে কোনো রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা দানের দাবি যাতে কেন্দ্র আমল না দেয় সেকথাও জানায় অর্থ কমিশন। প্রসঙ্গত, দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতেই বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বা বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ-এর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালে এবং জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ ‘গ্যাডগিল ফর্মুলা’ মেনে বিভিন্ন রাজ্যকে সেই মর্যাদা দিয়েছিল। প্রথমে সেই মর্যাদা পেয়েছিল আসাম, জম্মু–কাশ্মীর ও নাগাল্যান্ড। তারপর হিমাচল প্রদেশ ১৯৭০–৭১ সালে, পরের বছর মণিপুর, মেঘালয় ও ত্রিপুরা, ১৯৭৫–৭৬ সালে সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশ এবং ২০০১–০২ সালে উত্তরাখন্ড। বিশেষ মর্যাদায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দের ৯০ শতাংশ অনুদান ও মাত্র ১০ শতাংশ ঋণ। অন্যদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ অনুদান ও ৭০ শতাংশ ঋণ। করের ক্ষেত্রেও বিশেষ মর্যাদা পাওয়া রাজ্যগুলি বিশেষ ছাড় পায়।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, মোদী সরকার বিহার ও অন্ধ্র প্রদেশের বিশেষ মর্যাদার দাবি মানবে কীভাবে? বিহার বা অন্ধ্রের দাবি মানলে যে অন্যান্য রাজ্য থেকেও দাবি উঠবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে। তাছাড়া বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান অন্তরায় হল চতুর্দশ অর্থ কমিশনের ২০১৫ সালের বিশেষ মর্যাদা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব যা মোদী সরকার গ্রহণও করেছিল। যদিও অর্থ কমিশন ১১টি রাজ্যকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেয় অসম, নাগাল্যান্ড, হিমাচল প্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয়, সিকিম, ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, উত্তরাখণ্ড এবং তেলঙ্গানা রাজ্যকে। অবশ্য ভারতের সংবিধানে এই বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার কোনও সংস্থান রাখা হয়নি। তবে ঐতিহাসিক কারণেই কিছু রাজ্য যে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় খানিক পিছিয়ে রয়েছে, তা স্বীকার করে নেওয়া হয়। এবার দেখতে হবে বিহার বা নীতীশ কেন বিশেষ রাজ্যের মর্যাদার জন্য আর্জি জানাচ্ছে? সহজ কথা, বিহারে শিল্পোন্নয়ন হয়নি, বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আসেনি। ফলত সে রাজ্যে একাধিক অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তাছাড়া বিহার থেকে ঝাড়খণ্ড পৃথক রাজ্য হয়ে যাওয়ায় একাধিক খনি, শিল্প সবই চলে গিয়েছে ঝাড়খণ্ডে। তারপর থেকে বিহারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি থমকে গিয়ে দেখা দিয়েছে শিল্প, কর্মসংস্থান এবং খনিজ পদার্থের আকাল। নীতীশ কুমারের বক্তব্য, সাম্প্রতিক জাতগণনায় দেখা গিয়েছে বিহারের এক তৃতীয়াংশ মানুষ দরিদ্র। তাঁদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। চন্দ্রবাবুর যুক্তি শিল্পসমৃদ্ধ হায়দরাবাদ তেলঙ্গানায় চলে যাওয়ায় অন্ধ্রের ভাঁড়ারে পড়েছে টান।
দেখা যাচ্ছে বিহার এবং অন্ধ্রপ্রদেশ দুই রাজ্যই বা নীতীশ-চন্দ্রবাবুর দাবি প্রায় একই, অন্যদিকে তাঁদের সমর্থনেই কেন্দ্রে টিকে থাকতে হচ্ছে মোদী সরকারকে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার বিষয়টি অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক কিংবা সামাজিক মানদণ্ডের চেয়েও রাজনৈতিক ভাবেই বেশি। কারণ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকেই বিহার এবং অন্ধ্রকে কিছু বিশেষ সুবিধা দিতে হতে পারে। তবে স্বাধীনতার এত বছর পরেও কোনও রাজ্য অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকার অর্থ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিরাট গলদ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু দু-একটি রাজ্যকে এই বিশেষ মর্যাদা দিলে কি অন্য রাজ্যগুলি একই দাবি জানাবে না? উল্লেখ্য, আগে বিশেষ মর্যাদা পাওয়া রাজ্যগুলিকে অর্থ বরাদ্দ করত প্ল্যানিং কমিশনের জাতীয় উন্নয়ন কাউন্সিল। এখন প্ল্যানিং কমিশনের পরিবর্তে এসেছে নীতি আয়োগ। এখন দেখার মোদীর উপর চাপ বাড়ানোর কৌশলে নীতীশ-চন্দ্রবাবু কতটা সফল হন।