বুধবার | ৩রা জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:৩৩
Logo
এই মুহূর্তে ::
সুলেখা সান্ন্যাল-এর ছোটগল্প ‘ঘেন্না’ সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (শেষ পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী শোভারাম বসাকের লবণের ব্যবসা : অসিত দাস রাখাইনে সংঘাত ও সেন্টমার্টিন পরিস্থিতি : হাসান মোঃ শামসুদ্দীন খেলার মাঠ থেকে চেম্বারে : রিঙ্কি সামন্ত ছড়া কি শিশুসাহিত্য? : লুৎফর রহমান রিটন কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা দিবস ও ডা: বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মজয়ন্তী পালন : দীপাঞ্জন দে সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (তৃতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (শেষ পর্ব) : গীতা দাস সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (দ্বিতীয় পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (চতুর্থ পর্ব) : গীতা দাস সাবঅলটার্ন দৃষ্টিতে কলকাতার লবণচিহ্ন : অসিত দাস মোদীকে চাপে রাখতে নীতীশ-নায়ডুর রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা দাবি : তপন মল্লিক চৌধুরী সুখীমানুষদের দেশ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ডাইরি (প্রথম পর্ব) : নন্দিনী অধিকারী বাঁধে ইঁদুরের তৈরি গর্ত দিয়ে ঢোকে বন্যার জল চলছে সংস্কারের কাজ : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (তৃতীয় পর্ব) : গীতা দাস কবি সঞ্জীব প্রামাণিক, আবহমান বাংলা কবিতার পথে হেঁটে-যাওয়া এক কবিতাভিক্ষুক : অমৃতাভ দে সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘বিলাসী’ বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (দ্বিতীয় পর্ব) : গীতা দাস সাত্যকি হালদার-এর ‘ছোটগল্প’ কাজলদিঘি ডায়েটে আনতে হবে কয়েক টুকরো নারকেল তাহলেই কেল্লাফতে : রিঙ্কি সামন্ত বাতাসে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে বাঁশগাছের কদর বাড়ছে : মোহন গঙ্গোপাধ্যায় বেগম রোকেয়ার রচনায় লোকজ জীবন অভিজ্ঞতা (প্রথম পর্ব) : গীতা দাস স্পিকার নির্বাচন থেকেই শুরু হল সেয়ানে সেয়ানে টক্কর : তপন মল্লিক চৌধুরী বাসুলী লবণের দেবী (দ্বিতীয় পর্ব) : অসিত দাস শক্তিপদ রাজগুরু-র ছোটগল্প ‘পাখিরা আর নেই’ বিস্মৃত কথাসাহিত্যিক সুলেখা সান্যাল : আনিসুর রহমান ময়মনসিংহের গৌরব কেদারনাথ মজুমদার (শেষ পর্ব) : দিলীপ মজুমদার লেডি ম্যাকবেথ, ওয়াটার আঙ্কেল ও আমি : সসীমকুমার বাড়ৈ জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষার জনক : মনোজিৎকুমার দাস
Notice :

পেজফোরনিউজ ডিজিটাল পত্রিকার পক্ষ থেকে সকল বিজ্ঞাপনদাতা, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে জানাই জগন্নাথদেবের শুভ স্নানযাত্রার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।  ❅ আপনারা লেখা পাঠাতে পারেন, মনোনীত লেখা আমরা আমাদের পোর্টালে অবশ্যই রাখবো ❅ লেখা পাঠাবেন pagefour2020@gmail.com এই ই-মেল আইডি-তে ❅ বিজ্ঞাপনের জন্য যোগাযোগ করুন,  ই-মেল : pagefour2020@gmail.com

সৌমেন দেবনাথ-এর ছোটগল্প ‘বিলাসী’

সৌমেন দেবনাথ / ৬২ জন পড়েছেন
আপডেট শনিবার, ২৯ জুন, ২০২৪

মেয়ে হিসেবে বিলাসী লক্ষ্মীই। যেমন সুন্দর করে সাজতে জানে, তেমন সুন্দর করে ঘরের কাজ-কর্মও করে। আয়নায় চেয়ে দেখলো চোখের নিচে সামান্য কালো দাগ দেখা যাচ্ছে। কনসিলার দিয়ে স্পট, ডার্ক সার্কেল ঢেকে দিলো সে। চোখের লিডে হালকা ব্রাউন কালার আইশ্যাডো দিলো। চোখে ভারী করে মাশকারা ও ঘন কাজল দিয়ে সাজে সে। মাশকারা দেওয়ার আগে আই ল্যাশে একটু পাউডার ব্যবহার করে যাতে মাশকারা না ছড়ায়। চোখ সাজাতে এত সময় দিলো দেখে ঋষভ বললো, চোখ সাজাতে যদি এত সময় দাও, কাজ করবে কখন?

বিলাসী বলে, কোন কাজটি না করে আমি সাজতে বসেছি জানাও।

ঋষভ বলে, খরচও তো কম করো না।

বিলাসী বলে, আমি সাজবিলাসী, কিন্তু ব্যয়বিলাসী নই। কখনোই তোমার খরচ লাগাই না আমি। সাজসজ্জার জন্য কানের দুল, গলার হার, ব্রেসলেট, লিপস্টিক, স্নো, ক্রিম, পাউডার, মেকআপ বক্স আমার দিদি কিনে দেন আমাকে। বছরে একটি শাড়ি নিই, তুমি প্রশান্তিতে আছো; অন্যকোনো পরিবারের কোনো নারীর সাথে আমায় তুলনা করে দেখে নিও।

ঋষভ চলে যায়। বিলাসী সাজসচেতন, একটু না সাজলে তার ভালো লাগে না। আর একটু সাজলেই নানা কথা তাকে শুনতে হয়। ট্রেন্ডিং ফ্যাশন পছন্দ করলেও খুব বেশি স্টাইলিশ নয় সে, আবার বেশি ট্র্যাডিশনালও নয়। গায়ের রং যেমনই হোক না কেন সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজলে যে-কেউ হয়ে উঠে আকর্ষণীয়। লিপস্টিক পরার আগে ঠোঁটে সামান্য পেট্রোলিয়াম জেলি ঘঁষে নেয় সে, তাতে লিপস্টিক ছড়ায় না। লিপ প্রাইমার ব্যবহার করে ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করে, গাঢ় রঙের লিপস্টিক তার পছন্দ নয়। লিপস্টিক পরার পর ঠোঁটের চারপাশে সামান্য হাইলাইটার লাগিয়ে দেয়, লিপস্টিকের রং দীর্ঘস্থায়ী করতে ট্রান্সলুসেন্ট পাউডার দেয়। মেকআপের মধ্যে অবশ্যই সে ওয়াটার স্প্রে ব্যবহার করে, যাতে ফ্রেশ দেখায়। শেষে হালকা পাউডার ব্লাশন গালে ও নাকে দিয়ে মেকআপ শেষ করে। ঋষভ ঘরে এসে দেখে এখনও ড্রেসিং টেবিলে বসে আছে বিলাসী। তাই বললো, সাজগোজ করে যারা অলসতায় সেরা তারা।

বিলাসী স্বামীর কথার উত্তর না করে উঠান ঝাড়ু দিতে চলে গেলো। স্বামী তো কোথাও তাকে ঘুরতে নিয়ে যায় না, নিজের দুঃখ নিজেই পোষে, নিজের জন্য নিজেই ভাবে, নিজের দুঃখ-কষ্ট কাউকে বলে না। সেজেগুজে কখনও গোয়ালঘরে যায়, কখনও রান্নাঘরে যায়, কখনও উঠান ঝাড়ু দিতে যায়। মেকআপের শুরুতে যেমন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করেছিলো, মেকআপ রিমুভার দিয়ে মেকআপ তুলে স্নান করে এসে আবার ময়েশ্চারাইজার দিলো।

কথা বলার ধরনও সুন্দর, সুন্দর করে কথা বলতে জানা যে একটি নিপুণ গুণ তা বিলাসীর ভেতর আছে। বিলাসীর ভেতর যে একটি বদাভ্যাস আছে তা সে বাদ দিতে পারে না, অবশ্য প্রতিটি মেয়ের ভেতরই এই বদাভ্যাস থাকে। এই যে একটু সাজতে ভালোবাসে, তাই সময় পেলেই নিজেকে সাজায় সে। সাজতে ভালোবাসে না এমন নারী খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রতিটা নারীই চায় তাকে লাগুক সবার মাঝে নজরকাড়া। সুন্দর করে সাজতে জানা এক ধরনের শিল্প। সুন্দর করে সাজে বিলাসী, লাগে পরির মতো। মেয়েরা সাজে চেহারার সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য। মেয়েরা সাজে ছেলেদের দেখানোর জন্য নয়। মেয়েরা শুধু রূপচর্চার জন্য সাজুগুজু করে না। অধিকাংশই মন ভালো করার জন্যই সাজুগুজু করে। সাজুগুজু করা মেয়েদের মন ভালো রাখার মেডিসিন। কিন্তু অধিকাংশ পুরুষই ভাবে, মেয়েরা সাজে ছেলেদের দেখানোর জন্য। যেমনটি তার নিজের স্বামীও ভাবে। বিলাসীকে তাই তার স্বামী বিলাসীকন্যা বলে। বিলাসীর কথাটি ভালো না লাগলেও বলে, হ্যাঁ আমি বিলাসীই, তবে ঘ্রাণ বিলাসী। আমের কুড়ি দিও, না হয় জিরার গুঁড়ো দিও; আমার ঘ্রাণ বিলাসীতা আছে।

বাঁকা চোখে চেয়ে থাকে ঋষভ বিলাসীকে বিলাসীকন্যা বলার পরও বিলাসীতা নিয়ে কথা বলার কারণে। বিলাসী আবার বলে, রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আমায় নিয়ে বসবে একদিন? বসন্ত বিলাসীতা আছে আমার।

ঋষভ বলে, আর?

স্পষ্টই আর শব্দটি সে তাচ্ছিল্যস্বরে বলেছে। তাতে কর্ণপাত না করে বিলাসী বললো, পুঁইশাকের বেগুনি ফুল, জামের বেগুনি কষ দিও; আমার রং বিলাসীতা আছে।

ঋষভ এবার একটু ক্ষুব্ধই হয়ে বললো, বিলাসীতা মানেই ব্যয়বিষয়।

বিলাসী একটু হেসে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে; বেলীফুল, রজনীগন্ধা না দিও, দিও শিশির ভেজা ভোরের শিউলিতলায় ফুল কুড়ানো ঝরা ফুল, আমার ফুল বিলাসীতা আছে।

ঋষভ ভ্রূ বাঁকিয়ে বলে, তাই?

বিলাসী বলে, হাসনাহেনা, গন্ধরাজ ফুল বা বকুল ফুলে নয়; কচুরিপানা ফুলেই আমার বিলাসিতা। ব্যয়বিষয় আসবে না এই বিলাসীতায়।

বিলাসীর কথার সাথে ঋষভ না পেরে বাইরে চলে গেলো। ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরো বের করে ত্বকে ঘঁসতে থাকে বিলাসী। বরফের টুকরো ত্বকের তৈলাক্ত ভাব কমায়। ফেস পাউডারও ব্যবহার করে, মুখের অতিরিক্ত তেল নিয়ন্ত্রণ করে ফেস পাউডার। শাশুড়ি মা দেখে বলেন, ত্বক নিয়ে থাকলে হবে? রান্নাঘরের কথাও তো ভাবতে হবে! নিজের মেয়েকেও তো বিবাহ দিয়েছি, ওর তো সংসারের চাপে সাজগোজের কথাও মনে থাকে না!

ঘরের কাজ রেখে সে যে নিজের যত্ন ভাবে না কীভাবে বোঝাবে যদি দেখেও না দেখেন মা। রান্না-বান্না করতে চলে গেলো। নিজের সুখ নিজের কাছে, পরের কারণে মন ভালো হবে সে বিশ্বাস করে না ও। তাই ডিম ভাজলে ডিমের খোসায় লেগে থাকা তরল মুখে ঘঁসে, ত্বকের যত্নে খুব দামি কসমেটিকস ব্যবহার করা সবসময় লাগে না। পেছন থেকে এসে ঋষভ দাঁড়ালো। বিমর্ষ মনে কাজ করছে বিলাসী। বেশক্ষণ ঋষভ দাঁড়িয়ে, কিন্তু বিলাসী কোনো কথা বললো না। তাই ঋষভ বললো, অমঙ্গল, অলক্ষ্মী, অপয়া ভাবা হতো যে মেয়েদের তারা এখন বিষণ্নতা আর বিমর্ষতাকে বিলাসীতা করে ফেলেছে।

কথাটি শুনে বিলাসীর মন আরও খারাপ হয়ে গেলো। আজ মেয়ে বলে কত কথা শুনতে হয় তাকে। মনে মনে আক্ষেপ করে ভাবে, মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে সে বাঁচতো।

প্রতিটি নারী জীবনে একবার হলেও ভেবেছে সে পুরুষ হলে ভালো হতো। সংসারে নারী কত যন্ত্রণা সহ্য করে কাজ করে, তবুও আঘাত ছাড়া কিছুই পায় না। সংসারে কাজ করে, কিন্তু তা তো আর রোজগার নয়। নিজের হাতে পয়সা থাকে না, তাই স্বামীর কাছে কিছু হয়তো চায়, স্বামীর কাছে কিছু চাইলেই চাওয়া হয়ে যায় বিলাসীতা। এ দুঃখ-কষ্ট তারা প্রকাশ করতে পারে না। অথচ স্বামীর থেকে একটু আদর-সোহাগ পেলে তারা ব্যথা পাওয়া অপেক্ষা বেশি কেঁদে ফেলে। বিবর্ণ জীবন নিমেষেই শোভনময় ও ঝলমলে হয়ে উঠে। বিলাসী বলে, বিলাসী বিলাসীতা কী বোঝে না, দায়িত্ব কী বোঝে! বিলাসীর জীবনে বিলাসীতা নামে কোনো শব্দ নেই তা নয়। আমার বিলাসীতার প্রথম বিষয় আমার কপালের সিঁদুর, সিঁদুরের লাল রং তোমার দীর্ঘ জীবনের কামনা করে আমি পরি, তোমার মঙ্গলকামনায় আমি সিঁদুরের বিলাসীতা করি। গলায় শ্রদ্ধার সাথে মঙ্গলসূত্র পরি নজরদোষ থেকে বাঁচার জন্য, মঙ্গলসূত্র বিবাহিত জীবনে সুখ এবং স্থিতিশীলতা আনবে বিশ্বাস থেকে আমি মঙ্গলসূত্রের বিলাসী। আমি শাঁখা-পলা-চুড়ি পরি, শাঁখা-পলা-চুড়ি সধবা নারীর সবচেয়ে বড়ো ভূষণ। তোমার মঙ্গল কামনায় শাঁখা-পলা-চুড়ি পরি, শাঁখা-পলা-চুড়ি পরা তাই আমার বিলাসীতা। বিবাহিতাদের নাকের নথ বা নাকছাবি পরার অর্থ হলো বিবাহিত জীবনে শক্তি ও সম্পর্ক মজবুত করা। বিবাহিত মহিলার নাকছাবি একটি শুভ লক্ষণ। নাকছাবি পরা তাই আমার বিলাসীতা। আলতার প্রাণবন্ত লাল রঙ প্রতীকী মূল্য ধারণ করে, যা বিশুদ্ধতা এবং ঐশ্বরিক নারী শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। লাল রঙটি প্রায়শই শুভ, ভক্তি এবং ঐশ্বরিকতার সাথে যুক্ত। তাই আমি আলতা পরি, আলতা পরা আমার বিলাসীতা। নারীদের সম্মান, সম্পদ ও ভালোবাসার প্রতীক হচ্ছে কপালের টিপ। তোমার আমার ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ কপালে সিঁদুরের টিপ পরি আমি। তাই টিপ পরা আমার বিলাসীতা। বাজুবন্দ পরি অর্থ রক্ষার জন্য, আংটি পরি ভালোবাসা ও বিশ্বাসের চিহ্নস্বরূপ। চোখে কাজল পরি, কানে ঝুমকো বা দুল পরি, টিকলি পরি, হাত রাঙাই, চুলে টাটকা ও সুগন্ধযুক্ত ফুল গুঁজি নিজে ভালো থাকার জন্য, তোমার মনোরঞ্জনের জন্য। পায়ের আঙুলে চুটকি পরি, কারণ পায়ের আঙুলে চুটকি পরা বিবাহিত নারীর পরিচয় জ্ঞাপন চিহ্ন। চুটকি অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করে, রোগ-ভোগ থেকে রক্ষা করে। চুটকি পরা তাই আমার বিলাসীতা। রুপার নূপুর পায়ে পরি মানসিক শান্তি আর সুস্থতার জন্য, তাই নূপুর পরাও আমার বিলাসীতা। সর্বোপরি পবিত্র থাকতে স্নান করি, স্নান আমার বিলাসীতার প্রথম বিষয়।

শুনে থ বনে গেলো ঋষভ। আর কোনো কিছু বলার ভাষা পেলো না সে।

রান্না শেষ করে স্নান করে এসে বিলাসী চোখ দুটোকে বৈজ্ঞানিক চোখ করে সূক্ষ্ম করে চেয়ে কপালে দুই ভ্রূর মাঝখানে একটা টিপ পরলো। মুখের কোমলতা ও শ্রী বৃদ্ধি করে টিপ। যেখানে টিপ পরে থাকে সেখানটি তৃতীয় চক্ষুর স্থান। তাই টিপের সঙ্গে সৌভাগ্য জড়িয়ে। সৌন্দর্য ও শিল্পের পূজারীরা টিপ পরে। বিলাসী চওড়া কপালে বড়ো গোল টিপ পরে, লম্বাটে টিপ পরে, অনেক সময় ডিম্বাকৃতি টিপও পরে। তবে স্বামীর মঙ্গলের জন্য সিঁদুরে কনিষ্ঠা আঙুল রাঙিয়ে কপালে টিপ দেয় সে।

স্বামীর দীর্ঘ নীরোগ জীবনের জন্য হাতে শাঁখা পরে, তার দিদি তাকে স্বর্ণ দিয়ে বাঁধানো শাঁখা দিয়েছেন, সেই শাখাটি আজ পরেছে; বিবাহের শাঁখা তো আগে থেকে আছেই। শাঁখাতে প্রেম-ভালোবাসা বাড়ে। কিন্তু স্বামীর মনে আজও তেমন ঠাঁই পেলো না ও। শাঁখা না পরলে স্বামীর পরমায়ু নাশ হয়। তাই পরা শাঁখায় যেন কিছুর আঘাত না লাগে সেদিকেও সে সচেতন থাকে। শাঁখার রিনিঝিনি শব্দ বাড়িতে পজিটিভ এনার্জি বিকিরণ করে। এর ফলে পরিবারে সুখ ও শান্তি থাকে। চুড়ি সোহাগের চিহ্ন, আনন্দ ও সমৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত। তাই চুড়ি থাকা সত্ত্বেও চুড়ির বাহানা করে বসলো বিলাসী। ঋষভ বলে, সৌন্দর্য গহনায় বাড়ে না, সৌন্দর্য বাড়ে চিন্তার গভীরতায় ও মানবিক হৃদয় বিকাশমানতায়।

চুড়ির বাহানা ছেড়ে দিলো বিলাসী। ভাবে, কাচের চুড়ি চাওয়াতেই যদি এত দার্শনিক কথা শুনতে হয় তো স্বর্ণের বালা চাইলে না জানি কী বলতো!

মুখে উচ্চারণ করে বলে, সাজগোজ বা মেকআপ পূর্বজন্মের ঘটনা না।

ঋষভ বলে, এত ভোগ-বিলাসের মোহ মানুষকে ধ্বংস করে।

বিলাসী আর কিছু বলে না। সংসারের কাজে মনোনিবেশ করে। বসে থাকতে দেখলে হয়তো বলে বসতে পারে সময়বিলাসী। প্রিয় ফল লটকন, প্রিয় মাছ পাবদা, আখ প্রিয়; চায় না যদি বলে বসে ভোগবিলাসী! ঘুরতে ভালো লাগে, বলতে পারে না; যদি বলে বসে ভ্রমণবিলাসী! চোখভরা স্বপ্ন, বলতে চায় না; যদি বলে বসে স্বপ্নবিলাসী!

অবশ্য পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে তার সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ, প্রতিবেশীদের কাছেও সে সমান প্রিয়। সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠে যারা তারা দ্রুতই আবার সবার কাছে খারাপ হয়ে উঠে। তবে সবার কাছে প্রিয় যারা তারা প্রকাশ্যে খারাপ হয়ে উঠে না, পেছনের মানুষ খারাপ বলে। একজনের আচরণ অন্যজনের কাছে অনুকরণীয় হলেও অনুকরণ করে না, বরং হিংসা করে। হিংসার স্বীকার ভালো মানুষই হয় বেশি। খোদ বিলাসীর স্বামীই বিলাসীকে ক্ষণে সহ্য করে তো ক্ষণে সহ্য করে না। বিলাসীর ধৈর্য বিলাসীকে জিতিয়ে দেয়। বিলাসীর স্বামী বিলাসীর উপর রেগে গেলে বিলাসী প্রতিউত্তর করে না, তখন সত্য কথাটিও বলে না। সত্য কথা বলা স্বভাব যাদের সময়ে তারা সত্য কথা বলে না। অপ্রিয় সত্য সবসময় বলতে হয় না। সময়ে সে অন্যায্য কথাও মেনে নেয়, সময়ে সে অগ্রাহ্য বিষয়কেও গ্রাহ্য করে; এত কিছু না করলে সংসার করা যায় না, সংসারে টেকা যায় না।

বিলাসীকে ভুল বোঝার মানুষ অনেক। নিজের মানুষটিই যখন ভুল বোঝে তখন তার বেশি কষ্ট লাগে। একটু সাজতে বসলেই ঋষভ বলে, বিলাসিতা করতে গিয়ে সুখ পাওয়া হয় না, অথচ সুখ খুঁজলে সুখ আর বিলাসিতা দুটোই মেলে।

কথাটি শুনতেই বিলাসী মুখ তুলে স্বামীকে দেখে। সে ভেবে পায় না বিলাসীতা করলো কখন৷ সাজসজ্জা নারীর সৌন্দর্য বাড়ায় দ্বিগুণ। সাজসজ্জা করা নারীদের সৃষ্টিগত প্রবণতা। সাজতে বসেছে বলে উঠলো না। এরপর ঋষভকে বললো, দেখো তো কেমন লাগছে!

ঋষভ দেখেও না দেখার ভান করে বললো, কুঁড়ে মানুষের বিলাসীতা বেশি।

এমন কথা শুনলে দুঃখ পেয়ে বসে। একা হয়ে পড়তে হয়। নিজের মানুষের কাছ থেকে এমন কঠিন কথা কানে এলে চোখে জল আসে। মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে মাকে ফোন দিয়ে বলে, মা, আমি কি বিলাসীতা করি?

মা নিজের মেয়ের দোষ দেখেন, অন্যের দোষ দেখলে মেয়ে আশকারা পেয়ে যাবে। তাই বললেন, বিলাসী দ্রব্যের জন্য ব্যয় বাড়ে, সুখ বাড়ে না; সত্য আর সৌন্দর্যের সাথে বসবাস করলে ব্যয় কমে, শান্তি বাড়ে।

বিলাসী বলে, সত্য আর সৌন্দর্যের সাথে আমি বসবাস করি না, তুমি জানলে কীভাবে?

মা বলেন, তুমি কাজ করো, তুমি সবার মন পাবে। কাজ করলে কষ্ট হয় না, বরং কাজ করলে শরীর ভালো থাকে। তুমি অলসতার পরিচয় দিলে সবাই তোমাকে নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবে, এমনকি রোগ-বালাইও তোমাকে আক্রমণ করবে।

মায়ের সাথে কথা বলেও সান্ত্বনা পেলো না। সে ফোন রেখে দিলো। মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকলো। ঋষভ ঘরে এসে দেখে বিলাসী বসে আছে। তাই বললো, বিলাসিতা এমন এক ধ্বংসাত্মক রোগ ও দুরারোগ্য ব্যাধি, যা মানুষের কর্মস্পৃহা, কর্মদক্ষতা হ্রাস করে।

শুনে একটু না রেগে পারলো না বিলাসী। বললো, সংসারের কোন কাজটি আমি করি না? আমার দুটি হাত, দুটি পা কখন থেমে থাকে?

ঋষভ বলে, যে নারী বিলাসিতার মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে জড়িয়ে পড়ে কর্মদক্ষতা তার ধীরে ধীরে শেষ হতে শুরু করে। এক সময় সে দুর্বল হয়ে পড়ে।

শুনে বিলাসী হতভম্ব হয়, তার কাজ তার স্বামীর চোখে পড়ে না, তার সাজগোজই শুধু তার স্বামীর চোখে পড়ে।  কাজ জানা নারীরাই সমাজে কষ্ট ভোগ করে, অথচ কাজ না জানা বা না করা নারীরাই ঘর-সংসারে আধিপত্য রেখে বসত করে। বিলাসী বললো, আমায় তুমি চোখে দেখো না, তাই আমার কাজ চোখে পড়ে না৷ আমায় তোমার ভালো লাগে না, তাই আমাকে আর সহ্য হয় না।

ঋষভ বলে, বিলাসী দ্রব্য দিয়ে আশপাশ সাজানো যায়, ভালোবাসা রাঙানো যায় না।

বিলাসী বলে, ঘরের জিনিস কিনতে জোরারোপ করেছি, ঘর সাজানোর দরকার আছে, ঘর সাজাতে গিয়েই ভালোবাসা ফিকে করে দিলাম!

ঋষভ বলে, অল্পতে তুষ্ট থাকা কাম্য। বিলাসিতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। সীমাহীন বিলাসিতা দুর্ভোগ ও পাপের কারণ। বিলাসী মানুষ জীবনের প্রকৃত রূপ ভুলে যায়।

বিলাসী শুনে বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস কেটে বলে, ঘরনির প্রতি এত নীচু ধারণা কখনোই শুভফল দেবে না, ঘরনিকে বিশ্বস্তে রাখতে জানাও গুণ; ঘরনির কেবল দোষ ধরা আদর্শ স্বামিত্ব না। ব্যক্তিত্বশালিনী, প্রজ্ঞাবতী, জ্ঞানী, যোগ্যা ও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা মেয়েমানুষদের আটকানোর চেষ্টা, থামিয়ে রাখার চেষ্টা পুরুষের গুণগুলোর মধ্যের সেরা গুণ। নারীকে দমন করা, নারীর কাজের প্রশংসা না করা পুরুষের বিলাসীতা। সারাদিন নারী কাজ করলেও সেসব কাজ চোখে না পড়া পুরুষের বিলাসীতা।

ঋষভ ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, তুমি মুখে মুখে কথা বলো যা কখনোই শোভনীয় নয়।

বিলাসী বলে, নারীর থেকে যথোচিত জবাব পেলেই পুরুষের চোখে নারী খারাপ। নারী মাত্রই অকর্মণ্য বলা শুধু পুরুষের বিলাসীতা নয়, ফ্যাশনও। আর নারীর দৃঢ়তা দেখলেই তাকে বলা হয় পুরুষালী স্বভাবা, সেয়ানা। বিলাসীরা বিলাসী নয়, ক্রন্দনরতা। বিলাসীরা বিলাসব্যসন বোঝে না, তারা আমৃত্য ঘরকন্যা করে।

ঋষভ নরম সুরে বলে, কী বলো এসব?

বিলাসী বলে, তুমি যা ইচ্ছা তাই বলতে পারো, সেটাই তোমার বিলাসীতা। বিলাসীতার কোলে থেকে বড়ো হয়েছো তুমি। পিতার সম্পদে পুত্রের বিলাসিতা স্বাভাবিক। তোমার বিলাসীতা ছিলো, থাকবেও।

ঋষভ বলার ভাষা পায় না। বিলাসীর যৌক্তিক কথার সাথে পেরে উঠে না সে। নিজে নিজে ভেবে দেখলো বিলাসীর ভেতর কর্মগুণ আছে, সহ্যগুণ আছে, ধৈর্যগুণ আছে, অন্যকে শ্রদ্ধাগুণ আছে। সে সাজতে পছন্দ করে, কিন্তু খরচ করতে পছন্দ করে না; সে সাজতে পছন্দ করে, কিন্তু কারও উপর ভারবোঝা নয়; সংসারে দায়িত্ব পালন করে, কিন্তু কর্তৃত্ব করে না; দুঃখ পেলে কান্না করে, কিন্তু বাকবিতণ্ডা করে না। বিলাসীকেই বিলাসীতা করা মানায়।

রাতে বাজার করে ফিরলো ঋষভ। বাজার-সদাই নিয়ে ফিরলে বিলাসী প্যাকেট থেকে বের করে তরকারি-ফলমূল থাকলে ফ্রিজে রাখে, মাছ থাকলে পরিষ্কারের জন্য রান্নাঘরে নিয়ে যায়। আজ বাজারের প্যাকেট খুলতে গেলে ঋষভ বাঁধা দিলো, আর লজ্জামাখা হাসি হাসতে থাকলো। কৌতূহল কাজ করলো বিলাসীর ভেতর। সে জোরপূর্বক বাজারের প্যাকেট খুললো আর দেখলো অনেক প্রসাধনী সামগ্রী। তা দেখে ঋষভের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো সে।

পরেরদিন মার্কেটে ঘুরতে যাবে দুইজন। ঋষভ বললো, দ্রুত গুছিয়ে নাও।

এই বলে ঋষভ বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো। আধা ঘণ্টা পর এসে আবার বললো, এখনও গুছিয়ে নিতে পারোনি? দ্রুত গুছিয়ে নাও।

আরও আধা ঘণ্টা পরে এসে সে দেখে বিলাসী এখনো শাড়ি পরেনি, ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছে, কপালে সিঁদুর দেয়নি। আগের সেই রাগ তাকে পেয়ে বসলো। বাইরে দিয়ে দরজা এটে কোনদিকে ঘুরতে চলে গেলো। প্রসাধনী পেলে বুদ্ধিমতী, বিজ্ঞবতী, প্রজ্ঞাবতী, বিবেকবতী, নীতিমতী, রুচিমতী, চরিত্রবতী কিংবা অনন্যসাধারণা নারীরাও ত্রিপুরসুন্দরী, আফ্রোদিতি বা ইন্দ্রাণী হতে সাজতে বসে পড়ে। ঋষভের সহ্যসীমায় তাই আর বিলাসী থাকলো না।

নাভারণ, ঝিকরগাছা, যশোর, বাংলাদেশ থেকে


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশেষ সংখ্যা ১৪৩১ সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন