মা তারা কন্সট্রাকশনের সুসজ্জিত অফিসে ম্যানেজার বিজয় টেবিলের ওপর প্রান্তে বসা ক্লায়েন্ট ওঙ্কার সাউকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সমানে।
—”কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী ক্রেতা বিক্রেতার এগ্ৰিমেন্ট ডিডে কিছু পয়েন্ট রাখতেই হয় স্যার; সেসব নিয়ে আদপেই কেউ মাথা ঘামায় না।”
—”ওসব আমাকে বলে লাভ নেই। আপনি ডিড থেকে ওই ক্লজটা বাদ দিয়ে ফ্রেশ এগ্ৰিমেন্ট করুন।” ওঙ্কার সাউ গোঁ ধরে থাকেন।
—”দেখুন স্যার, কলকাতা কসমোপলিটন শহর। অন্য রাজ্যে নিজের সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও দেশের বহু রাজ্য থেকেই মানুষজন এখানে এসে জায়গা-জমি, বাড়ি কিনছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসবাস করছে। আর কলকাতার আয়তন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। কাউকে কখনোই অসুবিধায় পড়তে হয়নি। আসলে আইনের হাত থেকে বাঁচতে এগ্ৰিমেন্ট ডিডে কিছু ক্লজ আমাদের রাখতেই হয়। ওসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।” বিজয় হাসে।
—”না ভাই, দেশের অন্য কোথাও আমার নামে সম্পত্তি থাকলে কলকাতার বুকে একই নামে সম্পত্তি কেনা যাবে না এই ক্লজটা বাদ না দিতে পারলে আমার এ্যাডভান্সের টাকাটা ফেরৎ দিন। একটু ভেবেচিন্তেই এগোনো ভালো। এই কারণেই যদি ভবিষ্যতে আমার এখানকার বাড়ি জমির রেজিস্ট্রেশন ক্যানসেল হয়ে যায় তাহলে বিপদে পড়ব।”
ক্ষুদিরাম মাঁকড় এখন বাইপাসের ধারে গজিয়ে ওঠা শহরের নামী প্রোমোটার। শুধু বাইপাসের আশেপাশে নয়, ক্ষুদিরামের প্রোমোটিং সাম্রাজ্য এখন বাইপাস ছাড়িয়ে দক্ষিণে মুকুন্দপুর, পাটুলি পূবদিকে সল্টলেক ছাড়িয়ে নিউটাউন পর্যন্ত বিস্তৃত। বাইপাসের ধারে চিংড়িঘাটায় ক্ষুদিরামের অফিস মা তারা কন্সট্রাকশনের সমস্ত অফিশিয়াল কাজ ম্যানেজার বিজয় সামলায়। ইদানীং অফিসে একজন সুন্দরী রিসেপশনিস্টও রেখেছে ক্ষুদিরাম। ও আসাতে অফিসটা কেমনযেন ঝলমলে হয়ে উঠেছে। বাইরে থেকে তেতেপুড়ে এসে অফিসে ঢুকলেই ক্ষুদিরামের মনটা জুড়িয়ে যায়। কাঁচের ঘরের ভেতর থেকেই ও ম্যানেজার আর রিসেপশনিস্ট দুজনের ওপর নজর রাখে।
আজ কাঁচের দরজাটা খানিকটা খোলা ছিল। ফলে বাইরের সব কথাই ক্ষুদিরামের কানে আসছিল। নিয়মের বাইরে গিয়ে ওঙ্কার সাউয়ের আব্দারে আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে না ক্ষুদিরাম। নিজের চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বলে, “বিজয় এগ্ৰিমেন্টটা ক্যানসেল করে ওনার চেকটা ফেরৎ দিয়ে দাও।” তারপর ওঙ্কার সাউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “কলকাতা আপনার জন্য নয়। এখানে পারস্পরিক বিশ্বাসের দাম আছে। আমি ইচ্ছে করলে টেন পারসেন্ট ক্যানসেলেশন চার্জ কাটতেই পারতাম। কিন্তু কলকাতা অতিথিকে সম্মান দিতে জানে। আপনি শত চেষ্টা করেও কোনোদিনই এখানে সম্পত্তি কিনতে পারবেন না। এখানকার অতিথি হিসেবেই থাকবেন।”
মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর চীফ্ জেনারেল ম্যানেজার ওঙ্কার সাউয়ের মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। বিজয়ের থেকে চেকটা নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ান। কানে আসে ক্ষুদিরামের হাসির সাথে ব্যঙ্গোক্তি,—”ব্যাটা খোট্টা”।
—”দাদা এভাবে বোলো না।” বিজয় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে।
—”ঠিকাচে। ঠিকাচে।” বিজয়ের কথায় ক্ষুদিরাম চুপ করে যায়।
ক্ষুদিরামের বুকের ভেতর ক্ষতটা ঠিক কোথায় বিজয় সেটা ভালো করেই জানে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দেয়।
এবার শহর থেকে কাজের ছুটি নিয়ে গ্ৰামে বাড়িতে আসা ইস্তক সুকুমারের সাথে ওর বৌয়ের ঝগড়া চিল্লামিল্লি এখন রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুকুমারের জেদ এবার ছেলেকে নিয়েই শহরে কাজে যাবে। দুটো পয়সা আসবে ঘরে। তাই বৌকে বলে, “শোন্ সুন্দরী, আমাদের ক্ষুদে বছর বছর কেলাসে ফেল দিতেছে, ওর আর ইশকুলে গিয়ে কাজ নেই। বরং আমার সাথে শহরে গেলি কাজ শিকতে পারবে।”
সুকুমারের কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুন্দরী, “তোমার হায়া-লজ্জা কিছুই নেই নাকি গা? শহরের ওই উঁচু উঁচু বাড়িতে বাঁশের ভারাতে উঠে অতটুকু ছেলে কাজ করতে পারে? বলো দিকিনি এত পয়সার লোভ কেন তোমার?”
—”তা ক্ষুদের কি কাজ শিকতে হবেনি! একন থিকে পেটচুক্তিতে কাজে লেগে পড়লি একদিন বড় রাজমিস্ত্রি হতে পারবে। আর একবার কামাই করতে লাগলেই ঘরে বৌমা নিয়ে আসব। এ আমার বড় শখ রে সুন্দরী।”
সুকুমারের কথায় চোখে জল আসে সুন্দরীর। আঁচলে চোখ মুছে বলে, “তা তুমি ঠিকই বলিচো। আমাদের ঘরের ছেলে তো নেকাপড়া শিকে বাবু হবেনি, গতরে খেটেই খেতি হবে। তা তুমি যেমন ভালো বোঝো তেমনই কোরো ক্ষুদের বাপ।”
*****
সুকুমারের সঙ্গে শহরে আসে ক্ষুদে। সকালে বাপবেটায় ভরপেট পান্তা খেয়ে কাজে বেরোয়। আকাশ সমান উঁচু উঁচু বাড়িগুলো দেখে ক্ষুদের কি ভয়! মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখে অনেক উঁচুতে ভারার ওপরে উঠে ওর বাবা কাজ করছে। নীচে থেকে এতটুকু লাগে ওর বাপকে। সুকুমার সারাদিন কাজ করে মালিকের থেকে টাকা বুঝে নিয়ে নিজের আস্তানায় ফেরে।
মালিক লোকটাকে ক্ষুদের মোটেও ভালো লাগে না। ওর বাবাকে বকে, নাম ধরে ডাকে, তুই-তোকারি করে। সুকুমারকে বলে, “গ্ৰামে তো ছোটরা সবাই তোমাকে দাদা নয়তো খুড়ো বলেই ডাকে, আর কেউ তো তোমাকে তুই-তোকারি করে না। মালিককেও তো তোমার থেকে ছোট বলেই মনে হয় অথচ তোমাকে নাম ধরে ডাকে, তুই-তোকারি করে। কেন বাবা?”
সুকুমার বলে, “শহর এমনই রে বাপ। আমাদের মতো অশিক্ষিত গরীবদের কোনোই দাম নেই রে একেনে। আমরা এয়েছি কামাই করতে, ট্যাঁক ভরলেই দেশে ফিরে যাব।”
দিনকয়েক পর মওকা বুঝে ছেলেকে নিয়ে মালিকের অফিসে গিয়ে দাঁড়ালো সুকুমার।
—”বাবু, এই আমার ছেলে ক্ষুদে। এরে যদি একেনে কোনো একটা কাজ দেন”
—”এ তো বাচ্চা ছেলে, জোগাড়ের কাজও করতে পারবে না। বয়স কত?” মালিক ভালভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে ক্ষুদেকে।
“তা এই বারো পুইরে তেরোয় পড়ল” সুকুমার জবাব দেয়, “জানি বাবু ও কাজ তেমন কিছু করতে পারবে নি তবুও যদি অরে একটা কাজ দেন; অরে একনই টাকা দিতে লাগবে না। শুধু পেটচুক্তিতে যদি কাজে লাগান” সুকুমার হাত জোড় করে দাঁড়ায় মালিকের সামনে।
ওর কথায় মালিক ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “দেখ্ সুকুমার, এখানে আমি দানছত্র খুলে বসিনি। নিজের কাজ কর নয়তো পথ দেখ্।”
রাগে ক্ষুদের কানে আর কিছু ঢুকছিল না, মালিকের পেছনের দেওয়ালে লাগানো ঘড়িটার টিকটিক্ শব্দটা ওকে যেন গিলে খেতে চাইছিল। সুকুমার কিছু বলার আগেই ও দৌড়ে বাইরে চলে যায়।
মালিক হাসে। বলে, “তোর ছেলের তো বেশ তেজ আছে!”
—”বাচ্চা ছেলে বাবু, এবারের মতো ক্ষমা করে দেন।” সুকুমার বেরিয়ে যায় অফিস থেকে।
ক্ষুদে রোজই ওর বাবার সঙ্গে কাজে আসে। ও বাড়ির ভেতরে ঢোকে না। সারাটাদিন বাইরেই থাকে। মন দিয়ে বাড়ি তৈরী করা দেখে। একদিন বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ি তৈরীর কাজ দেখছে হঠাৎ কানে এল বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন ডাকছে, “ক্ষুদে এই ক্ষুদে, এদিকে আয়।”
তাকিয়ে দেখে মালিক ডাকছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ও পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। সামনে যেতেই মালিক একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই ক্ষুদে, ওই সামনের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয় তো।”
মালিকের কথামতো ও সিগারেট নিয়ে এসে মালিককে দেয়। তারপর বলে, “আমার নাম ক্ষুদিরাম। ক্ষুদে নয়।”
—”আরিব্বাস! এ যে ধানীলঙ্কা!” মালিক হেসে ওঠে। বলে, “তোর বাপ তো তোকে ক্ষুদে বলেই ডাকে।”
—”তুমি আমার বাপ নও।” বলেই বাইরে বেরিয়ে যায় ক্ষুদে।
রাতে লেবার বস্তির ঘরে ইঁট বেছানো মেঝের ওপর কাঁথা পেতে শুয়ে চোখে ঘুম আসে না ক্ষুদের। দরমার দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর তখন ছেঁড়া ছেঁড়া জ্যোৎস্না। সেদিকে তাকিয়ে শরীর জুড়ে একটা রাগ ঘুরপাক খায়। ভাবে, “একদিন একটা আস্ত বাড়ি বানাবো। আর ইচ্ছেমতো জানলা খুলে চাঁদের আলোকে ঘরে ঢুকতে দেব। সবটাই হবে আমার ইচ্ছেতে। চাঁদকে মুঠোয় ভরবো আমি।”
মাস ছয়েকের মধ্যেই ক্ষুদে বাড়ি তৈরীর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো রপ্ত করে ফেলে। বাড়ি তৈরীর মশলায় সিমেন্ট-বালির ভাগ, মশলা তৈরী, যন্ত্রপাতির নাম এসব নির্ভুলভাবে শিখে যায়। রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজে লেগে পড়ে। আরও সামনে থেকে কাজ দেখতে দেখতে পাকা রাজমিস্ত্রি হয়ে ওঠে। কিন্তু যাদের ঘাম ঝরিয়ে এত সুন্দর সুন্দর বাড়ি তৈরী হয় তাদের সাথে মালিকের অমানবিক ব্যবহার ওকে কষ্ট দেয়। মনের মধ্যে এক প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে।
সময় গড়ায়। ক্ষুদিরাম এখন লেবার কন্ট্রাক্টর। ওর অধীনে যারা কাজ করে তাদের ও যতটা সম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করে। ওর দক্ষতায় মালিকপক্ষও খুশী থাকে আবার ওর ভরসার হাতের নীচে মিস্ত্রির দলও খুশী মনে কাজ করে। এখন ও স্বপ্ন দেখে প্রোমোটার হওয়ার। নিজের পছন্দের বাড়ি তৈরী করার। কিন্তু পড়াশোনা না জানা সামান্য লেবার কন্ট্রাক্টরকে কেই বা সুযোগ দেবে!
তবুও সুযোগ এসে যায়। ও যে প্রোমোটারের কাছে দুটি বিল্ডিংয়ের লেবার কন্ট্রাক্টের বরাত পেয়েছিল সেই প্রোমোটার বিল্ডিং মেটিরিয়াল্স সাপ্লায়রদের কাছে বহু টাকা বাকি রেখে হঠাৎই বেপাত্তা হয়ে যায়। মালিকপক্ষ অথৈ জলে। তখন ক্ষুদিরাম চেষ্টাচরিত্র করে প্রোমোটারের কাছ থেকে মালিকপক্ষকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট জোগাড় করে দেয়। তারপর কপাল ঠুকে মালিকপক্ষকে বলে, “আপনারা তো এতদিন ধরে আমার কাজ দেখছেন। আমি প্রোমোটার নই ঠিকই, কিন্তু বাড়ি তৈরী আমার হাতেই হয়। যদি আমার ওপরে ভরসা করেন তাহলে আপনাদের হতাশ করব না।” আর কোনো উপায় না থাকায় মালিকপক্ষ ওকে বাড়ির বাকি অংশটুকু তৈরীর বরাত দেয়। এরপর ধীরে ধীরে বাড়ি তৈরীর কাজ হাতে আসে, ও লেবার কন্ট্রাক্টর থেকে প্রোমোটার হয়ে ওঠে।
কাজের প্রতি নিষ্ঠা, দক্ষতা আর লেবারদের প্রতি সহমর্মিতা ওকে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু অতীতটাকে ভুলতে পারে না। বড়লোক আজও ওর চিরশত্রু। তাই হেনস্থা করার সামান্যতম সুযোগও ও হাতছাড়া করে না। এই নিয়ে বিজয়ের সাথে প্রায়ই ওর ঠোকাঠুকি লাগে। বিজয় ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে, “দাদা, ব্যবসায় সবাইকে নিয়েই চলতে হয়। তাছাড়া ভুল ঠিক নিয়েই তো মানুষ। পয়সাওয়ালা মানুষজন যদি তোমার কাছে না আসে তাহলে তুমি এইসব বাড়ি, ফ্ল্যাট বিক্রি করবে কার কাছে? নাকি সব বিলিয়ে দেবে?”
ক্ষুদিরাম বলে, “তা তুমি ঠিকই বলেছ। আসলে কি জান, একদিন আমিও মজুর ছিলাম তাই মজদুরগিরির কষ্টটা যেমন বুঝি তেমনি বড়লোকের অকারণে চোখ রাঙানিটাও জানি। আমরা টাকার বিনিময়ে পরিশ্রম করি কিন্তু মানুষের সম্মানটুকু ওরা দিতে চায় না। তাই আজ ওই পয়সাওলা লোকগুলো যখন আমাকে তেল দিয়ে কাজ হাসিল করতে চায় তখন খুব রাগ হয়। ওদের অন্যায় আব্দারে মাথাটা গরম হয়ে ওঠে।”
—”তবুও দাদা, মানুষের সাথে তিক্ততা বাড়িয়ে কি লাভ! কথাটা ভেবে দেখো।” বিজয়ের কথায় ক্ষুদিরাম চুপ করে যায়। ওর মেজাজের পারদ কখন মনের কোন্ প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়ে যায় তা একমাত্র সময়ই জানে। অফিসের দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে ক্ষুদিরাম। সময় বদলের সময় বয়ে চলে টিকটিক্ টিকটিক্।।
পেজফোরনিউজ ২০২৪ পুজা সংখ্যায় প্রকাশিত