একটি নির্বাচনের জন্য কত কোটি টাকা যে খরচ হয় তার হিসাব সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তবে সাধারণ মানুষ এটা জানেন ভোটযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলি কোথা থেকে এই টাকা জোগাড় করে অথবা কারা সেই টাকা দলগুলিকে দেয়। সাধারণ মানুষ এও জানেন পুঁজিমালিকরা এই টাকা কেন দেয়। ২০১৭ সালে দেখা গেল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশের নির্বাচনে কালো টাকা রোখবার কথা বলে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, আয়কর আইন, কোম্পানি আইন ইত্যাদির সংশোধনী করে নির্বাচনী বন্ড চালুর আইন আনলো। কিন্তু কেন্দ্রের এই আইনের বিরোধিতা করলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালক এবং নির্বাচন কমিশন কর্তারা। তাঁরা জানালেন নির্বাচনে যে পরিমাণ টাকা খাটে তার যেমন কোনো হিসাব থাকে না, তেমনি তার স্বচ্ছতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। তার ওপর যদি তা আইনে পরিণত হয় তাহলে নির্বাচনে খাটা টাকার অস্বচ্ছতা আরও বাড়বে। কিন্তু আমরা দেখলাম তার পরের বছরই নরেন্দ্র মোদী সরকার সব আপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বন্ড চালু করে দিল। এর ফলে কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া থেকে ১ হাজার থেকে ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড কিনে তার পছন্দের রাজনৈতিক দলের হাতে তা তুলে দিতে পারেন। তার পরিচয় রাজনৈতিক দলটি ছাড়া গোপন থাকবে। রাজনৈতিক দলটিও বন্ডের কোনও রেকর্ড রাখতে বাধ্য থাকবে না। এবং যিনি টাকা দিয়েছেন তিনি আয়করে ছাড় পাবেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৭-১৮ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটেই নির্বাচনী বন্ডের ঘোষণা হয় এবং ২০১৮-র জানুয়ারিতে বিজ্ঞপ্তি জারির পর মার্চ মাস থেকে টাকার লেনদেন শুরু হয়। তবে নানা মহলে এই বন্ড নিয়ে আপত্তি তোলে বিশেষ করে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর), কমন কজ, সিপিএম এবং কংগ্রেস নেত্রী জয়া ঠাকুর নির্বাচনী বন্ড নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা করে। তাদের অভিযোগ ছিল, কে বা কোন সংস্থা কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা চাঁদা দিল তা নির্বাচনি বন্ডে গোপন থাকছে, তথ্যের অধিকার আইন লঙ্ঘন হচ্ছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও সরকারের এই নীতিতে কর্পোরেট সংস্থাগুলির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে এবং অবৈধ লেনদেন, হিসাব বহির্ভূত কালো টাকা সাদা করার সুবিধা হবে। উল্লেখ্য, নির্বাচনী বন্ড বা চাঁদার মাধ্যমে টাকা পাওয়ার সুবিধা শাসক দলের যতটা থাকে তুলনায় বিরোধী বা ছোট দলগুলির ততটা নয়। যেমন জাতীয় দল না হওয়ায় সব দল এর সুযোগ পায় না, ফলে নির্বাচনী বন্ড রাজনৈতিক দলগুলির আয়ের অসাম্য যেমন বাড়াবে পাশাপাশি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকেও বিপন্ন করবে। নির্বাচনী বন্ডের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলায় সিপিএম ছিল অন্যতম, কংগ্রেস টাকা নিলেও, প্রথম থেকে এই বন্ডের বিরোধিতা করেছিল।
ওই মামলাতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্বাচনী বন্ডকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ জানায়, এই বন্ড নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে, বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার এবং তথ্য জানার অধিকার লঙ্ঘন করছে।। তাঁরা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াকে নির্বাচনী বন্ড বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দিয়ে বলে, যেসব নির্বাচনী বন্ড রাজনৈতিক দলগুলি এখনো ভাঙায়নি, সেগুলি যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আদালত স্টেট ব্যাঙ্ককে এও বলে, কোন রাজনৈতিক দল কত টাকা পেয়েছে, বন্ড কেনার তারিখ, ক্রেতার নাম, বন্ডের মূল্য, যাবতীয় তথ্য আগামী ৬ মার্চের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেয়। নির্বাচন কমিশন সেই তথ্য ১৩ মার্চের মধ্যে জনসমক্ষে প্রকাশ করবে। ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি ২০১৮ থেকে ২০২৩-এর মার্চ পর্যন্ত নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলি ১২ হাজার ৮ কোটি টাকা পেয়েছে। মোট টাকার ৫৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা পেয়েছে বিজেপি, কংগ্রেস ১ হাজার ১৩৫ কোটি এবং তৃণমূল কংগ্রেস ১ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এছাড়াও বিজেডি, ডিএমকে, বিআরএস, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, আপ, টিডিপি, শিব সেনা প্রভৃতি দলগুলি মোট টাকার ভাগ পেয়েছে।
এবার প্রশ্ন, স্টেট ব্যাঙ্ক নির্বাচন কমিশনকে বন্ড ক্রেতাদের তালিকা দিল এবং নির্বাচন কমিশন তা প্রকাশও করলো। কিন্তু তাতে কি জানা যাবে? বড়জোর জানা যাবে কে বা কারা এই বন্ড কিনেছিল। কিন্তু কোন দলকে দিয়েছ তা কিভাবে জানা যাবে? রাজনৈতিক দলগুলির কাছে এর রেকর্ড রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ দাবি করেন, নির্বাচনি বন্ড বাতিল হলে ফের ভোটে কালো টাকার রমরমা ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল, বন্ড চালুর কিছুদিন পরেই বিজেপি সরকার কোম্পানি আইন থেকে বেশ কয়েকটি বিধিনিষেধ তুলে নেয় যাতে কালো টাকার মালিকরা ভুয়ো কোম্পানি খুলে শাসকদলের তহবিলে বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়। লক্ষ্যনীয় গত কয়েকটি নির্বাচনে প্রচার যেমন ব্যয়বহুল হয়েছে, বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে দল ভাঙিয়ে নির্বাচিত সরকারের পতনও ঘটিয়েছে। আশঙ্কা যে দলের প্রার্থীকেই মানুষ ভোট দিক, সরকার বিজেপিই গড়ছে। বোঝা যাচ্ছে বিজেপি নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিকেই তামাশায় রূপ দিয়ে বিরোধীমুক্ত স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করতে চাইছে। এর মূলে রয়েছে তাদের টাকার জোর, সেকারণেই তারা নির্বাচনী বন্ড আইনে পরিণত করতে চায়। এখন দেখার সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ মতো নির্বাচনী বন্ডের তথ্য জনসমক্ষে আসে, নাকি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আদালতের রায় বাতিল হয়ে যায়।