রাজশাহী থেকে ঢাকা এসেছি, বুক কেমন দুরু দুরু করছে। হলভর্তি মানুষ, সেসময়ের তরুণ কবি-লেখকেরা প্রায় সকলেই। আমি প্রবন্ধ পড়লাম। সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী তাঁর অনবদ্য বক্তৃতায় সাহিত্য-শিল্প সম্পর্কে যেসব কথা বললেন, তাকে এককথায় বলা যায় অতুলনীয়। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি। একসময় তিনি আমার কথাও বললেন, আমার শব্দ ব্যবহারের প্রশংসা করে বললেন, আমি উজ্জ্বল না বলে দীপ্র বলি, এই ব্যতিক্রম তাঁর চোখ এড়ায়নি। মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার আগেই দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি রাজশাহী গিয়েছিলেন আমাদের মৌখিক পরীক্ষার পরীক্ষক হয়ে।
আমাকে বললেন, বলো ‘আর পাব কোথা/দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’, এটি কোন কবিতা? আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথের ‘বৈষ্ণব’ কবিতা। মনে আছে কোন কাব্যগ্রন্থে? বললাম, ‘সোনার তরী’। স্যার খুব খুশি হলেন। বললেন, ভালো, খুব ভালো। বুঝতে পারছি, তুমি পারবে। সেই মুনীর স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে প্রবন্ধ পড়লাম, আমি কীইবা জানি, কীই বা লিখতে পারি। সেসময় অবজারভার পত্রিকার সাহিত্য ম্যাগাজিনের সম্পাদক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। পরদিন অবজারভার আফিসে গেলাম জ্যোতিদার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর সঙ্গে বগুড়ায়ই আমার পরিচয় হয়েছিল। জ্যোতিদা বললেন, অবজারভার হাউস থেকে একটি বাংলা দৈনিক বেরুচ্ছে, ‘পূর্বদেশ’। আবদুল গনি হাজারী তখন অবজারভারের ম্যানেজিং এডিটর। তাঁর সেসময়ের বিখ্যাত কবিতার বই ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’। পাবনার মানুষ। জ্যোতিদাই তাঁর কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন। হাজারী ভাই বললেন, অবজারভার হাউস থেকে একটি বাংলা পত্রিকা বেরুচ্ছে। একটা দরখাস্ত করে যাও। বলেই একখানা কাগজ এগিয়ে দিলেন। আমি তখন বাংলা একাডেমির বৃত্তি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করি। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন বাংলা একাডেমির ডিরেক্টর, তখন বাংলা উন্নয়ন বোর্ডও ছিল, বাংলা একাডেমি ও উন্নয়ন বোর্ড একত্রিত হয়নি। সেইসঙ্গে ইংরেজিও পড়ছি। ভাবলাম পড়ে গেলাম। হাজারী ভাই বললেন, কী এত ভাবছ, দরখাস্তটা করে যাও। পরে চিন্তাভাবনা করে ঠিক কোরো। আমি হাজারী ভাইয়ের টেবিলে বসেই একটা দরখাস্ত লিখে দিলাম। পাশেই ‘সমকাল’ অফিস। সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর। সেখানে দেখা হলো নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে। সন্ধ্যায় গেলাম নিউ মার্কেটে। সেখানে দেখা হলো সৈয়দ আকরম হোসেন, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসানের সঙ্গে। সঙ্গে ছিল মলয়, সে-ই পরিচয় করিয়ে দিল। সৈয়দ আকরম হোসেন তখন বোধহয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক।
রাজশাহী ফিরে নিজের কাজকর্মে ডুবে যাই। রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিতা নিয়ে গবেষণার কাজ, ইংরেজির ক্লাস। বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সেই দরখাস্তের কথা ভুলেই গেছি। হঠাত্ দেখি অবজারভার হাউস থেকে একটা চিঠি, মানে নিয়োগপত্র। পত্রিকায় সাব-এডিটরের কাজ। রাজশাহীতে আমাকে যাঁরা স্নেহ করেন তাঁরা সকলেই বললেন, না, এই চাকরিতে যাওয়া ঠিক হবে না। মুস্তাফা স্যার বললেন, জানিয়ে দাও সহকারী সম্পাদক হিসেবে নেওয়া হলে তুমি যাবে, নইলে না। আমি তা-ই করলাম। মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অবজারভার হাউস থেকে একখানা টেলিগ্রাম গিয়ে হাজির। তাতে লেখা, ‘ইওর আপয়েন্টমেন্ট অ্যাজ অ্যাসিসট্যান্ট এডিটর ফাইনালাইজড কাম শার্প।’ অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। আর কী করা; এবার ঢাকায় চলে আসার পালা।
ভাবলে কেমন অবাক হয়ে পড়ি, কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি আমি, একবার এখানে, একবার সেখানে। এ যেন কেবলই ভেসে চলা, ভাসতে ভাসতে কোথা থেকে কোথায় যাব, পথের শেষ কোথায়?
রাজশাহীর পাট চুকিয়ে ঢাকা রওনা হচ্ছি। এখনো মনে পড়ে, চলে আসার দিন রাজশাহী স্টেশনে বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের বিষণ্ন মুখ। হাফিজ ভাই, শেখ আতাউর রহমান, মহসীন রেজা, রুহুল আমিন প্রামাণিক, লতিফ, সাইফুল ইসলাম, মডার্ন প্রেসের আবদুর রশিদ খান। এত স্নেহ এত ভালোবাসা জীবনে সেও কি কম পাওয়া, সেই যে ‘দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি’। ঢাকা চলে এলাম, পেছনে পড়ে রইল রাজশাহী, মতিহার, পদ্মা। ঢাকা এসে উঠলাম এলিফ্যান্ট রোডের একটি মেসে। সায়ীদ ভাই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সেখানে থাকেন আবুল কাসেম ফজলুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শফি আহমদ। অধ্যাপক আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরীও থাকতেন এই মেসে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে চলে গেছেন। আমি এই খালি সিটটিতে থাকব। একটি কম বয়সী তরুণ ছিল মেসের বাবুর্চি। আমাদের রান্না করে দেয়। এরপর চলে যাই তোপখানা রোডে, অন্য একটি মেসে। সেখানে মলয় ভৌমিক থাকত। তাজুল, মলয় দুজনে আমাকে সেখানে নিয়ে যায়। দুজনই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এখানে কাশীনাথ রায়ও থাকত। এখান থেকে পূর্বদেশ অফিসও কাছে। উল্টো দিকেই প্রেসক্লাব। পূর্বদেশ বের হবে আগস্টে। তার আগেই এসে যোগ দিয়েছি। নতুন অফিস, নতুন চেয়ার-টেবিল, রুমভর্তি লোকজন, একেবারে গমগম করছে। অফিসে ঢুকে খুবই ভালো লাগল। বয়সও কম, যা দেখি তা-ই ভালো লাগে। নামকরা সাংবাদিকেরা পূর্বদেশে যোগ দিয়েছে। ‘আমাদের মুক্তি সংগ্রাম’-এর লেখক মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, কামাল লোহানী, জিয়াউল হক, সাহিত্য সম্পাদক আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শিশুকিশোর পাতা ‘চাঁদের হাট’-এর সম্পাদক রফিকুল হক। জেনারেল ম্যানেজার এম আর আখতার মুকুল। তিনি অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের ছোট ভাই। হিসাববিভাগের প্রধান দত্ত বাবু।
সম্পাদক মাহবুবুল হক। নতুন পত্রিকা বেরুচ্ছে। সবার মধ্যে উত্সাহ আর উদ্দীপনা। একেবারে জমে উঠেছে পূর্বদেশ অফিস। আমি তারই মধ্যে গিয়ে নতুন পত্রিকা অফিসটিতে যোগ দিলাম। নতুন পত্রিকা প্রকাশ একটা দারুণ উত্তেজনার ব্যাপার। আমার বয়সও কম, বোধহয় আমিই সর্বকনিষ্ঠ। সবাই স্নেহ করেন। রাজ্জাক ভাই আমাকে ডাকেন খোকন। ভালোই হলো, একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের সবটাই দেখা হচ্ছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বিখ্যাত কলাম ‘তৃতীয় মত’ বের হতে লাগল পূর্বদেশে। আবদুল গনি হাজারী লেখেন ‘কালো প্যাঁচার ডায়েরী’। তখন অবজারভারের বার্তা সম্পাদক কে জি মোস্তফা। সালাম সাহেব সম্পাদক। এবিএম মুসা পূর্বদেশে ‘বারোয়ারী’ নামে একটি কলাম লেখেন। ওবায়দুল হক সাহেবও কলাম লেখেন। এতসব বিখ্যাত সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করছি। আমি ‘মল্লিনাথ’ ছদ্মনামে ‘পাদটীকা’ নামে একটি কলাম লেখা শুরু করলাম।
রাস্তা পার হলেই সেইসময়ের ‘দৈনিক পাকিস্তান’ অফিস। বড় কবিরা এখানে কাজ করেন। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান সহকারী সম্পাদক। সাহিত্যে সম্পাদক আহসান হাবীব। ফজল শাহাবুদ্দিনও কাজ করেন। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন থেকে সায্যাদ কাদির আমাকে দৈনিক পাকিস্তান অফিসে নিয়ে যায়। সায্যাদই আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান ও ফজল শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এখানে আছেন আহমেদ হুমায়ুন, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহও। আমি পূর্বদেশে কাজ করি কিন্তু বেশির ভাগ সময় কাটাই শামসুর রাহমান ও হাসান হাফিজুর রহমানের রুমে, কবিদের সান্নিধ্যে। তাঁরা দুজনই এক রুমে বসেন। নির্মল, হাসান, হুমায়ুন কবির, সানাউল হক খান—এরাও আসে। এখানেই শহীদ কাদরীর সঙ্গে দেখা হয়। হাসান ভাই স্নেহপ্রবণ মানুষ, দেখা হতেই বুকে জড়িয়ে ধরতেন। সেই উষ্ণতা কি আর পাওয়া যাবে? হাসান ভাই খুব পান খেতেন, আমার কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে পান কিনতে চলে যেতেন রাস্তার ওপারে। কোনো কোনোদিন সমকাল অফিসে, কয়েক পা হেঁটে সমকাল অফিসেই আল মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকা এসেছি, মাঝে মাঝে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করি, মন খারাপ হয়ে যায়। এই রুক্ষ শহরে কিছুই ভালো লাগে না। অপরিচিত শহরে কোথাও একটু স্নেহ-ভালোবাসা পেলে কী যে ভালো লাগে। পূর্বদেশ অফিসেও সবাই স্নেহ করেন আমাকে। আমি কবিতা লিখি, কখন আসি কখন যাই এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না। প্রায় প্রতিদিন দুপুরেই আরামবাগে পাটোয়ারী ভাইয়ের বাসায় গাফ্ফার ভাই, রাজ্জাক ভাই ও আমি খেতে চলে যাই। সবার সেই স্নেহ-ভালোবাসা ভোলা যায় না। পাশেই ছিল ‘অতিথি’ নামে একটি চমত্কার রেস্টুরেন্ট। সেখানেও খেতে যেতাম আমরা। দুপুরের খাওয়া কখনোই আমরা কেউ আলাদা খেতাম না। সে এক সময় ছিল, এর মধ্য দিয়ে কবি হয়ে উঠছি। আ ন ম গোলাম মোস্তফাও সহূদয় মানুষ, কবিতার খুব অনুরাগী। দৈনিক পাকিস্তান অফিসে হাবীব ভাইও তরুণদের স্নেহ করতেন। ওই বয়সেই আমাদের লেখা কী যত্নেই না ছাপতেন তিনি। সমকালে গেলে জাফর ভাইয়ের স্নেহসন্নিধ্য, হাস্যরসিকতায় মন ভরে যেত। সত্যিকার অর্থেই সে ছিল কবিতায় মেতে থাকার জীবন। [ক্রমশ]