আজকাল সিন্ধুসভ্যতার নয়া আবিষ্কার বলে বিভিন্ন মাধ্যমে যা চালানো হচ্ছে, প্রাবন্ধিক-গবেষক অতুল সুর ৭৫ বছর আগে তাঁর ‘সিন্ধুসভ্যতার স্বরূপ ও সমস্যা’ বইটিতে সেটা হুবহু লিখে গেছেন। সিল ও ট্যাবলেট তথা ক্ষুদ্রাকৃতি সছিদ্র ফলকগুলি যে পণ্যবাহী আধারের গায়ে বেঁধে লাগিয়ে দেওয়া হত বহির্বাণিজ্যের প্রয়োজনে, সে কথা তিনি ৭৫ বছর আগেই লিখে গেছেন। তিনি লিখেছেন, “যে সীলমোহরগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো দিয়ে মাটির উপর ছাপ দিয়ে লেবেল তৈরি করে, লেবেলগুলো বাণিজ্যের পণ্যপূর্ণ ঝুড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হত।… সীলমোহরগুলিতে একটা জন্তুর প্রতিকৃতি ও তার উপর-ভাগে এক ছত্র লেখা থাকত। মনে হয় লেখাগুলি হচ্ছে ব্যক্তিবিশেষের নাম, আর জন্তুর চেহারাগুলি ‘টোটেম’ বা গোষ্ঠী বা সংঘ-বাচক।”
হরপ্পা-সভ্যতা তথা সিন্ধুসভ্যতায় কস্তুরীর প্রচলন ছিল কিনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রায় নেই। তবে অতুল সুর ১৯২৮ সালে মহেঞ্জোদারো খননকার্যে তাঁর সরেজমিনে অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে বহু হরিণের হাড়ের সন্ধান পাওয়ার কথা লিখেছেন। কস্তুরী হরিণের কথা আলাদাভাবে বলেননি যদিও। তবে কস্তুরীর সপক্ষে পরোক্ষ প্রমাণ আছে ভূরি ভূরি। মেসোপোটেমিয়া সঙ্গে নৌবাণিজ্য এবং স্থলবাণিজ্য হত সিন্ধু উপত্যকার। মেসোপটোমিয়ায় কস্তুরী তথা মৃগসুগন্ধির ব্যবহার হত ব্যাপকভাবে। মেসোপোটেমিয়ার প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতায় এর ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। মেসোপটেমিয়ায় কস্তুরী আসত হিমালয় অঞ্চল থেকে। সরাসরি আসত, না ঘুরপথে, তা কোথাও বলা নেই। তবে সিন্ধুনদ দিয়ে হিমালয় অঞ্চল থেকে সেডার কাঠ, মণিমুক্তো, বহুমূল্য পাথর, প্রাণীদেহের অংশবিশেষ সিন্ধু উপত্যকায় যে আসত, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে। সিন্ধু নদে ভাসিয়ে ভাসিয়ে বড় বড় কাঠের গুঁড়ি সিন্ধুউপত্যকায় আনা হত হিমালয়ের পাদদেশ থেকে। এই কাঠ দিয়েই গৃহনির্মাণ, জাহাজ ও বাণিজ্যতরী নির্মাণ করা হত। হাতির দাঁত, কস্তুরী মৃগনাভি হিমালয় অঞ্চল থেকেই আসত। সিন্ধু উপত্যকাতেও হাতি ও হরিণ ছিল, হাতির দাঁত ও মৃগনাভি এখানেও সুলভ ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত ইউনিকর্ন-চিত্রিত ফলক যে আসলে হরিণের প্রতীক তা বেশ বোঝা যায়। প্রতিটি ইউনিকর্নের মুখের নীচে মাটিতে যে পাত্রটি রাখা থাকে, সিন্ধুলিপি-বিশেষজ্ঞ ইরাবথম মহাদেবন তাকে Incense Burner বা ধূপদানী ভেবেছেন। আর একটু তলিয়ে দেখলে একে কস্তুরীদানী বলে চিহ্নিত করা যায়।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর খননে প্রাপ্ত স্নানঘরে আয়না, অস্থি ও হাতির দাঁতের চিরুনি, মেয়েদের চুলের কাঁটা, ওষ্ঠরঞ্জক পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে খালি প্রসাধনীর মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে অনেক। এগুলোতে সুগন্ধি থাকত বলে বিশেষজ্ঞরা ভাবেন। কী সেই সুগন্ধি? ভেষজ সুগন্ধির সঙ্গে কস্তুরীও থাকত সম্ভবত। সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক খননে একটি পরিস্রাবণ যন্ত্র পাওয়া গেছে। একই যন্ত্রের মুক্তছিদ্র ও বদ্ধছিদ্র নমুনা পাওয়া গেছে। যেগুলির ছিদ্র বন্ধ করা থাকত, সেগুলিতে আকরপদার্থ থেকে তরল সুগন্ধি তৈরি করা হত বলে মনে করা হয়। কস্তুরী হল মৃগনাভির একটি জমাট অংশ। সেটি এই যন্ত্রে বাষ্পীয় পরিস্রাবণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশুদ্ধ সুগন্ধিতে পরিণত করা হত।
এই বিশুদ্ধ কস্তুরী নৌপথে ও স্থলপথে টিন, রুপো, সোনা, তুলো, মণিমুক্তার সঙ্গে মেসোপটেমিয়া, ইজিপ্ট ইত্যাদি জায়গায় পাঠানো হত। গুজরাটে আবিষ্কৃত লোথাল বন্দর সিন্ধুসভ্যতার নৌবণিজ্যে প্রধান ভূমিকা নিত।
হিমালয়ান মাস্ক ডিয়ার, যা আগে ছিল আলপাইন মাস্ক ডিয়ার গোত্রের অন্তর্গত, হাজার হাজার বছর ধরে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারতের কাশ্মীর, নেপাল প্রভৃতি অঞ্চলে বাস করে। কস্তুরী মৃগ-র নাম কেই বা না শুনেছেন! তাদের দেহে লুকানো কস্তুরীর গন্ধে হরিণীরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় মিলনঋতুতে। বলা যায় হরিণের তূণের অস্ত্র এই কস্তুরী। আবার এই দুর্লভ কস্তুরীর লোভেই শিকারীরা তাদের বধ করে। কথায় আছে আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে হরিণ শিকারীরা কস্তুরী সংগ্রহ করে সিন্ধুনদে ভাসিযে দেওয়া কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে এসে পৌঁছাত সিন্ধু উপত্যকায়। সিন্ধুনদের তীর ধরে স্থলপথেও তারা আসত হাতির দাঁত, দামি পাথর, ও কস্তুরী নিয়ে।
বাস্তবিকই কস্তুরী ছিল সিন্ধুসভ্যতার একটি প্রধান বাণিজ্যপণ্য। কিন্তু টিন, রুপো, সোনাদানা, তুলা, পলা-নীলা-গোমেধের কথা বলা হলেও কস্তুরী যেন কাব্যে উপেক্ষিত। কোথাও তার উল্লেখ নেই। অথচ যে জায়গার সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার বাণিজ্য ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার, সেই মেসোপটেমিয়ায় কস্তুরী ছিল ব্যাপকভাবে আদৃত। সুমেরীয় সভ্যতারও প্রধান সুগন্ধি ছিল কস্তুরী।
তাহলে কি সিন্ধুউপত্যকা থেকেই সরবরাহ করা হত সেই কস্তুরী? কে দেবে জবাব?
রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়েই শেষ করা যাক, —
পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি
আপন গন্ধে মম
কস্তুরীমৃগসম।
ফাল্গুনরাতে দক্ষিণবায়ে
কোথা দিশা খুঁজে পাই না।
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।