ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিকে বলা হয় রঙ্গভরী একাদশী বা আমলকী একাদশী। অর্থাৎ যে একাদশী দেবী ভগবত উপাসকের মনের যাবতীয় মলিনতা আর চিত্তের দুষ্টতার পরিবর্তন করে চতুর্বগ ফললাভের পথ প্রশস্ত করেন, তিনি পুরাণে শ্রীশ্রী আমলকী একাদশী দেবী।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণের কথায়, দেবী পার্বতী সখীদের নিয়ে একবার প্রবাসে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে সকলে মুখরিত হয়ে ওঠেন ভগবান শিবের জয়গানে।
সেই সময় সেখানে পড়েছিল সকলের আনন্দঅশ্রু। যথাসময়ে সে অশ্রু থেকে উৎপন্ন হয় যে বৃক্ষ তার নামে আমলকি বা আধিভূত বৃক্ষ। পদ্মপূরণের কথায় এই বৃক্ষের উৎপত্তি হয় ভগবান শ্রী বিষ্ণুর মুখ থেকে। বৃক্ষের মূলে বিরাজ করেন ভগবান শ্রী বিষ্ণু। তারপরে পিতামহ ব্রহ্মা, কান্ডে রুদ্র, পাতায় বসু এবং ফলে প্রজাপতি প্রমুখ।
ব্রহ্মাণ্ড পুরানের কথায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যে কোন সাধক ভক্তি করে আমলকি একাদশী পালন করেন, নিঃসন্দেহে তিনি গমন করবেন বিষ্ণুলোকে। তাই আমলকি একাদশীতে ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে আমলকী প্রদান করলে বা আমলকী গাছ লাগলে মোক্ষ লাভ হয়। উদয় তিথির কারণে আজ আমলকী একাদশী পালন করা হচ্ছে সমগ্র দেশ জুড়ে। মনে করা হয় এই একাদশী পালন করলে রোগব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ পাওয়া যায়। আসলে প্রতিটি উপবাসের অন্তরালে রয়েছে বিশেষ কোন কারণ।
বর্তমান অনুসন্ধান অনুযায়ী, আমলকি যে অত্যন্ত উপকারী এবং প্রয়োজনীয় একটি ফল যা শরীরের নানা রকম রোগ ও সমস্যা নির্মূল করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। তাই এই ব্রত পালনের ভিতর আমলকী সেবনের রহস্য লুকিয়ে আছে।
আমলকির ইংরেজি পোশাকি নাম ইন্ডিয়ান গুসবেরি।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রে আমলকী কে “মা” বলা হয়। মা যেমন তার শিশুকে সমস্ত খারাপ জিনিস থেকে আগলে রাখে, ঠিক তেমনি আমলকী শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করে শরীরকে নানান রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করে। বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ছাত্রদের আমলকি বৃক্ষের চারা উপহার দিয়েছিলেন। সেই প্রাচীনকাল থেকে ঋতু পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে কাশি, হাঁচি, সিজনাল কাফ, জ্বর, গলার সমস্যা, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লুয়ের মতো অসুখে আমলকি ব্যবহার করা হয়ে আসছে।
আমলকিতে সবথেকে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন-সি বা এসকরবিক অ্যাসিড থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন উপকারী রাসায়নিক পদার্থ যেমন অ্যামাইনো এসিড, খনিজ, ট্যানিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন মিনারেল ম্যাটার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি থাকে। প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় শরীরের কোষগুলিকে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা করে কোষগুলিকে তরতাজা রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
আমলকী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-এ পরিপূর্ণ হওয়ায় নানান ধরনের দূষণের বিষক্রিয়া থেকে শরীরকে রক্ষা করে। হজম শক্তি বাড়াতে, বয়স ধরে রাখতে, হার্ট সুস্থ রাখতে, ডায়াবেটিসে, হাড় মজবুত করতে, গলব্লাডার স্টোন প্রতিরোধ করতে, ওজন কমাতে, বিপাক ক্রিয়া সঠিক রাখতে, রক্তাল্পতায়, যকৃত সুস্থ রাখতে, ত্বকের যত্নে ও চুলের সমস্যায় এর জুড়ি মেলা ভার। তবে অতিরিক্ত কোন কিছুই যেমন শরীরের জন্য কখনোই উপকারী নয়, তেমনি আমলকী অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়াও সঠিক নয়।
আমলকি খাওয়ার সব থেকে সেরা উপায় হল কাঁচা ও গোটা ফল অবস্থায় খাওয়া। তবে ছোট ছোট টুকরো করে লবণ, গোলমরিচ গুঁড়ো, জোয়ান মিশিয়ে হালকা রোদে শুকিয়ে নিয়ে অল্প অল্প করে রোজ খেতে পারেন। খেতেও ভালো লাগে উপকারও পাওয়া যায়। ভাতে আমলকি সেদ্ধ করেও অনেকে খান। একটু গুড় অথবা মিছরি সহযোগে আমলকির মোরব্বা অত্যন্ত উপাদেয়। দুর্বল শরীরের ওজন বাড়াতে, শরীরের ক্লান্তি দূর করতে এটি খুবই উপকারী। ভাত বা রুটি দিয়ে আমলকির আচারও খেতে পারেন। আমলকির তেল ত্বক ও চুলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া আমলকি দিয়ে তৈরি চ্যবনপ্রাশ, ত্রিফলা চূর্ণ, ভৃঙ্গরাজ আমলকী তেল ইত্যাদি প্রচলিত ওষুধও অনেকেই ব্যবহার করেন।
বারাণসীতে রঙ্গভরী বা আমলকী একাদশী বিশেষ করে বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের চত্বরে দারুন উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। মনে করা হয় এই একাদশীতেই প্রথম দেবী পার্বতীকে কাশী নিয়ে এসেছিলেন বাবা বিশ্বনাথ। রঙের মরশুমে আজ থেকেই আবির খেলার মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় সকলকে। আজ বাবা বিশ্বনাথের রৌপ্য মূর্তিকে খাদি কাপড় ও আকবরী টুপি পরানো হয়। দারুণ ব্যাপার হলো বেনারসের একটি মুসলিম পরিবার গত ২৫০ বছর ধরে এই আকবরী টুপি তৈরি করে আসছেন। এটি বেনারসের বৈশিষ্ট্য। আবিরের রঙে জাত-ধর্ম দুই মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে। এমন সুন্দর স্বাস্থ্য সম্মত ও মিলনের উৎসব মুখরিত হোক সকলের জীবনে।
সুন্দর একটা উপহার।
Dhonyobad 🌹
খুব সুন্দর লিখেছেন