বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী নিঃসন্দেহে মা কালী। কালী শুধু জনপ্রিয় নয়, বাঙালির যেন নিজস্ব সৃষ্টি তিনি। অনেকেই বলেন কালীঘাটের কালী থেকে নাকি কলকাতার নামকরণ হয়েছে। এই কারণেই প্রবাদ রয়েছে “কালী কলকাত্তাওয়ালী”।
কালী করালবদনি, উলঙ্গিনী, অনন্ত যৌবনা, ঘোর কালো অথবা নবদূর্বাদলশ্যাম, মেঘবর্ণা, লোলজিহবা, শিবের বুকে পা দিয়ে দন্ডায়মান,চতুর্ভুজা–এক হাতে উদ্ধত খড়গ, অন্যহাতে অসুরের ছিন্নমুন্ড, অপর দুহাতে বরাভয় ও ভক্তকুলভয়হারিনী মুদ্রা। কালী শুধু তামসাবৃত নয় কাল বা সময়ের প্রতীক তিনি–তাই তাঁর নাম কালী।
দেবীর কৃপাধন্য এই বাংলায় ভক্তের সংখ্যা অগণ্য। ভক্তের মাঝে সেসব মানুষ আছেন যারা দেব কর্মে নিজেদের সমর্পণ করেছেন, আছেন আমাদের মত সংসারী মানুষও। দুঃখ পেলে তাকে ডাকি, আনন্দ হলেও তাকে বলি, আঘাতে ভেঙে পড়লে তাঁর কোলেই আশ্রয় খুঁজি। মায়ের মন্দিরে সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে দর্শন করলে অনাবিল শান্তিতে ভরে ওঠে প্রাণ। সামনেই কালী পুজা। তাই বাংলার জাগ্রত কিছু মন্দিরের তথ্য রইলো আপনাদের জন্য।
আদ্যাপীঠ:
শ্রীরামকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র দক্ষিণেশ্বরের কিছুদূরেই দেবী আদ্যার পীঠস্থান—আদ্যাপীঠ।দেবী কালী এখানে আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে পূজিতা হন। স্বপ্নাদেশে শ্রীরামকৃষ্ণের আদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠাতা করেন অন্নদাঠাকুর–অন্নদাচরণ ভট্টাচার্য। অন্নদাঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় ঠাকুর স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন,’ওরে ওঠ, সময় হয়েছে! ইডেন গার্ডেনের যেখানে পাকুড় গাছ আর নারকেল গাছ একসঙ্গে উঠেছে তার ঠিক নিচেই একটি মূর্তি পাবি। তিনজন ভক্ত সঙ্গে নিয়ে যাবি আর তুই মৌনী থাকবি। মূর্তিটা যতদূর সম্ভব গোপন রাখবি তারপর যেমন আদেশ হয় সেই মতো কাজ করবি।’
অন্নদাঠাকুরকে এই পর্যন্ত নির্দেশ দিয়ে ঠাকুর স্বপ্নেই অন্তর্ধান হলেন। দুই শতীন আর সত্যকে সঙ্গে নিয়ে অন্নদাঠাকুর ইডেনের অগ্নিগণ দিয়ে প্রবেশ করে খুঁজে পেলেন নির্দিষ্ট স্থানটি। জায়গাটি অপরিষ্কার। খুঁজতে খুঁজতে সত্যর মনে হলো তবে কি ঠাকুর জলে? অন্নদা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে স্পর্শ পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে জল থেকে তুলে আনলেন মূর্তিটি। তারপর সোজা গাড়ি ভাড়া করে শচীনের বাড়ি।
মূর্তি খানি এক ফুট থেকে সামান্য উঁচু। একখন্ড কালো কষ্টিপাথরকে খোদাই করে বানানো হয়েছে মা কালীকে।মায়ের মাথার মুকুট থেকে হাতের খাঁড়া,পদ্মাকৃতি প্রস্তরাসন এবং তার ওপর শায়িত শিবমূর্তি সবই যেন নিখুঁতভাবে গড়া এমনকি শিবের হাতের মালা ও ডমরুও দৃশ্যমান। মায়ের প্রকাশিত জিহ্বা এবং হাতের মুণ্ডটিও অক্ষত।
রামনবমীর দিন মা এলেন তাকে পূজা করা হবে না? যথাসাধ্য আয়োজন করে পূজা করলেন অন্নদাঠাকুর। এরপর মাকে লুকিয়ে রাখলেন তালাবন্ধ ট্রাঙ্ক-এ। সেই রাতেই মা স্বপ্নে দেখা দিলেন এবং বললেন, ‘কাল বিজয়া দশমী আমাকে নিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসবে , তাহলে আমি বড় সন্তুষ্ট হবো।’
অন্নদা মায়ের এই নির্দেশ মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না তবুও মানতেই হবে।
অবশেষে নৌকা চাপিয়ে মাঝ গঙ্গায় বিসর্জন দিলেন সেই মূর্তিটিকে। যদিও তার আগে মায়ের অনুমতি নিয়ে মূর্তির একটি ছবি তুলে রেখেছিলেন এবং মা স্বয়ং অন্নদাকে স্বপ্নে শুনিয়েছিলেন নিজের স্তব ও পূজোর পদ্ধতি। সেই আদ্যাস্তোস্ত্র পাঠ করে পুজা করা হয় আদ্যাপীঠে।
১৩২৫ বঙ্গাব্দে ঝুলন পূর্ণিমার রাতে আবার স্বপ্ন দেখা দিলেন ঠাকুর, বললেন মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং সেবা ধর্মের কথা। ১৩২৭ পৌষ সংক্রান্তির দিন আদ্যামায়ের আদেশে অন্নদা ব্রত উদযাপন করলেন–সিদ্ধৎসব। সাধনগৃহের লাগোয়া হরি ঘোষের জমিতে একটি ছোট্ট মন্দির তৈরি করে আদ্যামায়ের একটি প্রতিমূর্তি ছবি স্থাপন করা হলো। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে বর্তমান আদ্যাপীঠের জমি কেনা হয়। যার মধ্যে ছিল জীর্ণ ছটা শিব মন্দির। তবে এখানকার মন্দির দেখে যেতে পারেননি অন্নদঠাকুর। নির্দেশ ছিল ১২ বছরের মধ্যে মন্দির সম্পূর্ণ নির্মাণ হলে মন্দিরে সাধারণের প্রবেশ অবাধ থাকবে কিন্তু মন্দিরটির কাজ সম্পূর্ন করতে বারো বছরের বেশি সময় লাগে। তাই আজও নাট মন্দির থেকে দর্শন করতে হয় দেবীকে।
মন্দিরের গর্ভগৃহে সবার উপরে রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি, ১২ বছরের ছেলে মেয়ের ন্যায় — লেখা আছে প্রেম। দ্বিতীয় চূড়ায় আট বছরের কুমারীসম আদ্যামা, লেখা জ্ঞান ও কর্ম। আর প্রথম চূড়াতে গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ। ঠাকুরের নির্দেশে অন্নদাঠাকুর বোঝাতে চেয়েছেন গুরুকে ধরে জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে প্রেমের সন্ধান থেকে পেতে হবে। আদ্যামার মূর্তিটি অষ্টধাতুর তৈরি আর অন্য দুটি পাথর খোদাই করে গড়া।
অন্নদাঠাকুরের ‘স্বপ্নজীবন’-এ বর্ণিত শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে প্রত্যহ মন্দিরে ভোগ নিবেদনের একটি নিয়ম আছে। রাধা কৃষ্ণের সাড়ে ৩২ সের, আদ্যামায়ের সাড়ে বাইশ সের আর রামকৃষ্ণদেবের সাড়ে বারোসের চালের অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। পঞ্চব্যঞ্জনে সেই ভোগ উৎসর্গ করে দেওয়া হয় আশ্রমের লোকজন ও দীন-দুঃখীদের মধ্যে প্রসাদ হিসেবে, সঙ্গে থাকে পরমান্ন ভোগ।
আড়াইসের সুগন্ধী চাল, পাঁচ পো ঘি, পেস্তা, আড়াই পো কিসমিস, পাঁচ ছটাক বাদাম, সাত পোয়া চিনি, লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা ও জাফরান সহযোগে পাক দিয়ে অমৃতভোগ নিবেদন করা হয় শয়ন আরতির আগে।
স্বপ্নাদেশে ঠাকুরের নির্দেশেই দ্বিতীয় মন্দিরের চূড়ায় আছে হিন্দুদের ত্রিশূল, মুসলমানদের চাঁদ-তারা, বৌদ্ধদের পাখা আর খ্রিস্টানদের ক্রশ।
মন্দিরে গরমকালে ভোর সাড়ে চারটে ফল সন্দেশ শরবত দিয়ে এবং শীতকালে সকাল পাঁচটায় ফল সন্দেশ সাদা মাখন ও মিছরি দিয়ে মঙ্গলারতি হয়। এরপর সাতটার সময় তিন দেবতাকে স্নান করানো হয়। সাড়ে দশটার সময় ঠাকুরকে ফল-মিষ্টি নিবেদন, তারপর ভোগ নিবেদন করা হয়। বিকেল চারটে নাগাদ ফল ফলাদি নিবেদন এবং গরমকালের সন্ধ্যা সাতটা আর শীতকালের সাড়ে ছটার সময় নিবেদন করা হয় অমৃত ভোগ। প্রতিদিন প্রসাদ পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। আদ্যাপীঠের আশ্রমিকরাই রান্না করেন। কয়েক হাজার ভক্ত প্রসাদ পান প্রত্যহ।
অন্নদাচরণ হতে চেয়েছিলেন আয়ুর্বেদ চিকিৎসক। কলকাতায় কবিরাজির ডিসপেনসারির জন্য দোকানও ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্ত শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। ঠাকুরের নির্দেশে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। অন্নদা ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁরই নির্দেশে অ্যাম্বুল্যান্সে তৈরি হয়েছে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসালয়। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সের গায়ে “সংক্রামক ব্যাধির জন্য নয়” কথাটি লেখা থাকে না। তাঁর আদেশেই মন্দিরের আয় থেকে বালকের জন্য ব্রহ্মচর্যাশ্রম, বালিকাদের জন্য শিক্ষাদান কেন্দ্র এবং সংসারবিবাগী গৃহস্থের জন্য তৈরি হয়েছে বাণপ্রস্থাশ্রম।
দীপান্বিতা অমাবস্যা শুরু হলে আদ্যাপিঠে বার্ষিক কালীপুজো শুরু হয়। দুর্গাপূজা, বাসন্তীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, ঝুলন পূর্ণিমা, সংঘমাতা মণিকুন্তলাদেবীর জন্মদিন, রামনবমী, ঠাকুরের জন্মোৎসব ইত্যাদি পালন করা হয়। শ্বেত পাথরের তৈরি মন্দিরের ভেতরের প্রতিটি দেওয়ালে কিছু না কিছু কথা লেখা রয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় বিরল গঠনশৈলীতে নির্মিত তিনটি মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদ্যামায়ের দর্শন ও শান্তি অনুভব করতে অতি অবশ্যই ঘুরে আসুন প্রায় ২৭ বিঘা জায়গা জুড়ে আদ্যাপীঠ মন্দিরে।