তিনশো বছরের বেশি বয়সি কলকাতা আদিতে ছিল এক জলাজংলা জায়গা৷ কলকাতা তখন আক্ষরিক অর্থেই ছিল জঙ্গল। সপ্তগ্রামের বসাক ও শেঠ পরিবার কলকাতার ‘জঙ্গল-কাটানো’-র মূল কারিগর। সপ্তগ্রাম-বন্দর নাব্যতা হারালে তারা হাওড়ার পর্তুগিজ অধ্যুষিত বেতোড়ের হাটে বাণিজ্য করতে আসে। সেখানে সুবিধে না হওয়ায় তারা ভাগীরথীর উল্টোপারে সুতানুটি হাটের পত্তন করে। এর জন্যে জঙ্গলাকীর্ণ তথা অরণ্যসঙ্কুল কলকাতার জঙ্গল সাফ করতে হয় তাদের।
অরণ্যদ্রুম, গাছগাছালি, লতাগুল্মে পূর্ণ কলকাতায় তখন দিনের বেলাতেও হিংস্র শ্বাপদের গর্জন শোনা যেত৷ খালবিল-নদীনালা-বাদাবনে ভরা সোমত্থ চেহারা তখন নাগিনীকন্যার৷ কলকাতা-সুতানুটি-গোবিন্দপুর নিয়ে কলকাতা পত্তনের আগে থেকেই শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের নামশরীরে বৃক্ষলতাদি থাবা বসিয়েছে৷
উত্তর কলকাতার সিমলা তথা সিমুলিয়ায় শিমুলগাছের আধিক্য ছিল, এন্টালিতে ছিল হেঁতাল বা হিন্তাল গাছের সারি৷ বাঁশদ্রোণীর নদীনালায় বাঁশ দিয়ে তৈরি ডোঙা বা ডিঙি নৌকা চলছে তখন৷ আমদের ‘ধর্মতলা’ যে আসলে ‘দ্রুমতলা’ বা ‘দুরমোতলা’, ধর্মের কারবারিদের তা কে বোঝাবে? বৈঠকখানা বাজারের বিখ্যাত বটগাছতলায় জোব জার্নক সাহেব সপার্ষদ একটু জিরিয়ে নিতেন বলে শোনা যায়৷ তবে বটতলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘর উত্তর কলকাতার শোভাবাজার সন্নিহিত বটতলা হলেও, বটগাছ একা তার পেটেন্ট দাবি করছে না৷ বট অর্থে মুখরোচক তেলেভাজা-বড়াও ক্রেডিট নিচ্ছে৷ পুরোনো কলকাতার হোগলকুড়িয়ায় ছিল হোগলাবাগান, সুকুমার সেনের মতে হোগলা থেকেই কলকাতার কাছের জেলা হুগলির নাম এসেছে৷ নোনাডাঙা, বাদামতলা, পেয়ারাবাগান, লেবুতলা, চালতাবাগান, কলাবাগান বস্তি নিয়ে শহর কলকাতার আবহমানের ফলার৷ পলতা, পটলডাঙা, নিমতলা, কলকাতার পেট ঠান্ডা ও আত্মার শুদ্ধিকরণ করছে চিরটা কাল ধরে৷
পুরনো কলকাতার দুর্গ-মর্গ-স্বর্গের রাস্তা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ছিল ফণীমনসা ও শিয়ালকাঁটায় জর্জরিত৷ পদ্মপুকুর, একডালিয়া ও ফুলবাগান, — এই সমস্ত তল্লাটে প্রস্ফুটিত ফুলের সঙ্গে গাছগুলিও বেশ মনোহর৷ বেলগাছিয়ায়, বেলতলায় বেলগাছ যে এক সময় ছিল, তা বোঝার জন্য ন্যাড়াকে বারবার বেলতলায় যেতে হয় না৷ শহর কলকাতায় গাদাগুচ্ছের গাছ যখন ছিল, বাগান তো থাকতেই হবে৷ বকুলবাগান, জোড়াবাগান, চোরবাগান, কলাবাগান, চালতাবাগান, মোহনবাগান, — কত বাগনের ছড়াছাড়ি৷ বাদুড়বাগানের বাদুড় কী গাছে ঝুলতো, তা ঠিক বলতে পারবো না। বাগবাজারের পলাশির যুদ্ধকালীন পেরিনস গার্ডেন অধুনা অবলুপ্ত হলেও, ধর্মতলায় ইডেন গার্ডেনস এখনও তার সান্ধ্যধর্ম ও ক্রিকেট ধর্ম পালন করে চলেছে৷ পুরোনো কলকাতায় সাপগাছি, কাঁকুড়গাছি ছিল৷
কলকাত্তাই বাবুবিবিদের আমড়াগাছিও ছিল৷ সাপগাছির দেখা মেলে না আর৷ কাঁকুড়গাছি তার বারো-তেরো অনুপাত নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে, এখনও ধর্মকর্ম করছে৷ উত্তর কলকাতায় হোগলাবাগান ভরা হোগলাকুড়ে ছিল৷ গঙ্গাতীরের নাবাল জলাজমিতে শণ-পাটে ভরা শণগাছিও ছিল৷ উত্তর কলকাতার শণগাছিই কি সনাগাছি হয়ে এখনকার সোনাগাছি? পণ্ডিতগণ সোনাগাছি নামটির মূলে সোনা গাজীর মাজারের কথা বললেও, ‘সোনাগাছি’ই মনে হয় বেশি প্রণিধানযোগ্য, যেহেতু শণপাট/গাছ বেশি প্রাচীন৷ কলকাতায় আমতলা-জামতলা-লিচুতলা-শিউলিতলার ছড়াছড়ি৷ কত গলিতে কত গাছের নাম যে লুকিয়ে আছে, তার ইয়ত্তা নেই৷ ‘এ কলকাতার ভেতর আছে আর-একটি কলকাতা৷’ বড়োবাজারের আমড়াতলার মশলার খুশবু সমস্ত কলকাতার শরীর থেকে যেন ভেসে আসছে৷ কলকাতার প্রাচীন মানচিত্রে সাহেবরা বড়বাজারের আমড়াতলাকে ওমরাতলা লিখেছেন৷ হয়তো আমীর-ওমরাদের বাসছিল এখানে। একদা গাছগাছালিতে পূর্ণ কলকাতা কি ক্রমশ কংক্রিটের ‘জঙ্গল’ হয়ে যাচ্ছে?
বরং লবণহ্রদের দিকে কলকাতার আসল রূপটা কিছুটা ধরা পড়ছে। নলবন এলাকার মোচ্ছবের মধ্যেও কোথাও কোথাও কাশফুল চোখে পড়ে, উলুখাগড়ার জঙ্গলও মাঝে মাঝে উঁকি মারে।