প্রতিদিন শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির খবর দেখতে দেখতে, বৈদ্যুতীন মাধ্যমে সান্ধ্য আসরে এসব বিষয়ে তরজা দেখতে দেখতে আমি যখন উত্তেজিত ও প্রায় অবশ, তখন হঠাৎ মোহিত রায় মহাশয়ের একটি লেখা চোখে পড়ল। তাঁর লেখার প্রারম্ভিক অংশ এ রকম : “গত কয়েক মাস রাজ্য-রাজনীতি সরগরম শিক্ষক ও শিক্ষা-কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অর্থনৈতিক দুর্নীতি নিয়ে। এর সূত্রপাত কিছু প্রার্থীর পরীক্ষা ঠিকঠাক দিয়ে ও উপযুক্ত ফলাফল পেয়েও বিদ্যালয়ে চাকরি না পাওয়ার অভিযোগে কয়েকজন আইনজীবীর কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা। … রাজ্যের তদন্তের উপর ভরসা না থাকায় বিচারক হাজির করলেন কেন্দ্রীয় সরকারের দল সিবিআই ও ইডিকে। এ বার টিভির পর্দায় কোটি কোটি টাকার স্তূপ দেখা গেল, টাকা আদায় লেনদেনের রোমহর্ষক কাহিনি বেরোতে থাকল। জড়িয়ে গেলেন কয়েকজন তরুণী, যাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নেতা-মন্ত্রীদের। গরম খবর করার জন্য যা যা মশলা দরকার — কামিনী, কাঞ্চন ও নেতা — সবই পাওয়া গেল। দৃশ্য সংবাদ মাধ্যম তো বটেই মুদ্রিত সংবাদ মাধ্যমও চায় খবর হবে থ্রিলার মাফিক — ঘটনাময়, রক্তাক্ত, হাঁ করে তাকিয়ে থাকার মতো। এর পরে রায়মহাশয় বলেছেন, ‘একেবারে সরকারি ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাটাই নষ্ট হয়ে যাওয়ার’ কথা। সেটাই মূল ও গুরুতর সমস্যা; অথচ রাজনীতিবিদ বা সংবাদ মাধ্যমের সে দিকে দৃষ্টি নেই।
রায় মহাশয়ের এই লেখা কেন জানি না, আমার সামনে মেলে ধরল একটা আয়না। সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে আমিও চাকরি করেছি কি না! নিয়োগ দুর্নীতিতে রাশি রাশি টাকা নিয়েছেন নেতা-মন্ত্রীরা। নিন্দনীয়, অতীব নিন্দনীয়। নিন্দনীয় এবং শাস্তিযোগ্য। কিন্তু আমি যে এখন ভালোমানুষ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমিও কি দুর্নীতিতে যুক্ত নই? আমার মতো আরও হাজার হাজার? আমি তুলনা করি আমার মেয়ের সঙ্গে। সে আছে একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে। সকাল সাতটায় যায়, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। ঠাসা ক্লাশ, হোমটাস্কের বোঝা, করোনাকালেও নিয়মিত অনলাইন ক্লাশ। এত পরিশ্রম কি আমি তেত্রিশ বছরে করেছি? অথচ তার চেয়ে অনেক বেশি মাইনে আমি পেয়েছি। মেয়ের এক বন্ধু সরকারি বিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছে, মেয়ের চেয়ে চার গুণ বেশি মাইনে তার অথচ শ্রম পাঁচগুণ কম। শ্রম না করে এই যে বাড়তি অর্থ উপার্জন হচ্ছে, এটা কি দুর্নীতি নয়?
মনে পড়ে যাচ্ছে আর একটা ঘটনা। আমাদের পাড়ার এক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কথা। তিনি সকাল নটায় বিদ্যালয়ে আসতেন, চলে যেতেন বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ। একদিন তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে তিনি বললেন যে তিনি বৃ্হত্তর কাজে অর্থাৎ শিক্ষক আন্দোলনের কাজে নিযুক্ত। তার মানে যেখান থেকে তিনি মাইনে পান সেখানকার কাজ না করলেও চলে। আন্দোলনমুখী শিক্ষক ও সরকারি কর্মীরা কত শ্রমদিবস অপচয় করেছেন, তার হিসেব কেউ রাখেন কি? আন্দোলন নিশ্চয়ই দরকার, কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি হয়, তা পরবর্তীকালে পুষিয়ে দেবার কি কোন চেষ্টা আছে? এই সঙ্গে গুণগত আর একটি প্রশ্ন মাথা চাড়া দেয়? আমরা যারা সরকারি বিদ্যালয়ে চাকরি করি, বেশ ভালো মাইনে পাই, তারা কতটুকু সময় ব্যয় করি নিজেদের তৈরি করতে? জ্ঞান তো নিরবচ্ছিন্ন একটা ধারা, একবার ডিগ্রি লাভ করলেই বিদ্যাদিগগজ হওয়া যায় না। তাই তো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীকে জীবনের প্রান্ত সীমায় এসেও বলতে হয় : আমি জ্ঞান সমুদ্রের তীরে কয়েকটা নুড়ি কুড়িয়েছি শুধু। সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি নিরন্তর জ্ঞান আহরণ না করেন, তাহলে নতুন যুগের নতুন মনোভাবের ছাত্রদের কি ভাবে উদ্বুদ্ধ করবেন?
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক নিয়ে কোন আলোচনা, গবেষণা দেখি না। ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক যদি না হয়, ডাক্তার যদি রোগীকে, তার পারিবারিক পরিমণ্ডলকে না বোঝেন, তাহলে চিকিৎসা হয় যান্ত্রিক। শিক্ষাক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। ছেলেরা সব উৎকেন্দ্রিক, নষ্ট-ভ্রষ্ট এই অভিযোগ দায় এড়াবার। আমার মনে হয়, শিক্ষককেই ছাত্রের কাছে যেতে হবে, বুঝতে হবে, লাভ ও লোভের ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে হবে। তাহলেই যত দুর্বিনীত হোক, ছাত্রের মনে প্রভাব পড়বে শিক্ষকের।
লাভ ও লোভের কথায় মনে পড়ল টিউশনির কথা। অন্যান্য ব্যবসার কথা। আবার আত্মসমালোচনায় আসি। আমিও করেছি টিউশনি। বাড়তি রোজগারের আশায়। তাতে যে শক্তি ক্ষয় হয়েছে, তা বিদ্যালয়ের কাজে লাগলে ছাত্রের কিছু লাভ হত। টিউশনির বিরুদ্ধে সরকারি জেহাদ একবার হয়েছিল। সে জেহাদ টেকে নি। ২০২২ সালের সমীক্ষায় এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রথম’ জানায় যে, পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে বেশি ছাত্র-ছাত্রী সরকারি স্কুলে পড়ে ; কিন্তু সারা দেশে এই রাজ্যের ছাত্রছাত্রীর প্রায় ৭৪% টিউশনি নেয়। শুধু টিউশনি নয়, অনেক শিক্ষক আবার শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত, যুক্ত বই ব্যবসার সঙ্গে।
পূর্ববর্তী সরকার সরকারি কর্মী-সহ শিক্ষকদের মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিপুলভাবে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকার বেশি মাইনে পান। তবু বাড়তি রোজগারের প্রয়োজন, তবু মহার্ঘভাতা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন। একটা মজার কথা বলি। ৪০/৫০ বছর আগেও বিয়ের বাজারে কোন দাম ছিল না শিক্ষকদের। বুনো রামনাথের উত্তরসূরীদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না মেয়ের বাপ-মা। এখন অবস্থা বদলেছে। এখন শিক্ষকরা দো-চাকায় আসেন, চারচাকাও কম নয়। চিরকাল শিক্ষকরা বুনো রামনাথ হয়ে থাকবেন, এ মত গ্রহণীয় নয়। কিন্তু বিনিময় মূল্য বলে একটা কথা আছে। যে হারে আমি পাচ্ছি, সে হারে আমাকে তো দিতে হবে। অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দেশব্যাপী শিক্ষকদের কাজের, শিক্ষাদানের মূল্যায়ন কি কখনও হয়েছে? তাঁদের কাজের ভিত্তিতে প্রমোশন-ডিমোশন চালু করা কি যায় না?
সরকারপোষিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভালো মাইনে পান, তাঁদের চাকরির নিরাপত্তা আছে, তুলনায় কাজের বোঝা তাঁদের অনেক কম। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বিদ্যালয় বন্ধ হবার ঘটনা। গত ফেব্রুয়ারি মাসের একটি সংবাদে দেখছি তীব্র ছাত্র সংকটের ফলে রাজ্যের ৮২০৭টি স্কুল বন্ধ করে দিতে হবে। এর মধ্যে কলকাতার স্কুল ৫০০-র ওপরে। এতগুলি স্কুল বন্ধ হলে প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা উদ্বৃত্ত হবেন। ছাত্রসংকটের কথা ভাবতে গিয়ে দেখলাম আমার পাড়ার এক মাধ্যমিক স্কুলে মোট ৫০ জন ছাত্র। অথচ শিক্ষক ১৪ জন। গড়ে ৫০ হাজার মাইনে হলে মাস শিক্ষকদের বেতনবাবদ ৭ লক্ষ টাকা ব্যয়।
কিন্তু কোথায় গেল শিক্ষার্থীরা? কেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। মোহিত রায় মশায় জানিয়েছেন সরকারি স্কুল থেকে বেসরকারি স্কুলে যাওয়ার স্রোত সারা ভারতবর্ষেই। ভারত সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সাল থেকে ২০১৯-২০তে দেশে ৫১,১০৮টি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে; একই সময়ে বেসরকারি স্কুল বেড়ে্ছে ১১,৭৩৯টি। আমাদের রাজ্যে বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমের বাড়-বাড়ন্ত ১৯৮৬ সাল থেকে, ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি বর্জন করার সিদ্ধান্তে। শুনেছি, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত ছিলেন না, তিনি শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু ইংরেজি তুলে দেওয়া নয়, বা সরকারি স্কুলের পরিকাঠামোগত ঘাটতি নয়, সরকারি হাসপাতাল সম্বন্ধে যেমন, তেমনি সরকারি স্কুল সম্বন্ধে মানুষের মনে একটা সংস্কার তৈরি হয়েছে। তাঁরা মনে করেন সরকারি স্কুলে পড়াশুনো হয় না, অভাব আছে শৃঙ্খলার। সে সংস্কার সরকারি স্কুলের শিক্ষকদেরও আছে। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের অকাতরে বেসরকারি স্কুলে পড়তে পাঠান, অকাতরে ডোনেশন দেন।
আগের সরকার এক সময়ে অতিষ্ঠ হয়ে ‘কর্মসংস্কৃতি’ চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। সফল হন নি। দায়িত্বহীন অধিকারের বোধ একবার মনের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলে তাকে দূর করা মুশকিল। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা। মনে করুন নচিকেতার গানটার কথা।
নিয়োগ-দুর্নীতির আন্দোলন করুন, কিন্তু একই সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবুন যে আমাদের শিক্ষা-কাঠামোয় ঘুন ধরেছে। সেটা অনেক দিনের ব্যাপার। তার জন্য বিশেষ কোন সরকারই দায়ী, সে কথা বলা যাবে না। এর থেকে মুক্তি দরকার। তার জন্য সরকারপক্ষ, বিরোধীপক্ষ, বিদ্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকাকে আন্তরিকভাবে হাত লাগাতে হবে। নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায়ঃ।
লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক