নীরবতার সাথে কাটাতে চান কিছুসময়, কুয়াশার সাথে গল্প করতে চান কিছুক্ষণ, সবুজের সাথে ভাগ করে নিতে চান আপনার দুঃখগুলোকে, আপনার যত আনন্দ যত খুশি পাইনের বনে ছড়িয়ে দিয়ে চান, চলে যেতে পারেন চটকপুর। গরমের ছুটি পড়তেই আমাদের ‘উঠলো বাই’ গ্রুপের সদস্যরা বেরিয়ে পড়লাম সবুজে-ঘেরা পাহাড়ি গ্রাম চটকপুরের উদ্দেশ্যে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে খুব বেশি দূরে নয়, ঘন্টা তিনেকের পথ। দার্জিলিং-এর ঘুম স্টেশন থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়েই পশ্চিমবঙ্গ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের চেকপোস্টে নাম এন্ট্রি করিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে চলে যাবেন, পৌঁছে যাবেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মধ্যে। চটকপুরে পৌঁছানোর এই জঙ্গলের পথটুকু খুব একটা ভালো নয়। তবে সবুজ অরণ্য যাদের ভাল লাগে তাদের কাছে এই পথটুকুর মুগ্ধতা মনে থাকবে অনেকদিন। চটকপুরে পৌঁছানোর পর, আর কি বলব? পাহাড়ের এই গ্রাম তার নিজস্ব বৈচিত্র নিয়ে যেন আমাদের জন্য অপেক্ষমান। মাত্র ১৯টি পরিবারের বাস এখানে। অদ্ভুত আতিথেয়তায় কাছে টেনে নিলেন মঞ্জু দিদি, আর তার ছেলে ছেতন শেরপা।
ছেতন স্নাতক স্তরের ছাত্র ছিল। বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে পরিবারটির অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। ছেতন এখন হোমস্টে সামলাই মায়ের সাথে। বর্ষার সময়টা তারা নানান ধরনের সবজি চাষ করে। সাত কিলোমিটার দূরের সোনাডা বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যায় সেই সবজি। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই পাহাড়ি গ্রামে চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা হয় জৈব সার। গোবর সারকে কাজে লাগিয়ে সবজি চাষ হচ্ছে। তাছাড়া গো পালন, মুরগি পালন এসব তো আছেই। পর্যটকদের জন্য যে সমস্ত খাবার পরিবেশিত হয় তার বেশিরভাগটাই এদের খেত খামারে উৎপাদিত ফসল থেকেই। প্রতিটি হোমস্টেতেই রয়েছে রঙ-বেরঙের বাহারি ফুল। চটকপুরে আমরা ছিলাম হামরো হোম-স্টেতে। হোমস্টে থেকে কিছুটা গিয়েই উঁচুতে রয়েছে ভিউ পয়েন্ট। তৈরি করা হয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। ভিউপয়েন্টে যাবার রাস্তাটি অনবদ্য। আসলে চটকপুর থেকে চারপাশ ৩৬০ ডিগ্রি উন্মুক্ত। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকেও খুব ভাল দেখা যায়, দেখা যায় নাথুলা পাস, দেখা যায় কমলা লেবুর গ্রাম সিটং, হর্নবিল পাখির জন্য বিখ্যাত লাটপাঞ্চার, এমনকি শিলিগুড়ি শহর। আমরা আবহাওয়া খুব একটা ভালো পাই নি প্রথম দিন। যদিও পাহাড়ের বর্ষা কিংবা মেঘলা অথবা কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া অনেকেরই ভালো লাগে। চারপাশের ছবিটা ততটা স্পষ্ট হয় না ঠিকই, তবু পাহাড়ে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা দেখতে তো খুব ভাল লাগে। মেঘ এসে জড়িয়ে ধরে। তাছাড়া চটকপুর জায়গাটির নির্জনতা মুগ্ধ করবেই। যেহেতু চটকপুর অরণ্য অঞ্চলের মধ্যে পড়ে তাই প্রচুর নিষেধাজ্ঞা।
চটকপুরের অন্যতম আকর্ষণ চটকপুর ইকো ভিলেজ। ফরেস্ট বাংলোগুলি দেখার মতো। ফরেস্ট বাংলোর উল্টোদিকে আছে একজন প্রাক্তন সেনাকর্মীর বাংলো, সেখানেও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। যদিও আমাদের হামরো হোমস্টে ফরেস্ট বাংলো থেকে বেশ অনেকটাই উপরে। উপরের সৌন্দর্য একেবারেই অন্যরকম। চারপাশের ভ্যালিগুলি মন ভরিয়ে দেয়। দূরের অরণ্য অঞ্চলকে দেখা যায় খুব ভালোভাবে। আমাদের হোমস্টে থেকে গ্রামের উঁচু-নিচু পথ ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলোর কাছে। সেখান থেকে একটা পথ চলে গেছে অরণ্যের ভিতর। আরেকটি পথ এসে মিশেছে আমাদের হোমস্টেতে ওঠার পথে। বিকেল বেলায় ফরেস্ট বাংলোকে পাশে রেখে আমরা চললাম অরণ্যের গভীরে। পাইনের ঘন বন, পথ চলে গেছে আরো গভীর অরণ্যের ভিতর। দিনের বেলাতেও গা ছমছম করে। আসলে এই অঞ্চলে চিতাবাঘ, রেড পান্ডা আছে। বেশ কিছুটা হাঁটার পরে মনে হতে পারে আপনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকটা ভিতরে প্রবেশ করে পাবেন একটা পোখরি অর্থাৎ পুকুর। সেখানে দেবতার পুজো হয় বলেই মনে হয়। দেখলাম শিবের একটি ছবি রাখা আছে পাথরের গায়ে। পয়সা দিয়েছেন কেউ কেউ। হয়তো অঞ্চলের মানুষজন সেখানে আসেন তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য। সিঁদুরের ছোঁয়া লেগে আছে পাথরে, হাতের চুরি দেবতার কাছে রাখা। এই ঘন অরণ্যের মধ্যে এই দৃশ্য বিস্মিত করলো আমাদের। ঘন্টার আওয়াজ অন্যরকমের আবহ তৈরি করে। সত্যিই যেন সেখানে ‘মৌনতা স্থির হয়ে রয়েছে’। আবার ফিরলাম অরণ্য পথ ধরে অনেক উঁচুতে আমাদের হামরো হোমস্টেতে। বেশ কিছুটা পথ ট্রেকিং হয়ে গেল। আকাশ কিছুটা রাঙিয়ে সূর্য অস্ত গেল। ধীরে ধীরে সন্ধে নামল। ভোরের চটকপুর অপরূপা। কাঞ্চনজঙ্ঘা আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। সূর্যোদয়ের সাক্ষী থাকলাম আমরা। ছোট্ট কথা, রিজু কিংবা গাবলু মেতে উঠেছিল ছবি আঁকায়। শিল্পী দীপঙ্কর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলল গ্রামের নির্জনতাকে। প্রকৃতির নীরবতা রূপ পেল ওর রং তুলিতে।
দুদিন চটকপুরে কাটিয়ে চললাম আর এক মায়াময় পরিবেশে, লেপচা জগতে। চটকপুর থেকে দার্জিলিংয়ের বাতাসিয়া লুপ হয়ে, ঘুম মনেস্ট্রি দেখে, ঘুম স্টেশনকে পাশে রেখে পৌঁছে গিয়েছিলাম লেপচা জগতে। ঘুম স্টেশন থেকে লেপচাজগতের দূরত্ব খুব বেশি নয় ৬/৭ কিলোমিটার। লেপচাজগতে হয়তো দেখার কিছু নেই কিন্তু যারা ঠান্ডা আবহাওয়ায়, সবুজের ভিতরে কাটাতে চান আরো দুটো দিন, প্রাণভরে অক্সিজেন নিতে চান, কংক্রিটের জঙ্গলকে ভুলে থাকতে চান তারা অবশ্যই লেপচা জগতে থাকতে পারেন। আমরা ছিলাম পাখরিন হোমস্টেতে। শান্ত সবুজ অরণ্যে ঘেরা এই হোমস্টে-র নিচ দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা, রাস্তাটি মিশেছে গিয়ে বনদপ্তরের একটি বাংলোর কাছে। পুরো পথ জুড়ে পাইনের বন, পাখির কলতান। রাতের অন্ধকারে পথ মায়াবী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে হোমস্টের উপরের দিকে রয়েছে অরণ্য পথ। অরণ্য পথ ধরে পৌঁছানো যায় ভিউ পয়েন্ট। প্রসঙ্গত বলে রাখি লেপচা জগত থেকে দার্জিলিং এবং মিরিক শহরকে খুব সুন্দর ভাবে দেখা যায়। লেপচাজগতে ঠাণ্ডা ছিল খুব। বৃষ্টি চলছিল। তবে মেঘ-কুয়াশার সঙ্গে খেলা করতে মন্দ লাগছিলো না। মোমো, কফি পকোরা সঙ্গে থাকলে মন খারাপ কখন পালিয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে দূরের দার্জিলিং শহরের আলোরমালা মন ভরিয়ে দিল। লেপচাজগৎ থেকে অবশ্যই যাবেন জোড়পোখরি। লেচাজগৎ থেকে কিছুটা দূরেই সুখিয়াপোখরি। সুখিয়াপোখরি থেকে একটু এগোলেই ডানদিকে মানেভঞ্জন, যেখান থেকে শুরু হয় সান্দাকফু ট্রেকিং। সেদিকে না গিয়ে আর একটু এগুলেই একটু উপরে জোড়াপোখরি। নয়নাভিরাম দৃশ্য। জোড়পোখরি করে মানে দুটো পুকুর। এই পুকুর দুটির চারপাশের সৌন্দর্য অসাধারণ। নানা রঙের ফুলের সমাবেশ এখানে। চারিদিকে সবুজ বনানী, সবুজ ঘাস যেন গালিচা পেতে দিয়েছে। পুকুরের জলে সবুজ গাছের ছায়া তৈরি করেছে জীবন্ত ক্যানভাস। আছে মন্দির। হর পার্বতীর মূর্তি বসানো রয়েছে সেখানে। কিছু সময় কাটিয়ে আমরা চললাম ভারত-নেপাল সীমান্ত-ঘেঁষা সীমানা বাজারে। সেখানে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি দোকান, নানান জিনিসের সম্ভার সেখানে। এখান থেকে দূরের নেপাল দেশটাকে দেখতে বেশ লাগে! এই বুঝি ছুঁয়ে ফেলা যায় প্রতিবেশী দেশটাকে। সীমানা বাজার থেকে বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে চলে গেলাম নেপালের পশুপতি মার্কেটে। নেপালের সীমান্তে পরিচয় পত্র দেখিয়ে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করলো নেপালের ভিতর দুই পাশে অনেক দোকান, নেপালি সামগ্রীতে পূর্ণ। কেনাকাটার পর রওনা হলাম মিরিকের উদ্দেশ্যে। মিরিকের লেকে কিছু সময় কাটিয়ে চা বাগান গুলি দেখতে দেখতে ফেরা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। সবশেষে আমাদের ড্রাইভারের কথা বলতে হয়। এমনিতেই পাহাড়ের ড্রাইভারদের মনে এক অদ্ভুত রকমের আনন্দ আমরা সব সময় দেখতে পাই। কিন্তু সেদিন ওর মনে আনন্দটা একটু বেশিই ছিল। কারণ কি- জানতে চাইলে ও জানালো ওর নতুন বিবি আজ গ্যাংটক থেকে ফিরছে। আমাদের স্টেশনে নামিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়েই ওরা এক সঙ্গে ওদের গ্রামে ফিরবে।
কিভাবে যাবেন : হাওড়া অথবা শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখান থেকে গাড়ি করে চটকপুর। হোমস্টেতে ফোন করে গাড়ি আনিয়ে নেওয়াই ভালো। চটকপুর থেকে বাতাসিয়া লুপ ও ঘুম হয়ে চলে আসুন লেপচাজগৎ। লেপচা জগত থেকে জোড়পোখরি হয়ে, সীমানা বাজার ছুঁয়ে, মিরিকের সৌন্দর্য উপভোগ করে, সবুজ চা বাগানের মধ্যে দিয়ে ফিরুন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন।
কোথায় থাকবেন : চটকপুরে এবং লেপচা জগতে থাকার জন্য অনেক হোমস্টে আছে। অনলাইন বুকিং করেই চলে যেতে পারবেন।
কখন যাবেন : বর্ষার সময়টা বাদ দিয়ে যেকোনো সময় যেতে পারেন। জুনের শেষ থেকে আগস্ট পর্যন্ত না যাওয়াই ভালো।