শনিবার | ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:০৮
Logo
এই মুহূর্তে ::
সৌরভ হোসেন-এর ছোটগল্প ‘সালাম’ বঙ্গের শক্তি-পূজা : সুখেন্দু হীরা পুজোর পরিবর্তন, পরিবর্তনের পুজো : সন্দীপন বিশ্বাস পিতৃপক্ষের মধ্যে পালিত একাদশী — ইন্দিরা একাদশী : রিঙ্কি সামন্ত অরণ্যের অন্তরালে তাম্বদি সূরলা : নন্দিনী অধিকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেন : রিঙ্কি সামন্ত বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র, পূর্ব পুরুষের ভিটে আজও অবহেলিত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (সপ্তম পর্ব) : বিজয়া দেব সুধীর চক্রবর্তী স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার : দীপাঞ্জন দে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েকে দুর্গা রূপে আরাধনা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালির নিজস্ব দুর্গা : শৌনক দত্ত সে নারী বিচিত্র বেশে মৃদু হেসে খুলিয়াছে দ্বার : দিলীপ মজুমদার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটগল্প ‘প্রাতঃভ্রমণ’ বন্যায় পুনর্জীবন বেহুলার : রিঙ্কি সামন্ত গরানহাটা কি ছিল ভেড়ার হাট : অসিত দাস ডিভিসি-র ছাড়া জলে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ নাজেহাল, দায় কার : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সুধীর চক্রবর্তী মুক্তধারা ভাষণমালা : দীপাঞ্জন দে বোর্হেসের গোলকধাঁধা : অশ্রুকুমার সিকদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের দুর্গোৎসব : রিঙ্কি সামন্ত মর্ত্যে দুর্গাপূজার সেকাল ও একাল : অসিত দাস বই-বাই : নবনীতা দেব সেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘প্রবাসী’ ম্যান মেড নয় ডিভিসি-র পরিকল্পনা আর রূপায়নে গলদ : তপন মল্লিক চৌধুরী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে রাখাইনে সেইফ জোন তৈরি করা আবশ্যক : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন ফলের নামটি পাকা কলা : রিঙ্কি সামন্ত বই-বাই : নবনীতা দেব সেন হেমচন্দ্র বাগচীর ১২০তম জন্মবর্ষ : দীপাঞ্জন দে নিম্ন চাপের অতিবৃষ্টি ও ডিভিসির ছাড়া জলে প্লাবিত আরামবাগ : দেবাশিস শেঠ আরামবাগে ভয়াবহ বন্যা, দুর্যোগের পদধ্বনি, ক্ষোভ জনমানসে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মেয়েদের ক্ষমতায়নের পক্ষেও আওয়াজ তুলেছে : তপন মল্লিক চৌধুরী
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র, পূর্ব পুরুষের ভিটে আজও অবহেলিত : মোহন গঙ্গোপাধ্যায়

মোহন গঙ্গোপাধ্যায় / ৩৩ জন পড়েছেন
আপডেট বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আজ ২৬ সেপ্টেম্বর। বাঙালির ‘বর্ণপরিচয়’ যাঁর হাত ধরে উত্থান, সেই মনীষিকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর দিন। বাঙালির এই মনীষিকে ঘিরে উৎসবের দিন, আবার গর্বের দিনও বটে। আমাদের কাছে তিনি বিদ্যাসাগর, আবার দয়ার সাগরও বটে। কিন্তু বাঙালির কাছে বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র। প্রাতিষ্ঠানিক উপাধি কী ভাবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য তিনি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’-এর জায়গায় ‘শর্ম্মা’ বা ‘শৰ্ম্মণঃ’ লিখতেন। তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি শুধু তাঁর কৌলিক উপাধিই শুধু নয়, নামটিকে পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর গুণমুগ্ধবন্ধুকে নিয়ে যে সকল চিঠি লিখেছিলেন তা শুধু মুগ্ধতাই বয়ে আনে না, বহুরূপী ঈশ্বরচন্দ্রকে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে। সেখানেই ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগর হওয়ার পাশাপাশি ‘করুণাসাগর’ হওয়ার হদিস মেলে। তবে আম বাঙালির ‘দয়ার সাগর’ বিশেষণে সুবাসিত হলেও তা বিদ্যাসাগরের মতো তা বিশেষ্য হতে পারেনি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র (১৮৬৬) দু’টি সনেট ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে লেখা। প্রথমটিতে (‘বঙ্গদেশে এক মান্য বন্ধুর উপলক্ষে’) যাও-বা উহ্য ছিল, পরেরটিতে (‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’) তা শিরোনামে প্রকট হয়ে উঠেছে। মধু কবির মূল্যায়নেই ঈশ্বরচন্দ্রের বহুমুখী পরিচয়ের নিদান বর্তমান। ‘সমকালের সেরা ব্যক্তি’, ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘প্রাচীন মুনিঋষির মতো প্রজ্ঞা ও জ্ঞান’, ‘ইংরেজের মননশক্তি ও বাঙালি নারীর হৃদয়ের নিদান বর্তমান।’ ঈশ্বরচন্দ্রের বহুধা ব্যাপ্ত ব্যক্তিত্বের পরিচয় উঠে এলেও সবগুলিই সমুদ্রগামী নদীর মতো বিদ্যাসাগরে মিলিত হয়েছে।

১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বীরশালিঙ্গম পান্তলু ‘সোসাইটি ফর সোশ্যাল রিফর্ম’ গড়ে তুলে তেলুগুভাষী অঞ্চলে বিধবা বিবাহের জন্য আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে ‘দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর’ বলে অভিহিত করা হয়। সে দিক থেকেও ঈশ্বরচন্দ্রকে পিছনে ফেলে বিদ্যাসাগরের খ্যাতি প্রশস্ত হয়ে ওঠে। তাঁর বিদ্যাসাগরীয় পরিচয় সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র শুধু আত্মসচেতনই ছিলেন না, তাকে মান্যতা দিয়েই জীবনের উপান্তে এসে আত্মজীবনী শুরু করেছিলেন। ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ (১৮৯১) এর সূচনাবাক্যে ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন, ‘শকাব্দঃ ১৭৪২, ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার, দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হয়।’ অবশ্য তখনও বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়নি। তার জন্য ১৯ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৮৩৯-এ সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময় হিন্দু-ল কমিটির পরীক্ষায় সাফল্যের মাধ্যমে তাঁর বিদ্যাসাগরে নবজন্ম লাভ হয়। অন্য দিকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পরে ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ নামেই দু’টি প্রবন্ধ লিখেছেন। অবশ্য সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্রের চরিত্রের মধ্যে দয়া ও বিদ্যার পরিবর্তে ‘অজেয় পৌরুষ’ ও ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’কে প্রধান গৌরব বলে অভিহিত করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র মূলত সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শনের অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের প্রশংসা পত্র পেয়েছিলেন। সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করার অব্যবহিত পরিসরে মাত্র একুশ বছর বয়সে যখন তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনার জীবন শুরু করেন, তখনও তাঁর ভাল করে ইংরেজি শেখাই হয়নি। বন্ধুবর আনন্দকৃষ্ণ বসুর কাছে তিনি ইংরেজি শিখেছিলেন। সংস্কৃতে তাঁর অসামান্য অধিকার যেমন তাঁকে শাস্ত্রীয় পরিসরে বিধবাবিবাহ থেকে বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহের আয়ুধ সংগ্রহে সাহায্য করেছিল, তেমনই ভাল ভাবে ইংরেজি জানার দৌলতে শিক্ষাবিস্তারের পথ সুগম হয়ে উঠেছিল।

অন্য দিকে, ঈশ্বরচন্দ্র অঙ্কও শিখতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য তিনি সেই চেষ্টা থামিয়ে দেন। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর জ্ঞানের চেয়ে কাণ্ডজ্ঞানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, শিক্ষাবিস্তার থেকে সমাজসংস্কার সবেতেই সেই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় বর্তমান। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে (১৮৫৬) সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাফল্য তাঁকে যে বিপুল জনপ্রিয়তা প্রদান করে, তাতে তাঁর বিদ্যাসাগরীয় পরিচয় আরও তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। ঈশ্বরচন্দ্র বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য সর্ব ভারতীয় পরিচিতি লাভ করেন। উনিশ শতকে তাঁকে নিয়ে গান বাঁধা হয়েছিল। শান্তিপুরের তাঁতিদের কাপড়ে বিদ্যাসাগর নাম উঠে এসেছে। একপলক দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব জনতা রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছে। অথচ তাঁকে দেখে নিরাশ হয়েছে। দৃষ্টিনন্দনযোগ্য চেহারা দেখে নিরাশ হয়েছে। দৃষ্টিনন্দনযোগ্য চেহারা তাঁর ছিল না। আসলে মূর্তিকে প্রতিমা গড়ে তোলাতে ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন বিমুখ। এ জন্য রেলি ব্রাদার্সের একখানি কাপড়কে ফেঁড়ে একখণ্ড পরতেন আর একখণ্ড গায়ে দিতেন। পায়ে থাকত দেশি মুচির শুঁড়তোলা চটিজুতো। শুধু তাই নয়, তাঁর সামনের চুল অবাঙালিসুলভ ছাঁটা।

রামমোহন রায় ১৮২৯-এ সতীদাহ প্রথা রদ করে যে সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র তার পরিসমাপ্তির দায়ভার নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন। সতীদাহ রোধে জীবন বাঁচলেও মনে আর মানে বাঁচা দায় হয়ে উঠেছিল বিধবাদের। সে ক্ষেত্রে, ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে সেই বিধবাদের চোখের জল মোচনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাঁদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বহুবিবাহ রোধ থেকে বাল্যবিবাহের প্রতিরোধেও শামিল হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, নারীশিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে মেয়েদের স্বনির্ভর নারীশিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলা ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ঈশ্বরচন্দ্রের লক্ষ্যেই ছিল দেশের মানুষের সার্বিক প্রগতি। স্বেচ্ছায় পারিবারিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্রমশ আত্মীয়পরিজনহীন নিঃসঙ্গতার মধ্যেও আজীবন জনবিচ্ছিন্ন হননি। মানসিক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তিক্ততাবোধে তাঁর জীবনের সেরা কাজ বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য একবার সখেদে বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন মাত্র, কিন্তু তা থেকে সরে থাকেননি। স্বনামধন্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্রের সুহৃদ ছিলেন। বারবার প্রতারিত হওয়ার পরে সেই পরম সুহৃদকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।’বলা বাহুল্য, ঈশ্বরচন্দ্র সেই নিঃসঙ্গ জীবনের অন্তিম পর্যায়ে কলকাতা ছেড়ে সুদূর কার্মাটাড়ে গিয়েও তাঁর স্বধর্মে সক্রিয় থেকেছেন। তাঁর প্রত্যাশাহীন দানধ্যান নিয়ে উপকার করলে অপকার পাওয়ার কিংবদন্তী ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ সেই ‘অসার ও অপদার্থ’ লোকজনের প্রতি তার পরেও অবিচল ভাবে সক্রিয় থেকেছে তাঁর সাহায্যের হাত। অন্য দিকে, ঈশ্বরচন্দ্র জানতেন সাগরের জলের মতোই বিরূপ সমালোচনাও স্বাভাবিক, কিন্তু সেটাই সব নয়। তা পানের অযোগ হলেও তাই আবার বাষ্পায়িত হয়ে পানীয় জলের উৎস হয়ে ওঠে, দাহিত হয়ে লবণ নিষ্কাশন করে। তিনি যে যথার্থই বিদ্যাসাগর। সে দিক থেকে বিদ্যাশিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র যে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষিতের অবিকল্প প্রতিভূ, তা তাঁর বিদ্যাসাগরেই প্রতীয়মান। এরকম মহান ব্যক্তিত্ব ও মনীষির জন্য শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে ওঠে মস্তক।

এত কিছুর পরেও কোথায় যেন তাঁর মর্যাদা টিকিয়ে রাখার অভাব বোধ করি। প্রশাসন, রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিদ্যাসাগরকে মর্যাদা দিতে অক্ষম বাঙালি সমাজ। তা নাহলে তাঁর আরামবাগের বনমালীপুরে পিতৃপুরুষের ভিটে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবহেলিত।

উল্লেখ করা যেতে পারে, বনমালীপুরে বিদ্যাসাগরের পূর্বপুরুষদের ভিটেটা এখনও টিকে আছে। পরিবারের উত্তর পুরুষরাও আছেন। কিন্তু স্মৃতিবিজড়িত সেই ঘর আর নেই। সেখানে বসানো হয়েছে আবক্ষ মূর্তি। এ পর্যন্তই। কালের করাল গ্রাসে আজ সবই শেষ। সংরক্ষণ বা সংস্কার না করায় সবই ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। লোহার বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে মূর্তিটিকে। মাথায় ঝোলানো আছে একটি ইলেকট্রিক ল্যাম্প। এখানেই শেষ। শ্রদ্ধা অর্পণ কেবল ২৬ সেপ্টেম্বর। এভাবেই বিদ্যাসাগরকে মনে রেখেছে আরামবাগের বনমালীপুর গ্রামের বাসিন্দারা। এখানকার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারকে সকলেই এক ডাকে চেনে। কারণ, একটাই। এই বংশেই জন্মেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যদিও তিনি জন্মগ্রহণ করেন মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে। কিন্তু পূর্বপুরুষরা কাটিয়েছেন এই বনমালীপুরেই। পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ সকলেই এই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। এখনও সেই বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার আছে। আছে চার ঘর। এই বাড়িতে যদিও ঠাকুরদাস খুব অল্প দিনই ছিলেন। তবে পরে ছেলে ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে এখানে এসেছেন। বিদ্যাসাগরও দেখেছেন এখানকার গ্রামের মানুষদের। দুঃস্থ লোকেদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কম্বল বিতরণ করেছেন শিবু, শঙ্কর, তারাপদ দলুইদের। জায়গাটিকে এখনও কম্বলতলা বলে অনেকেই ডাকেন। শিক্ষার আলো দেখাতে এখানে একটি বিদ্যালয়ও গাড়েছিলেন তিনি। আজ সবই ইতিহাস। মানুষ মনে রাখলেও তাঁর পিতার ভিটেয় আজও পর্যন্ত কোনও সরকারি বা বেসরকারি ভাবে সংস্কার বা সংরক্ষণ কিম্বা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায় কিনা তা তেমনভাবে ভেবে দেখা হচ্ছে না। ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যাবে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অনেক তথ্য। বিদ্যাসাগরের পূর্বপুরুষরা কেন এখান থেকে চলে গেলেন?

তবে অনেক বদনাম নিয়েই তাঁরা চলে গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার বংশপরম্পরায় বনমালীপুরের বাসিন্দা। এই বংশেরই একজন ধর্মনিষ্ঠ ও সৎ ব্রাহ্মণ ছিলেন ভুবনেশ্বর বিদ্যালঙ্কার। তাঁর পাঁচ ছেলে। নৃসিংহরাম, গঙ্গাধর, রামজয়, পঞ্চানন ও রামচরণ। সকলে একসঙ্গে বাস করতেন। কিন্তু নৃসিংহরাম ও গঙ্গাধর সংসারের সমস্ত কার্যভার গ্রহণ করেন। কিন্তু অতি সামান্য সামান্য বিষয়ে নিয়ে ঘরে অশান্তি করতেন। এটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি বিদ্যাসাগরের পিতামহ রামজয়। তিনি নিতান্ত নিরুপায় হয়ে শেষে দুই ছেলে ঠাকুরদাস ও কালিদাস, চার মেয়ে মঙ্গলা, কমলা, গোবিন্দমণি ও অন্নপূর্ণা এবং স্ত্রী দুর্গাদেবীকে রেখে সকলের অজ্ঞাতসারে দেশত্যাগ করলেন। দুর্গাদেবী সংসারের অশান্তি ভোগ করতে না পেরে শেষে তিতিবিরক্ত হয়ে দুই ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে বীরসিংহ গ্রামে বাপের বাড়িতে চলে যান। বাবা ছিলেন এই গ্রামের একজন বিখ্যাত পণ্ডিত। নাম উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত। বাবার কাছেই রয়ে গেলেন দুর্গাদেবী। রামজয় তর্কভূষণ অবশ্য পরে বনমালীপুরে ফিরে আসেন। স্ত্রী দুর্গাদেবীকে দেখতে না পেয়ে খোঁজ করতে যান বীরসিংহে। দুর্গাদেবীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি নারাজ হন। এর পর থেকে রামজয়ও সেখানে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থেকে যান। ঠাকুরদাস বনমালীপুরে এখানকারই পাঠশালায় পড়তে যেতেন। পরে বিয়ে হয় ভগবতীর সঙ্গে। যদিও ভগবতী পাতুলের মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। অনেক তথ্য আজও লুকিয়ে আছে এখানে। কান পাতলেই তা শোনা যাবে। এখানকার পারিবারিক ঐতিহ্যকে বজায় রেখে চলেছেন অশোক, অলোক, সমীর, বন্দ্যোপাধ্যায়েরা।

প্রসঙ্গত, বনমালীপুর আজও অবহেলিত। পর্যটকদের মানচিত্রে এখনও জায়গা করে নিতে পারেনি সরকারিভাবে । তেমন সাড়া মেলেনি কোনও বেসরকারি উদ্যোগেও। আরামবাগের এস ডি ও-কে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বনমালীপুরের ভিটেয় বিদ্যাসাগরের মূর্তি বসানো হয়েছে। জন্মদিন পালন করা হয়। তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে বনমালীপুরে বন্দ্যোপাধ্যায়দের ভিটের অর্ধশতক জায়গা নেওয়া হয়েছে। ওই জায়গাতে ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের আবক্ষমূর্তির উন্মোচন হয়। প্রতিবছর নিয়ম করে জন্মদিন পালন করা হয়। তাছাড়া পাশেই খেলার মাঠে বিদ্যাসাগর মেলা হয়ে থাকে। ভিটে পর্যন্ত মোরাম রাস্তা তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনায় আছে অনেক কিছু। অর্থের অভাবে কোনো কিছুই করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা। তাছাড়া মুক্তমঞ্চ, বয়স্ক স্বাক্ষর কেন্দ্র, গড়ে তোলার পরিকল্পনাও আছে। জায়গাটি মনোরম পরিবেশের জন্য চিন্তাভাবনা চলছে। তাছাড়া ব্যাপারটা এখন পঞ্চায়েত সমিতি দেখছে। পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ আশ্বাস দেন সবই হবে। কিন্তু বাস্তবে রূপদান আজও দূর অস্ত। স্থানীয় প্রবীণদের আক্ষেপ, বনমালীপুরকে আরামবাগের অনেক লোকই চেনে না, জানে না। কেন, কী জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম তা সকলের কাছে অজ্ঞাতই থেকেই যাবে। যতক্ষণ না একে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা যায়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন