উত্তর কলকাতার গরানহাটার ইতিহাস আমাদের কাছে যেন মস্ত বড়ো ধাঁধা। সহজে গিঁট খোলা শক্ত।
শাল নয়, সেগুন-মেহগিনি নয়, পুরোনো কলকাতার কাঠের নাম দিয়ে একটা জায়গাই পাওয়া যাচ্ছে,-তা এই গরানহাটা৷ গরান কাঠ কোনো কুলীন কাঠ নয়, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ মাত্র৷ এর ছাল থেকে রং হয় ও লম্বা সরু গুঁড়ি দিয়ে বাগানের বেড়া দেওয়া হয়৷ তা, এমন একটি কাঠের জন্য বনেদি কলকাতায় একটি আস্ত হাট বসে যাবে, এ কথা বিশ্বাস হয় না৷ আবার ‘গরান’ কোনো ব্যক্তি-বিশেষের নাম বলেও মনে হচ্ছে না, গোরা বা ‘গোরান’ হলে কথা ছিল৷ ঢাকার খিলগাঁও জেলায় দক্ষিণ গড়ান নামে একটি জায়গা আছে। কলকাতার এই অঞ্চলেও যে একটি গড়ান বা ঢাল ছিল, আর তার উপরেই গড়ে উঠেছিল একটি হাট, সেটা অনুমান করা যেতেই পারে। মনে একটি সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে, ‘গরানহাটা’ নামটি অন্য কোনো নামের অপভ্রংশ নয় তো?
গরানহাটা অঞ্চলটির ভূগোল-ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, এই অঞ্চলে বটতলাসাহিত্য তার ডানা মেলেছিল৷ বস্তুত শোভাবাজারসন্নিহিত বটতলার সঙ্গে সঙ্গে গরানহাটার চৌরাস্তাও বটতলাসাহিত্যের বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল৷ মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ও প্রাথমিক বিকাশ, লিথো ফটোগ্রাফ, কাঠখোদাই সবই সমানে চলত গরানহাটায়৷ গহনাশিল্প তুলনায় নবীনতর৷ গরানহাটায় বহুযুগ ধরেই রমরম করে চলছে বড়োবড়ো মাংসবিপণি৷ বস্তুতপক্ষে, রেওয়াজি খাসির মাংস গরানহাটায় এখনও অতি উত্তম মেলে, দামও বেশি৷
এ বঙ্গে মাটন বলতে এখন আমরা পাঁঠার মাংস বুঝলেও, আগে মাটন বলতে বোঝানো হত ভেড়ার মাংসকে৷ মোগল ও ইংরেজরা খাসির মাংস যে পছন্দ করত না, বলাই বাহুল্য৷ উভয়ের কাছে পরম তৃপ্তিকর ছিল ভেড়ার মাংস৷ দু-তিন শতাব্দী ধরে গরানহাটার মাংসের দোকানগুলো চলছে৷ ভেড়ার ভালো নাম মেষ হলেও, প্রাচীন বাংলা ভাষায় ‘গড়ের’ বলা হত ভেড়াকে৷ সংস্কৃত ‘গড্ডর’ শব্দ থেকে এসেছে এই ‘গড়ের’৷ কলকাতায় ভেড়ার বিকিকিনির জন্যে গড়ের হাটও ছিল এবং আজও আছে৷
‘গড়েরহাটা’ই অপভ্রংশে ‘গরেড়হাটা’ হয়৷ তারপর ‘গরেনহাটা’ হয়ে গরানহাটায় উপনীত হয়৷
এর স্বপক্ষে আরও তথ্য আছে৷ গরানহাটী ধুতির আর-এক নাম গড়েনহাটী বা গরেনহাটী ধুতি৷ এটি বিশেষ ধরনের খাটো ধুতি৷ গড়েনহাটী ধুতি আজকাল কেউ পরে কিনা জানি না, তবে গড়েনহাটী যে ‘গড়েরহাটী’ নামেরই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়৷ গরানহাটায় যে এক সময় ভেড়া (সঙ্গে অন্য পশুও) বিক্রি হত, তার পারিপার্শ্বিক প্রমাণ আরও আছে৷ গরানহাটার একপাশে চিৎপুর, অন্যপাশে সোনাগাছি৷ ভেড়ার ছেঁটে ফেলা লোম বা পশম থেকে পরচুলো বা উইগ তৈরি হত৷ এর ব্যবসা জমজমাট হল পাশের চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায়৷ সোনাগাছির সনপাটের আঁশ থেকেও তন্তুজ উইগ হত, এখনও হয়৷ ভেড়া ও অন্যান্য পশু বাঁধার জন্যে সনের মজবুত দড়িও মিলত সোনাগাছিতে৷ চিৎপুরের যাত্রাশিল্প গরানহাটার গড়ের হাট তথা ভেড়ার হাটের কাছে ঋণী৷ কুমোরটুলির প্রতিমার কাঠামো বাঁধার সময় সরু সনদাড়ি পাওয়া যেত সোনাগাছি থেকে৷ পুজোয় সোনাগাছির মাটি এখনও লাগে৷ গরানহাটার পেল্লাই পেল্লাই মাংসের দোকানের পাশ দিয়ে ঘ্রাণ নিতে নিতে হাঁটলে বোঝা যাবে, দেড়শো-দুশো বছর আগে রেওয়াজি খাসির পাশে লোভনীয় ভেড়ার মাংসও ঝুলত৷ প্রসঙ্গত, পূর্ণবয়স্ক ভেড়ার মাংসকে মাটন বলে ও কচি নধর মেষ-মাংসকে বলে ল্যাম্ব (Lamb)৷ মাটনই বলুন আর ল্যাম্বই বলুন, কেনার জন্যে কিউ পড়ত লম্বা৷
আসলে ‘গড়ের’ শব্দটি বাঙালিকে বহু বছর ধরেই লেজে খেলাচ্ছে৷ গড়ের মাঠ যে ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার প্রতিষ্ঠার আগেই ছিল, তা প্রমাণিত৷ বস্তুত আবহমানকাল ধরেই এখানে মেষ চরছে৷ তেমনি গড়েরহাট মেটিয়াবুরুজের দিকে এখনও একটি আছে৷ যেমন ছিল ‘গরানহাটা’য়৷ গরানহাটী যে দু-তিনশো বছর আগে ‘গড়েরহাটী’ ছিল তা একপ্রকার নিশ্চিত৷ গরানহাটাও তিন-চারশো বছর আগে ছিল গড়েরহাট৷ গরান বৃক্ষের থিয়োরি বাতিল করায় পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ক্ষুন্ন হবেন না যেন।
গরানহাটার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্কুলজীবন শুরু করেছিলেন বলে জানা যায় তাঁর লেখা জীবনস্মৃতি বই থেকে। তবে পরবর্তীকালের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে কবিগুরুর প্রথম স্কুল ছিল ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি। প্রশান্তকুমার পাল তাঁর লেখা ‘রবিজীবনী’ গ্রন্থে এই তথ্য দিয়েছেন।