বাংলাভাষী মানুষের রবীন্দ্রনাথের গানের মতো আশ্চর্য সম্পদ আর কী আছে? সুখে দুঃখে আনন্দে বেদনায় আমরা তো বার বার তাঁর গানের ঝর্ণাতলায় আশ্রয় নিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হন ১৯৪১ সালে। এর ২০ বছর বাদে ১৯৬১ সালে এ বাংলা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ মহাসমারোহে কবির শতবর্ষ পালনে ব্রতি হলেন। এই সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথের গানের বড়ো সংখ্যক রেকর্ড প্রকাশিত হতে লাগলো। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের গানের বিপুল প্রসার এই সময় থেকেই- এটা মনে করেন অনেকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সময়ই তাঁর গান সঠিক সুরে যাতে গাওয়া হয় সে বিষয়ে উদ্যোগ দেওয়া হয়। কবি নিজে বার বার জানিয়েছেন, তাঁর লেখা গান তাঁর সুরেই গাইতে হবে। ফলে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী- এঁদের হাত ধরে গান শিখলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখ। এঁদের পরবর্তী প্রজন্মের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান নক্ষত্র সুচিত্রা মিত্র।
১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সুচিত্রা মিত্রের জন্ম, চলন্ত ট্রেনে শোন নদীর ধারে গুজহাণ্ডি স্টেশনের কাছে। সুচিত্রা মিত্র বলতেন- সেই থেকে আমার চলে বেড়ানই এক মাত্র কাজ। আর আমার শেষ পারানির কড়ি রবীন্দ্রনাথের গান। সুচিত্রা মিত্রের বাবা বিখ্যাত লেখক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। পড়াশোনা প্রথমে বেথুন স্কুল এবং স্কটিশ চার্চ কলেজে। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের সামান্য কিছু দিন পরে বোলপুর স্টেশন থেকে গরুর গাড়িতে ট্রাঙ্ক চাপিয়ে খাস উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের মেয়ে সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় পৌঁছে গেলেন নিবিড় বনচ্ছায়া ঘেরা শান্তিনিকেতনে। এমন করে দিগন্ত দেখা আগে তাঁর হয়নি, লিখেছেন সুচিত্রা। আর মজার কথা হলো, তখন সংগীত ভবনে তাঁর সহপাঠী যে ছাত্রীরা, তাঁরাই একে একে হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথের গান ও সংস্কৃতির দিকপাল। তখন গান শেখান ইন্দিরাদেবী, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন, ভি ওয়াঝেলজর। আর গান শেখেন সুচিত্রা, কণিকা, নীলিমা, সেবা মাইতি, অরুন্ধতী দেবী- এঁদের মধ্যে সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নীলিমা সেন রবীন্দ্রসংগীতের তিন কিংবদন্তি। নীলিমা এবং কণিকা আশ্রম কন্যা এবং সারা জীবন থেকেছেনও শান্তিনিকেতনে।
কিন্তু সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় ১৯৪৫-৪৬ নাগাদ কলকাতায় ফিরে আসেন। পরবর্তীকালে ধ্রুব মিত্রের সঙ্গে বিবাহসূত্রে (১৯৪৮ সালে) তিনি সুচিত্রা মিত্র হন।
কলকাতায় এসে ধীরে ধীরে যুক্ত হলেন গননাট্য আন্দোলনে। সেখানে তাঁর সঙ্গী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী- এরকম অনেকে। বর্ধমানের গলসিতে খোলা মাঠের এক সভায় গান গাইছেন দেবব্রত বিশ্বাস এবং সুচিত্রা মিত্র। গননাট্যের মঞ্চ তখন রবীন্দ্রনাথের গানে কেঁপে উঠছে। এর কিছু দিন পরেই ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়র ইংরেজি এবং বাংলা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো। ভারত বিখ্যাত সংগীতবেত্তা লিখলেন- এ তো স্বয়ং দীনেন্দ্রনাথ। গলায় টপ্পার দানা আছে, তবে শুনলাম মেয়েটি কমিউনিস্ট। মাঠে ঘাটে গান গেয়ে বেড়ায়। তবে গলার তেমন ক্ষতি হয়নি।
১৯৪৫ সালেই প্রথম রেকর্ড— ‘মরণও রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’ এবং ‘হৃদয়ের একূল ওকূল, দুকূল ভেসে যায়’। সূচনাপর্বেই বিখ্যাত হলেন সুচিত্রা মিত্র। এর পর ১৯৪৬ সালে সংগীত প্রতিষ্ঠান রবিতীর্থের সূচনা। নামকরণ করলেন প্রখ্যাত পণ্ডিত কালিদাস নাগ। ১৯৫১ সালে পূর্ব ইওরোপের বিভিন্ন দেশে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে পৌঁছে গেলেন সুচিত্রা মিত্র। এর কিছু পরেই রামকিঙ্কর বেইজ গড়লেন সুচিত্রা মিত্রের মূর্তি। বিষ্ণু দে লিখেছিলেন- ‘আকাশের নীল স্রোতে, শরতের অশরীরী শুভ্র মেঘে,/ যেদিকে তাকাই গান, রঙে গন্ধে গান আর গান,/ না শুনে থাকাই ভার, থামিয়ে রাখাই ভার’। এইভাবে ২০১১ পর্যন্ত বাঙালি সংস্কৃতির এবং রবীন্দ্র গানের এক প্রধান মুখ হয়ে বিরাজ করেছেন সুচিত্রা মিত্র। আজ প্রয়াণের পর তাঁর উপস্থিতি আরও উজ্জ্বল।