সেই কবে অচেনা নবকুমারকে এ প্রশ্ন করিয়াছিল অরণ্যবালিকা কপালকুণ্ডলা। অরণ্যের জটিল জটার জালে পথ হারাইয়াছিল নবকুমার। পথিকের পথ হারাইবার প্রশ্নটি উঠিয়াছে যুগে যুগে। নব যুগে জনারণ্যে পথ হারাইয়া ফেলে পথিক। বিমূঢ় বিভ্রান্ত হয়। পথ খুঁজিতে গিয়া আবার বিপথে যায়। পথ হারাইয়া নবকুমার কাপালিকের খপ্পরে পড়িয়াছিল। এ যুগের কাপালিক রাজনৈতিক নেতারা। পথ খুঁজিতে গিয়া পথিক তাঁহাদের খপ্পরে পড়ে। না, সে যুগের কাপালিকের মতো এ যুগের কাপালিকেরা হাড়িকাঠে নরবলি দেন না। তাঁহারা সম্মোহিত করিয়া ফেলেন পথিককে। মেঘমন্দ্র স্বরে পথিককে বলেন : মামেকং শরণং। আমাকে অনুসরণ কর, আমার কথামতো চল, আমিই তোমার ভাগ্য ও ভবিতব্য, আমি যা করি তা করো না-— শুধু আমি যা বলি তা শোনো।
সেকালের নবকুমারের মতো একালের আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারবাবুরাও জনারণ্যে পথ হারাইয়া ফেলিয়াছেন।
একটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধ্বনি উঠিল : বিচার চাই, বিচার চাই। ধর্ষিতা জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের সহপাঠিনী। তাঁহাদের মর্মে লাগিবে, ইহা স্বাভাবিক। তাহার পর কে বা কাহারা দিল রাত দখলের ডাক। সে ডাকে সাড়া মিলিল প্রচুর। জুনিয়রবাবুরা তাহা দেখিয়া উৎসাহিত হইলেন। স্বাভাবিক। তাঁহারা বৃ্হত্তর আন্দোলনের ডাক দিলেন।
ইতিমধ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বিচিত্র পালাবদল হইয়া গিয়াছে। রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘য পলায়তি স জীবতি’ নীতি অনুসরণ করিয়া পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় লইতে হইয়াছে। সেখানকার সেই ডাক ‘দাবি এক, দফা এক, পদত্যাগ পদত্যাগ’ আশা জাগাইয়াছে এখানকার বিরোধীদের বুকে। বৃথা আশা মর মর করে, তবু মরে না। তাঁহারা দেখিলেন জুনিয়রদের কাজে লাগানো যাইতে পারে। আরে, মাও-জে দঙ বলিয়াছেন না, ‘একটা স্ফুলিঙ্গ দাবানল সৃষ্টি করিতে পারে’। তাহা হইলে এই ধর্ষণ–খুন কেন দাবানল সৃষ্টি করিবে না? তাঁহাদের অমিত উৎসাহ জুনিয়রদের বুকেও আগুন জ্বালিল। কিন্তু তাঁহারা মনে রাখিলেন না যে পরিকল্পিত আন্দোলনটা রুটি-রুজির নহে। একটা খুন ও ধর্ষণ দীর্ঘস্থায়ী তরঙ্গ সৃষ্টি করিত পারে না। দেশব্যাপী প্রসারিত হইতেও পারে না। তবু আশা। আশায় চাষা বাঁচিলে আমরা পারিব না কেন?
কিন্তু একটা ভুল করিয়া বসিলেন তাঁহারা। যদি সব বিরোধীদের তাঁহারা কোলে তুলিয়া লইতেন, তাহা হইলে অন্য রকম হইত। কিন্তু তাঁহারা শুধু অগ্নি-উত্তরীয়দেরই প্রশ্রয় দিলেন। সৃষ্টি হইল বিভাজন, যাহার ফসল তোলা শাসকের পক্ষে সহজ হইয়া গেল। আরও একটা ভুল তাঁহারা করিলেন। গণমাধ্যমের বৃহৎ জগতকে প্রশ্রয় দিয়া। সেখানে রঞ্জিত, অতিরঞ্জিত নানা তথ্য ছড়াইতে শুরু করিয়াছিল। শুরু হইয়া গেল মিডিয়া ট্রায়াল। গল্পের গরুর গাছে উঠার মতো। তাঁহারা বুঝিয়াও বুঝিতে চাহিলেন না যে মিডিয়া হাউজ জনসেবা করিবার জন্য বিপণি খুলে নাই। বেওসা করিবার জন্যই খুলিয়াছে। যত টি.আর.পি বাড়িবে, ততই বেওসায় গতি আসিবে। আর টি.আর.পি বাড়াইতে হইলে নিত্য-নতুন মুখরোচক সন্দেশ চাই।
রাজ্যের শাসকদল যে প্রথমটা ঘাবড়াইয়া গিয়াছিল, সে ব্যাপারে সন্দেহ নাই। জুনিয়ররা দেখিলেন তাঁহাদের গরম গরম আচরণেও শাসক তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাইতেছে না।
ইহাকে দুর্বলতা বলিয়া ধরিয়া লইয়া জুনিয়ররা কর্মবিরতি, অনশন, এবং দাবির পর দাবি করিয়া যাইতে লাগিলেন। দ্রৌপদীর শাড়ির মতো সেসব দাবি ক্রমশ বর্ধিত হইতেছিল। এদিকে কালের গতিতে জনতার আবেগের স্রোত স্তিমিত হইতেছিল। জনগণের আন্দোলন হইতে ইহা নিছক জুনিয়রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে পর্যবসিত হইল। হইবারই কথা। এই আন্দোলন যদি লিঙ্গ-সাম্যের আন্দোলন হইত, নারী সুরক্ষার আন্দোলন হইত, জনস্বাস্থ্যের আন্দোলন হইত, তাহা হইলে তাহা নগরের ও মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করিয়া যাইত; পল্লিতে, জনজাতির মধ্যে, নিম্নবিত্তের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িত। শাসকের কাছে সত্যই এক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করিতে পারিত।
সংকীর্ণ স্বার্থের কথা ভাবিতে ছিলেন বলিয়া জুনিয়রবাবুরা ভুলের পর ভুল করিয়া গেলেন। মানুষ দেখিতে লাগিলেন কাহারও উপর তাঁহাদের আস্থা নাই। রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের উপর আস্থা নাই, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার উপর আস্থা নাই, সর্বোচ্চ আদালতের উপর আস্থা নাই। ইঁহাদের মনোমতো কথা যাঁহারা না বলিবেন। তাঁহাদের কাহারও উপর ইঁহাদের আস্থা নাই। তবে কি ইঁহারা নৈরাজ্যবাদী? না কি ইঁহারা পাগলা দাশু?
আবেগের স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিলেন বলিয়া ইঁহারা শাসকের শাঠ্য ও চাতুর্য অনুধাবন করিতে পারেন নাই। প্রথম কথা, শাসক জুনিয়রদের উপর পুলিশ লেলাইয়া দেন নাই, খেলিতে সময় দিয়াছেন। দ্বিতীয় কথা, বারংবার আলোচনার জন্য ডাকিয়াছেন, সদিচ্ছা থাকুক বা না থাকুক। তৃতীয় কথা, শাসকদলের প্রধান ছুটিয়া গিয়াছেন ধর্নামঞ্চে, আন্তরিকতা থাকুক বা না থাকুক। চতুর্থ কথা, জুনিয়র বনাম সিনিয়র, জুনিয়র বনাম জুনিয়র, সরকারি হাসপাতাল বনাম বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করিয়াছেন। একটির বদলে জুনিয়রদের তিনটি সংগঠন হইয়াছে। পদত্যাগের নাটক করিলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে কোন সিনিয়র পদত্যাগ করেন নাই। যে সব সিনিয়র জুনিয়রদের পক্ষ লইয়া গলা ফাটাইয়াছিলেন, তাঁহাদের কাহারও কাহারও কণ্ঠে নতুন সুরের রাগিনী বাজিতে শুরু করিয়াছে। এমন কি, ঘোলা জলে মাছ ধরিবার চেষ্টা যে বিরোধী দলটি করিয়াছিলেন, তাঁহারাও ক্রমশ নিরাপদ দূরত্বে সরিয়া যাইতেছেন। নির্যাতিতার পিতা-মাতাও এক্ষণে ঘটনাক্রম অনুধাবন করতঃ মনের সংকীর্ণতা দূরীভুত করিয়া গৈরিক নেতার আশ্রয় লইতে চান।
চতুর শাসক ইতিমধ্যে তাঁহাদের ঝুলি হইতে আরও তিনখানা শাণিত শর বাহির করিয়াছেন। প্রথম শর, সেই কাগজখানা যেখানে পোস্ট মর্টেমের ব্যাপারে জুনিয়রবাবুদের চারজন প্রতিনিধির সম্মতি-স্বাক্ষর আছে। দ্বিতীয় শর, কর্মবিরতিকালে ৫৭৩ জন জুনিয়রবাবুর বেসরকারি চিকিৎসালয়ের কর্মকাণ্ড। তৃতীয় শর, কর্মবিরতি চলাকালীন আন্দোলনকারী জুনিয়রদের বিপুল অর্থ (৪ কোটি) সংগ্রহ।
সত্যকে মানিয়া লইলে ভালো, না মানিলে ভবিষ্যতে মনস্তাপের সীমা থাকিবে না। সত্যটা এই যে জুনিয়রবাবুরা পথ হারাইয়া ফেলিয়াছেন। সম্মুখে অন্ধ তামসঘন ঘোর রজনী। তাই তাঁহাদের পক্ষে আর বলা সম্ভব হইবে না—পথে এবার নামো সাথী / পথেই হবে এ পথ চেনা। কারণ, পথটাই যে হারাইয়া গিয়াছে।
বেশ কিছু ডাক্তার পথিক প্রথম হইতেই পথ যাহাতে কিছুতেই চিনিয়া লওয়া নাযায় তাহার জন্য ফন্দিফিকির করিতেছিলেন। তাহারা সফল হইয়াছেন। তাহারা পথ হারাইয়া মহানন্দে সবাইকেই বেপথে চালাইতেছেন।
পথের ধারে বিচার ঘুমাইয়া আছে এই ভ্রমে সকলেই এখন পথ দেখিলেই ঐ তো বিচার ও তো বিচার করিতেছে। যাদের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হইতেছে তাহারা নিরুপায় হইয়া ভাবিতেছে হায়! এইজন্য পথে নামিয়া ছিলাম! পথ হাসিতেছে, আর ভাবিতেছে আমার উপর কম শহিদের রক্তের দাগ নাই। তোমরা কয় জনা রক্ত দিলে? শ্লোগান দিয়াই বিচারের সন্ধান চাও?
বিশ্লেষণ ভালো। লেখার ভঙ্গিমা খুবই আকর্ষণীয়। লেখার মধ্যে বেশকিছু বাক্য নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
যাইহোক, আন্দোলন শুরু হয়েছিল ধর্ষণ এবং খুনের বিষয়কে কেন্দ্র করে কিন্তু পরে আন্দোলন এগিয়ে গিয়েছিল স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অনাচার এবং ভয়ংকর দুর্নীতি যা চাপা দিতে পরিকল্পিত ধর্ষণ ও নৃশংস খুনের ঘটনা।
এই আন্দোলন সংকীর্ণ স্বার্থের আন্দোলন ছিল না, বৃহৎ জনস্বার্থের আন্দোলন ছিল।
আর আস্থা রাখার কি কোন বিশ্বস্ত জায়গা আছে!
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে কেউ কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক বা কর্মী হতে পারেন কিন্তু কেউ কখনো কোন গণআন্দোলনে যুক্ত ছিলেন বলে মনে হয় না। অবশ্য আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের যা বয়স তাতে এই সময়ে এদেশে কোন গণআন্দোলন কিছু গড়ে ওঠেনি( সত্যি কথা বলতে কি আমার দেশে সঠিক অর্থে সঠিক নেতৃত্বাধীন কোন গণআন্দোলনে কোন কালে কখনো গড়ে ওঠেনি। ) সুতরাং এই আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের সঠিক অর্থে গণআন্দোলন সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই, এঁদের আছে একটা চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আবেগ। সাধারণ মানুষ এঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারি ব্যবস্থার প্রতি নানা বিষয়ে অনাস্থায়। তাই এই আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা নৈরাজ্যবাদী বা পাগলা দাশু বলে মনে হয় না।
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের মূল উদ্দেশ্য সমগ্র সমাজ ব্যবস্থা বা শাসক বদল ছিল বলে মনে হয়নি।
শাসনযন্ত্র বা সমাজ বদলের জন্য যে ধরনের আন্দোলন হওয়া উচিত এ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি তেমন ছিল না। সমসাময়িক সময়ে প্রতিবেশী দেশে মূল যে কারণেই হোক প্রকাশ্যে একটা চূড়ান্ত গণবিক্ষোভের মধ্য দিয়ে শাসক পরিবর্তন হয়েছিল, তাই দেখে অনেকে হয়তো ভেবেছেন যে এই আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের উদ্দেশ্য ও বুঝি তাই। কিন্তু যুক্তি সহকারে আন্দোলনের গতি, প্রকৃতি, ধারা বিবেচনা করলে ভালোই বোঝা যায় যে জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ তা ছিল না। হয়তো কেউ জল ঘোলা করে বড় কোন মাছ পাবার আশা করলেও করতে পারেন। কিন্তু আন্দোলনকারী ডাক্তারবাবুরা জল ঘোলা করতে বা হতে দেননি।
পরবর্তীতে অনেক রকমের খেলা শুরু হয়েছে। আন্দোলনকারী ডাক্তারবাবুদের মধ্যে বিভাজন হয়েছে। চতুর শাসক নানা ধরনের “শাণিত শর” বার করছেন।
আন্দোলনের ঝাঁজ কমেছে।
সবকিছু এখন বিচারব্যবস্থার অধীনে।
আপনার বলিষ্ঠ লেখনী অনেকগুলি বিষয় আলোকপাত করেছে।প্রথম পঙক্তি তে উপস্থাপিত বক্তব্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করি।
কিন্তু পরবর্তী অংশে কিছু অতি সরলীকরণ হয়েছে বলে মনে হল। মনে রাখা ভালো বিষয়টি বিচারাধীন এবং কতিপয় ব্যক্তি যদি বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা হারিয়েও থাকেন আমাদের ধৈর্য্য ধরে রাখা উচিৎ।
সামাজিক সমস্যা গুলি হয়ত এক দিনে সমাধান হবে না, কিন্তু মনে রাখা দরকার যে ডাক্তার সন্দীপ ঘোষ এবং প্রাক্তন ও সি অভিজিৎ মন্ডল সি বি র হাতে বন্দি।সেক্ষেত্রে অতি সরলীকরণ হলে আমরাও মিডিয়া ট্রায়াল এর দোষে দোষী হব।
প্রবীরবাবু ও অভিজিৎবাবুকে ধন্যবাদ । আত্মপক্ষ সমর্থনে দু-একটি কথা । প্রথম কথা , আমি আলোচনায় আরোহী পদ্ধতি ( Inductive Method0 অবলম্বন করেছি । আগে থেকে কোন সিদ্ধান্ত করে তাকে উদাহরণ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করি নি ; যা করেছে বেশিরভাগ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ।
দ্বিতীয় কথা , প্রবীরবাবু দুচারটি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া দেখে তাঁর সিদ্ধান্ত গঠন করেছেন । আজকের তথ্য-বিপ্লবের যুগে cross reference ছাড়া সত্যে পৌঁছানো যায় না । তাছাড়া বেশ কিছু নতুন নথি বা দলিল সামনে এসেছে , যেগুলো ‘গদি মিডিয়া’ ( প্রবীরবাবুর দেখা মিডিয়া ) দেখাচ্ছে না । তৃতীয় কথা, খুন ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে কিভাবে কখন দুর্নীতির প্রশ্ন জড়িয়ে গেল , সেটার সময়কাল লক্ষ্য করলে একটা অভিপ্রায় বোঝা যায় । চতুর্থ কথা , অভিজিৎবাবু কোন কোন জায়গায় ‘অতি সরলীকরণ’ দেখলেন সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না ।