বৃহস্পতিবার | ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১:০৬
Logo
এই মুহূর্তে ::
হাইনরিখ হাইনে : শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত ‘হীরক রাজার দেশে’র একটি স্মরণীয় আউটডোর : রবি ঘোষ বাবরি মসজিদ ভাঙার ‘ঐতিহাসিক যুক্তি’ : ইরফান হাবিব হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি : সুবিমল মিশ্র সর্বনামই যেখানে নাম হয়ে উঠতে পারে : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (শেষ পর্ব) : রহমান হাবিব নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘পূর্ণিমা রাত ও পাটকিলে কুকুর’ মহানাটক শেষ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হলেন ফড়ণবীস : তপন মল্লিক চৌধুরী বাজার মাতাচ্ছে রাজ্যেরই ড্রাগন ফল, লাভবান চাষিরা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কবিতার শত্রু মিত্র : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (চতুর্থ পর্ব) : রহমান হাবিব মৌসুমী মিত্র ভট্টাচার্য্য-এর ছোটগল্প ‘রেফারী’ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (তৃতীয় পর্ব) : রহমান হাবিব কাশ্মীরী মন্দির — অবহেলায় না অনীহায়? অবন্তীস্বামী ও মার্তন্ড মন্দির : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী মমতার স্পষ্ট বার্তা — আগে বাংলার মানুষ আলু খাবে, তারপর বাইরে পাঠানো হবে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (দ্বিতীয় পর্ব) : রহমান হাবিব লঙ্কা চাষ বাড়ছে, লাভবান চাষিরা, রপ্তানি বাড়াতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পাশাপাশি, তবে প্রাণ নেই, চিহ্ন বইছে ভেলুগোন্ডা, রবিবার জল সরার পরে : অশোক মজুমদার নলিনী বেরার কবিতা — স্বভূমি, স্বদেশ, স্বজন : ড. পুরুষোত্তম সিংহ অদ্বৈত মল্লবর্মণ — প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালোচক (প্রথম পর্ব) : রহমান হাবিব রংবাহারি ক্যাপসিকাম : রিঙ্কি সামন্ত রাজ্যের কৃষকমান্ডিতে কৃষকদের ধান বিক্রিতে দালাল মুক্ত করার নির্দেশ সরকারের : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় নন্দিনী অধিকারী-র ছোটগল্প ‘উচ্ছেদ’ আমাদের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নানা মত : তপন মল্লিক চৌধুরী বেঙ্গল গোট গ্রামীণ অর্থনীতিতে এনে দিতে পারে স্বচ্ছলতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় পিটার নাজারেথ-এর ছোটগল্প ‘মালদার’ অনুবাদ মাসুদ খান আমরা নারী-আমরাও পারি : প্রসেনজিৎ দাস ঝুম্পা লাহিড়ীর ছোট গল্প “একটি সাময়িক ব্যাপার”-এ অস্তিত্ববাদ : সহদেব রায় ঝুম্পা লাহিড়ী-র ছোটগল্প ‘একটি সাময়িক বিষয়’ অনুবাদ মনোজিৎকুমার দাস ঠাকুর আমার মতাে চিরকালের গৃহীর চিরগুরু : সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই দীপাবলি এবং কালীপুজোর আন্তরিক শুভনন্দন।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বাংলার হস্তশিল্প : বিশ্বেন্দু নন্দ

বিশ্বেন্দু নন্দ / ৬২৮ জন পড়েছেন
আপডেট শুক্রবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২২

সম্পাদক লেখককে বাংলার জেলাওয়ারি হস্তশিল্পের বিহঙ্গ পরিচয় লিখতে বলেছেন। শীর্ষকে যদিও এই কাজকে হস্তশিল্প বলেছি, কিন্তু একে এই প্রবন্ধে আমরা পরম্পরার গ্রাম উৎপাদন হিসেবেই চিহ্নিত করব। এই প্রবন্ধে আমরা মূলত কয়েকটি পরম্পরার গ্রাম শিল্প আর শিল্পীদের কথা বলব। এই প্রবন্ধের উল্লিখিত গ্রাম শিল্প-শিল্পীর তালিকার বাইরে আরও অনেক গ্রাম শিল্পী-শিল্প রয়েছে, যা স্থানাভাবে উপস্থাপন করা গেল না। এর বাইরে অনেক কিছু শিল্প, অনেকজন শিল্পী সংগঠনের জানার বাইরেও থেকে গিয়েছেন। বাংলাজোড়া ১৮টি জেলায় সংগঠনের জেলা সমিতির সঙ্গে যুক্ত থেকে, বাংলার যে যে এলাকায় আমরা সদস্য হিসেবে গিয়েছি, যে যে মানুষ আর শিল্পর সঙ্গে মিলেছি দেখেছি, সংগঠন তৈরি হয়েছে, সেই সব দেখা শোনা মানুষদের শিল্প এখানে উপস্থিত করা গেল। এর বাইরে আরও হাজারো শিল্পী, আর শিল্প পরিচয়ের ভূমিকা অন্য কোনও সময়ে হয়ত করা যাবে, যদি সম্পাদকের অনুমতি হয়।

কয়েক স্তবক আগে যে দুটি শিল্পী সংগঠনের কথা বলা গেল, তাঁর নাম কলাবতী মুদ্রা আর বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ। বাংলার দুই মহান শিল্পগুরু আন্তর্জাতিক শোলা শিল্পী মধুমঙ্গল মালাকার আর ছো মুখোশ, ঝুমুর আর ছো নৃত্য শিল্পী নেপাল সূত্রধরের মূল উদ্যোগে এই দুটি সংগঠন তৈরি হয়েছে। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য পরম্পরার গ্রাম শিল্পীদের জীবিকা আর স্বার্থ রক্ষা, যে গ্রাম শিল্পগুলি প্রায় মুছে যেতে বসেছে সেগুলিকে রক্ষা; নতুন বাজার খুঁজে বার করা ইত্যাদি। এর বাইরে আরও অনেক কাজের মধ্যে সংগঠন দুটি চেষ্টা করছে বাংলা জোড়া কারু গ্রাম ভ্রমণের মত একটি নতুন ভাবনার ভ্রমণদ্যোগ শুরু করতে, যেখানে উৎসাহীরা শিল্পীদের গ্রামে গিয়ে তাদের উৎপাদন, তাঁদের আভিকর শিল্প, তাদের জীবনযাত্রা ইত্যাদি দেখতে পাবেন স্বচক্ষে, হাতে কলমে তাদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং সেখান থেকেই নানান শিল্প কর্ম কিনতে পারবেন – একই সঙ্গে বাংলার গ্রাম, তার শিল্প, শিল্পী, ঐতিহ্য, পরম্পরা, প্রযুক্তি, জীবন জীবিকা ইত্যাদি বিযয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণাও তৈরি করতে পারবেন।

সম্পাদক-পাঠকের অনুমতি নিয়েই লেখাটির মুখবন্ধ শুরু করব কিছুটা ব্রিটিশপূর্ব সময় থেকে, যখন গ্রাম বাংলার উৎপাদন বিশ্বের বাজারে বিকোত একচেটিয়াভাবে। এর সঙ্গে ছুঁয়ে যাব গ্রাম শিল্পীদের নিজস্বতার যায়গাটিও – কেন তাঁরা আজও সম্মানীয়, কেন এই শিল্পীদের আজও এই সভ্যতার প্রয়োজন। হয়ত এই মুখবন্ধটি তত্ত্ব আর তথ্যের জালে কিছুটা ভারাক্রান্ত মনে হবে, কিন্তু যারা বাংলার গ্রাম শিল্পের ইতিহাসে আগ্রহী, তাঁদের কাছে এর আবেদন থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু যাঁদের এই ভূমিকাটি নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় মনে হবে, তাঁরা স্বচ্ছন্দে এই বেকার বকবকানি টপকে মাদুর শিল্প থেকে পড়া শুরু করতে পারেন। বিন্দুমাত্র ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বরং কিছু সময় বেঁচে যেতে পারে।

পলাশির আগে লন্ডন-সহ ইওরোপে বাংলার চা, মসলিন ইত্যাদি ভারতীয় ভোগ্যপণ্য ভোগের উচ্চ-মধ্যবিত্তের অসম্ভব আদিখ্যেতার বর্ণনা, জেন অস্টিনের উপন্যাসেরমত রিজেন্সি যুগের নানান সাহিত্যে ফুটে রয়েছে। পলাশী চক্রান্তের আগে কয়েক হাজার বছর ধরে বাংলা তথা এশিয়ার নানান কৃষি আর শিল্প দ্রব্যই ছিল সমগ্র ইওরোপের ভোগ্য। ১৮০০র আগের চার শতকে, ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া নানান পণ্য ব্রিটেন তথা ইওরোপিয় জীবনযাত্রার মান নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল – যা আমরা এই সময়ে ভুলতে বসেছি। বিগত দুশ বছর ধরে একটি উলট পুরাণ অভিনীত হয়ে চলেছে ফোরেন গুডসের প্রতি ভারতের উচ্চমধ্যবিত্তের আদেখলেপনার দেখনদারিতে।

বছরের পর বছর ধরে রপ্তানিমুখী আর বিপুল আভ্যন্তরীণ দেশিয় বাণিজ্যের হাত ধরে কারিগরির যন্ত্রের বিকাশ, ভারতে আর বিশ্বে নতুন নতুন বাজার তৈরি, নতুন নতুন পণ্যদ্রব্যের উদ্ভাবনী দক্ষতায় বাংলার গ্রাম উতপাদকেরা ছিলেন মাহির। মনে রাখতে হবে ভারতের উৎপাদনের মাত্র ১০ শতাংশ বিদেশে যেত রপ্তানির জন্য – বাকিটা কিন্তু দেশে আভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হত। শুধু বস্ত্র উত্পাদনে অসাধারণ দক্ষতাই নয়, নানান ধরণের ধাতুজ সংকর দ্রব্য (ক্রুসিবল স্টিল – প্রখ্যাত দামাস্কাস তরোয়ালের পিন্ডটি তৈরি করতেন বাংলা-ভারতের ডোকরা কামারেরা। আজও তাঁরা যে লোহার দ্রব্য তৈরি করেন, তাতে মাথা খারাপকরা জং ঢাকতে, বিন্দুমাত্র রংএর প্রয়োজন হয় না – যে প্রযুক্তি আজও প্রযুক্তিগর্বী ইওরোপের অধরা – দিল্লির লৌহ স্তম্ভ অথবা বিষ্ণুপুরের মদনমোহন কামান মাথায় ছাতা ছাড়াই শয়ে শয়ে বছর খোলা আকাশের তলায় পড়ে থাকে মাথা উঁচু করে, কোণার্কের ৮০ ফুটের শোয়ানো বিম আজও বিষ্ময় জাগায়, এখোনো বাংলার যে কোনও পুরোনো পরিবারের ঠাকুর ঘরের কাঁসা-পিতলের তৈরি দেবতা কোনও বিশেষ প্রসাধন ছাড়াই বিরাজমান রয়েছেন কয়েকশ বছর অক্লেশে), খাবারদাবার (পান, সুপুরি, গুড়, চা, নুন, মশলা, চাল, মিষ্টি, ফল, আচার, সাদা চাটনি, চিনি, মদ্য (গৌড়ি বা রাম)), পরিধেয় (চামড়া, সুতো, সিল্ক, তসর, মুগা, এন্ডি), রং(নীল অর্থাত ইন্ডিগোসহ হাজারো প্রাকৃতিক রং), শিল্প-শিল্পী (মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের কারুশিল্পী, হাতির দাঁতের তৈরি নানান আসবাব তৈজস রপ্তানি হত পারস্যে ইওরোপে, মস্করী বা পটুয়ারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানান বৌদ্ধ গুম্ফায় ছবি এঁকেছেন, মগধের (পাটনা – সে সময়ের বাংলার সীমানার মধ্যেই ছিল) বঙ্গের পাথর শিল্পীরা অজন্তা ইলোরা বরবুদর, চম্পা (কাম্পুচিয়ায়)মন্দির খোদাই করেছেন, বিশ্বের দামিতম ভারি জাহাজগুলি তৈরি হত সন্দ্বীপ আর হুগলীর বলাগড়ে, বাংলা থেকে তাঁত শিল্পী বস্ত্র শিল্প শেখাতে গিয়েছেন পারস্যে- আজকের বড় পুঁজির প্রয়োজনে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইরাকে), মাটির বাড়ি তৈরির (পোড়া মাটির মন্দির অন্ততঃ তিনশো বছর ধরে রোদ, জল, ঝঞ্ঝায় দাঁড়িয়ে থেকেছে বাংলার প্রযুক্তির অনন্য বিজ্ঞাপন হয়ে, আজও বিলাসবাহুল বাড়ির ব্রিটিশ নাম কিন্তু বাংলা আঙ্গিকের বাড়ি যার পোশাকি নাম বাংলো) প্রযুক্তি আর পণ্য সরবরাহ করত বাংলার গ্রাম শিল্পীরা। অকলঙ্ক খ্যাতি ছিল নানান ধরনের বস্ত্র উত্পাদনে, লৌহ দ্রব্য তৈরিতে, শিল্পীর গুণমানে আর কারিগরীর চূড়ান্ত দক্ষতায়।

কয়েক হাজার বছর ধরে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম ধনী অঞ্চল, বাংলা সুবা শুধু উদ্বৃত্ত অর্থনীতির দেশ ছিল না, প্রযুক্তিতেও বাংলা ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা জনপদ। বেশকিছু প্রযুক্তি বাংলার নিজস্ব ছিল। দেশজুড়ে বিশ্বদ্যালয়সম শিক্ষা কেন্দ্র খুলে সে তত্ত্ব তথ্য শিখিয়েছে বিশ্বের নানান সমাজকে। তার নিজের মেধা আর পরিশ্রমে এতই বিশ্বাস ছিল, সে প্রযুক্তি ভাবনা কেউ চুরি করলেও সেই প্রযুক্তি অতিক্রম করে নতুন কিছু সৃষ্টি করার যোগ্যতা বিশ্বাস ছিল, তাই কোনও প্রয়ুক্তিই পেটেন্ট করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে নি। অন্তত ১৫০টির বেশি শিল্পদ্রব্য বাঙলার গ্রামীণেরা তৈরি আর ব্যবসা করে এসেছেন ১৮০০ সাল পর্যন্ত। বিশ্বের শিল্প উত্পদনের প্রায় ৮০ শতাংশ উত্পাদিত হত ভারত, চিন আর পারস্যে (আজকের ইরাকে)।

এর মধ্যে বাংলার অবদান খুব কম ছিল না কেননা ১৬৮০ সালে শুধু ইওরোপে রপ্তানি হচ্ছে ভারত থেকে ১০ কোটি গজ কাপড় – যা বাড়বে চক্রবৃদ্ধি হারে আগামীদিনে গায়ের জোরে তাঁতিদের শিল্পকর্ম আর তাঁত বোনার পরিকাঠামো ধ্বংস করে ম্যাঞ্চেস্টারের মিলের জন্য ভারতের বাজারের দ্বার খুলে না দেওয়া পর্যন্ত। রপ্তানি করা কাপড়ের নব্বই শতাংশ ছিল গ্রাম বাংলার তাঁতিদের উৎপাদন।

প্রায় প্রত্যেকটি দ্রব্যের বিশ্বজোড়া একচেটিয়া বিশ্ববাজার। অথচ বাঙলার ছোটবড় সব বণিক বা উত্পাদকেরা সমাজের বিধিনিষেধের আওতার মধ্যে থেকেই বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করতেন। দেশে তাদের একচেটিয়া কারবার করতে ভারতীয় সমাজ কোনওদিনও উত্সাহ দেয় নি। ইওরোপিয় উদ্যমী এবং বণিকদেরমত, নিজের দেশ অথবা সামগ্রিক বিশ্বের সামাজিক গঠন পাল্টে অথবা প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশ্ব বাজার দখল করার বিধ্বংসী পরিকল্পনা তৈরি করে নি – বলাভাল সমাজ করতে দেয় নি। এই উত্পাদন প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত ছিলেন বিকেন্দ্রিভূত কয়েক কোটি উতপাদক কয়েক কোটি বিক্রেতা – যেন রক্তবীজের বংশধর। আজকের বড় পুঁজির তৈরি করা আইনের মত এঁরা কেউ কারোর শিল্প বা ব্যবসা দখল – যাকে আইনে বলে হোস্টাইল টেকওভার বা জোর করে কিনে নিতে পারতেন না। এই বিকেন্দ্রীকৃত উত্পাদন ব্যবস্থার বড় অংশিদারিত্ব ছিল বাঙলার পারম্পরিক শিল্পী-ব্যবসায়ীদের, যাদের উদ্যমকে পরের দিকে অসংগঠিত অথবা হস্তশিল্প ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে বড় পুঁজির উৎপাদন আর ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য। ফলে লাভের গুড় সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে না গিয়ে, কয়েকটি মানুষের সিন্দুকে কেন্দ্রীভূত হয়ে চলেছে। পেছনে সরে গেছে সামাজিক সাম্য। বেড়ে চলেছে কর্পোরেট পুঁজির এলাকা।

শহুরে বাঙালি মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী থেকে চাকরিজীবী হল দেশের প্রথম কর্পোরেট তাত্ত্বিক দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময়ের কিছু আগে থেকে। ইওরোপিয় আধিপত্য বিকাশের সঙ্গে চাকরি আর দালালির টোপ দিয়ে বাঙালি উচ্চমধ্যবিত্ত সাম্রাজ্যের লুঠের ছোট অংশিদার করে নেওয়া হল। এই চাকুরীজীবীদের হাত দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রথমে বাঙলা-বিহার, পরে সারা ভারতের জনপদে অসীম অত্যাচার, দখল-ধ্বংসমূলক বাণিজ্য এবং উত্পাদনের পরিকাঠামো ধ্বংস করায় অযুত গ্রামীণ কারিগরের স্বনির্ভরতার বিলয়, বাংলার বিশ্বজয়ী বণিকদের পরাধীণতা, বাংলার অর্থনীতি-প্রযুক্তির ধংসের যুগ শুরু হল।

হাজার হাজার বছরের গ্রামভিত্তিক পঞ্চায়েতি গণতন্ত্র ধ্বংস করে শহরকেন্দ্রিক পশ্চিমি সংসদীয় গণতন্ত্রের বনিয়াদ যত দৃঢ় হচ্ছে, ভারতের মাটিতে ততই গ্রাম-শিল্পী-উদ্যমীরা বিলুপ্তপ্রায় হচ্ছেন। এই কাজের ঋত্ত্বিক ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি সরকারি আর বড় পুঁজির আমলারা। তাদের পরিকল্পনায় আগ্রাসী কর্পোরেট বাজারের বিপুল খাঁই আর বড় পুঁজির নিশ্ছিদ্র লুঠ চাহিদা সফল করতে গ্রামীণ উৎপাদক আর বিক্রেতারা রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় হয়ে গেলেন উদ্বৃত্ত। ইংরেজ আমল থেকেই এদের গরীব, আনপড়, অজ্ঞাণী, পরনির্ভর, আদিবাসী, প্রান্তিক, তপশিলী জাতি উপজাতি ইত্যাদিরূপে চিহ্নিত করার যে চেষ্টা চলেছে, তার প্রভাব পড়েছে স্বাধীণতার পরের সরকারি-বেসরকারি পরিকল্পনায়। ফলে অদম্য ভারতীয় তথা বাঙলার সভ্যতা সৃষ্টিকারী শিল্পী-উদ্যমী থেকে স্বাধীণতার পর থেকে নানান উদ্যমে, গ্রাম শিল্পীদের পিঠে সাধারণ দিনমজুর, খেটেখাওয়া, গরীব, বিপিএল, অথবা করুণাযোগ্য হস্তশিল্পীর অনপনেয় ছাপ পড়ে গিয়েছে। এরা সকলেই যে দাগি শ্রমিক সরকারি পরিকল্পনা আর অনুদানরাশিতে তা স্পষ্ট। পারম্পরিক শিল্পীরা বিপিএলশ্রমকার্ডধারী, ভারত সরকারের বছরের একশ দিনের কাজের পরিকল্পনার কয়েকশ টাকার মাটি কাটার মজুরমাত্র।  সামাজিক নিরাপত্তা প্রায় শূন্য, রোজগারও তথৈবচ, লুঠ হয়ে যাওয়া সামাজিক সম্মানের কথা যত কম বলাযায় তত ভাল।

তবুও নতুন সময়ে নতুনভাবে, মধ্যবিত্ত প্রজন্মের একটি অংশ সামাজিকভাবে আবার শেকড়ে ফিরতে চাইছেন, এটিই সব থেকে বল-ভারসার কথা – তাই কলকাতা তথা জেলার নানান শিল্প মেলায় বিক্রি বাড়ছে – নতুন করে তাঁরা তাঁদের ঐতিহ্যকে দেখতে চাইছেন – নতুন করে সম্মান ফিরিয়ে দিতে চাইছেন এই গ্রামীণ উতপাদকেদের। শহরের নতুনতম প্রজন্মের দিকে গ্রাম শিল্পীদেরও নতুন প্রজন্ম তাকিয়ে রয়েছেন বড় আশায়। এই শেকড়ছেঁড়া উদ্দাম সময়ে বৃন্দাবন চন্দ, মধুমঙ্গল মালাকার, গীতা কর্মকার বা নিতাই নন্দীমত শিল্পীদের এবং তাঁদের উত্তরাধিকারীদের সবলে টিকে থাকা একান্ত প্রয়োজন। কেননা তাঁরা আজও ধরে রেখেছেন সেই কয়েক হাজার বছরের আজেয় বাংলার নিজস্ব প্রযুক্তি, যে প্রযুক্তির বলে এই অনবদ্য সম্মানীয় মানুষগুলি বলতে পারেন, তাঁরা বিন্দুমাত্র বিদ্যুৎ ব্যবহার না করে, স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে, স্থানীয় মানুষকে রোজগার দিয়ে, পরিবেশের কম ক্ষতি করে, কমতম সম্পদ ব্যবহার করে গ্রামীণদের বাজারের চাহিদা পূরণ করছেন। এঁরা নিজেরা তৈরি করেছেন সংগঠন। কারোর দয়ায় নয়, নিজেদেরই বলে বাঁচতে চাইছেন। এঁরা বাঁচলে তবেই বাঙলার শিল্প-প্রযুক্তির ইতিহাস বাঁচবে বাংলার ঐতিহ্য পরম্পরা বাঁচবে, বাংলা তার নিজস্ব পরিচয়ে বাঁচবে। আশ্বাসের কথা মধ্যবিত্ত নতুন প্রজন্ম বোধ হয় সেটুকু বুঝতে পেরেছেন। এই গাওনা গেয়ে আমরা আমাদের জেলাওয়ারি কারুশিল্প পরিক্রমা শুরু করি। (চলবে)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন