৩রা ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয় পাকিস্তান। মনে পড়ে, ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের এই আক্রমণের কথা উল্লেখ করে ভারতজুড়ে যুদ্ধাবস্থার ঘোষণা দেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তখন দ্বারপ্রান্তে। ৬ই ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরদিন স্বীকৃতি দেয় ভুটান। আমি কলকাতা থেকে ঢাকা আসি জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। কিন্তু তার আগেই কলকাতা থেকে একটি মাইক্রোবাস নিয়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, নিরঞ্জন হালদার ও আমি ভোমরা হয়ে সাতক্ষীরা এসেছিলাম। সাতক্ষীরা তখন মুক্ত এলাকা। পাকিস্তানিদের এর আগেই সেখানে পতন হয়। ১৬ই ডিসেম্বরের আগেই আমি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করতে পেরেছিলাম—এ আমার পরম সৌভাগ্য। ভাবতেই গর্বে বুক ভরে ওঠে। বাংলাদেশের বিজয় সূচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইয়াইয়া খান প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ২০ শে ডিসেম্বর ভুট্টো প্রেসিডেন্ট হন। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে চাপ দিয়েও একচুলও টলাতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি না দিয়ে তখন তার উপায় ছিল না। ৭ই জানুয়ারি ভোর রাতে, ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে ৮ই জানুয়ারি ভোরবেলা ভুট্টো তাঁকে বিমানে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। ১০ তারিখ সকালে বঙ্গবন্ধু এসে নামেন দিল্লিতে। রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সকল সদস্য, প্রধান নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনীর প্রধান ও বিশিষ্ট নাগরিকদের কাছ থেকে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ করেন। ওইদিন অপরাহ্নেই তিনি ঢাকা পৌঁছান। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি আমি নিজের চোখে দেখতে পারিনি। আমি তখনো কলকাতায়। ফিরে আসি ১৮ তারিখে। কলকাতায় বসেও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই আনন্দ ও উত্তেজনা অনুভব করেছি। কলকাতায় লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে দেখার জন্য উদগ্রীব ছিল। বঙ্গবন্ধু আসছেন শুনে মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার। খবরের কাগজগুলোতে বড় বড় হেডিং, আকাশবাণীর খবর ও সংবাদ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর বন্দনা। কলাকাতায় রাস্তায় রাস্তায় মানুষের একমাত্র আলোচনা বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু। আমি নিজে তখন কলকাতা ছিলাম জন্যই মানুষের এই আবেগ ও ভালোবাসা কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি।
এবার দেশে ফেরার পালা। মন ব্যাকুল হয়ে আছে। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে মা-বাবা দেশের পথে রওনা হয়েছে শুনেছি। তারা কোথায় গিয়ে উঠবে, কোথায় থাকবে, কিছুই জানি না। পরে জানতে পারি গ্রামের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারাই তাদের সব ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়। ঢাকা পৌঁছে বন্ধুবান্ধবদের দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে পড়ে। কে কেমন আছে, কোথায় আছে কিছুই জানি না। কত মানুষ দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, কত নারী-শিশু বর্বরতার নির্মম শিকার হয়েছে। কত মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে। এয়ারপোর্টে নামতেই চোখ জলে ভিজে ওঠে। সেইসঙ্গে বুকে জাগে দেশের মাটি স্পর্শ করার আনন্দ শিহরণ। সেই অনুভূতির কথা বলে বোঝানো যাবে না। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে যাই প্রেসক্লাবে। মনে মনে চিন্তা করি সেখানে সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, পাশেই তাজুলেরও অফিস। তখন প্রেসক্লাবে যাঁরা ছিলেন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ পরেই চলে যাই পূর্বদেশ অফিসে। সেখানেই প্রায় সারাদিন কাটাই। পূর্বদেশ-এর সম্পাদক তখন এহতেশাম হায়দার চৌধুরী। সাহিত্য সম্পাদক আ ন ম গোলাম মোস্তফা পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর দোসরদের হাতে নিহত হয়েছেন। সন্ধ্যার কিছু আগেই তাজুলের সঙ্গে ওর মগবাজারের বাসায় যাই। ঢাকা তখনো ভীতি ও আতঙ্কের শহর। দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার শত্রুরা তখনো সক্রিয়, তারা নানাভাবে ষড়যন্ত্র করছে। চলাফেরা খুব নিরাপদ নয়। কত বন্ধু-পরিচিতজন বর্বরদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। সেকথা ভাবতেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। গ্রামে মা-বাবা কী অবস্থায় আছে কিছুই জানি না। ঢাকা কয়েকদিন থেকে গ্রামে চলে যাই, সেখানে গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা নতুন করে আমাদের ঘরবাড়ি তৈরির কাজে সহযোগিতা করে। কোনোমতে মাথা গোঁজার মতো ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিই। বোধহয় সপ্তাহখানেক পর আবার ঢাকায় ফিরে আসি।
ঢাকা তখন শোকে স্তব্ধ, কত প্রিয়জন, কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দীন হোসেন, এমনি কত কৃতী মানুষ। কতজনের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কতজনকে আর কোথাও খুঁজে পাব না—এসব ভাবতেই মন কেমন করে ওঠে। জানি না, ঢাকা কবে আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, কান্নায় বিষাদে তখনো ঢাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে। দেশজুড়ে তখন স্বজন হারানোর বেদনা। ঢাকার সেই মেসবাড়িটি উঠে গেছে। তারা কে কোথায় জানি না। আজিমপুরের সেই বাড়িটিতে আমার বইপত্র সব সযত্নে রক্ষা করেছেন ওই বাড়ির মালিকেরা। আমার সঙ্গে দেখা হতেই তাঁরা খুব খুশি হলেন। তাঁদের কাছেই শুনতে পেলম পাশেই চায়না বিল্ডিংয়ের গলিতে ‘রংপুর হাউস’-এ এই মেসে যারা ছিল তারা কয়েকজন মিলে একটি মেস করে আছে। সেখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। মেসের পুরনো বন্ধুরা আমার জন্য একটি রুম রেখে দিয়েছে। এই মেসে এসে উঠলাম। পাশেই চায়না বিল্ডিং, সবাই চায়না বিল্ডিং বললেই চেনে। সব এলোমেলো হয়ে গেছে—মেস, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, অফিস আর প্রেসক্লাব। কোথাও খুব যাই না। ধীরে ধীরে পুরনো বন্ধু ও পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, সবখানে কেমন ভীতি ও আতঙ্ক। স্বাধীনতার শত্রুরা নানা চক্রান্ত করে চলছে। বেশির ভাগ সময় অফিসেই কাটাই। পূর্বদেশে আমাদের সঙ্গে তখন যোগ দিয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীন। প্রগতিশীল চিন্তা ও মুক্তমনের মানুষ। পূর্বদেশের সম্পাদকীয় বিভাগে তখন আরো আছেন রেজাউর রহমান ও সালাহউদ্দিন চৌধুরী। কোনো কোনোদিন অফিস থেকে শামসুর রাহমানের কাছে যাই। তিনি আমাকে বেশ পছন্দও করেন। সেখানে হাসান ভাইয়ের সঙ্গেও দেখা হয়। দুজনই আমার প্রিয় মানুষ। [সমাপ্ত]