স্বল্পদৈর্ঘ্যের জীবন ও বিপুল বৈচিত্র্যময় কর্মে আঘাতশূন্য উজ্জ্বল হাস্যরস সৃষ্টিতে আপামর বাঙালিকে যিনি মুগ্ধ করেছেন, সেই লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার সুকুমার রায়ের আজ জন্মদিন।তাঁর বিচিত্র শব্দ-ব্যবহার, লেখার লাইন, চরিত্রের নাম কী অনায়াসে আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। যেমন ধরুন গোমড়ামুখো বোঝাতে আমরা রামগরুড়ের ছানা বলি, ঠিক জায়গার ফোড়ন কাটতে বলি ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল’… ব্যাস আর ডিটেলসে বলার কোন প্রয়োজন হয় না কিম্বা অদ্ভুত টাইপের জোড়াতাপ্পি ঘটনা দেখলেই ‘বকচ্ছপ’ বলে থেমে যাওয়া ব্যস… তাঁর সৃষ্টি একটি কথা বললেই দশটা কথার মানে অন্য দিকের লোক বুঝে নেয়।আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় তিনি অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক। জন্মদিনে আজকের লেখা তাঁর স্মরণে।
১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও বিধুমুখীর প্রথম পুত্র সুকুমার জন্মালেন। উপেন্দ্রকিশোর একধারে যেমন বিখ্যাত লেখক, সম্পাদক ছিলেন তেমনি ছিলেন শিল্পী, ভালো গায়ক ও যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শী। সেকালে তার বাড়িতে আসা যাওয়া ছিল ডক্টর নীল রতন সরকার, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের প্রীতির সম্পর্কের দরুন রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের চরিত্রের নাম অনুসারে সুকুমার ও তার দিদি সুখলতার ডাক নাম রাখা হয় ‘তাতা’ আর ‘হাসি’।
সুকুমার রায়ের ছিলেন অতি আকর্ষণীয় চরিত্রের মানুষ — সাহসী, প্রতিবাদী, অন্যায় সইতে পারতেন না মোটেও। পড়াশোনায় মেধাবী ছেলেটি ছোট বয়স থেকেই মুখে মুখে ছড়া বেঁধে ফেলতে পারতো, কলম ধরলেই কবিতা ঝরে পড়তো। ছবি আঁকতে, ভালো গান গাইতে, নাটক লিখতে এমনকি অভিনয়ও করতেন দুর্দান্ত। খেলাধুলায়ও ছিলেন সকলের সেরা।ছোটবেলা থেকে ভাষার উপর তাঁর বিশেষ দখল ছিল।
মাত্র আট বছর বয়সে শিবনাথ শাস্ত্রীর মুকুল পত্রিকায় সুকুমার রায়ের ‘নদী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়, পরের বছর দ্বিতীয় কবিতা ‘টিক্ টিক্ টং’।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে দেশভক্ত শিক্ষিত বাঙালি শপথ নিয়েছিল বিদেশী জিনিসের বদলে দেশী জিনিস ব্যবহার করবে। রায়পরিবারও এর থেকে বাদ গেল না। দেশি সুতোর মোটা কাপড়, হাতে তৈরি তুলোট কাগজ, ট্যারা ব্যাঁকা পেয়ালা পিরিচ, খুঁজে পেতে নিয়ে আসা হতো। সুকুমার রায় গান বাঁধলেন —
আমরা দেশি পাগলার দল /দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল/ দেখতে খারাপ টিকবে কম দামটা একটু বেশি/ তা হোক না তাতে দেশেরই মঙ্গল…
একদিকে যেমন হাসির গান লিখলেন, তেমনি লিখলেন স্বদেশী গান ‘টুটিল কি আজ ঘুমের ঘোর’।
সিটি কলেজ থেকে প্রবেশিকা পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়নে অনার্স নিয়ে স্নাতক হলেন সুকুমার। ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধির গুণে হয়ে ওঠেন ব্রাহ্ম যুব আন্দোলনের নেতা। রবীন্দ্রনাথ বিশেষ স্নেহ করতেন এই প্রতিভাবান যুবককে, বলতেন ‘আমার যুবক বন্ধু’। সুকুমার তার দলবল নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মবর্ষ পূর্তি উৎসবে শান্তিনিকেতনে গিয়ে সবাইকে শোনালেন ‘অদ্ভুত রামায়ণ’।
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় সমাজ পাড়ার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। সে ক্লাবের মুখপত্র ছিল হাতে লেখা পত্রিকা ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’। এখানেই তার আবোল তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু হয়।ছোট থেকে বড় সকলেই খুব উপভোগ করত সেই পত্রিকার সম্পাদকের লেখা, মলাটের মজার মজার সব ছবি ইত্যাদি। তবে সুকুমার রায়ের লেখার বিশেষত্ব ছিল এই যে তার লেখা পড়ে কেউ আঘাত পেত না, কারো প্রতি খোঁচা থাকত না, থাকতো শুধু মজা আর নির্মল আনন্দ।
সুকুমার রায়ের একটি ‘মন্ডাক্লাব’ (মনডে ক্লাবের লোকমুখে চলতি রূপ) ছিল। এই ক্লাব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’ পর্যন্ত সব বিষয়ে আলোচনা করতেন। সেখানে মাঝে মধ্যেই শব্দকল্পদ্রুম, অদ্ভুত রামায়ণ প্রভৃতি নানা অভিনয় করতেন আর তা সবাই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতো।
১৯১১ সালে মুদ্রণ শিল্পের কাজ শেখার জন্য বিলেতে যান সুকুমার। ম্যানচেস্টার স্কুল অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হয়ে পরীক্ষায় প্রথম হয় দেশে ফিরেন ১৯১৩ র শেষের দিকে। ফেরার পর সুকুমার রায় বিয়ে করেন স্যার কে জি গুপ্তর ভাগ্নী ও জগতচন্দ্র দাসের মেজ মেয়ে সুপ্রভা (টুলু)কে।
বাবা উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর তার ব্যবসা ও পত্রিকার হাল ধরলেন সুকুমার ও ভাই সুবিনয়। সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক সুকুমারের চোখে বোন লীলার লেখার প্রতিভা ধরা পড়েছিল। ১৪ বছরের বোন লীলাকে বলেন সন্দেশের জন্য গল্প লিখতে। গল্প লেখা হল, একটু সংশোধন করে এসে গল্প পত্রিকায় প্রকাশ করে সুকুমার ‘লেখিকা’ লীলা মজুমদারের পথ খুলে দিয়েছিলেন।
সুকুমারের সৃষ্টি কবিতাগুলি সরল দৃষ্টিতে শিশু মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যাঙ্গাত্মক মনে হলেও, তিনি যথেষ্ট সমাজ সচেতক ছিলেন। তার কবিতায় হাস্যরসের অন্তরালে সমাজে বাস্তবচিত্রটা ফুটে উঠত। তিনি শুধুমাত্র বঙ্গ রসাত্মক কাব্য অথবা শিশু মন উপযোগী গল্প লিখেই থামেননি তার লেখা রচনা প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। তার রচিত প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ের রচনা ‘সূক্ষ্ম হিসাব’ ১৯১৩ সালে সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কাঠের কথা, চাঁদমারি, কয়লার কথা, পাতালপুরি, ক্লোরোফরম, আশ্চর্য আলো এদের মধ্যে অন্যতম। সুকুমারের ‘চাঁদমারি ‘ রচনাটি মানুষের চাঁদে পাড়ি দেবার বিষয় ভবিষ্যৎবাণী করেছিল।
কথন-বচনে, দৈনন্দিন জীবনচর্চায় সুকুমার রায়ের বিভিন্ন বাক্যবান্ধব ও শব্দাবলী প্রবচনে রূপান্তরিত হয়েছে। আবোল তাবোল কিম্বা খাই খাই এর জগত যেমন বাঙালি মননে নিখাদ ফ্যান্টাসি রূপময়তাকে তুলে ধরে, তেমনি মধ্যবিত্তীয় গ্লানিময়তার মধ্যে তৈরি করে ছদ্ম অন্তর্ঘাতের অভীপ্সা–যে জীবন পাওয়া হলো না,দেখা হলো না অথবা আর ফিরে আসবে না তার কথা।
মৌলিক স্বকীয়তা ছিলো তাঁর লেখার পরতে পরতে।
সৎপাত্রের খোঁজ করে হিতৈষী সাজা আর তারপর সেই বিয়েতে ভাঙছি দেওয়া এ বাংলার পুরনো কালচার। পাত্র গুণধর গঙ্গারাম যিনি ১৯টি বার ম্যাট্রিকে ফেল করার পরও তার ব্যর্থতার কথা নয়, বিরল অধ্যাবসায় পরাকাষ্ঠা রূপে সুকুমার তাঁকে দেখিয়েছেন সৎপাত্র কবিতাতে।
আজকের রাজনৈতিক পরিবেশ বলছে, তিন মাসের জেল নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই কিন্তু সাত দিনের ফাঁসি খুব জরুরী। কথায় বলে না, ‘হাকিম নড়ে তো, হুকুম নড়ে না।’ স্বাধীনতার এত বছর পরও সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন স্বাধীনতা হারানো একুশে আইনের যুগ মনে করিয়ে দেয়।
অমল পালেকর, উৎপল দত্ত অভিনীত হৃষিকেশ মুখার্জির গোলমাল ছবিটির কথা মনে পড়ে? ছবিটিতে উৎপল দত্ত মনে করতেন ‘গোঁফ’ হচ্ছে পৌরুষের প্রতীক — গোঁফের আমি গোঁফের তুমি ‘গোঁফ’ দিয়ে যায় চেনা। কিন্তু পুরুষের চরিত্র বা দৃঢ়তা বোঝাতে ‘গোঁফের প্রয়োজন হয় না, সেটা বোঝাতে হিমশিম খেতে হয়েছিল গোটা পরিবারকে। এই সিনেমাটি বানাতে হৃষীকেশের অনুপ্রেরণা ছিলো সুকুমার রায়ের ‘গোঁফ-চুরি’ কবিতার নায়ক — ‘হেড অফিসের বড়বাবু।’
“শুন্ছ দাদা! ঐ যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে,
সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে?
শুন্ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে?
চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে?”…
সুকুমার রায়ের “অবাক কাণ্ড” আজও বড়ই প্রাসঙ্গিক। ছত্রিশ ঘন্টা টানা ডিউটি করার পর তাইতো সুকুমার রায়ের বদ্যি বুড়ো, আজকের “অভয়া” ক্লান্তিতে চক্ষু আপনা হতেই বুজেছিল।
কিন্তু অসম্ভব প্রতিভাধর এই মানুষটি মধ্য তিরিশে পা দেওয়ার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, রোগের নাম কালাজ্বর। তখনকার দিনে তার আর কোন ভাল চিকিৎসা ছিল না। চোখের সামনে সকলের প্রিয় সুকুমারের শরীর ভাঙতে লাগলো। তার আগের বছরেই তাদের একটি সুন্দর ছেলে হয়েছিল ঘটা করে নামকরণও করা হয়েছিল। ছেলের নাম সত্যজিৎ ডাক নাম মানিক। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে অর্থাৎ মৃত্যুর আগের বছরই কত ইচ্ছা কত আশা নিয়ে সুকুমারের প্রথম বই ‘আবোল তাবোল’ প্রেসের জন্য তৈরি হয়েছে, তার ছবি আঁকা হয়েছে বালিশে ঠেস দিয়ে। ১৯২৩ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে সুকুমার রায় তার গড়পার রোডের বাড়িতে সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
সুকুমার রায়ের লেখার পরতে পরতে যে রাজনৈতিক মাত্রা, রসবোধের আড়ালে ক্ষুরধার সমালোচনা আম বাঙালির কাছে সর্বজনীন। সুকুমারীয়-দর্শনের মাঞ্জায় সান দিয়ে রইলো জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।