সেই সময় বাংলা সিনেমায় কমল মিত্র বা ছবি বিশ্বাস যখন মুখে পাইপ ঢুকিয়ে রেখে একটু বাঁকানো উচ্চারণে কথা বলতে বলতে অল্প পজ’এ দেশলাই জ্বালিয়ে পাইপ ধরাতেন — ক্ষণিকের মধ্যে রুপোলি পর্দা যেন ঝলমলিয়ে উঠতো তাদের সেই পৌরুষের দাপটে। সেই আমলে দাঁতে পাইপ চেপে ধরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ইংরিজিতে ঝড়ের বেগে কথা বললে তার বাজার দরই থাকতো আলাদা। দেশ বিদেশের রুপোলি পর্দায় কোথাও যেন পাইপ খাওয়ানোকে দেখা হতো পুরুষতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে।
মূলত স্বাধীনতার আগে এবং কিছু পরে আপিসগুলির বড়কর্তারা ছিল মূলত লালমুখো সাহেব। সেই সময় সেখানে নেটিভ ইন্ডিয়ানদের প্রবেশাধিকার তেমনভাবে মিলত না। সেইসময় সাহেবরা পাইপ কামড়ে রেখে ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে যত রকমের কথার ফোয়ারা ফোটাতো, তখন আমাদের দিশিবাবুরা সেকথার মানে বুঝতেই হিমশিম খেয়ে যেতো। শুধু তাই নয়, এর জন্য দিশি বাবুরা হীনমান্যতায় ভুগতেও শুরু করেন আর তাদের ইন্ধন যোগাতো আর এক দল দিশিবাবু, যারা ওই সাহেবদের উচ্চারণের ইংরেজি একটু বেশি বুঝে নিতে পারত। তারা হ্যাটা করতো প্রথম দলকে। আসলে ইংরেজি শুধুমাত্র ভাষাতে নয় এর পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ক্ষমতার আস্ফালন।
এরপর সাহেবসুবোরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিজে ভূমে ফিরে যায়। সেই শূন্যস্থানগুলি পূরণে এলো দিশি সাহেবেরা। তারাও লালমুখো সাহেবদের নকলে পাইপ মুখে একই কান্ড করতে লাগলেন। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে উত্তম কুমারের ওই গানটা আছে না — “সাহেবরা তো চলে গেছে/ স্বাধীন করে দেশটাকে/ আমরা তাদের ছাড়ি নি তো/ ধরে আছি তবু ল্যাজটাকে।” ওই ব্যাপার আরকি। সাহেবরা এ দেশের শাসনভার কব্জা করে এখানকার মানবসম্পদ ব্যবহার করে মুনাফা করেছে, বাণিজ্য করেছে, এদেশের ভাষাকে বিলকুল পাত্তা না দিয়ে নিজের ভাষাতে ফটর ফটর করেছে তাও কিনা মুখে পাইপ ঢুকিয়ে আর দিশি সাহেবেরা শুধুমুধু ক্ষতিকারক দিকটা নকল করেছে।
পাইপ কামড়ে সাহেবিয়ানার সেই ট্র্যাডিশন আজও চলমান। পাইপ ধূমপানের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রথম উৎপাদিত তামাকের পাইপ ছিল মাটির তৈরি এবং ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে উত্তর ইউরোপ থেকে এসেছিলো। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে উইলিয়াম বার্নেল্টস (William Barnelts) মাটির পাইপের প্রথম ব্যাপক উত্পাদন শুরু করার জন্য তার জন্মভূমি ইংল্যান্ড থেকে হল্যান্ডে চলে আসেন। ধীরে ধীরে শুরু হওয়া সত্ত্বেও উত্পাদন ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের দক্ষিণে প্রসারিত হয়। ফ্রান্সে ত্রিশ বছরের যুদ্ধের পর (১৬১৮-১৬৪৮) ডাচ ডিজাইনের প্রতিলিপি করে ডানকার্ক এবং ডিপেতে প্রথম মাটির পাইপ তৈরি করা হয়েছিল।
আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপে তামাক আসে। প্রথমদিকে, তামাক প্রধানত ঔষধি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত। পড়ে ইংরেজ ভাড়াটেরা পাইপ ধূমপানের অভ্যাস প্রচলন করে। পাইপের মাধ্যমে তামাকের ধূমপান আমেরিকার আদিবাসী এবং মেক্সিকোতে প্রাচীন পুরোহিতদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে উদ্ভূত। আরও উত্তরে, আমেরিকান ভারতীয়রা আনুষ্ঠানিক পাইপ তৈরি করেছিল, যার মধ্যে প্রধান ছিলো হলক্যালুমেট বা শান্তির পাইপ। এই ধরনের পাইপগুলিতে মার্বেল বা লাল স্টেটাইট (বা পাইপস্টোন) বাটি এবং ছাইয়ের কান্ড প্রায় ৩০ থেকে ৪০ইঞ্চি লম্বা ছিল এবং এগুলি পালক দিয়ে সাজানো হতো। পাইপ ধূমপানের অনুশীলন নাবিকদের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছেছিল।
অনেকই মনে করেন সিগারেটের চেয়ে ভাল বিকল্প হিসাবে পাইপ স্মোকিং করা যায়। কেননা পাইপগুলিতে, তামাক শেষের একটি বাটিতে থাকে এবং একটি কান্ড বাটিটিকে মুখবন্ধের সাথে সংযুক্ত করে। পাইপের মধ্যে ফিল্টারও সেট করা যেতে পারে। চেরি, আপেল বা পুদিনার মতো বিভিন্ন স্বাদের সুগন্ধি তামাক দিয়ে ভরা হয় পাইপ।
তবে জেনে রাখুন তামাকের প্রতিটি ফর্মের ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আজ বিশ্বব্যাপী এই ৩১ মে দিনটি পালন করা হয় বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবস হিসেবে (World No-Tobacco Day)। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন দেশের প্রায় ২৯% মানুষ ভোগেন নিকোটিন ডিপেন্ডেন্স সিনড্রোমে। এবং এক্ষেত্রে পুরুষরা প্রায় তিন গুণে এগিয়ে মহিলাদের থেকে। তামাক আসক্তির মধ্যে গুটকা, খৈনি, জর্দা, গুঁড়াখুর মতো ধোঁয়াবিহীন তামাকের নেশাও রয়েছে। সংখ্যার বিচারে তামাক আসক্তিতে দুনিয়ায় এদেশ শীর্ষে। বিশেষজ্ঞরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন, ইউরোপ আমেরিকায় জনপ্রিয় হলেও নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি এ দেশে এখনো কল্কে পায়নি।
বিশ্ব তামাক বর্জন দিবসে চিকিৎসকরা বলেন, আসক্তের তামাক বর্জনের ইচ্ছেই সবচেয়ে জরুরী। তামাক ছাড়ার দৃঢ় মানসিকতা থাকলেই কাজ দেয় নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (এনআরটি) এবং মোটিভেশন এনহ্যান্স থেরাপি।
এনআরটি তে মূলত নিকোটিন ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা চিউইংগাম অথবা স্কিন প্যাচের মাধ্যমে। ফলে নিকোটিনের অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হয় না মস্তিষ্ক কিন্তু কার্সিনোজেনিক যৌগগুলো ঢোকে না শরীরে। ধীরে ধীরে নিকোটিনের দোষ কমিয়ে একেবারে শুন্যে আনা হয়। ‘উত্তেজনা, উদ্বেগ, অবসাদ, মানসিক চাপে নিকোটিনের চাহিদা বেড়ে যায় শরীরে। নেশামুক্তির চিকিৎসায় সেই দিকগুলোরও খেয়াল রাখা হয়।’
ঘরের ভেতরের দূষণের অন্যতম কারণহলো স্মোকিং। প্যাসিভ স্মোকিং, অর্থ্যৎ বাড়িতে কেউ ধূমপান করলে সেই ধোঁয়া নাকে টেনেও স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে পরিবারের অন্য সদস্যদের। ধুমপায়ীদের প্রতি দু-জনের এক জন তার নির্ধারিত আয়ুর প্রায় ১৪ বছর আগেই মারা যান। প্যাসিভ স্মোকিং বা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে মারা যান বছরে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ।
অনেকেই বলেন, কম বয়সে ধূমপান করবো আর বয়স বাড়লে ছেড়ে দেবো। মনে রাখবেন, অল্প বয়সে যে সিগারেট আপনি খাচ্ছেন, বয়স বাড়লে তার প্রভাব পড়বে আপনার শরীরে। আপনি যদি নিজেকে ও পরিবারকে ভালোবাসেন তবে অবশ্যই তামাক বর্জন করুন। তবেই হবে বিশ্ব তামাক বর্জন দিবস পালনের সার্থকতা।
“এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘তামাক নয়, খাদ্য বাড়ান’। ২০২৩-এর গ্লোবাল ক্যাম্পেইনের লক্ষ্য হল তামাক চাষীদের জন্য বিকল্প শস্য উৎপাদন এবং বিপণনের সুযোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং তাদের টেকসই, পুষ্টিকর ফসল চাষে উৎসাহিত করা।”
বাহ্ anti tobacco day তে প্রতিবেদন টি পড়ে আপ্লুত, আমিও পান করি, যদিও কম বা controlled, দিনে 2 টো, সেটাও বন্ধ করবো শীঘ্রই
প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্য সচেতনতা বাড়ানো।
অনেক ধন্যবাদ দাদা ❤️🌹 ভালো থাকুন সবসময়।
Khub sundar lekha…aapnar lekhate natun ekta kichhu thake onek kichhu jante pari…ebaro jante parlam…onek onek dhannyabad…bhalo thakun
খুব খুশি হলাম আপনার মতামত পেয়ে। ধন্যবাদ।
“পাইপ মুখে বা চুরুট মুখে ইংরেজ অফিসারের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজেকে অত্যন্ত সজাগ
রাখতাম ঈশ্বরকে স্মরণ করে তার অফিস কেবিনে ঢোকার আগে মনে মনে প্রার্থনা করতাম “ঠাকুর
সাহেবের মুখে যেন চুরুট/পাইপ না থাকে”
উপরোক্ত কথন আমার স্ব* বাবার।উনি উচ্চ পদস্থ
পুলিশ অফিসার ছিলেন,তার immediate boss
ছিলেন হ্যারিসন সাহেব বোধহয় তার কাছ থেকে
বাবা সিগারেটে অভ্যস্ত হন কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তার বিদায়ী ভাষনে তিনি বলেন “আজ থেকে সিগারেট ছাড়লাম,ব্যাজ,বেল্ট,বন্দুক,বুট
পোষাক সব ছেড়ে যাচ্ছি আর ছাড়ছি আমার প্রিয়
চেয়ার টেবিল অফিস,কফি,চা” তিনি সেদিনের
পর আর নেশার ধারে কাছে যেতেন না।সরকারী
মিটিং এ ডাক পরলে ফেরাতেন চা,কফির কাপ।
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়,তবে মানসিক জোর থাকা চাই তবেই ছাড়া যায় তামাক পাতার সঙ্গ।
চমৎকার প্রতিবেদন আর পাইপের ছবি ফোর পেজ আর ম্যাডাম সামন্ত’র কথা আবেদন সব
পাঠকের কাছে বিশেষ বার্তা দিলো! ফ্যাশনের
বেশে নেশার ছদ্মবেশে তামাক বর্জন করাই শ্রেয়।
ভালোলাগা ভালোবাসা
দারুণ লিখলেন। আপনার মূল্যবান মতামত আমাকে ঋদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে।আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আপনাকে শ্রদ্ধেয় ❤️।