ডাচরা মজা করে একটা কথা বলে থাকেন, “God created the earth and the Dutch created The Netherlands” অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা তৈরি করেছেন পৃথিবী এবং ডাচরা তৈরি করেছে নেদারল্যান্ডস। ডাচদের ল্যান্ড রিক্লেমেশন প্রজেক্ট পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বড় এবং শক্তিশালী প্রজেক্ট। ইউরোপের মধ্যে সবচাইতে ঘন বসতীপূর্ণ ছোট্ট দেশ নেদারল্যান্ড। সেই কারণেই ১৬০০ শতক থেকে অনেক বড় বড় ল্যান্ড সমুদ্র থেকে এবং লেক থেকে সংগ্রহ করেছে ডাচরা। পোল্ডারিং করে সাগর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভূমি। খুবই অবাক লেগেছিলো এদের পোল্ডার ল্যান্ড দেখতে গিয়ে। পোল্ডার ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে পাশেই বাঁধের ওপাশে সমুদ্রের পানিতে চলমান জাহাজকে দেখতে হয় ঘাড় অনেকটা উঁচু করে, কারণ আমরা দাঁড়িয়েছিলাম সমুদ্রের পানির লেভেল থেকে অনেক নিচে। বর্তমানে ৯০০০ পোল্ডার জোন আছে নেদারল্যান্ডে। এই ইউনিক ল্যান্ডস্কেপ পৃথিবীর মধ্যে সেরা।
পোল্ডার ল্যান্ড হচ্ছে একটি নিচু জমি যা বাঁধ দিয়ে সমুদ্র থেকে পৃথক করা হয়েছে এবং যার বাঁধের বাইরের পানির সাথে এদের কোনো যোগাযোগ নেই, ম্যানুয়ালি অপারেটেড ডিভাইস ছাড়া। এরা প্রথমে সমুদ্রের ভিতর দিয়ে বাঁধ দিয়ে খানিকটা পানির এলাকা বা পানিসহ জমি পৃথক করে ফেলে মূল সমুদ্র থেকে। এরপর তারা এই ঘেরাও করা জমি থেকে পানি পাম্প করে সমুদ্রের ভিতর ফেলে দেয়। এক সময় ব্যাপক ভাবে উইন্ডমিল ব্যবহার করা হতো এই কাজে। এরপর এই জমি তারা বহু বছর ফেলে রাখে। অনেক বছর ধরে ফেলে রাখার ফলে জমির লবনাক্ততা কমতে থাকে এবং জমির বালি মাটির উপর পলিমাটি জমতে থাকে। প্রথম দিকে ঐ জমিতে ঘাসের চাষ করা হয়। পরে ধীরে ধীরে আবাদ যোগ্য হয় জমিগুলো। এই জমিগুলো খুবই উর্বর হয়ে ওঠে দিনে দিনে এবং এভাবেই তারা পৃথিবীর মধ্যে ২য় বৃহৎ ফুড এক্সপোর্টার হয়ে কাজ করছে।
তিন ধরণের পোল্ডার আছে নেদারল্যান্ডে –
১) সাগর বা অন্য কোনো জলস্থান থেকে উদ্ধারকৃত জমি। যেমন লেক, নদী অথবা সমুদ্র।
২) বন্যার আশঙ্কাযুক্ত জমি যা বাঁধ দিয়ে সমুদ্র বা নদী থেকে পৃথক করা হয়েছে।
৩) নিচু জলা-জমি যা আশে পাশের পানির উৎস থেকে পৃথক করা হয়েছে। এদেরকে জার্মানিতে বলা হয় koogs।
নদী বা সামুদ্রিক বাঁধ ছাড়া নেদারল্যান্ডের অধিকাংশ ভূমি তলিয়ে যেত। নেদারল্যান্ডস এর বেশির ভাগ অংশ সমুদ্র থেকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং এই জমিগুলো আসলে সমুদ্র সমতলের নিচে অবস্থান করছে। সমুদ্র-উপকূলে নির্মিত বাঁধগুলো এই নিম্ন ভূমিগুলোকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করছে। নেদারল্যান্ডস আসলে একটি নিচু ভূমির দেশ। নেদারল্যান্ড শব্দটির অর্থই হলো নিচু ভূমির স্থান বা দেশ। এদের মাত্র ৫০% জমি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে তিন ফুট উঁচুতে অবস্থান করছে। পোল্ডার ভূমি বা ল্যান্ডগুলো সব সময় পাশের সাগর বা লেকের পানির লেভেলের চাইতে অনেক নিচে থাকে। নিচু পোল্ডার এলাকাগুলোতে পানি ঢুকে পড়ে বিভিন্ন কারণে যেমন, বৃষ্টির পানি বা অন্যান্য উৎস থেকে পানি জমে যেতে পারে যা পাম্প করে স্লুইস গেটের মাধ্যমে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পোল্ডার ল্যান্ডগুলো সবসময় বন্যার ঝুঁকির মধ্যে আছে। কাজেই ডাইকগুলোকে খুবই যত্নের সাথে দেখাশুনা এবং নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে বাঁধগুলোকে তৈরি করা হয়েছে ঐ স্থানে পাওয়া জিনিস দিয়ে। এবং প্রতিটি জিনিসেরই এক ধরণের রিস্ক রয়েছে। যেমন ডাইক তৈরিতে বালুর ব্যবহার হয়েছে কিছু এলাকাতে, যা পানি শোষণ করে ডাইকের ক্ষতি করতে পারে অথবা শুকনো পিট ব্যবহার করা হয়েছে, যা পানির চাইতে হালকা, যা শুকনোর মৌসুমে পানি ধারণ করার ক্ষমতা হারাতে পারে। অনেক সময় বিভিন্ন পশু বা জলজ প্রাণী (muskrat) সুরঙ্গ খুঁড়তে পারে যার ফলে বাঁধের তলা দিয়ে পানি চলে আসতে পারে। কিছু কিছু ইউরোপিয়ান দেশে এই কারণে muskrat দের শিকার করা হয়েছে।
পানি যখন সাগর থেকে উথলে ওঠে তখন বাঁধকে দুর্বল করে দিতে পারে। ১৯৫৩ সালের বন্যায় অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয় নেদারল্যান্ডস। ফলে বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নতুন ধরণের উদ্যোগ নিতে শুরু করে ডাচরা। তারা নতুন তথ্যের উপর ভিত্তি করে বাঁধগুলোর ডিজাইন চেঞ্জ করেন।
এখানে নেদারল্যান্ডের ভূমি সংক্রান্ত কিছু তথ্য দেয়া হলোঃ
২৬% ভুমি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে নিচে অবস্থান করছে।
২১% জনগোষ্ঠী সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচের এলাকাতে বাস করে।
৫০% এরিয়া সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক মিটার উপরে অবস্থান করছে।
Flevoland হলো খুব সাম্প্রতিক প্রস্তুতকৃত পোল্ডার ল্যান্ড প্রোভিন্স, যা প্রস্তুত করা হয়েছে ১৯৮৬ সনে। এদেরকে সাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো ১৯৫০ এবং ১৯৬০ সনে।
ছবিঃ নেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
কভারের ছবি নেদারল্যান্ডের পোল্ডার ল্যান্ড