শুক্রবার | ৫ই জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | দুপুর ১২:৫৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন (দ্বিতীয় পর্ব) : অভিজিৎ রায় হুগলির খানাকুল থানাকে দুটি করার দাবিতে সরব এলাকার বাসিন্দারা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা নামের ব্যুৎপত্তি, নতুন আলোকপাত : অসিত দাস আবার সেই হাথরস! এবার স্বঘোষিত ধর্মগুরু ভোলেবাবা : তপন মল্লিক চৌধুরী সন্ন্যাসী ও সুন্দরী : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ-এর ছোটগল্প ‘একটা পিস্তল ও ডুমুর গাছ’ ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ : কিছু অশ্রুত গুঞ্জন (প্রথম পর্ব) : অভিজিৎ রায় সুলেখা সান্ন্যাল-এর ছোটগল্প ‘ঘেন্না’ সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (শেষ পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী শোভারাম বসাকের লবণের ব্যবসা : অসিত দাস রাখাইনে সংঘাত ও সেন্টমার্টিন পরিস্থিতি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন খেলার মাঠ থেকে চেম্বারে : রিঙ্কি সামন্ত ছড়া কি শিশুসাহিত্য? : লুৎফর রহমান রিটন কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা দিবস ও ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মজয়ন্তী পালন : দীপাঞ্জন দে সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (তৃতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (শেষ পর্ব) : গীতা দাস সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (দ্বিতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (চতুর্থ পর্ব) : গীতা দাস সাবঅলটার্ন দৃষ্টিতে কলকাতার লবণচিহ্ন : অসিত দাস মোদীকে চাপে রাখতে নীতীশ-নায়ডুর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা দাবি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (প্রথম পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বাঁধে ইঁদুরের তৈরি গর্ত দিয়ে ঢোকে বন্যার জল চলছে সংস্কারের কাজ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (তৃতীয় পর্ব) : গীতা দাস কবি সঞ্জীব প্রামাণিক, আবহমান বাংলা কবিতার পথে হেঁটে-যাওয়া এক কবিতাভিক্ষুক : অমৃতাভ দে সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘বিলাসী’ বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (দ্বিতীয় পর্ব) : গীতা দাস সাত্যকি হালদার-এর ‘ছোটগল্প’ কাজলদিঘি ডায়েটে আনতে হবে কয়েক টুকরো নারকেল তাহলেই কেল্লাফতে : রিঙ্কি সামন্ত বাতাসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে বাঁশগাছের কদর বাড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (প্রথম পর্ব) : গীতা দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সুলেখা সান্ন্যাল-এর ছোটগল্প ‘ঘেন্না’

সুলেখা সান্ন্যাল / ৪৮ জন পড়েছেন
আপডেট মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪

হাওড়া ছাড়িয়ে ও-দিকে হুগলি পর্যস্ত যে-স্টেশনগুলি পড়ে তারই একটা থেকে কোলকাতামুখো ট্রেন ছাড়ছে। কলরব করতে করতে একদল মেয়ে আসে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে। বেশির ভাগই বিধবা — মধ্যবয়সি। প্রায় হাঁটুর ওপর উচু করে পরা আধ-ময়লা থান, সবাইয়েরই খালি গা, খালি পা। মাথায়, কাখে প্রত্যেকেরই একটা করে বস্তা। সবুজ নিশান দেখাতে শুরু করেছে গার্ড, অস্ফুট আর্তনাদ করতে করতে পায়ের গতি আরও বাড়ায় ওরা, হেই বাবা লোকনাথ, পৌঁছে দিও বাবা! হাঁসফাঁস করতে করতে উঠে পড়ে কোনোরকমে কামরায় মাথায় — কাঁখের বস্তাগুলোকে ফেলে দিয়ে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নেয়, পেয়েছি গো বাবার দয়ায়। ভাবলাম আজ বুঝি আর যাওয়া হোলোনি।

হ্যাঁগো? সদি কই গো? একটু আরাম করে বসে কৌটো থেকে মিসি বার করে দাঁতে দিতে দিতে হঠাৎ খেয়াল হল সুন্দরীর, হ্যাঁরে তাকে কেউ দেখলিনি তোরা? এখনও এলনি! মাগি হাঁটতেই কি পারে?

ও-পাশের বেঞ্চ থেকে যোগমায়া বলে, বলিনি তখন, নিসনে ও বাঙালকে ব্যাবসার কাজে। শুনলিনি। ওর জন্যে তোকে বিপদে পড়তে হবে, এ আমি বলে দিলাম।

সুন্দরী উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়েছিল জানলা দিয়ে। দুটো বাঁশি পড়েছে ট্রেনের, এখনও এল না। — হেই যা! গাড়ি যে ছাড়ল গো।

একটু দূরে দেখা যায় সৌদামিনীকে। হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জানলা থেকে সুন্দরী প্রাণপণে চেঁচায়, হেথা গো — এই সদি! দৌড়ো — দৌড়ো। গাড়ি পাবিনি! দৌড়োয় সৌদামিনী। সারা গাড়িসুদ্ধ লোক যেন হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, ভেবে কানদুটো লাল হয়ে ওঠে।

হেঁচকা টান মেরে প্রায় চলস্ত গাড়িতে ওকে তুলে নেয় সুন্দরী, আর চেঁচায়, এমন ঝকমারিও করিছি গো তোকে কাজে নিয়ে, আমার সব্বোনাশ না করে ছাড়বিনি তুই।

বলে নিঃশ্বাস ফেলে সদি। কপাল বেয়ে ঘামের ফোঁটা নেমে আসছে। বড়ো বড়ো ভীরু চোখের দৃষ্টি দিয়ে গাড়ির ভেতরটা একবার দেখে নেয়।

গাড়ির যাত্রিনীরা এ-গ্রাম ও-গ্রামেরই ঘর-গেরস্থের। কেউ বউ, কেউ শাশুড়ি। মুখ চেনাচিনি এর সঙ্গে ওর, আনকোরা বাইরের লোক ছাড়া এসব লাইনে আসে না। একজন জিজ্ঞেস করে, একে আবার কোথায় পেলি সুন্দরী! নতুন লোক যে।

পাশের একজন গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, বাঙাল গো বাঙাল, বুঝছোনি? হাঁটা, চলাফেরা দেখেই বোঝা যায়।

সুন্দরী সৌদামিনীর ফেলে দেওয়া বস্তা ভালো করে বেঞ্চির নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে ঠিক হয়ে বসে, তারপর ট্রেনটা জোরে চলতে শুরু করলে আঁচলে বাঁধা একরাশ মুড়ি কোলের ওপর রাখে, বলে, খা — আজ তো আর সারাদিন পাবিনি খেতে। ছলছল করছিল তখনও সৌদামিনীর চোখ। ভারি গলায় বলে, আসার সময় ছেলেটা হাত টানাটানি করে কাঁদতেছিল, বলে আমি যাব। ওরে ফেলে আসতি মন চায় না।

থাকবে ঠিক। কেন আমারও তো রয়েছে গঙ্গা আর বোঁচা, মানুষ লয় ওরা? তোর ছেলে বাপু বড়ো নেই আঁকড়া।

ওরা যে বাঙাল কয়ে খেপায় ওরে। কানতিছেল কাল রাত্তিরে, এখানে থাকতি চায় না।

ও-পাশে কয়েকজন মুচকি হাসে সৌদামিনীর পূর্ববঙ্গের টান শুনে — ওর ছলছলে চোখ দেখে।

রেগে গিয়ে সুন্দরী মুখভঙ্গি করে, তা যাও, দেশেই ফিরে যাও তোমরা। সুখে আছ — সইবে কেন? পড়েছিলে তো সেই ইস্টিশনে — সেই ছিল ভালো। তোমাকে দিয়ে আমার ব্যাবসা চলবেনি বাপু। এই তো সেদিন শ্রীরামপুরের রামলোচন দোকানির সঙ্গে ঠিক করে এলুম পঁচিশ টাকা মন, তোমাকে দিল চব্বিশ টাকা। একটা আপত্তিও না কিছু না। ন্যায্য দাম চাইতে গেলাম, বলে, দেব কেন? যার চাল সেই তো দিলে।” আরে বাপু টাকাটা সেদিন ধার দিয়েছিল কে? বলে সামনের বেঞ্চের সহযাত্রীর মুখের দিকে তাকাল সমর্থনের আশায়। “তা যাও। দুটো পয়সা পাচ্ছো আর এখন বুঝি দেশের মায়া উথলে উঠছে তোমার । ঝুঁটি ধরে ধরে মুসলমানগুলো তাড়াল যখন, তখন তো কই বাঁচাল না তোমাদের দেশ।

আবার ক্ষীণ কণ্ঠে প্রতিবাদ করে ওঠে সৌদামিনী, তাড়াবি কেন। ওরাও থাকতেই কইছিল। সকলে আসতিসে দেখে আমি আর থাকি কোন ভরসায়।

কিন্তু ভরসা কি একেবারেই ছিল না? যাবার খবর পেয়ে কানাই এসে বসেছিল, ম্লানমুখে বলেছিল, সত্যই যাবাই।

যাব না?

না।

ক্যান?

যাচ্ছ কি মুসলমানগারে ভয়ে, আমাদের হবিস কাকা আর হাফেজেরে জিজ্ঞেস কর না?

লজ্জিত হয়ে বলেছিল সৌদামিনী, না — তা না। এখানে থাকলি খাব কী? বাবুগারে পাড়ায় ভদ্দরলোক এক ঘর নাই যে খাট্যে খাব — পেট চলবি কীসে?

ক্যান, আমরা নাই? তুমি আমার মিতে কার্তিকের বউ না? একসঙ্গে মাঠে যাই নাই ফসলের দখল নিতে? আমার কোলের উপর প্রাণডা যায় নাই কার্তিকের?

তবু ভরসা পায়নি সে। ছেলের হাত ধরে একটা পোটলা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। খানিকটা পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে হন্‌ হন্‌ করে এগিয়ে এসে পেছন থেকে কানাই বলেছিল, কাজডা কিন্তু ভালো করলে না তুমি। শহরে পথে কত বিপদ-আপদ, লোভ আর পাপের ছড়াছড়ি। মান-ইজ্জত নিয়ে টানাটানি সেখানেই বেশি। অপমান আর দুঃখু পালি এখানে জানাবার লোক আছে তোমার — সেখানে নাই। এর বেশি কিছু বলতে পারেনি, গলাটা ধরে এসেছিল।

এখনও ওর সেই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, সেই ভাসা ভাসা গলার স্বরে আটকানো কথাগুলো কানে বাজে। মাঠে-ক্ষেতে লাঙল চালানো, ঘামে-ভেজা চকচকে চওড়া পিঠ চাষিকে দেখলেই মনে পড়ে কার্তিকের কথা — কানাইয়ের কথা। চোখে জল আনে রাত্রে শুয়ে, দ্যাশ কই? এ-কনে আলাম আমি। চোখের জল ঠোঁট দিয়ে চেপে নিয়ে অস্ফুটে কাঁদে সৌদামিনী — বাঙালের কান্না।

সেই নোনা জলেই ভরে আসছিল চোখ, হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। কথা থামিয়ে কাজে লাগার সময় এখন। সুন্দরী বলে, আয়রে সদি। একটা বস্তার মুখ খুলে ভেতর থেকে চটের টুকরো বার করে একখানা, লাঠি দিয়ে চটখানাকে অদ্ভুত কায়দায় ঢুকিয়ে দেয় দরজায় — মাঝখানের ওই এক ইঞ্চি সরু ফাঁকে। তারপর সুন্দরী ছোট একটা র‍্যাশন ব্যাগে পুরে দেয় চাল আর ও ঢালে । হাত কেঁপে কটা চাল উড়ে পড়ে বাইরে — কটা ছড়িয়ে পড়ে ভেতরে। হাঁ হা করে ওঠে সুন্দরী, ফেলিসনি, ফেলিসনি। গায়ে বুঝি লাগে না তোর, হ্যাঁরে সদি? টাকাটা আমার কিনা, মায়া হবেই বা কেন!

ও-পাশে আরও দুজন দুটো দিক অধিকার করেছে, একজন দরজায় ফাঁকে ঢালছে, একজন ঢালছে জানলার ফাঁকে।

সর দেখি। ওকে সরিয়ে সুন্দরী নিজে ঢালে চাল। সৌদামিমীর হাত কাঁপে — বুকের ভেতরটা কেমন করে। ঘরে কি চাল দেখেনি সে!

উঠোনে ধান এনে ফেলত কার্তিক। নিজের হাতে সেই ধান ভেনে ঘর ভরে রেখেছে। একটা চাল মাটিতে পড়লে খুঁটে তুলেছে। চাল না লক্ষ্মী, সোনাদানার চেয়েও বেশি।

কী যে দুঃখ তার! চালের মূল্য বোঝাতে আসে সুন্দরী চুরি করা চালের ব্যবসা করতে গিয়ে! হায় রে কপাল! উপুড় হয়ে কপালটা একবার মেঝেয় ঠুকে দেয়।

সুন্দরী বলে, কী লো, ঘুমোচ্ছিস নাকি! দে, এটা দিলেই তো শেষ হয়।

তারপর কাজ শেষ করে, শুকনো মুখ করে চুপ করে বসে থাকে সবাই। কপালে, হাত ঠেকিয়ে যোগমায়া ফিশফিশ করে, দোহাই বাবা তারকনাথ, এই ইস্টিশনটা. পার করে দাও বাবা।

ওরা জানে বিশেষ একটা স্টেশনের কথা। ধরা পড়ে বেশির ভাগই ওখানে। সব জায়গায় পয়সা দিয়ে কেঁদেকেটে মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্ত এখানে শক্ত পাহারা। তাই বড়ো ভয় ওদের শেওড়াফুলি জংশনকে। ওটা পার হয়ে গেলেই আবার কাজে মন দেয়। নীচের থেকে চটখানাকে টানে আর সব চাল ছড়িয়ে পড়ে বাইরে। সেগুলোকে কুড়িয়ে তুলতে হয়। সুন্দরী বলে, একটা করে খুঁটে তোল সদি, পড়ে থাকেনি যেন। এ আর পারিনি বাপু, আধমন চালে আমার দশ সের যাবে গুনাগার।

এ আর পারিনি বাপু! — এই কথাটা সদির মনে কান্নার ঢেউ তোলে। বুকের মধ্যে উথালপাথাল করে দুঃখের সাগর। সত্যিই আর পারে না সে। এই চুরি করে পেট চালানো, অপমান আর অভিযোগ।

ছেলেটার কথা মনে পড়ে। আহা, কচি ছেলেটা। সেই অন্ধকার শেয়াল ডাকা মাঠের মধ্যে কুঁড়েতে পিদিম জ্বালিয়ে কাঠ হয়ে বসে থাকে সে। গেলে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, আমি থাকব না — কিছুতেই থাকব না। তুই আমারে কানাই কাকার কাছে রাখ্যে আয়। ছেলে-মা দুজনেই কাঁদে।

ছেলে বলে, ক্যান তুই আলি ইস্টিশন থে। ওখানে কত লোক ছিল চেনা, এখানে ওরা আমারে বাঙাল কয়, হাসে।

স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঘুরতে ঘুরতে সৌদামিনীর ওপর চোখ পড়েছিল সুন্দরীর, বলেছিল, যাবি মা, ব্যাবসা করবি — স্বাধীন ব্যাবসা? দুটো পয়সা আসবে। এত কষ্টে থাকতে হবে না।

সাগ্রহে তখন রাজি হয়েছিল সে। সুন্দরী ঘর দিয়েছে একখানা । টাকা ধার দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসা বোঝায়। তাই ওর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে আছে সে। আর অন্যদের মতো সুন্দরী মুখরাও নয়, মনটা নরম আছে এখনও।

অন্যদের হাসি-ঠাট্টা-ব্যঙ্গের উত্তরে কতদিন বিরক্ত হয়ে সুন্দরীকে বলতে শুনেছে সৌদামিনী, বাঙাল-টাঙাল বুঝিনি বাপু। কষ্টে পড়েছে, বলতেই এল, নিয়ে এলাম। তোরাই বা অমন বাঙাল বাঙাল করে মরিস কেন? বাঙালরা কি মানুষ নয়?

স্টেশনে পৌঁছে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সবাই, একসঙ্গে থাকলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কুলিরা জানে কোথায় পৌঁছে দিতে হয় বস্তাগুলোকে। টিকিটবাবু, দাঁড়িয়ে থাকা রেলের লোক, গার্ড সবাইয়ের জন্য আলাদা করে পয়সা গুঁজে রাখে ট্যাঁকে। হাত ওরাও বাড়িয়ে থাকে, এরাও বাড়িয়ে রাখে। কথার চেয়ে কাজ হয় তাড়াতাড়ি। রিক্সায় উঠে সুন্দরী বলে, দাঁড়া বাবা, দাঁড়া একটু। পেছনেরটাকে বেশি ছাড়িয়ে যাসনি। পেছনের রিক্সায় আসে সৌদামিনী। তাকে ডেকে বলে দেয়, বলে দিবি সুবল সখাকে, টাকা আর আমি ফেলে রাখবনি। পারিস যদি, আজই আনবি আদায় করে।

সুবল সখা বড়ো বাকি ফেলে রাখে টাকা, একটু বেশি দাম পাওয়া যায় বলে ওর কাছে চাল দিতে হয় বটে, কিন্তু টাকা আদায় করতে প্রাণ যায়। নিজের অতিকষ্টে জমানো সমস্ত জীবন ধরে জমানো গোটা পঞ্চাশেক টাকা নিয়ে কাজে নেমেছিল সে। ভারী তো লাভ, ঘুষ থেকে শুরু করে গুনাগার দিয়ে সারাদিন একটা টাকাও তার লাভ হয় কিনা সন্দেহ। তবু তারই জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম, অপমান, প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ার ভয়, সারাটা দিনের না খাওয়ার ধকল — ভেবে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে। এ-ব্যবসা ছেড়ে দিলেই বা খাবে কী সে! তিনটে ছোটো ছেলে — নিজের পেটটা তো আছে!

স্টেশন থেকে কত দূরে সব দোকান! বাবা! অসমান রিক্সার ওঠা-নামায় শরীরে যেন ব্যথা ধরে যায় সৌদামিনীর। খিদেয় পেটের ভেতরটা মোচড়ায়। আজ সকালে খেয়েও আসেনি সে মনটা খারাপ ছিল বলে। গলা শুকিয়ে আসে তেষ্টায়।

সুবল সখার দোকানে যাবার সময় দেখল বেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এখানকার কাজ শেষ হলে স্টেশনে পৌঁছতে হবে তাড়াতাড়ি — সাড়ে ছটার গাড়ি যদি চলে যায় তবে আটটার আগে আর গাড়ি নেই। ছেলেটাকে দুটো রেঁধে দিতে হবে তাড়াতাড়ি গিয়ে।

চালের ছোট বস্তাটা পাশের ঘরে রেখে এসে বেঞ্চটা গায়ের গামছা দিয়ে ঝেড়ে দিয়ে একটা হাতপাখা এগিয়ে দিয়ে সুবল সখা বলে, “নাও বোসো। যা রোদ, জিরিয়ে নাও একটু।

বসে পড়ে সৌদামিনী বলে, বসবার সময় নাই, টাকা কয়ডা যদি দেতেন আজ… সুন্দরীদিদি কয়ে দিল।

সে হবে এখন। অনুরোধের দৃষ্টি নিয়ে সুবল বলে, টাকা কি আর ফেলে রাখব নাকি? জল খাবে? বলে একগ্লাস জল এগিয়ে দেয়। সৌদামিনী মুখে দিয়ে দেখে শুধু জল নয়, মিষ্টি, ঠান্ডা ঠান্ডা! একচুমুকে সেটা শেষ করতে করতে একটা শিরশিরানি ভাব জাগে মনে। স্টেশনে একধরনের লোকের আনাগোনা, তাদের খুব কাছে এসে দাঁড়ানো দেখলে এমনি একটা গা ঠান্ডা-করা ভাব জাগত। অনেকদিন পরে মনের মধ্যে সে-রকম করে উঠল। জলের গ্লাসটা শেষ করে ভোঁতা আর বোকা চোখে তাকিয়ে রইল।

ছেলেমেয়ে আছে তোমার? সুবল প্রশ্ন করল।

আছে, এক ছাওয়াল মাত্তর।

একটু ইতস্তত করে সুবল, কী-একটা কথা বলতে গিয়ে বলে না। খানিক চুপ করে কী যেন ভাবে, তারপর মৃদু স্বরে বলে, রাগ যদি না করো তবে একটা কথা বলি সৌদামিনী।

ঘরের চারপাশটা একবার আবছায়ার মতো চোখ বুলিয়ে নিল সৌদামিনী, তারপর ম্লান নিস্তেজ গলায় বলল, কন্‌, কী কবেন। আমার আবার রাগ আর বিরাগ!

বলি কী, সুন্দরীর সঙ্গে ব্যাবসা করা ছেড়ে দাও তুমি। আমারও ত্রিসংসারে কেউ নেই, ছেলেকে নিয়ে তুমি আমার এখানে চলে এসো। তুমি ঘর-সংসারের কাজ করবে, আমি উপায় করে আনব।

অত্যত্ত সহজ-সরল প্রস্তাব। এরকম দু-একটা প্রস্তাব স্টেশনে থাকতেও এসেছিল তার কাছে। সিঁটিয়ে তাই যেন গুটিয়ে গেল সৌদামিনী।

ওকে অসহায়েব মতো চুপ করে থাকতে দেখে সুবল বলে, কথাটা আমি ভেবেছি তোমাকে দেখার পর থেকেই, বলিনি সাহস করে। বড়ো লক্ষ্মীর মতো চেহারা আর স্বভার তোমার। ও চুরির ব্যাবসা যে তোমার ভালো লাগে না, তাও বুঝি আমি।

তবু সৌদামিনীর গুটিয়ে থাকা ভাবটা যায় না। মাথা নিচু করেই বসে থাকে। প্রায় গোপন কথা বলার মতো করে সুবল বলে, এ-ব্যাবসা আমারও ভালো লাগে না — করি কেবল টাকার লোভে। আসল ব্যাবসা ত দেখছো আমার — এই দর্জির কাজ — এই ভালো। এ শালা চালের জন্যে জ্বালা কী আমারও কম! পুলিশ-দারোগার ভয়ে তটস্থ। দু-পাঁচ সের চালের উপরই যত নজর শালাদের।

তবু উত্তর না পেয়ে বিরক্ত মুখে সুবল বলে, কী বলবে বলো না — অন্যায় বলেছি কিছু? কী ভাবছো?

ভাবা কি এতই সহজ? সুন্দরী ছাড়তে যাবি ক্যান? আর আমি বাঙাল, আপনারা তো ঘেন্না করেন আমাগোরে — তার উপর বিধবা। মানের ভয়ে পালায়ে আস্যে, শ্যাষে কি দুর্নাম কেনবো?

ওসবের কোনোটাই মানিনে আমি — বাঙালও না, বিধবাও না। আর লোকে কী বলল না বলল ভদ্দর বাবুদের মতো তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামালে চলবে কেন?

হঠাৎ মাথা তুলে বেলার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে সৌদামিনী বলে, “সন্ধে হয়ে গেল যাবনে কেমন করে আমি?”

একটা রিক্সা করে যেতে বলে সুবল সখা। ভাড়াটাও দিয়ে দিতে চায়। কিন্তু একা যেতে রাজি হয় না সৌদামিনী। সুবলকে তখন উঠতে হয় পৌঁছে দেবার জন্য। দোকান বন্ধ করে, চাবিটা ট্যাঁকে গুঁজে খানিকটা রাস্তা এগিয়ে এসে মাঝরাস্তা থেকে একটা রিক্সা ডেকে বসে। নিজে যথাসম্ভব গুটিয়ে বসে জায়গা ছেড়ে দিয়ে। গাঁয়ের মেয়ে, তার ওপর বিধবা — পরপুরুষের পাশে বসে যেতে সংকোচ তো হবেই। সৌদামিনী সমস্ত শরীরটাকে শামুকের মতো গুটিয়ে আনে ভয়ে, সংকোচে। হয়তো মাথার ওপর হুড-তোলা রিক্সায় লোকটা জড়িয়ে ধরতে পারে। ওর অবস্থা বুঝে সুবল মুচকি হাসে, অত ভয় পাচ্ছো কেন গো? হাত-পা খেলিয়েই বসো না — ভয়টা কীসের?

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে গলাটা পরিষ্কার করে বলে, বলছিলাম — আসল কথার ত কোনো উত্তর দিলে না। আমি তো রাজি — তোমার আপত্তি থাকলে চালের ব্যাবসা ছেড়ে দেব তো বললাম।

সৌদামিনীর কমে আসা ভয়টা আবার বাড়ে। স্টেশনের পথ কতদূর একবাব তাকিয়ে দেখে নেয়। লোকটা বুঝি এখনই তার অধিকার কায়েম করতে চায়। খানিক জোর গলায় তাই বলতে হয়, কথা ত তোমারে এখনই দিতি পারিনে, দেখি ভাব্যে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভেবেই দেখো তুমি। সে আমি জোর করে মত আদায় করব না তোমার। তা সামনের দিনেই যা হোক কিছু ভেবে এসো — কেমন?

সৌদামিনীর নিঃশ্বাস ফেলবার শব্দ পেয়ে সুবল বলে, বিশ্বাস করা না করা তোমার হাত, আমার অন্তরের কথাই বলেছি — লোক আমি খারাপ না।

লোক যে খারাপ নয় সেটা টের পাওয়া গেছে রিক্সায় পাশাপাশি এসেই। কথাটা তা নয়, সৌদামিনীর এখন ধানের দখল দিতে গিয়ে প্রাণ দেওয়া স্বামীর কথা মনে পড়ে, তার মিতে কানাইয়ের কথা মনে পড়ে। দেশ-ঘর, জমি-ধান, পাপ-পুণ্য মিলিয়ে মনের মধ্যে অন্ধকার নামে।

স্টেশনের আলো দেখতে পেয়ে সুবল বলে, আমি এবার যাই। তোমার দলকে পেয়ে যাবে ওখানে।

হঠাৎ সুবলের হাত শক্ত করে চেপে ধরে সৌদামিনী, না, না, গাড়ি পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে যাও আমারে।

সাড়ে ছটার গাড়িটা একটু আগে ছেড়ে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় পরের ট্রেনটার জন্য। সুবল ওকে স্টেশনের চায়ের স্টলের বেঞ্চিতে বসিয়ে কাপে করে চা খাওয়ায়।

গাড়ি এলে দুজনে একটা খালি কামরায় গিয়ে বসে থাকে পাশাপাশি। চুপ করে থাকে যেন সব কথা ফুরিয়ে গেছে।

যেতে পারবে তো একা? গাড়ি ছাড়ার ঘণ্টা দিলে সুবল জিজ্ঞেস করে। চলন্ত গাড়ির সঙ্গে অনেকদূর এগিয়ে যায়। যেন অনেকদূর চলে যাচ্ছে তার প্রিয়-পরিজন, আর বুঝি দেখা হবে না।

গাড়ি প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেলে জানলার কাছ থেকে সরে এসে ভেতরে বসে সৌদামিনীর দু-চোখ ভরে জল আসে। খালি কামরায় গায়ের মধ্যে কেমন ছমছম করে। মনে হয় এ-সময়টায় সুবল সঙ্গে থাকলেই যেন ভালো লাগত — এই ভয় ভয় ভাবটা একটুও থাকত না তাহলে।

সেই গা ছমছম-করা ভাব নিয়ে ঘরে এলে ছেলেটা আগুনের মতো গরম গা নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে, তুই ছিলিনে মা। শীতে আমারে কাঁপাইছে সারাডা দুপুর। অনুতাপে বুকের মধ্যেটা পুড়ে যায় — কপালে বুঝি সত্যিই অনেক দুঃখ আছে তার। বিধবা মানুষ, ছেলের মা, দেড় কুড়ি বয়স হতে চলল। দেশ-জমি-জায়গা ছেড়ে এসে নইলে আবার নতুন করে সংসার করবার শখ জাগবে কেন মনে। ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।

থমথমে মুখে সুন্দরী ঢোকে, বলে, আজ সুবাসী আর হারানীরে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ — একেবারে হাজতে চালান। ওভাবে আর নেওয়া যাবেনি চাল।

পাপপুণ্যের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে চলে আসতে হয়, বোকা ভোঁতা চোখে তাকিয়ে সৌদামিনী জিজ্ঞেস করে, তবে কী করব?

উপায় আছে রে, উপায় আছে। এতক্ষণ পরে একটু হাসে, মিশি মাখা কালো দাঁতে বলে, বজ্জর অটনেরই গেরো যায় ফসকে। দে দেখি আট আনা পয়সা — দর্জিকে দিতে হবে। ব্যাবসাও রাখতে হবে — তোরও, আমারও। নইলে পোড়া পেট চলবে কী করে?

দর্জি? বিস্ময়ে সৌদামনীর কথা আটকে আসে।

দেখেছিস কী? এবার মেমসাহেবি পোশাক পরতে হবে যে। উঠে আয় দেখি।

গুটিয়ে নিয়ে আসা মস্ত বড়ো একখণ্ড চটের টুকরো তার বুক থেকে পিঠ পর্যন্ত ফেলে একবার মেপে নিয়ে বলে, ঠিক হবে তোর এতে। আমি মোটা মানুষ, আমার লাগবে বেশি।

পয়সা নিয়ে যাবার সময় বলে, ভাবিসনি কিছু, সব ঠিক হয়ে যাবে।

ওর চিন্তিত বিষণ্ন মুখের দিকে চোখ পড়তে বলে, মর মাগি। ছেলের জ্বর যেন কারুর হয় না, কাঁদছিস কেন? রাতে আমার ওখান থেকে চাড্ডে খেয়ে নিসখনি তুই। কাল বোঁচাকে দিয়ে পাঁচু কবরেজের কাছ থেকে ওষুধ আনিয়ে দিলেই জ্বর সেরে যাবে — ভাবিসনি।

ছেলে বলে, তোরে যদি পুলিশে ধরে নিযে যায় মা? বলে কেঁদে ফেলে।

পাপ-পুণ্য একনিমিষে উধাও হয়ে যায় মন থেকে। সৌদামিনী বলে, যাবি চলে এখান থে সোনা? একজন আমাগোরে নিয়ে যাতি চাইছে। তোরে আমি লেখ্যাপড়া শেখাব।

ছেলে ভারি খুশি হয়ে বলে, তাই চল্‌ মা।

ওদের মনের মধ্যে সুখেব ছবিটা একবার জাগে, আবার মিলিয়ে যায়।

সকালবেলা সুন্দরী নিয়ে এল দর্জির তৈরি-করা জিনিসটা। গলার ওপর থেকে পেট পর্যন্ত একটা মস্ত বড়ো চটের টুকরো ভাঁজে ভাঁজে সেলাই-করা — পেছনে কাঁচুলির মতো কতগুলি দড়ি।

সুন্দবী বলে, চাল আন তো দেখি ক-সের। চালের ধামা এগিয়ে দিলে বলে, ধর্‌ দেখি লম্বা করে। তারপর কৌটোয় করে চাল ঢালতে থাকে সেলাই-করা ভাঁজগুলোর মধ্যে।

হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সৌদামিনী। দরজা-জানলার ফাঁকে ছালা গুঁজে চাল ঢালবার সময়ও এত আশ্চর্য হয়নি সে। ধামার প্রায় সব চালগুলি ঢেলে নিয়ে সুন্দরী বলে, আয় এদিকে। তার পা থেকে কাপড় ফেলে দিয়ে বেঁধে দেয় শরীরের সঙ্গে। চটের পরশ আর চালের ভ্যাপসা গন্ধে দম যেন বন্ধ হয়ে আসে। ভীষণ মোটা মেয়েমানুষের মতো হাঁপাতে থাকে সৌদামিনী, এ আমি পারব না। আমি মরে যাব ও-সব পরে — ও দিদি।

ছেলেটাও মায়ের অদ্ভুত সাজ দেখে হাউমাউ করে কাঁদে।

সুন্দরী রেগে ওঠে, পারব না তো করবে কে শুনি? আমি এমন মোটা মানুষ, আমি পারছিনে? আরও সবাই যে নেবে, কষ্ট তাদের নেই? না হয় চাল কিছু কম করেই নিও তোমারটায়। পেট চালাতে হবে তো? ফিতেগুলো খুলে দিয়ে আবার চালগুলো ধামায় ভরে ফেলে তাড়াতাড়ি। সেদিকে তাকিয়ে কান্নায় যেন গলা আটকে আসে সৌদামিনীর। সে কাকুতি জানায়, তিন-চারটে দিন আমারে মাপ দেও দিদি। ছেলেডারে দেখার কেউ নাই। আমারও শরীরডা খারাপ। তারপর যাতি ত হবিই। তোমাগোরে যে পথ, আমারও সেই পথ — এ ত জানিই।

তা না হয় নাই গেলে তুমি কটা দিন। সুন্দরী এবার সহানুভূতিতে নরম হয়ে আসে, বুঝিস ত দিদি, পেটের দায়েই ত সব। এই বা ক-দিন, আবাগীর ব্যাটারা ঠিক ধরে ফেলবে দেখিস। যত চোখ কি আমাদের উপর গো। দশ সের বিশ সের চাল নিয়ে কি দালান তুলব আমরা!

সুন্দরীর কথা সৌদামিনীর কানে যায় না। ও পথ খোঁজে। এইবার গিয়েই সে সুবল সখার প্রস্তাবে রাজি হয়ে আসবে। তারপর চলে যাবে ছেলেকে নিয়ে। তাতে যদি পাপ হয় হোক।

সেই একই সময়ে কলরব করে মেয়েরা দৌড়য় গাড়ি ধরতে। বস্তা নিয়ে ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকায় না বটে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসে। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নেয় আর হাঁপায়।

চেনাজানা লোকের সঙ্গে দেখা হলে তারা হাসে, কী গো, তোমরা যে সব পাল্লা দিয়ে মোটা হচ্ছো?

ওরা গালাগালি করে, চুপ কর না ড্যাকরা, কে কোথা দিয়ে শুনবে — হয়ে যাবে ব্যাবসা করা!

বিকেলে ফিরে আসে স্বাভাবিক শরীর নিয়ে ওরাই, স্বাভাবিক মানুষের মতো নিঃশ্বাস নেয়।

সবাই বলে ছেড়ে দেব ছাই এ-ব্যাবসা। দু-পাঁচ সের চালের জন্য প্রাণ যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল গো?

কিন্তু ছেড়ে দেব বলেও কেউ ছাড়তে পারে না। কষ্টটা সেখানেই।

কটা দিন পরে ছেলে সুস্থ হয়ে গেলে কোনো অজুহাত দেওয়া যায় না। সুবল সখার সঙ্গেও দেখা করা দরকার। এখনও যদি তার মত বদলে না থাকে তবে সৌদামিনী মত দিয়েই আসবে আজ। খানিকটা আশা থাকে বলে সের পনেরো চাল নিয়ে চটের পোশাকটা খুব ভারি মনে হয় না।

সুন্দরী বলে, আর একটু জোরে হাঁট।

চালের ভ্যাপসা গরমে কষ্ট হয়। হাঁটতে পারে না, তবু চেষ্টা করে। কেবলই মনে হয় আজই তো শেষ দিন তার!

চলতে চলতে ভাবে, সুবল পরিশ্রম করে ফিরবে, ছেলেটা স্কুলে যাবে পড়তে — সেও দরকার হলে সুবলকে সাহায্য কববে। আহা, একনিমিষে যদি পৌঁছে যাওয়া যেত সেখানে!

গাড়িতে উঠে কষ্ট হয়। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসে। দুটো স্টেশন পার হয়ে গেলে সুন্দরীকে বলে, একটু খুলি দিদি, আর ত পারতিছি নে।

ছেলেমানুষ বাতাসীও বলে, সত্যি, খুলেই বসি একটু।

কোন ইস্টিশন এটা, দেখি দাঁড়া। বলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে গিয়ে সুন্দরী চমকে সরে আসে। তখনও প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে যায়নি গাড়ি। খাকি পোশাক-পরা লম্বা-চওড়া দুজন লোক গাড়ির হাতল ধরে উঠে পড়ে ওদেরই কামরায় — সঙ্গে মস্ত লাঠিধারী সেপাই। নিমেষে মেয়েদের মুখগুলো শুকিয়ে যায়, বুকের মধ্যে সবাইয়েরই ধড়ফড় করে।

দুজনেই দরজায় পিঠ দিয়ে একটু দাঁড়ায়। জামায় বুকে অনেকগুলো ব্যাজে রোদ পড়ে ঝকমক করে। দাঁড়িয়ে ছুঁচলো গৌঁফজোড়াটায় পাক দেয়, আর একজন তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে লক্ষ করে মেয়েদের। সেপাইটা যেন কাঠের পুতুল — চুপ করে দাঁড়িয়েই থাকে অ্যাটেনশনের ভঙ্গি নিয়ে। মাঝবয়েসি, কমবয়েসে, মোটা মোটা অনেকগুলো মেয়ে পাশাপাশি বসে তবু ওদিকের দরজার কাছে বসে থাকা সৌদামিনীর দিকেই যে ওদের চোখ পড়েছে — ফ্যাকাশে মুখখানা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখেও সেটা সে বুঝে ফেলে। মেয়েরা ভোঁতা আর বোবা দৃষ্টি নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে — নড়ে না, শব্দও করে না একটা।

সিগারেটে দুটো বড়ো টান দিয়ে পায়ের নীচে জুতো দিয়ে পিষে একজন অফিসার হঠাৎ অদ্ভূত ক্ষিপ্র হয়ে উঠে বাতাসীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। “চাল নিয়ে ভাগছিস শালি? বার কর শিগগির”।

হাউমাউ করে বাতাসী আর্তনাদ করে, ও বাবু, পায়ে পড়ি বাবু, আজকের মতো ছেড়ে দাও বাবু।

দাঁত বার করে তৃপ্তির হাসি হাসতে থাকে পেছনের লোকটা। সে’ই আবার এগিয়ে গিয়ে বাতাসীর কাপড় চেপে ধরে। আর-একজন সম্মতির দৃষ্টি নিয়ে সামান্য দূরে সরে দাঁড়ায়। রিভলবারটা বার করে হাতের ওপর নাচায়। মেয়েগুলোর ভয়ে আড়ষ্টতায় দম আটকানো ভাবটা ওরা খুব উপভোগ করছে — সেটা ওদের চোখ দেখেই বোঝা যায়।

সৌদামিনী হঠাৎ উঠে গাড়ি থামাবার শেকলটার দিকে হাত বাড়াতেই একজন এগিয়ে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে হাত নামিয়ে দেয়। — বড়ো যে শখ চাঁদ। শেকল টেনে গাড়ি থামাবে? চুরি করে ব্যাবসা করে আবার তেজ দেখ!

সৌদামিনী রাগে হাঁপায়, চোখ দুটো জুলে ওঠে, তালি নাম্যে যাও। যা পার স্টেশনে নাম্যে কর। পাঁচজন লোকের সামনে বিচার হোক — পুলিশে দাও, হাজতে পোরো। তা না, চলস্ত গাড়িতে উঠে মেয়েগোরে কাপড় ধরে টানাটানি — এ কি চাল ধরা, না বজ্জাতি?

চোপরাও, হুংকার দিয়ে এগিয়ে আসে অফিসার একজন। ভারি যে গর্জন! সরকারি লোক দেখেও ভয় নেই একটু? ভাবছিস আমরা জানিনে চাল নিয়েছিস কোথায় ? সব শালির কাপড় খোলাব আজ।

পেছনের দরজাটা বাতাসে কখন যেন খুলে গেছে, কিন্তু সেদিকে তাকাবার অবসরও থাকে না। লোকটা যতই এগিয়ে আসে, বুকের কাপড় শক্ত করে চেপে ধরে বিস্ফারিত চোখে সৌদামিনী পিছিয়ে যায়।

এতটুকু কুণ্ঠা নেই, আঁচল চেপে ধরে সরকারি লোক বলে, খোল কাপড়। সেপাইটার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে, সেই যে চোখ নামায়, আর তোলে না।

রুদ্ধ কান্নায় শরীরটা তুলতে থাকে সৌদামিনী। তীব্র ঘৃণায় ঠোঁট দুখানা কুঞ্চিত হয়। শেষে প্রাণপণ শক্তিতে লোকটার চুলের গোছা মুঠি করে চেপে ধরে দু-হাতে। অফিসার বারেবারে মাথা নাড়ায়, ছাড়াতে পারে না। কষ্ট হয় খুব, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসে। শেষ উপায় হিসেবে বুটশুদ্ধ পায়ের একটা জোর লাথি কষিয়ে দেয় মেয়েটার পেটে। তাতেই কাজ হয়। কাপড়খানা থেকে যায় হাতে, খোলা দরজাটা দিয়ে সৌদামিনীই কেবল ছিটকে বেরিয়ে যায়। কাপড়ের শেষ প্রান্তটায় সামান্য একটু টান পড়ে। ভদ্রলোক নোংরা জিনিস হাতে পড়ার মতো চমকানো ভাব নিয়ে কাপড়খানাকেও জানলা গলিয়ে ফেলে দেয় বাইরে — বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে যায় সেটা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন