বুধবার | ১৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৩রা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৫:০৯
Logo
এই মুহূর্তে ::
মনসার নাম কেন ঢেলাফেলা : অসিত দাস ভোও.. ও ..ও.. কাট্টা…! ভো… কাট্টা…! : বিজয় চৌধুরী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা : সন্দীপন বিশ্বাস নারীবেশী পুরুষ অভিনেতা শঙ্করকে সামাজিক ট্যাবুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় না : বিশ্বেন্দু নন্দ সাসারামের রোহতাসগড়, বৃহতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ : নন্দিনী অধিকারী জমিদার রবীন্দ্রনাথ : আহমাদ ইশতিয়াক আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের আবেদন মুখ্যমন্ত্রীর, এবারও অধরা রইলো আলোচনা : সুমিত ভট্টাচার্য জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব চাষির দুঃখের ঘরে সাপের বাসা, আজও রেহাই নেই ছোবলের হাত থেকে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় সল্টলেক তথা লবণহ্রদই কি কুচিনান : অসিত দাস পদ্মা বা পার্শ্বপরিবর্তনী একাদশী ব্রতকথা : রিঙ্কি সামন্ত জয়া মিত্র-র ছোটগল্প ‘ছক ভাঙার ছক’ কত দিন বিনা চিকিৎসায় চলে যাবে অসুস্থ মানুষের প্রাণ? প্রশ্ন দেশ বাঁচাও গণমঞ্চের : সুমিত ভট্টাচার্য দেবী করন্দেশ্বরীর পূজো ঘিরে উৎসবের আমেজ মন্তেশ্বরের করন্দা : প্রবীর কুমার সামন্ত প্রেতবৈঠকে (প্ল্যানচেট) আত্মার আগমন : দিলীপ মজুমদার সংগীত সাধক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য : রিঙ্কি সামন্ত শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যের অন্দরে বাহিরে বিরাজমান সিণ্ডিকেট : তপন মল্লিক চৌধুরী কবিতা সিংহ-এর ছোটগল্প ‘পশ্চিম রণাঙ্গন আজ শান্ত’ কলকাতার আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠী : অসিত দাস মঙ্গলবারের মধ্যে কাজে ফিরুন — সুপ্রিম ধমক, উৎসবে ফিরুন — মমতা : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (পঞ্চম পর্ব) : বিজয়া দেব বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (শেষ পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত হাঁসের ডিমের উৎপাদন বাড়াতে এগিয়ে এল রাজ্যের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতর : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় এ আমার এ তোমার পাপ : দিলীপ মজুমদার জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (চতুর্থ পর্ব) : বিজয়া দেব রোহিঙ্গা সংকট — ত্রান সহায়তা ও কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন দেশের সর্বোচ্চ আদালতে কি তিলোত্তমা সুবিচার পাবে : তপন মল্লিক চৌধুরী বিবিসির ইয়ংগেস্ট হেডমাস্টার বাবর আলী (প্রথম পর্ব) : রিঙ্কি সামন্ত সময় হোক বা পরিস্থিতি, প্রণাম সব শিক্ষককেই : প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (তৃতীয় পর্ব) : বিজয়া দেব
Notice :

পেজফোরনিউজ অর্ন্তজাল পত্রিকার (Pagefournews web magazine) পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই শুভ কৌশিকী অমাবস্যার-র আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

জগদীশ গুপ্তের গল্প, কিছু আলোকপাত (ষষ্ঠ পর্ব) : বিজয়া দেব

বিজয়া দেব / ২৩ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

“মাখনের ভয় করিতে লাগিল…কালোর অতলগর্ভে অবতরণ করিয়া কাহারা যেন মন্থনে রত হইয়াছে, তাহারা তাহাদের হারানো রত্ন খুঁজিতেছে, তাহাদের হাতের শব্দ নাই, পায়ের শব্দ নাই, মুখে শব্দ নাই, কেবল চক্ষু দুটি দপদপ করিতেছে… তাহাদের নির্মম অবিশ্রান্ত দন্ডপ্রহারে আবর্ত কেন্দ্র হইতে ঢেউ উঠিতেছে, আগে ধোঁয়া, তাহার পর ফেনমুখী হলাহল উদগীরিত হইতেছে… সেই জ্বালাময় হলাহলের পাত্র লইয়া কে যেন অগ্রসর হইতে লাগিল, কালোর মাঝেই কালো মূর্তিটি স্পষ্ট, যেমন নিঃশব্দ, তেমনই দৃঢ়, তেমনই মন্থর। ঐ হলাহল তাহাকে পান করিতেই হইবে, নিস্তার নাই। কতদূর হইতে কালোর স্তরগুন্ঠন ঠেলিয়া ঠেলিয়া মূর্তি অগ্রসর হইতেছে। — তাহার গতির বিরাম নাই, অনন্তকাল ধরিয়া তাহারা আসিতেছে, তাহারা আসিবেই।” (কলঙ্কিত সম্পর্ক)।

এই বর্ণনার অন্ধকার ও অন্ধকার মন্থনকারী ছায়াময় অবয়বের ক্রমাগত অগ্রসরময়তা মাখন নামের গৃহবধূর অন্তরের গহন অন্ধকারে ভয় ও বিভীষিকাময় এই অনুভূতি “স্বামী “নামক এক সম্পর্কের প্রতি তার অসহায়ত্বের অসাধারণ প্রকাশ ঘটিয়েছে। সেই সময়ের “গৃহবধূ” শব্দটিই অন্তরালের অসহায় জীবনের প্রতি তর্জনী নির্দেশ করে। আদ্যন্ত পরাধীন এক নারীজীবন, নাম তার মাখন।

মাখনের স্বামী সাতকড়ির ঝুলনের মেলায় নারী সংক্রান্ত এক ঘটনায় হাতে হাতকড়া পড়ে। সে জেলে যায়। সাতকড়িকে বিয়ে করানো হয়েছিল ঘরের বউ তাকে ঠিকপথে আনবে বলে। বেপথু সাতকড়িকে সে যখন পথে আনতে পারল না তখন সংসারে মাখনের মূল্য গিয়ে দাঁড়াল শূন্যতে। একটি স্বতন্ত্র মানুষের পরিচয়ে তো তাকে এই সংসারে ঢোকানো হয়নি। বিনামূল্যের একটি দায়িত্বশীল কাজ দিয়ে তাকে এই সংসারে ঢোকানো হয়েছিল। কাজটি হলো চরিত্রহীন সাতকড়ির চরিত্র সংশোধন করার কাজ। সে তা পারেনি। সুতরাং তার সংকুচিত অস্তিত্ব সংকুচিত হতে হতে একেবারে শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে। সুতরাং স্বামীর অপরাধকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না। শাশুড়ি ওসব ভুলে গেছেন। তিনি শুধু দিন গুণছেন কবে ছেলে বাড়ি ফিরবে। আর মাখনের সাতকড়ির ফেরাটা বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে।

“স্বামীর অপরাধ গুরুতর, এতো যে, তাহার চিন্তাই সহ্য হয় না, মানুষ কোনদিন তাহা সহ্য করিতে পারে নাই… ভগবানের নাম যার বুকে আছে,পশু হইয়া জন্মগ্রহণ করি নাই, এ জ্ঞান যার আছে, সে তাহা ক্ষমা করে নাই।”

গভীর অন্ধকারে সে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে মুখ তুলে ভগবানকে ডাকে। প্রকৃতির কালিমালিপ্ত নিষ্ঠুর করাল মূর্তি যেন নি:শব্দে তাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসে। সেই অন্ধকার রাত্রিতে ঘন মেঘে আচ্ছন্ন কালো আকাশে বিচরণ করে আঁধারের ভয়াবহ নৈ:শব্দ। সেই নৈ:শব্দ ভয়ঙ্কর, ভীষণ। মাখন সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে।

সাতকড়ি দিনের আলোয় আসে না। ঘরে ফিরে অন্ধকারে, চাদর মুড়ি দিয়ে।পুত্রস্নেহে বিগলিত বিরাজবালা অফুরন্ত স্নেহ প্রদর্শনে জানতে চান কেমন ছিল সে জেলে, কতখানি কষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়েছে। বাড়ির সবাই সাতকড়িকে দেখে বেরিয়ে আসে। শুধু একটি মানুষকে সাতকড়ি দেখতে পায় না, সে মাখন। বুদ্ধিমতী বিরাজবালা মাখনের হাবভাব লক্ষ করে একটা কিছু আন্দাজ করে নেন। এবং গলা নামিয়ে বধূকে শাসন করতে থাকেন সাতকড়ির সামনে সে যেন এই বিষমুখ নিয়ে না এসে দাঁড়ায়। মাখন ও বিরাজ, সাতকড়ির স্ত্রী ও মাতা দুটি বিপরীতমুখী কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে উভয় উভয়কে চিনতে ও বুঝতে পারে। হয়তো সেজন্যে বিরাজ মাখনকে ছেলের পক্ষ নিয়ে তেমন কিছুই বোঝাতে পারে না, বরঞ্চ এক ধরনের ভয় ও অসহিষ্ণুতা তাকে আচ্ছন্ন করে তুলতে থাকে। ছেলের অপরাধ অত্যন্ত লজ্জাজনক, বধূর পক্ষে সেই অপরাধ ক্ষমা না করাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু যেহেতু বিরাজের কাছে ছেলের অঙ্গাঙ্গী অংশ ব্যতীত মাখনের দ্বিতীয় কোনও অস্তিত্ব নেই, সেইজন্যে মাখনের এই বিতৃষ্ণ মনোভাব বিরাজের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে, মাখনের এই ক্ষমাহীনতাকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না।

পূর্বেই মাখন স্বামীকে চিনেছিল। যদিও অভ্যস্ত দাম্পত্য জীবনে অনুভূতিহীন একটি মিলনসূত্র উভয়ের ছিল, এবং সেটাই ছিল মাখনের কাছে একধরনের স্বস্তিবোধ। সাতকড়ি জেলে যাওয়ার পর সেই স্বস্তিটুকু অপহৃত হলো, সুতীব্র উৎকন্ঠা আর মানসিক চাপ নিয়ে মাখনের কাছে ভীতিপ্রদ হয়ে উঠছিল এই ৭ই, সাতকড়ির ফিরে আসার দিনটি। আজ মাখনের “সব লুপ্ত হইয়া গেছে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর উপর নিপতিত জলবিন্দুর মতো সে এতোবড় ব্রহ্মান্ডের কোথায় যাইয়া আশ্রয় লইয়া অদৃশ্য হইয়া গেছে, তাহার উদ্দেশ নাই।

মাখন স্বামীর চোখের উপর চোখ পাতিয়া রাখিল। সে দৃষ্টির অর্থ কি সাতু তাহা বুঝিল না, সে বুঝিল না যে, দুজনাই মানুষ হইলেও তাহাদের জগৎ বিভিন্ন কোনো অপরিচিত জগতের, অনভ্যস্ত আত্মা যেন জগতের আত্মার কাছে বন্দী হইয়া আসিয়াছে, পুরুষের দিকে স্ত্রীর এই দৃষ্টি বিভীষিকার সম্মুখে মূর্ছিতার বিহ্বল দৃষ্টি, নিঃশব্দ আর্তনাদ… ”

তখন সাতকড়ির ভাবনার জগত নারীদেহের রূপকে কেন্দ্র করে আবিষ্ট, শয়নকক্ষে বসে সে ভাবছিল সশ্রম কারাবাসের দিনগুলির কথা, মনে পড়ছিল সেই ঝুলনের মেলা, ঐ মেয়েটি, মেয়েটির মুখখানা, কী মনোহারিণী রূপ, মেয়েটির সাথে তখন কেউ ছিল না, এখন কোথায় আছে কে জানে, এই সময়েই প্রবেশ ঘটল মাখনের, সাতকড়ির মনে হলো ভারি সুন্দর মাখন, মেয়েটির চাইতেও। মুগ্ধভাবে আহ্বান জানাল স্ত্রীকে। মাখনের কাছে না আসা, বিহ্বল, বিভ্রান্ত দৃষ্টি তার মনে কোনও আশঙ্কার জন্ম দিল না, কেননা, সাতকড়ি স্ত্রীর মানসিক স্তরবিক্রিয়া অনুশীলনযোগ্য ব্যক্তিই নয়, তা ছাড়া তার কাছে স্ত্রীলোক কোনও আলাদা অস্তিত্বই নয়, একমাত্র ভোগ্যবস্তু। সুতরাং স্ত্রীর এই ব্যবহারে —

“সাতু হাসিতে লাগিল, বলিল, বড়োই অভিমান যে, ডাকছি তা আসা হচ্ছে না। ঢঙ দেখলাম বিস্তর। নেও হয়েছে, এসো এখন, না কি আমাকেই উঠতে হবে?

মাখন চোখ নামাইয়া মাটির দিকে চাহিয়া একবার ঢোক গিলিল, তাহার বুক ধড়ফড় করিয়া সর্বাঙ্গ যেন কাঠ হইয়া যাইতেছে..সাতু উঠিতে উঠিতে বলিল — উঃ! বলিয়া বিরক্তি ও শ্লেষ প্রকাশ করিয়া সে উঠিল।”

সাতকড়ির এই উঠে আসা, যেন মুমূর্ষুপ্রায় হতচেতন অসহায় প্রাণীর দিকে মাংসলোলুপ শিকারির ধাবমানতা। এতদিনকার জমাটবাঁধা ঘৃণা, বিরাগ, আতঙ্ক একযোগে মাখনকে নিয়ে গেল বিহ্বলতার চরম পর্যায়ে, দেওয়ালের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সে সরে যেতে লাগল, যেন দেওয়ালের বাইরে যে উন্মুক্ত, অবারিত পৃথিবী রয়েছে সেদিকেই তার গতি, আবিষ্টের মতো সরতে সরতে একসময় দেওয়ালের ঘর্ষণে কেটে গেল তার পিঠের চামড়া, আতঙ্কের চরম পর্যায়ে মাখন অনুভব করল অগ্রসরমান সাতু, দেহ সঙ্কোচনের অবকাশহীনতা এবং সাতুর কলুষ স্পর্শ। বিস্রস্ত মাখনের সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বিস্ফোরিত হলো লক্ষ লক্ষ বিষাক্ত হুলের আক্রমণ। সেই হুলের জ্বালা বিস্তৃত হলো মাখনের সমগ্র অস্তিত্বে, যেন বিদ্যুতের আগুনে অগ্নিবর্ণ হয়ে মাখন এতক্ষণে নিজেকে প্রসারিত করতে সুযোগ পেল, বিস্মিত সাতকড়ি তা দেখল, কিন্তু গ্রাহ্য করল না।

“সাতু তাহা দেখিল, এমন ব্যাপার না দেখিয়া উপায় নাই, কিন্তু সাতু তাহা গ্রাহ্য করিল না, তা করিবার মন হইলে সে জেলে যাইত না। বলিল — সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় একটা কথা আছে না, অমন করে চাইলে কি হবে, আমার…”

কথা শেষ করার অবকাশ সাতু পেল না, মাখন হাত তুলল, এই হাত তোলার ভঙ্গিটি বড়ো অসাধারণ, নিজেকে রক্ষা করতেই মাখন হাত তোলেনি, তার উদ্দেশ্য আরও ভয়ঙ্কর, মারাত্মক। এবার আর সাতুর ভুল হলো না, ভয় পেয়ে পিছু হটে জিজ্ঞেস করে-মারবে নাকি?

মাখন বলিল — আমাকে ছুঁয়ো না।

— যদি ছুঁই?

— ভালো হবে না।

শুনিয়া সাতুর বুক কাঁপিয়া উঠিল। নিজের হাতে হামেশাই থাকে বলিয়া তৎক্ষনাৎ মনে হইল, তীক্ষ্ণ একখানা অস্ত্র তাহার স্ত্রীর বাঁ হাতে আছে। আঁচলে তা ঢাকা আছে।

সাতু ফিরিল। প্রাণভয়ে পলাইবার মতো করিয়া ছুটিয়া যাইয়া দড়াম করিয়া দরজা খুলিয়া বাহিরে সে চেঁচাইয়া ডাকিল- মা।

বিরাজ ঘুমায়েরদোয়া নি। দেড় বৎসর কারাবাসের পর ছেলের বাড়ি ফিরে আসার উৎকন্ঠা অপনোদনের শ্রান্তি এবং মাখনের অস্বাভাবিক (বিরাজের কাছে) আচরণের ভাবনায় বুঝিবা ঘুম আসেনি। ছেলের আতঙ্কিত কণ্ঠ কানে যেতেই সে ফিরে, কি হলো রে, বলে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।

সাতু বলিল -বউকে বের করে আনো মা, ওঘরে আমি যাবো না, মারবে বলছে।

বিরাজ ঠিকরাইয়া উঠিলেন — মারবে বলছে?

— তা পারে, ওর কাপড়চোপড় ঝেড়ে দেখো-ছুরিছোরা বোধ হয় ওর কাছে আছে।

শুনিয়া বিরাজ হতজ্ঞান হইলেন।”

দেড়টি বছর বড় কষ্টে কেটেছে বিরাজের, দু:খের দিন সহজে ফুরোতে চায় না, উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে এই বৎসরের দিনগুলি ছিল দীর্ঘ। আজ ছেলের ফিরে আসায় যদিও তার অবসান ঘটেছে, তবু সাতুর ক্লান্ত শীর্ণ চেহারা দেখে বিরাজের কিছুই ভালো লাগেনি, তদুপরি মাখনের একগুঁয়েমিতে তার বিরক্তির অন্ত ছিল না, এখন ছুরি নিয়ে বউ ছেলেকে মারতে উদ্যোগী হয়েছে শুনে বিরাজ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হলো এবং মাখনের কাপড়ের অন্তরালে ছুরি লুকানো আছে কি না সে ভয় না করেই একলাফে তার সামনে উপস্থিত হয়ে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বারান্দায় বের করল, বারান্দা থেকে উঠোনে, উঠোন থেকে সদর দরজার বাইরে। উপর থেকে বড়ো ছেলে সতীশ জিজ্ঞেস করল — সদর দরজা কে খুলেছে?

সাতু উত্তর দিল- মা। এবং তারপর দু:খিত কণ্ঠে বলে উঠল — “জেলই আমার ছিল ভালো। ”

“বিবেক” শব্দটি যতখানি গালভরা ততটুকুই অবাস্তব বেশ কিছু মানুষের ক্ষেত্রে। পাশাপাশি দুটি মানুষ অবস্থান করে কিন্তু তাদের মনোগত অবস্থান সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমাজ চেনে সবলতাকে। অর্থ, প্রভাব, প্রতিপত্তি, সম্মান, খ্যাতি, শারীরিক জোর প্রাধান্য পায় সমাজের কাছে। তাই নারীসমাজ সন্তানের জন্মদাত্রী হয়েও সমাজে ব্রাত্য হয়ে থাকে এবং নির্ধারিত পণ্য হিসেবে তার মূল্য বিচার হয়। জগদীশ গুপ্তের গল্পবলয় এই বৃত্তকেই বারবার আলোকিত করে তোলে। সম্ভবত এই সত্যকে অত্যন্ত নির্মোহে উপস্থাপন করার অসাধারণ দক্ষতার দরুণ তাঁর গল্প সেই অর্থে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নি। [ক্রমশ]


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন