আমাদের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু দেশের আদিবাসী জনজাতি থেকে আসা একজন নারী। বিশ্বের অসংখ্য দিবসের ভিড়ে জায়গা পেয়েছেন আদিবাসী জনজাতিরাও। আগামি ৯ তারিখ আদিবাসী জনজাতি দিবস। নানা দেশের মত আমাদের দেশেও অসংখ্য প্রতিশ্রুতি ও কর্মসূচি সাজিয়ে দিনটি উদযাপিত হবে। কিন্তু যাদের বঞ্চনা করে দিব্যি চলছে দেশটি; যাদের গান, গল্প, লোককথা নির্বিচারে চুরি ও অপব্যাখ্যা করে স্ফীতোদর হচ্ছে আমাদের নাচ-গান-গল্প-নাটক-সিনেমা; যাদের অধিকার হনন করা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত নামক রাষ্ট্রটির নিয়মিত অভ্যাস – তাদের অবস্থার কি কোন পরিবর্তন হবে ? আদিবাসী মানুষদের সিংহভাগই অবশ্য তাদের জন্য যত্ন করে তাকে তুলে রাখা এই বিশেষ দিনটির কথা জানেন না। তাতে কী হয়েছে? দিন কে রাত করা দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা তো জানেন, তাহলেই চলবে। আফ্রিকার পরেই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি আদিবাসী জনজাতির বাস, ১০৪ বিলিয়ন। এটাও ২০১১-র জনগণনার হিসেব, এখন সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। আরও খারাপ হয়েছে তাদের অবস্থা।
ওড়িশার ডোংরি, মধ্যপ্রদেশের বাইগা, পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ডের সাঁওতালদের মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে প্রায় ৭০০ আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীর বাস, কেউই ভালো নেই। শুধু আরও ভালো এবং আরও ঝকঝকে হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বিতরিত বাণীর বন্যা। বেড়েছে তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। বনবিনাশের অভিযোগ তুলে অরণ্যের সন্তানদের জঙ্গলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খনি ও আবাসন প্রকল্প গিলে খেয়েছে তাদের বাসস্থান। জঙ্গলেই চাষ হচ্ছে হাইব্রিড শস্য, ফলে ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খল। বিপন্ন হচ্ছে আদিবাসী জনজাতির খাদ্য নিরাপত্তা। এসবই কিন্তু চলছে মহা সমারোহে আদিবাসী উন্নয়নের ব্যানার ঝুলিয়ে। প্রকৃতির কোলে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বলেই সারা পৃথিবীতে এই মানুষগুলি অরণ্যের সবচেয়ে বড় রক্ষক। কিন্তু সরকার-কর্পোরেট-আমলাকুল তাদের মার্কামারা ভিলেন বানিয়ে অরণ্যবিনাশের বিশ্বজোড়া কারবার ফেঁদে বসেছেন।
এই সংগঠিত অরণ্যবিনাশকরা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে বিশ্ব জুড়ে দিব্যি অরণ্য লুণ্ঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশের কথাই বলি, এখানে তেল-কয়লা-অরণ্যের মূল পাহারাদার আদিবাসী মানুষ। তিনটিই জাতীয় সম্পদ। বহুজাতিক সংস্থা, ব্যবসায়ী এবং রাষ্ট্র যথেচ্ছ লুণ্ঠন ও আইনের অপব্যাখ্যা করে এগুলি ধ্বংস করে চলেছেন। কিন্তু অসম যুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হার হচ্ছে আদিবাসীদের। অরণ্যের এই প্রতিবাদী সন্তানদের জঙ্গলের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের নির্দেশ, ভূমিপুত্রদের প্রতিবাদ করা চলবে না। প্রতিরোধ, নৈব নৈব চ। তাহলেই তাদের উন্নয়নের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
এ নিয়ে জায়গায় জায়গায় কেন্দ্র ও রাজ্যের লড়াই আছে — তবে তা নিছক ভাগ বাঁটোয়ারার ব্যাপার! আদিবাসীদের কথা বেশিরভাগ রাজ্যই ভাবে না, কেন্দ্র তো নয়ই। গোটা দেশের আদিবাসী জনজাতি সম্প্রদায় তাদের জল-জঙ্গল-জমির স্বাভাবিক অধিকার হারিয়ে তলিয়ে যাচ্ছেন এক অনিশ্চতার গহ্বরে। একটি ‘দিবস’ তাদের কতটা রক্ষা করতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়! শুধু একজন জনজাতি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রপতি করাই নয়, তাদের অধিকার রক্ষা করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। সে কাজটি করা গেলে দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়াটা প্রকৃত গুরুত্ব পাবে।